

ইউনিতে প্রথম দিকে (এখনো প্রথম দিকে শেষের দিকে বলার সময় আসেনাই যদিও, একবছরও হয় নায়) একদিন বাস থেকে নেমে থতমত খায়ে গেলাম। বাস স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে, রাবিশ বিন থেকে শুরু করে, লাইটপোষ্ট থেকে শুরু করে, গেইটের আশেপাশে, টেবিলে চেয়ারে সব জায়গায় পোষ্টার আর পোষ্টার “ফ্রী প্যালেস্টাইন”! এই একটা লাইন বাকা করে বড় বড় করে লেখা। আমিতো মনে মনে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ শুরু করলাম, খাইছে আমারে। এই কাজ যদি মুসলিম পোলাপাইন করে থাকে তাইলে খবর আছে।
ভিতরে ঢুকে দেখি সিঁড়ির গোড়ায় দুই মেয়ে দাঁড়ানো। একজনের নাক কান চোখের পাতা, আইব্রু, জিহবা কিছুই বাদ নাই যেখানে রিং লাগানো নাই। আরেকজন গিক-টাইপ, ভদ্রস্থ, ঢোলাঢালা শার্ট-প্যান্ট পরা। হাতে একই পোষ্টার। বিলাইতেছে যাকে সামনে পাইতেছে তাকেই। মনে মনে খুশী হইলাম, কারণ মেয়ে দুইটাই সাদা চামড়া। নাম জিগায়ে বুঝলাম মুসলিম ও না। খুশী মনে তাই পোষ্টার নিলাম। জানতে চাইলাম ঘটনা কী। রিং রিং-এ রিংময় মেয়েটা ঠা ঠা ঠা ঠা করে লেকচার দেয়া শুরু করে দিলো। যা বুঝলাম তা হইল এর আগেরদিনও প্যালেস্টাইনে ছোট একটা ছেলে মারা গেছে মর্টার শেলে না কিসে, তার প্রতিবাদ। এইভাবে আর কতদিন, ফিলিস্তিনকে ইসরাঈল ‘ওপেন এয়ার প্রিজন সেল’ বানায়ে ফেলছে। তার প্রতিবাদ করা মানুষ হিসেবে দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তারা পালন করতেছে। স্টুডেন্ট এসোসিয়েশানে মিটিং ডাকছে। আমিও সেই মিটিং এ আসলে সে খুবই খুশী হবে।
সত্য কথা বলতে, কোনো ফিলিংসই হইলোনা আমার। প্রতিদিনই বলতে গেলে ফিলিস্তিনে মানুষ মরে। তার উপর বিশ্ব-অবরোধের কারণে পরোক্ষ মৃত্যু তো আছেই। কেমন যেন গন্ডারের চামড়া হয়ে গেছে। এত সহজে আর ফিলিংস হয়না। মনে মনে লজ্জা লাগলো নিজেরই অনুভূতিহীনতা দেখে। উলটা কেমন যেন স্বস্থির অনুভূতি মেয়েগুলা সাদা আর অমুসলিম দেখে। যেন নিজের উপর থেকে জবাবদিহীতার ভার কমে গেল!
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পিস-এক্টিভিস্টদেররা ত্রান-সাহায্য নিয়ে তুরস্কের শিপে করে পৌঁছাইলে ইসরাঈলী সৈন্যরা হামলা করে কমপক্ষে উনিশজন এক্টিভিষ্টকে মাইরে ফেলছে, বন্দী করে রাখছে বাকী সবাইকে। খবরে অবাক হয়ে দেখি, ইসরাঈল বার বার বলতেছে একটিভিষ্টরা ইসরাঈলে হামলা করতে আসতেছিল। অস্ত্র হিসেবে যা দেখানো হইল- অনেকগুলো গুলতি, মার্বেল, লাঠি, আর পেপার কাটারের মত ছোট ছুরি!!!!!!!!!............ আমি হাঁ করে তাকায়ে থাকি। ওরা কি মনে করে পৃথিবীর সব মানুষ চারপায়ের গাধা, যা বুঝাবে তাই বুঝে বসে থাকবে??! এইগুলা অস্ত্র?!?!?!
জার্মানের দুইজন বামপন্থী রাজনীতিবিদও ছিলেন ঐ শিপে, এক্টিভিস্ট হিসেবেই অবশ্যই। ইসরাঈল তাদেরকে ডিপোর্ট করছে সাথে সাথে। একজন প্রতিবাদ মিছিলে জানালেন “… ওরা বিনা উস্কানীতে আমাদের উপর হামলা করছে…… শেষে যখন বসেছিলাম, আমার পাশেই আরেকজন তার্কিশ মহিলা বসে ছিলেন। তার স্বামী একটু আগেই বন্দুকের গুলিতে স্পট ডেড হয়েছেন…… আমি বুঝতে পারছিলাম না তাকে কিভাবে স্বান্তনা দিবো, ইংগিতে ইশারায় চেষ্টা করছিলাম আমার সহমর্মিতা বুঝাতে…”।
উস্কুখুশকু চুলের মহিলাটার কথা শুনতে শুনতেই একটা চরম অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে আমার মধ্যে। এই মহিলা, যার সাথে কিনা ইসলাম-মুসলিমদের নূন্যতম কোনো লেনাদেনা নাই, সে পর্যন্ত তার মানবিক দায়িত্ব হিসেবে গাজার মুসলিমদেরকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের জীবনের রিস্ক নিতে পারছে; আর আমি-আমরা?!?!…… এখনো মিডিয়ায় পুরা বিস্তারিত আসতে পারে নাই। আসতেছে। অনেক খুঁজে দুইটা স্টিল ছবি পাইলাম। দুইজন এক্টিভিস্ট পরে আছে গুলি খায়ে। জানলাম, শিপে ছয় মাসের একটা ছোট্ট তার্কিশ পিচ্চিও ছিল ওর বাপ-মা’র সাথে।
স্টুডেন্ট এসোসিয়েশান শিউর প্রতিবাদ টাইপ কিছু করবে। এইবার ভাবতেছি যাইতেই হবে। নাইলে নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেই লজ্জা লাগবে। একটু আগে খুব সুন্দর লাইন পড়তেছিলাম, মুক্তমনা’র জাফরউল্লাহ নামের একজনের লিখায়- “The good sense has taken the back seat” …… কথাটা তিতা হইলেও সত্য। উপায় নাই, প্রতিবাদে তাই যাইতেই হবে। কোন যেন বিখ্যাত ব্যক্তি বলে গেছেন, “পৃথিবীতে খারাপ কিছু হওয়ার জন্যে ভাল মানুষদের চুপচাপ বসে থাকাই যথেষ্ট”। কথাটা চরম সত্য!