সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাঁদের স্মৃতির চরণে
মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসি মুখে যারা দিয়ে গেলো প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান
তাদের বিজয় মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে
ভাইয়ের বুকের রক্তে আজিকে
রক্ত মশাল জ্বলে দিকে দিকে
সংগ্রামী আজ মহাজনতা
কণ্ঠে তাদের নব বারতা
শহীদ ভাইয়ের স্মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে
বাংলাদেশের লাখো বাঙালি
জয়ের নেশায় দিল রক্ত ঢালি
আলোর দেয়ালি ঘরে ঘরে জ্বালি
ঘুচিয়ে মনের আঁধার কালি
শহীদ ভাইয়ের স্মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে
সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে
গীতিকারঃ ফজলে খোদা
সুরকার ও শিল্পীঃ আব্দুল জব্বার
এই অবিস্মরণীয় গানের শিল্পী আব্দুল জব্বার আর নেই। তিনি আজ সকাল ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হাই ব্লাডপ্রেশার ও হৃদরোগে ভুগছিলেন।
আব্দুল জব্বার নামটি শোনামাত্রই যে গানটি সবার আগে কানের কাছে ভেসে ওঠে, সেটি হলো - সালাম সালাম হাজার সালাম। এ ছাড়া, তুমি কি দেখেছ কভু, তারা ভরা রাতে, ওরে নীল দরিয়া, তুমি আছো সবই আছে, পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি, ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় গান তিনি গেয়েছেন।
গত বছর জুলাই/আগস্ট মাসে তাঁর সাথে আমার দুইবার সাক্ষাৎ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তাঁকে আমাদের কলেজে আমন্ত্রণ করেছিলাম ছাত্রছাত্রীদের গান শেখানোর জন্য। ঐ দুইদিন তাঁর সাথে গান নিয়ে আমার বেশ অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা হয়। তাঁর মুখোমুখি বসে এভাবে আলাপ করতে পারায় নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছিলাম, এবং আমার খুব গর্ব বোধ হচ্ছিল। সামনে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ছিল, এই মহান শিল্পীকে আমাদের আজকের ছেলেমেয়েরা চিনতে পারে নি বলে আমি খুব লজ্জিত ও বিব্রত হয়েছিলাম। পরে শিল্পীর মহান কীর্তির সাথে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিই।
আব্দুল জব্বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাঁকে দেখতে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করছিলাম আমি, এবং ভাবছিলাম আমি আরেকটূ সুস্থ হলেই তাঁকে দেখতে যাব। আমার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেলো।
আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশত নসিব করেন। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল সমবেদনা।
এবার তাঁর গাওয়া কিছু বিখ্যাত গানের লিংক নীচে জুড়ে দেয়া হলো।
সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে
গীতিকারঃ ফজলে খোদা, সুরকার ও শিল্পীঃ আব্দুল জব্বার
তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়
তুমি অাছো সবই অাছে তুমি নাই কিছু নাই
ওরে নীল দরিয়া
তারা ভরা রাতে তোমার কথা যে মনে পড়ে বেদনায়
শুধু গান গেয়ে পরিচয়
হে পৃথিবী আমার প্রশ্ন শোনো
মুখ দেখে ভুল করো না, মুখটা তো নয় মনের আয়না
রাগ করবার আরো কত যে
অামি তো বন্ধু মাতাল নই
শত্রু তুমি বন্ধু তুমি তুমি আমার সাধনা
ওরে পান্না যৌবন তোর টলোমলো
মাগো তোর চরণতলে বেহেশ্তি আমার - আব্দুল জব্বার ও খুরশিদ আলম
এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি
বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা এবার দাও বিদায়
মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরা যেতে চায়
তোমাকে বিদায় দেয়া গেলো না, হে মহান
আমাদের মন ও মননে তুমি চির-অম্লান
***
নীচের গানটির শিল্পী কে, কেউ কি প্লিজ বলবেন? ছবির নাম 'দিন যায় কথা থাকে'। অসাধারণ গায়কী।
মায়ের মতো আপন কেহ নাইরে
***
পাঠকদের জন্য উইকিপিডিয়া থেকে তাঁর জীবনী নীচে তুলে ধরা হলো
আব্দুল জব্বার (৭ নভেম্বর ১৯৩৮ - ৩০ আগস্ট ২০১৭) একজন বাংলাদেশি সঙ্গীত শিল্পী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত সালাম সালাম হাজার সালাম, জয় বাংলা বাংলার জয়সহ অনেক উদ্বুদ্ধকরণ গানের গায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তাঁর গাওয়া তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়, সালাম সালাম হাজার সালাম ও জয় বাংলা বাংলার জয় গান তিনটি ২০০৬ সালে মার্চ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দুটি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক (১৯৮০) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯৬) ভূষিত হন।
আব্দুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
জব্বার ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন। তিনি ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র সংগমের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে এতটুকু আশা ছবিতে সত্য সাহার সুরে তার গাওয়া 'তুমি কি দেখেছ কভু' গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৬৮ সালে পীচ ঢালা পথ ছবিতে রবীন ঘোষের সুরে 'পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি' এবং ঢেউয়ের পর ঢেউ ছবিতে রাজা হোসেন খানের সুরে 'সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো' গানে কণ্ঠ দেন।
১৯৭৮ সালে সারেং বৌ চলচ্চিত্রে আলম খানের সুরে 'ও..রে নীল দরিয়া' গানটি দর্শকপ্রিয়তা পায়। তার প্রথম মৌলিক গানের অ্যালবাম কোথায় আমার নীল দরিয়া ২০১৭ সালে মুক্তি পায়। অ্যালবামটির গীতিকার আমিরুল ইসলাম। সুরকার গোলাম সারোয়ার।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা যুগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালাম সালাম হাজার সালাম ও জয় বাংলা বাংলার জয়সহ অংসখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া যুুদ্ধের সময়কালে তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন। তৎকালীন সময়ে কলকাতাতে অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধাদের ক্যাম্প ঘুরে হারমোনি বাজিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন যা মুক্তিযুদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে সেসময় বিভিন্ন সময় গণসঙ্গীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ রুপি দান করেছিলেন।
আব্দুল জব্বারের প্রথম স্ত্রী গীতিকার শাহীন জব্বার যার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্দুল জব্বার, সুবীর নন্দী, ফাতেমা তুজ জোহরার মতো জনপ্রিয় বাংলাদেশি সঙ্গীতশিল্পীরা। তাঁদের সন্তান মিথুন জব্বারও একজন সঙ্গীতশিল্পী। জব্বারের দ্বিতীয় স্ত্রী রোকেয়া জব্বার মিতা যিনি ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
প্লেব্যাক
সংগম (১৯৬৪)
নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭)
উলঝন (১৯৬৭)
পীচ ঢালা পথ (১৯৬৮)
এতটুকু আশা (১৯৬৮)
ঢেউয়ের পর ঢেউ (১৯৬৮)
ভানুমতি (১৯৬৯)
ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০)
দ্বীপ নেভে নাই (১৯৭০)
বিনিময় (১৯৭০)
জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
নাচের পুতুল (১৯৭১)
মানুষের মন (১৯৭২)
স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা (১৯৭৩)
ঝড়ের পাখি (১৯৭৩)
আলোর মিছিল (১৯৭৪)
সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬)
তুফান (১৯৭৮)
অঙ্গার (১৯৭৮)
সারেং বৌ (১৯৭৮)
সখী তুমি কার (১৯৮০)
কলমিলতা (১৯৮১)
পুরস্কার ও সম্মাননা
বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩)
একুশে পদক (১৯৮০)
স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬)
বাচসাস পুরস্কার (২০০৩)
সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস - আজীবন সম্মাননা (২০১১)
জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার
মহান শিল্পীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:০৩