নদী-স্বপ্ন
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষ্মী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে- আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোনো ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব আমার- না, আমি একা লব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারী নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামি? সোনালি? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালিটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে শুয়ে মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বার বার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রুপোর নদীতে রুপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান করে আসি দিয়ে সাতশোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বেশ তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হলো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমর দু’জন দেখি বসে বসে আকাশ কত না নীল,
ছোটো পাখি আরো ছোটো হয়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গেলো, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে,
সোনা হয়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হলো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হলে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা
– মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
চিল্কায় সকাল
কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়,
কেমন করে বলি!
কী নির্মল নীল এই আকাশ,
কী অসহ্য সুন্দর!
যেন গুণীর কণ্ঠে অবাধ উন্মুক্ত তান,
দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
কী ভালো আমার লাগল এই আকাশের দিকে তাকিয়ে।
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা,
কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।
তুমি কাছে এলে,
একটু বসলে,
তারপর গেলে ওদিকে,
ইস্টিশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চলে গেল।
- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি!
আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না।
গরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত।
- তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে
আমরা পাব
যা এতদিন পাই নি?
রুপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে,
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর সমস্ত আকাশ
সূর্যের চুম্বনে।
- এখানে জ্বলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?
কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কত দূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।
- কী দুঃসাহস!
তুমি হেসেছিলে,
আর আমার
কী ভালো লেগেছিল
তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ সুখ।
দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ।
- আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ,
কত মৃত্যু,
কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।
অচেনা মানুষ
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদ – বুদ্ধদেব বসু)
বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি
সবচেয়ে ভালবাসো?
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?
পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নী- কিছুই নেই আমার।
তোমার বন্ধুরা?
ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনোই জানি নি।
তোমার দেশ?
জানি না কোন্ দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
সৌন্দর্য?
পারতাম বটে তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি অমরা।
কাঞ্চন?
ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমরা ঘৃণা করো ঈশ্বরকে।
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালবাসো তুমি?
আমি ভালবাসি মেঘ,…..চলিষ্ণু মেঘ…….
উঁচুতে……..ঐ উঁচুতে……..
আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।
ইলিশ
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
দায়িত্বের ভার
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,
যা-কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার-
সব যেন, বৃহদরণ্যের মতো তর্কপরায়ণ
হয়ে আছে বিকল্পকুটিল এক চতুর পাহাড়।
সেই যুদ্ধে বার বার হেরে গিয়ে, মরে গিয়ে, মন
যখন বলছে; শুধু দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা তার
সবচেয়ে নির্বাচিত, প্রার্থনীয়, কেননা তা ছাড়া আর
কিছু নেই শান্ত, স্নিগ্ধ, অবিচল প্রীতিপরায়ণ-
আমি তাকে তখন বিশ্বস্ত ভেবে, কোনো-এক দীপ্ত প্রেমিকার
আলিঙ্গনে সত্তার সারাত্সার করে সমর্পণ-
দেখেছি দাঁড়িয়ে দূরে, যদিও সে উদার উদ্ধার
লুপ্ত করে দিল ভাবা, লেখা, পড়া, কথোপকথন,
তবু প্রেম, প্রেমিকেরে ঈর্ষা করে, নিয়ে এলো ক্রূর বরপণ-
দুরূহ, নূতনতর, ক্ষমাহীন দায়িত্বের ভার।
কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।
প্রত্যহের ভার
যে-বাণীবিহঙ্গে আমি আনন্দে করেছি অভ্যর্থনা
ছন্দের সুন্দর নীড়ে বার বার, কখনো ব্যর্থ না
হোক তার বেগচ্যুত, পক্ষমুক্ত বায়ুর কম্পন
জীবনের জটিল গ্রন্থিল বৃক্ষে; যে-ছন্দোবন্ধন
দিয়েছি ভাষারে, তার অন্তত আভাস যেন থাকে
বত্সরের আবর্তনে, অদৃষ্টের ক্রূর বাঁকে-বাঁকে,
কুটিল ক্রান্তিতে; যদি ক্লান্তি আসে, যদি শান্তি যায়,
যদি হৃত্পিণ্ড শুধু হতাশার ডম্বরু বাজায়,
রক্ত শোনে মৃত্যুর মৃদঙ্গ শুধু; … তবুও মনের
চরম চূড়ায় থাক সে-অমর্ত্য অতিথি-ক্ষণের
চিহ্ন, যে-মূহূর্তে বাণীর আত্মারে জেনেছি আপন
সত্তা বলে, স্তব্ধ মেনেছি কালেরে, মূঢ় প্রবচন
মরত্বে; খন মন অনিচ্ছার অবশ্য বাঁচার
ভুলেছে ভীষণ ভার, ভুলে গেছে প্রত্যহের ভার।
ব্যাঙ
বর্ষায় ব্যাঙের ফুর্তি। বৃষ্টি শেষ, আকাশ নির্বাক;
উচ্চকিত ঐকতানে শোনা গেল ব্যাঙেদের ডাক।
আদিম উল্লাসে বাজে উন্মুক্ত কণ্ঠের উচ্চ সুর।
আজ কোনো ভয় নেই- বিচ্ছেদের, ক্ষুধার মৃত্যুর।
ঘাস হল ঘন মেঘ; স্বচ্ছ জল জমে আছে মাঠে
উদ্ধত আনন্দগানে উত্সবের দ্বিপ্রহর কাটে।
স্পর্শময় বর্ষা এল; কী মসৃণ তরুণ কর্দম!
স্ফীতকণ্ঠ, বীতস্কন্ধ- সংগীতের শরীরী সপ্তম।
আহা কী চিক্কণ কান্তি মেঘস্নিগ্ধ হলুদে-সবুজে!
কাচ-স্বচ্ছ উর্ধ্ব দৃষ্টি চক্ষু যেন ঈশ্বরের খোঁজে
ধ্যানমগ্ন ঋষি-সম। বৃষ্টি শেষ, বেলা পড়ে আসে;
গম্ভীর বন্দনাগান বেজে ওঠে স্তম্ভিত আকাশে।
উচ্চকিত উচ্চ সুর ক্ষীণ হলো; দিন মরে ধুঁকে;
অন্ধকার শতচ্ছিদ্র একচ্ছন্দা তন্দ্রা-আনা ডাকে।
মধ্যরাত্রে রুদ্ধদ্বার আমরা আরামে শয্যাশায়ী,
স্তব্ধ পৃথিবীতে শুধু শোনা যায় একাকী উত্সাহী
একটি অক্লান্ত সুর; নিগূঢ় মন্ত্রের শেষ শ্লোক-
নিঃসঙ্গ ব্যাঙের কণ্ঠে উত্সারিত- ক্রোক, ক্রোক, ক্রোক।
রূপান্তর
দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,
রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে।
ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,
বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,
মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা।
জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,
চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়,
ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন।
দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম,
মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা
আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পড়ো না, কথা বলেও নষ্ট করো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।
কেননা কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হয়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।
কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বলো না ‘সুন্দর’, বলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের-
শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।
আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।
আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হতেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধরে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-
সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব
সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।
আমাকে ভুল বোঝো না। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।
তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।
নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলো নি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :
আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।
স্টিল্ লাইফ
সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয়?
এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র। হেমন্তের যেন অন্ত নেই।
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে।
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার। কিন্তু শুধু এই?
তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারী-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে
ছুঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হয়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা-
যা দেখে, হঠাৎ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হতে
কোনো মৃতার প্রতি
‘ভুলিবো না’ - এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা। তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক।
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক। তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক
তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে।
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে - তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে।
বিদ্যাসুন্দর
বলতে পারো, সরস্বতীর
মস্ত কেন সম্মান?
বিদ্যে যদি বলো, তবে
গণেশ কেন কম যান?
সরস্বতী কী করেছেন?
মহাভারত লেখেন নি।
ভাব দেখে তো হচ্ছে মনে,
তর্ক করাও শেখেন নি।
তিন ভুবনে গণেশদাদার
নেই জুড়ি পাণ্ডিত্যে
অথচ তার বোনের দিকেই
ভক্তি কেন চিত্তে?
সমস্ত রাত ভেবে ভেবে
এই পেয়েছি উত্তর-
বিদ্যা যাকে বলি, তারই
আর একটি নাম সুন্দর।
প্রেমের কবিতা
শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন
কম্পিত অধরের চম্পক-চুম্বন।
শুধু নয় কঙ্কণে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার
আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।
শুধু নয় তনিমার তন্ময় বন্ধন।
-কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ।
পুষ্পের নিশ্বাস, রেশমের শিহরণ,
রক্তের রক্তিমা, কনকের নিক্কণ।
গন্ধের বাণী নিয়ে পরশের সুরকার
অঙ্গের অঙ্গনে আনলো যে-উপহার-
সে-তো শুধু বর্ণের নহে গীত-গুঞ্জন।
-কিছু তার স্বর্ণ, কিছু তার স্বপ্ন।
বিলাসিত বলয়ের মত্ত আবর্তন,
মূর্ছিত রজনির বিদ্যুৎ-নর্তন।
বিহ্বল বসনের চঞ্চল বীণা তার
উদ্বেল উল্লাসে আঁধারের ভাঙে দ্বার-
সে কি শুধু উদ্দাম, উন্মাদ মন্থন।
---কিছু তার সজ্জা, কিছু তার লজ্জা।
শুধু নয় দু’জনের হৃদয়ের রঞ্জন,
নয়নের মন্ত্রণা, স্মরণের অঞ্জন।
রঙ্গিণী করবীর গরবিনী কবিতার
জাদুকর-তির্যক ইঙ্গিত আনে যার,
সে কি শুধু দেহতটে তরঙ্গ-তর্পণ।
-কিছু তার দৃশ্য, কিছু বা রহস্য।
এসো শুভ লগ্নের উন্মীল সমীরণ
করো সেই মন্ত্রের মগ্নতা বিকীরণ,
যার দান বিরহের অনিমেষ অভিসার,
মিলনের ক্ষণিকার কণ্ঠের মণিহার;---
সেথা বিজ্ঞানিকের বৃথা অণুবীক্ষণ।
---কিছু তার জৈব, কিছু তার দৈব।
শেষের রাত্রি
পৃথিবীর শেষ সীমা যেইখানে, চারিদিকে খালি আকাশ ফাঁকা,
আকাশের মুখে ঘুরে-ঘুরে যায় হাজার-হাজার তারার চাকা,
যোজনের পর হাজার যোজন বিশাল আঁধারে পৃথিবী ঢাকা।
(তোমার চুলের মতো ঘন কালো অন্ধকার,
তোমারি আঁখির তারকার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
বিশাল আকাশ বাসনার মতো পৃথিবীর মুখে এসেছে নেমে,
ক্লান্ত শিশুর মতন ঘুমায় ক্লান্ত সময় সগসা থেমে;
দিগন্ত থেকে দূর দিগন্তে ধূসর পৃথিবী করিছে খাঁ-খাঁ।
(আমারি প্রেমের মতন গহন অন্ধকার,
প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
নেমেছে হাজার আঁধার রজনি, তিমির-তোরণে চাঁদের চূড়া,
হাজার চাঁদের চূড়া ভেঙে-ভেঙে হয়েছে ধূসর স্মৃতির গুঁড়া।
চলো চিরকাল জ্বলে যেথা চাঁদ, চির-আঁধারের আড়ালে বাঁকা
(তোমারি চুলের বন্যার মতো অন্ধকার,
তোমারি চোখের বাসনার মতো অন্ধকার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
এসেছিল যত রূপকথা-রাত ঝরেছে হলদে পাতার মতো,
পাতার মতন পীত স্মৃতিগুলি যেন এলোমেলো প্রেতের মতো।
---রাতের আঁধারে সাপের মতন আঁকাবাঁকা কত কুটিল শাখা
(এসো, চলে এসো; সেখানে সময় সীমাহীন
হঠাৎ ব্যথায় নয় দ্বিখণ্ড রাত্রিদিন;
সেখানে মোদের প্রেমের সময় সীমাহীন,
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
অনেক ধূসর স্বপনের ভারে এখানে জীবন ধূসরতম,
ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম,
আদিম রাতের বেণিতে জড়ানো মরণের মতো এ-আঁকাবাঁকা।
(ঝড় তুলে দাও, জাগাও হাওয়ার ভরা জোয়ার,
পৃথিবী ছাড়ায়ে সময় মাড়ায়ে যাবো এবার,
তোমার চুলের ঝড়ের আমরা ঘোড়সাওয়ার---
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না। )
যেখানে জ্বলিছে আঁধার-জোয়ারে জোনাকির মতো তারকা-কণা,
হাজার চাঁদের পরিক্রমণে দিগন্ত ভরে উন্মাদনা।
কোটি সূর্যের জ্যোতির নৃত্যে আহত সময় ঝাপটে মাথা।
(কোটি-কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার;
তবু চলে এসো; মোর হাতে হাত দাও তোমার-
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
তোমার চুলের মনোহীন তমো আকাশে-আকাশে চলেচে উড়ে
আদিম রাতের আঁধার-বেণিতে জড়ানো মরণ পঞ্জে ফুঁড়ে,---
সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে---বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।
(এসো চলে এসো যেকানে সময় সীমানাহীন,
সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।
যেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন
কঙ্কা শঙ্কা কোরো না।)
বিতৃষ্ণা-৩
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
আমি যেন রাজা, যার সারা দেশ বৃষ্টিতে মলিন,
ধনবান, নষ্টশক্তি, যুবা, তবু অতীব প্রবীণ,
শিক্ষকের নমস্কার প্রত্যহ যে দূরে ঠেলে রেখে
শিকারি কুকুর নিয়ে ক্লান্ত করে নিজেই নিজেকেই
কিছুই দেয় না সুখ- না মৃগয়া, না শ্যেনচালন,
না তার অলিন্দতলে মৃতপায় তারই প্রজাগন!
মনঃপূত বিদূষক প্রহসনে যত গান গাঁথে
আনত ললাট থেকে রোগচ্ছায়া পারে নাসরাতে;
ফুলচিহ্ন আঁকা তার শয্যা, তাও নেয় রূপান্তর
কবরে, এবং যার সাধনায় রাজারা সুন্দর,
জানে না সে-মেয়েরাও, লজ্জাহীন কোন প্রসাধনে
আমোদ ফোটানো যায় এ-তরুণ কঙ্কালের মনে।
করেন কাঞ্চনসৃষ্টি, সে-মুনিরও মেলে নি সন্ধান
কোন বিষময় দ্রব্যে অহোরাত্রি নষ্ট তার প্রাণ।
এমন কী রক্তস্নান, লিপ্ত যাতে সব ইতিহাস,
পুরাতনী রোমকের, অর্বাচীন দস্যুর বিলাস,
তাও এই মূঢ় শবে তাপলেপ পারে না জোগাতে,
লিথির সবুজ স্রোত-রক্ত নয়- বহে যেশিরাতে।
এক পথচারিণীকে
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
গর্জনে বধির করে রাজপথে বেগ ওঠে দুলে।
কৃশতনু, দীর্ঘকায়, ঘন কালো বসনে সংবৃত,
চলে নারী, শোকের সম্পদে এক সম্রাজ্ঞীর মতো,
মহিমামন্থর হাতে ঘাঘরার প্রান্তটুকু তুলে–
সাবলীল, শোভমান, ভাস্করিত কপোল, চিবুক।
আর আমি – আমি তার চক্ষু থেকে, যেখানে পিঙ্গল
আকাশে ঝড়ের বীজ বেড়ে ওঠে, পান করি, কম্পিত বিহবল
মোহময় কোমলতা, আর এক মর্মঘাতী সুখ।
রশ্মি জ্বলে… রাত্রি ফের! মায়াবিনী, কোথায় লুকোলে?
আমাকে নতুন জন্ম দিল যার দৃষ্টির প্রতিভা–
আর কি হবে না দেখা ত্রিকালের সমাপ্তি না হলে?
অন্য কোথা, বহু দূরে! অসম্ভব! নেই আর সময় বুঝি বা!
পরস্পর – অজ্ঞতায় সরে যাই – আমারই যদিও
কথা ছিল তোমাকে ভালোবাসার, জানো তা তুমিও!
লাল চুলের ভিখিরি মেয়েকে
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
লাল চুলের, ফর্সা, একমুঠো
বালিকা, তোর ঘাঘরা – ভরা ফুটো
দেখায় তোকে অকিঞ্চন অতি
এবং রূপবতী।
স্বাস্থ্যহীন তরুণ তনু তোর
ছুলির দাগে চোখে লাগায় ঘোর,
আমাকে দেয় মধুরতার ছবি–
আমি গরীব কবি।
কাঠের জুতোর গরবে তোর, মানি,
লজ্জা পায় উপন্যাসের রানি;
চলুন তিনি কিংখাবের জুতোয়; -
ভঙ্গি তোকে জিতোয়।
ন্যাকড়া – কানি ঢাকে না তোর লাজ;
তার বদলে দরবারি এক সাজ
নিস্বনিত লম্বা ভাঁজে-ভাঁজে
পড়ুক পায়ের খাঁজে;
রন্ধ্রময়, ছিন্ন মোজা জোড়া,
তার বদলে সোনার এক ছোরা
জঙ্ঘা তোর যেন মোহন রেখায়
লম্পটেরে দেখায়;
হালকা গেরো উন্মোচন করুক
দুটি চোখের মতো রে তোর বুক
দীপ্তিময় – লাবণ্যের চাপে
আমরা জ্বলি পাপে;
নির্বাসনের সময় বাহুযুগল
যেন অনেক আরজিতে হয় উতল,
ফিরিয়ে দিতে না যেন হয় ভুল
দুর্জনের আঙুল,
যত সনেট লিখে গেছেন বেলো,
বাছাই করা মুক্তো ঝলোমলো,
বান্দারা তোর বন্দনাতে দান
দিক না অফুরান,
হতচ্ছাড়া কবির দল, খাতায়
নামটি তোর লিখুক প্রথম পাতায়,
কুড়িয়ে নিতে খুঁজুক ছলছুতো
সিঁড়ির চটিজুতো;-
চটি তো নয়, কোমল এক নীড়,
তার লোভে যে বেয়ারাগুলোর ভিড়,
আড়ি পাতেন ওমরাহেরা নাচার,
এবং অনেক রঁসার!
ফুলের চেয়ে আরো অনেক বেশি
শয্যা তোর চুমোয় মেশামেশি,
তোর ক্ষমতার বিপুল পরিমাণে
ভালোয়া হার মানে!
অবশ্য তুই এখন ভিখারিণী
ঐ যেখানে চলছে বিকিকিনি,
হাত বাড়িয়ে দাঁড়াস চৌকাঠে
সস্তা মালের হাটে;
আহারে তোর চক্ষু ভরে জ্বালায়
চৌদ্দ আনা দামের মোতির মালায়,
সেটাও তোকে – মাপ করো গো মিতে–
পারি না আজ দিতে।
তাহলে তুই এমনি চলে যা রে,
বিনা সাজে, গন্ধে, অলংকারে,
শীর্ণ দেহে নগ্নতাই শুধু
সাজাক তোকে বঁধু!
আত্ম-প্রতিহিংসা
(জে. জি. এফ কে)
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
মারবো আমি তোকে, যেন কসাই,
ঘৃণার লেশ নেই, শূন্য মন,
কিংবা শিলাতটে মুশা যেমন!
তাহলে আঁখি তোর যদি খসায়
আমার সাহারার সান্ত্বনাতে
দুঃখধারা এক উচ্ছ্বসিত; -
আমার অভিলাষ, আশায় স্ফীত
সে – লোনা জলে পারে ভাসতে যাতে
নোঙর-তুলে-নেয়া তরী যেমন।
মাতাল এ হৃদয়ে কান্না তোর
শব্দ তুলে করে দিক বিভোর,
ঢাকের নাদে যেন আক্রমণ!
নই কি আমি এই দিব্য গানে
স্বরের অন্বয়ে এক বেসুর,
যেহেতু ব্যঙ্গের মুঠি চতুর
আমার সত্তারে নিত্য হানে?
আমারই কণ্ঠ সে – কি জঞ্জাল!
আমারই কালো বিষ রক্তে মাতে!
আমি সে – উৎকট মুকুর, যাতে
আপন মুখ দ্যাখে সে – দজ্জাল!
আমিই চাকা, দেহ আমারই দলি!
আঘাত আমি, আর ছুরিকা লাল!
চপেটাঘাত, আর খিন্ন গাল!
আমিই জল্লাদ, আমিই বলি।
ছন্নছাড়া আমি শূন্যবাসী
আপন হৃদয়ের রক্ত গিলে,
কখনো প্রীত হতে শিখি নি বলে
আমার আছে শুধু অট্টহাসি।
স্মারক লিপি
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
এমন মানুষ কে আছে, বুকের তলে
না পোষে হলদে সাপের তীব্র ফণা
মসনদে বসে অনবরত যে বলে:
‘আমি রাজি’, আর উত্তরে ‘পারবো না!’
কিন্নর, পরী, অপ্সরীদের স্তব্ধ
নয়নে তোমার নয়ন করো নিবদ্ধ,
বিষদাঁত বলে : ‘মন দাও কর্তব্যে!’
গাছে ঢালো জল, সন্তানে দাও জন্ম,
গড়ো কবিতায়, মর্মরে কারুকর্ম,
সে বলের : ‘হয়তো আজকেই তুমি মরবে!’
মানুষ যতই ভাবুক, করুক চেষ্টা,
মেলে না জীবনে এমন কোনো মুহূর্ত
মানতে যখন না হয় – দারুণ ধূর্ত
এই অসহ্য সর্পই উপদেষ্টা।
দিনের শেষে
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
উদ্ধত বেগে, পাংশু আলোর তলে,
চেঁচিয়ে, পেঁচিয়ে অকারণ অভিযাত্রী,
মত্ত জীবন নেচে-নেচে ছুটে চলে।
তারপর, যেন রতিবিলাসিনী রাত্রি
দিকমণ্ডলে উঠে এসে, দেয় মুছে
এমনকি উন্মুখর বুভুক্ষারে,
সে-নীরবতায় লজ্জাও যায় ঘুচে–
তখন কবির মনে হয়: ‘এই বারে
আত্মা আমার বিশ্রামে পায় যত্ন,
ক্লান্ত পাঁজর কাতর মিনতি করে;
হৃদয়ে আমার শত বিষণ্ণ স্বপ্ন!
তবে ফিরে যাই, শিথিল শয্যা পরে
অন্ধকারের পর্দা জড়ানো ঘরে
শুশ্রূষাময় কালিমায় হই মগ্ন!’
প্রেমিক-প্রেমিকার মৃত্যু
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
কবরের মতো গভীর ডিভানে লুটিয়ে
মৃদু বাসে ভরা রবে আমাদের শয্যা,
সুন্দরতর দূর আকাশেরে ফুটিয়ে
দেয়ালের তাকে অদ্ভুত ফুলসজ্জা।
যুগল হৃদয়, চরম দহনে গলিত,
বিশাল যুগল-মশালের উল্লাসে
হবে মুখোমুখি – দর্পণে প্রতিফলিত
যুগ্ম প্রাণের ভাস্বর উদ্ভাসে।
গোলাপি এবং মায়াবী নীলের সৃষ্টি
এক সন্ধ্যায় মিলবে দুয়ের দৃষ্টি,
যেন বিদায়ের দীর্ণ দীর্ঘশ্বাস;
পরে, দ্বার খুলে, মলিন মুকুরে রাঙাবে
এক দেবদূত, সুখী ও সবিশ্বাস;
আমাদের মৃত আগুনের ঘুম ভাঙাবে।
বিষাদগীতিকা-১
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
কী এসে যায়, থাকলে তোমার সুমতি?
হও রূপসী, বিষাদময়ী! অশ্রুজল
নতুন রূপে করে তোমায় শ্রীমতী,
বনের বুকে ঝরনাধারা যেমতি,
কিংবা ঝড়ে সঞ্জীবিত ফুলের দল।
পরম ভালোবাসি, যখন আনন্দ
তোমার নত ললাট থেকে গেছে সরে;
হৃদয় জুড়ে সংক্রমিত আতঙ্ক,
এবং তোমার বর্তমানে, কবন্ধ
গত কালের করাল ছায়া ছড়িয়ে পড়ে।
ভালোবাসি, আয়ত ঐ চক্ষু যখন
তপ্ত যেন রক্ত ঢালে জলের ফোঁটায়,
ব্যর্থ করে আমার হাতের সাধ্যসাধন
অতি পৃথুল দুঃখ তোমার ছেঁড়ে বাঁধন–
নাভিশ্বাসের শব্দে যেন মৃত্যু রটায়।
নিশ্বাসে নিই – স্বর্গসুখের পরিমেলে–
এ কি গভীর স্তোত্র, মধুর আরাধনা!–
কান্না যত ওঠে তোমার বক্ষ ঠেলে;
ভাবি, তোমার হৃদয়তল দেয় কি জ্বেলে
নয়ন দুটি ঝরায় যত মুক্তোকণা?
বিষাদগীতিকা-২
(মূলঃ শার্ল বোদলেয়ার। অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু)
জানি, তোমার হৃদয় শুধু উগরে তোলে
জীর্ণ প্রেম, পরিত্যাগে পঁচে-ওঠা,
আজও সেথায় কামারশালের চুল্লি জ্বলে,
এবং রয় লুকিয়ে তোমার বুকের তলে
মহাপাপীর অহমিকার ছিটেফোঁটা।
কিন্তু, শোনো, স্বপ্নে তোমার যতক্ষণে
না দেয় ধরা বিকট আভা নরকের,
এবং ডুবে অন্তহীন দুঃস্বপনে
না চাও বিষ, তীক্ষ্ণ ফলা মনে-মনে
বারুদ, ছোরা, কিংবা ছোয়া মড়কের,
না পাও ভয় দরজাটুকু খুলতে হলে,
কারো নিখিল অমঙ্গলের পাঠোদ্ধার,
কেঁপে ওঠো, ঘণ্টা পাছে বেজে বলে–
জানলে না, কোন অপ্রতিরোধ অন্ধ বলে
আঁকড়ে ধরে কঠিন মুঠি বিতৃষ্ণার;
রানি, দাসী, সভয় তোমার ভালোবাসায়
তা না হলে ফুটবে না এই উচ্চারণ
অস্বাস্থ্যকর আতঙ্কিত কালো নিশায়
আমার প্রতি পূর্ণ প্রাণের বিবমিষায়–
‘রাজা! আমি তোমার সমকক্ষ এখন!’
নবযৌবন
(এটি অগ্রন্থিত কবিতা)
বেদনায় রাঙা মোর দগ্ধ বুক ভরি
যুগ হতে যুগান্তর ধরি
কী গান উঠেছে বাজি, কী সঙ্গীত তুলিয়াছে তান
কোন্ মহামায়া মন্ত্র তুলিয়াছে নিত্য নব গান,
কী সঙ্গীত উঠিয়াছে ধ্বনিয়া
মর্ম-মাঝে রণিয়া-রণিয়া,
ওগো মহাকাল,
হে সুন্দর, নিষ্ঠুর, ভয়াল
তোমার ললাট ’পরে লেখা হয়েছিল যদি,
নিরবধি
বয়ে চলা ফল্গুধারা সম
ছিন্ন-তন্ত্রী এই বীণা মম
তোমার বুকের ’পরে জাগাইয়াছে যদি প্রতিধ্বনি
সে কথায় জেগে যদি উঠেছে অবনী,
তবে ওই ভীষণ মৌনতা
কেন আজ টুটিল তা?
কেন আজ ভেঙে গেল যুগান্তের শৃঙ্খল কঠিন?
প্রসন্ন নবীন
উদিল প্রভাত
অকস্মাৎ,
পোহাইল যেন দীর্ঘ দুঃখ-বিভাবরী,
কেটে গেল মরণ-শর্ব্বরী।
আর ভয় নাই, নাই ভয়,
জীবনে-মরণে আজ, প্রভূ মোর, হোক তব জয়!
এনেছে যৌবন তার
বিচিত্র সম্ভার;
বসন্তের ফুলদল হাতে লয়ে এসেছে সে
নব অতিথির বেশে।
তারে আজ করিনু বরণ,
তাহার পরশ পেয়ে ধন্য হল আমার মরণ,
ধন্য হল দুঃখ-দগ্ধ ক্লান্ত বিভাবরী,
তাই বক্ষ তরঙ্গিত করি,
উঠিয়াছে আনন্দ-হিল্লোল,
চিরন্তন সঙ্গীত কল্লোল
বক্ষে বাজে শঙ্খধ্বনি-সম,
নিরূপম
উচ্ছ্বাসের উন্মত্ত ধারায়,
জীবনের সূত্রগুলি আচম্বিতে কখন হারায়!
চিরদিনকার পাওয়া যৌবন আমার
লহ নমস্কার!
তুমি রুদ্র, তুমি ভয়ঙ্কর,
তাই তুমি অমন সুন্দর।
প্রবালের মতো তব রাঙা ওষ্ঠাধরে
চুম্বন আঁকিয়ে দিতে জন্ম-জন্মান্তরে
সাধ মোর;
অন্ধতার ঘোর
রাত্রির আকাশ সম সুনিবিড় কেশ,
ঊষার উদয় সম চক্ষে তব আনন্দ-উন্মেষ,
বক্ষে তব নবজন্ম আশা
মুখে তব বিশ্বসৃষ্টি ভাষা
সারা দেহে লীলায়িত গভীর বেদন
অনন্ত জীবন আর নিবিড় মরণ
নমি তোমা বার বার, হে আমার অনন্ত যৌবন।
বি: দ্র: কবিতাগুলো ইন্টারনেট ঘেঁটে সংগ্রহ করা হয়েছে। যাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। যেসব সাইট থেকে কবিতাগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে:
নীড়পাতা, কবিতা ও গান
বাংলা কবিতা
বাংলা কবিতা সম্ভার
বুদ্ধদেব বসু ব্লগস্পট
শ্রী মিলন সাগর গুপ্তের ‘বুদ্ধদেব বসুর কবিতা’
শব্দছেঁড়া কবিতারা
কবিতার খাতা
এসব কবিতার বাইরে কারো কাছে এ কবির অন্য কোনো কবিতা থাকলে শেয়ার করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
***
বুদ্ধদেব বসুর সংক্ষিপ্ত জীবন
বুদ্ধদেব বসু (নভেম্বর ৩০, ১৯০৮-মার্চ ১৮, ১৯৭৪) ছিলেন বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত।
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের অল্প পরেই তাঁর মাতার মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্নাসব্রত গ্রহন করে গৃহত্যাগ করেন। বুদ্ধদেবের শৈশব কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়।
বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতায় গিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৌজন্যে: বুদ্ধদেব বসু ব্লগস্পট
***
বুদ্ধদেব বসু: জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধার্ঘ্য
লেখক: আবদুল মান্নান সৈয়দ | ২৮ নভেম্বর ২০০৮ ৬:৫০ অপরাহ্ন
সৌজন্যে: আর্টস.বিডিনিউজ২৪.কম
------------------------------------------------------------------------------
…কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে; কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না।
– ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’: বুদ্ধদেব বসু
------------------------------------------------------------------------------
কল্যাণীয়াসু,
গতকাল রাতে একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)-র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সাক্ষাৎকার দিলাম। সাক্ষাৎকার নিল অনুজোপম মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দশ মিনিটের সাক্ষাৎকারে কী আর বলা যায়। কিন্তু জাহাঙ্গীরের প্রশ্নমালা আমার ভেতরে যে-জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছে, সেটাই একটু বিশদ বলি তোমাকে।
প্রথম প্রশ্ন ছিল বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য কোথায়। এই একটি প্রশ্নের জবাবে যা বলা যায়, তারই মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর সারসত্তা ছেঁকে তুলে নেওয়া যায়। — কবি হিশেবে বুদ্ধদেব বসুকে আমি জীবনানন্দ দাশের মতো তাঁর কালের মহত্তম কবি বলব না, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে’র মতো অসাধারণও তিনি নন। তারপরেও বুদ্ধদেব বসুকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্র নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আলোচনা কি আমরা করতে পারি?
পারি না। কেন পারি না? এ জন্যে যে, রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার তথা সাহিত্যের পৌরোহিত্য করেছিলেন তিনি। ঠিক এরকম নায়কত্ব বাংলা সাহিত্যে দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কালে। বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য এঁদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। বরং তাঁর সাহিত্য-সংবেদন-ও-গ্রহিষ্ণুতার সঙ্গে তুলনীয় আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের কবি-সমালোচক এজরা পাউন্ড অথবা আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের কবি-সমালোচক গিওম আপোলিনেয়ার। কবি ছিলেন আপোলিনেয়ার। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি পাবলো পিকাসোরও প্রথম দিকের আবিষ্কর্তা সমালোচকদের একজন। টি. এস. এলিয়টের কবিতাকে কাটাকুটি করে পাউন্ডই তো তাঁর বিশ্বপরিব্যপ্ত পরিচায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যের এক ইতিহাসে আমি দেখেছিলাম কবি হিসেবে আপোলিনেয়ারকে একবারে নসাৎ করে দিতে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা নিয়ে অন্যদের কথা কী বলব, আমি নিজেই ঠিক মনস্থির করতে পারি না। একেক সময় ভাবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা কাঁচা, বানানো, কৃত্রিম। আবার একেক সময় মনে হয় কবিতা তো অনেক রকম। বুদ্ধদেবের কাঁচা রোমান্টিকতাও কি ভুলে যেতে পারি? ‘একটু সময় হবে — কাছে গিয়ে বসিব তোমার?’ এ রকম লাইন তো আজো মনেই শুধু বিঁধে নেই, মাঝে মাঝে মুখে উচ্চারণ করতেও হয়। ‘একখানি হাত’-এর মতো কবিতা কখনো কি আমূল নাড়িয়ে দেয় না আমাদের? কিছুকাল আগে আমাকে একজন শুনিয়েছিলেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।’ এই যে সব কবিতা বা কবিতার পঙ্ক্তি আজো আমাদের মনে উড়ছে, মুখে উড়ছে, এই তো কবিতার তাবৎ তত্ত্বকথাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ রকম আরো অনেক কবিতা বা কবিতার পঙ্ক্তি কাব্যপাঠক আমরা বিস্মৃত হবো না কখনো। জীবনানন্দ দাস তো বটেই, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দেও যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধদেবের প্রথম কবিতাগ্রন্থ মর্মবাণী থেকে কবির জীবৎকালে প্রকাশিত সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ স্বাগত বিদায় পর্যন্ত এক বিরাট পরিক্রমা। এখানে একটু আলাদা করে বিষয়টা তোমাকে বুঝিয়ে বলি।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আর বুদ্ধদেব বসু — এই তিনজন ছিলেন ‘কল্লোল’ যুগের তিন নায়ক। কল্লোল(প্রথম প্রকাশ: ১৯২৩), কালিকলম (প্র: প্র: ১৯২৬) ও প্রগতি (প্র. প্র. ১৯২৭) এই তিনটি প্রত্রিকা ছিল আধুনিকতার প্রথম মুখপাত্র। কল্লোল ও কালিকলম বেরিয়েছিল কলকাতা থেকে, আর প্রগতি প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। আশ্চর্য কিংবা একান্ত স্বাভাবিক, যে, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আধুনিকতার মুখপত্র এই তিনটি সাময়িকপত্রেরই প্রধান লেখক। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, এখন যখন নজরুল ইসলামকে কেউ কেউ খারিজ করতে চান আধুনিকতার খাতা থেকে তারা দয়া করে ঐ তিনটি পত্রিকার পুরোনো পৃষ্ঠা একটু উলটিয়ে দেখবেন।
মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রগতি পত্রিকা বুদ্ধদেব বসু আর অজিত দত্ত যুগ্মভাবে সম্পাদনা করতেন। প্রগতি পত্রিকাতেই আধুনিকতার একটি বীজধানভূমি প্রস্তুত হয়েছিল — যার মধ্যে রবীন্দ্রদ্রোহিতা ছিল। তাকেও ক্ষমাশীল দৃষ্টিতেই দেখতে হবে বলে মনে করি। কেননা কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি এবং সেকালের আরো কিছু পত্রিকার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রবিধর্মী সাহিত্যের সূচনা হয়। দরকার ছিল ওই দ্রোহের। আজকাল কেউ কেউ এদের ইউরোপীয়ানা বলে নাকচ করবার চেষ্টা করছেন, অতীতেও তা হয়েছে। তাঁরা ভুলে যান সমগ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যকেই তাহলে বাতিল করে দিতে হয়। মধ্যযু থেকে বাংলা সাহিত্য তো বেরিয়ে এল কবিতাকে অচ্যূত রেখে গদ্যের সমতলে নেমে এসেই। গদ্যে যতিচিহ্ন বিদ্যাসাগর আনলেন কোত্থেকে? মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য আর সনেট লিখলেন কোন দুঃখে? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন? নাটক ও প্রহসনই বা দীনবন্ধু মিত্র ও অন্যেরা লিখতে গেলেন কী আনন্দে?
হ্যাঁ, প্রগতি-র কথা বলছিলাম।
বুদ্ধদেব বসুর বন্ধুমণ্ডলীতে তখন এবং তারপরও অনেকদিন ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। মনে রেখো, যা আমরা অনেকেই ভুলে যাই সেটা হচ্ছে, কবিতা পত্রিকার প্রথম দু’বছর বুদ্ধদেব বসু আর প্রেমেন্দ্র মিত্র যুগ্মভাবে সম্পাদক ছিলেন। প্রগতি বরাবর বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত যুগ্মভাবে সম্পাদনা করে গেছেন। বুদ্ধদেবের এই যে বন্ধুমহল, এঁরা ছিলেন উত্তাল রোম্যান্টিক ও হৃদয়বাদী। ১৯৩৫ সালে কবিতা পত্রিকা যখন বেরোল, তখনও বুদ্ধদেব ঐ হৃদয়বাদী বন্ধুদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব অন্তঃপরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলেন। বিষ্ণু দে-র কথা এখানে বলিনি তোমাকে। বিষ্ণ দে প্রগতি পত্রিকার লেখক ছিলেন তো বটেই, কবিতাতেও লিখেছেন। তাঁর মধ্যে বরাবরই হৃদয় ও মননের একটি আশ্চর্য মিশ্রণ ও দ্বন্ধ ছিল। এও মনে রেখো, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। ওরকম মননজীব সাহিত্যপত্র বাংলা ভাষায় হয়নি আর। অথবা প্রথম চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র (প্র. প্র. ১৯১৪) কে পরিচয়-এর পূর্বসূরী বলা যায়। তবে পরিচয়-এর পরিব্যপ্তি ছিল অনেক বেশি। প্রকৃতপক্ষে, পরিচয় পত্রিকাই বাংলা কবিতার মননভূমি প্রস্তুত করে দেয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ বাংলা কবিতায় মননের আরাধনা করে সমগ্র বাংলা কবিতাতেই সম্পূর্ণ একটি নতুন আয়তন যুক্ত করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ নিজে উল্লেখ করেছেন এক সন্ধ্যা তিনি ‘উড়ে চলে গেছে’ কথা ক’টি ‘উড্ডীন’ শব্দে রূপান্তরিত করার জন্যে ব্যয় করেছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভালোবেসে র্ভৎসনা করেছিলেন। ‘রবীন-ধুত্তোর’ (কথাটি তোমার অতি প্রিয় গুরুদেব রবীন্দনাথ ঠাকুরের স্বকৃত ‘রবীন্দ্রোত্তর’ শব্দের লালিকা বা প্যারোডি) হৃদয়বাদী কবিতার বিরুদ্ধে মননশীল কবির ওই পরিশ্রম প্রয়োজন ছিল। এ কালের দৃষ্টিতে ওকে বিদেশিয়ানা বলে খারিজ করলে ইতিহাসজ্ঞানের অভাবই প্রমাণ করে। পরম্পরা বা ধারাবাহিকতা ব্যতিরেকে মানুষ কেন, কোনো ইতিহাসই রচিত হতে পারে না — এ তো তুমি প্রায়শ বলো।
চিঠি লেখার এই মুশকিল। এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যায়। অথচ তুমিই আমাকে দিনের পর দিন প্ররোচনা দিয়েছ পত্রসাহিত্য রচনা করবার জন্যে। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের হাজার দশেক চিঠিকে অতিক্রম করা এই বয়েসে সম্ভব হবে না। তারপরে শিলাইদহে কুঠিবাড়ি করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক। পদ্মানদীতে বোট নিয়ে ঘোরবারও সাহস নেই। কেননা সাঁতার জানি না। তবে আনন্দের কথা যে, পদ্মা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ভাবছি ডাঙার কাছাকাছি কম পানিতে নৌকা নিয়ে ঘুরবো কিনা। কিন্তু শুনছি কোথায় যেন ব্রীজও তৈরি হয়ে গেছে। কাজেই সব মিলিয়ে ভেবেচিন্তে দেখি আরকি! আপাতত ওই দ্বন্দ্বের মীমাংসার আগে চিঠিটা শেষ করা দরকার।
হৃদয়বাদী বুদ্ধদেব ক্রমশ মননশীল কবি হয়ে উঠলেন। যিনি একদিন লিখেছিলেন বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), তিনিই তখন লিখলেন যে-আঁধার আলোর অধিক (?)। ঠিক এরকম পরিষ্কার পরিবর্তন বুদ্ধদেবের সমসাময়িক কারো কবিতায় নেই। ফল হলো এই: বুদ্ধদেবের বন্ধু পরিমণ্ডল থেকে বাদ পড়ে গেলেন হৃদয়বাদী পূর্বোক্তেরা। প্রেমেন্দ্র মিত্র দু’বছর পরে কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা ছাড়লেন। একই বাড়িতে দোতলা-তেতলায় থেকেও বাল্যবন্ধু অজিত দত্তের সঙ্গে বুদ্ধদেবের বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। বিষ্ণু দের সঙ্গে বুদ্ধদেবের কোথায় যেন একটি ব্যবধান ছিলই বরাবর, সখ্যও ছিল। কলকাতার কয়েকজন কবির মধ্যে দু’টি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল যাদের পরিহাসাঞ্চিত না ছিল ‘বৌদ্ধ’ আর ‘বৈষ্ণব’। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন এ সমস্ত কোলাহলের উর্ধ্বে, এক আশ্চর্য মানুষ ও কবি। তিনি বুদ্ধদেব সম্পাদিত প্রগতি ও কবিতা পত্রিকায় যেমন লিখতেন, তেমনি লিখতেন কবিতা-পত্রিকা ছেড়ে যাওয়া প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত নিরুক্ত পত্রিকায়, তেমনি লিখতেন বিষ্ণু দের সাহিত্যপত্র সাময়িকীতেও। বুদ্ধদেব বসুর এই আশ্চর্য রূপান্তর — হৃদয়শীলতা থেকে মননশীলতার প্রস্থান — একে ভালো-মন্দ যাই বলো একটি বড় ব্যাপার বলে মনে করতেই হয়। উপান্ত জীবনে বুদ্ধদেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সুবীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীও খানিকটা।
আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা তুলনাহীন। সাধারণ বাঙালি লেখকদের মতো তিনি কেবল আত্মরচনায় তৃপ্ত ছিলেন না। অন্যদের কবিতায়ও অসম্ভব অভিনিবেশ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বিচার তো করেছেনই, তাঁর সমসাময়িক কবিদেরও একত্রিত করেছেন। জীবনানন্দ দাশের সমর্থক ও সম্প্রচারক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য (সঞ্জয় বাবুর কথা জীবনানন্দ প্রসঙ্গে তেমনভাবে আসে না কেন, বুঝি না)।
দ্যাখো, আমরা অনেক সময় একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলি। এটা সবাই জেনে গেছে, জীবনানন্দের আপ্রথমশেষ সমর্থক বুদ্ধদেব বসু। খুব সত্যি। তার সঙ্গে এটা যোগ না-করলে অন্যায় হবে কিন্তু: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, এমনকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধদেবের আক্ষরিক অর্থে অনন্য ভূমিকা ছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই ঋণ শোধ করেছিলেন তাঁর সম্পাদিত একটি কবিতা সংকলনে বুদ্ধদেব বসু (এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে) বর্জন করে। বিষ্ণু দে-র জন্যে সেটা দরকার নেই। তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং আরো কেউ কেউ। একটা বিষয় লক্ষ্য করো: বয়েসে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-অমিয় চক্রবর্তী বুদ্ধদেবের ৮/১০ বছরের বড় ছিলেন, অন্যদিকে সমর-সুভাষ ছিলেন অনেক ছোট। কিন্তু বুদ্ধদেবের লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতা কোথায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন। এই কেন্দ্রলক্ষ্যে তিনি অবিচল ছিলেন।
তাই বলে দীপ্তি ত্রিপাঠী তিরিশের যে-পাঁচজন কবিকে চিহ্নিত করেছিলেন, তা আমরা যথার্থ মনে করি না। প্রেমেন্দ্র মিত্র নেই কেন — এই প্রশ্ন শুধু আমার নয়, অনেকের। কবি আবুল হোসেনের অভিমত, সমর সেনকেও তিরিশের কবি হিশেবেই বিবেচনা করা উচিত।
সে যাই হোক, যতজন কবি এখানে উল্লেখিত হলেন — জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, সুবাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন — সকলের ওপরই বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন। অচিন্ত্যকুমারের কবিতা নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না, কিন্তু মন্তব্য তো করেছেনই। এই যে সমকালীন কবিতার প্রতি সর্বব্যপ্ত আগ্রহ এ তো শুধু তাঁর সমকালীন সাহিত্যেই নয়, আগে পরেও বিরল। শুধুমাত্র এই আশ্চর্য গ্রহিষ্ণুতার কারণেই বুদ্ধদেব বসুকে সম্মান জানাতে বাধ্য হই আমরা।
তবে জেনে রেখো, বুদ্ধদেব বসু আমাদের মতো দোষে-গুণে মানুষ ছিলেন। তুমি যে-আদর্শবাদী হিসেবে আমাকে দেখতে চাও তা যে আমি হতে পারছি না এজন্যে আমার একটু দুঃখ আছে। সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানব নয়। তবে তুমি আবার চটে যেয়ো না রবীন্দ্রনাথের বিরাটত্ব সত্ত্বেও দু’একটি সামান্য ক্রুটি ছিল। সেদিন কোথায় পড়ছিলাম তাঁর গানের ভাণ্ডারী দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের জমিজমা নিয়ে কী যেন গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছিলেন। কাঙাল হরিনাথের ডায়েরিতে একবার পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ জমিদার হিসেবে কেমন ছিলেন তার বিবরণ। তবে সাংবাদিকরা, বোঝো তো অনেক সময় হয়তো একটু রঙ চড়িয়ে… । কাজেই খুব বেশি বিচলিত হোয়ো না।
***
বুদ্ধদেব বসু ও কালের কৃপাণ
লেখক: খোন্দকার আশরাফ হোসেন
সৌজন্যে: বুদ্ধদেব বসু ব্লগস্পট
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যসাধনার বিপুলতা কেবল রবীন্দ্রনাথের খন্ডাংশের সঙ্গে তুলনীয়। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, আত্মজৈবনিক রচনা, ভ্রমণকাহিনী−সব মিলিয়ে তিনি অতুল বৈভবময় সৃষ্টিজগতের অধীশ্বর। আধুনিক সাহিত্যকাল খন্ডায়নের, বিচুর্ণায়নের, নানা একদেশদর্শিতার−আধুনিক সাহিত্যিকজীবন নামক বিশাল-বিপুল যজ্ঞের এক কণাংশের খবরদারি পেলে বর্তে যান। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের অন্যতম ধারক ও প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও নিজের সৃষ্টিশীলতাকে সংকীর্ণতায় নিবিষ্ট করেননি। তিনি দৃশ্যত সেই ধরনের বৈশ্বকোষিক সাহিত্যিকদের মধ্যে শেষতম, যাঁদের দেখা অধুনাপূর্ব যুগে সচরাচর মিলত, যাঁরা সমুদ্রসন্ধানী ছিলেন, যাঁরা একই সঙ্গে সৃজনকলার নানা ভঙ্গিমাকে আরাধ্য করতে পেরেছিলেন। জন্নশতবার্ষিকীর শুভক্ষণে বাংলা সাহিত্যের এই নিবিষ্ট সাধককে অভিবাদন জানাই।
কিন্তু বর্তমান এই নিবন্ধকে যদি শুধু শ্রদ্ধাবাসর করে তুলি, তবে তা কপটতার নামান্তর হবে। আমাদের প্রয়োজন হলো বুদ্ধদেব বসুর উত্তরাধিকারকে বুঝে নেওয়া। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অনেকটা অবিসংবাদিত হলেও কবিতায় দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর গৌরবময় ভুমিকা সত্ত্বেও তিনি কেন পুরোধাদের মধ্যে গুণক্রমে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, এমনকি সুধীন্দ্রনাথেরও পশ্চাদ্বর্তী হলেন এবং তাঁর প্রবল শিষ্যদের নানা শ্রমী উদযোগ সত্ত্বেও তরুণ পাঠকদের কাছে কেন তিনি অনাদরণীয় থাকছেন, তার একটি অনুসন্ধান আজ করা যেতেই পারে।
আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় নামের দীপ্তি ত্রিপাঠী-রচিত প্রবাদপ্রতিম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। বুদ্ধদেব বসুর বয়স তখন পঞ্চাশ, তাঁর কাব্যখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত; পুনরপি বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা নামের প্রবলপ্রতাপী ও প্রভাবক অনুবাদগ্রন্থ, যেটি অচিরেই উভয় বাংলার তরুণদের ‘আঁখি হতে ঘুম’ হরণ করে নেবে, প্রস্তুয়মান, এবং তাঁর সামনে ‘পথ রুধি’ কোনো ‘রবীন্দ্র ঠাকুর’ বর্তমান নেই। সেই ঘটনার পর আরও পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে; শতাব্দী-ক্রান্তির অন্য আলোয় বুদ্ধদেব বসুকে শুধু নয়, সমগ্র আধুনিক কাব্যমন্ডলকে পুনর্বিচারের প্রয়োজনীয় দুরপ্রেক্ষা আমরা অর্জন করতে পেরেছি বলে আমার ধারণা।
ত্রিপাঠী তাঁর আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয় গ্রন্েথ তিরিশ-উত্তর বাংলা কবিতার নাম দিয়েছেন আধুনিক বাংলা কাব্য। এরও পাঁচ বছর আগে বুদ্ধদেব বসু স্বয়ং তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ-র ভুমিকায় আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায়ন প্রচেষ্টা করেছেন এভাবে: ‘... এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকল শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্নয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন-ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’ এই সংজ্ঞায়ন যে দ্বিধাগ্রস্ত মাধবীর মতো দোলাচলে দীর্ণ তা বেশ বোঝা যায়। ত্রিপাঠী, বুদ্ধদেবের অনুরাগিণী গবেষক, তাঁর বইতে এই দোলাচলকে ঢাকতে চেয়েছেন, কিন্তু আমরা বুদ্ধদেবের মন সহজে বুঝতে পারি। য়ুরোপীয় আধুনিকবাদ (আধুনিকবাদ শব্দটি অবশ্য বুদ্ধদেব বা ত্রিপাঠী কেউই ব্যবহার করেননি) কবিতার যে সব লক্ষণ নির্দেশ করেছে, সেখানে ‘বিস্নয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ’ প্রভুত থাকলেও, ‘বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি’ রয়েছে বললে সত্যের অপলাপ হবে। বিশ্ববিধানে এবং এর নিয়ন্তার অস্তিত্বে আস্থাকে ভুমিহীন করার মধ্য দিয়েই অথবা এর ভুমিহীন হওয়ার কারণেই আধুনিক কবিতা তাঁর স্থান করে নিয়েছে নৈরাশ্য আর সংশয়ের পোড়োজমিতে। ‘আকাশভরা সুর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ’ দেখে ‘বিস্নয়ে’ যাঁর প্রাণ জেগেছিল, তিনি তো ‘প্রাগাধুনিক’ মানুষ রবীন্দ্রনাথ, যাঁর চিত্তবৃত্তিকে অস্বীকার করার মধ্যেই তো ছিল বুদ্ধদেব বসুদের বিদ্রোহ। দীপ্তি ত্রিপাঠী আধুনিক কবিতার যে লক্ষণসংহিতা রচনা করেছেন, সেই দ্বাদশ লক্ষণের মধ্যে ‘বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি’ নেই, বরং আছে ‘ভগবান এবং প্রথাগত নীতিধর্মে অবিশ্বাস’। বুদ্ধদেব বসুকৃত আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। মনে হয় তিনি অনেকটা নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে ওই উচ্চারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একদা তিনি বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদকে আবাহন করতে গিয়ে কবিতার যে অন্বিষ্ট স্িথর করেছিলেন, তাতে প্রাধান্য ছিল নন্দনবাদিতার, কবির আত্মতার সগর্ব প্রতিষ্ঠা এবং কবিতাকে সমাজপ্রসঙ্গ, নৈতিকতা ও উপযোগিতাবাদ থেকে মুক্ত করে আনন্দের সাহিত্যের আয়োজন। সেখানে ‘বিদ্রোহের, প্রতিবাদের’ কোনো স্থান ছিল না। বুদ্ধদেবের কবিতায় ‘সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের’ চিহ্ন নেই; প্রেমের অসংবৃত উচ্ছ্বাসে আবিল তাঁর প্রথম যৌবনের কবিতা। (স্নর্তব্য, ‘সেরেনাদ’, ‘কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি কবিতায় “কঙ্কা, কঙ্কা, কঙ্কাবতী গো” ধরনের আর্তনাদ। বস্তুত, বুদ্ধদেব যে নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কালের পুতুলে মন্তব্য করেছিলেন, “একটি দুটি স্নিগ্ধ কোমল কবিতা ছাড়া প্রায় সবই ভাবালুতায় আবিল”, তা তাঁর নিজের প্রেমের কবিতা সম্পর্কেও অনেকটা প্রযোজ্য।) আর তাই বুদ্ধদেব যখন আধুনিক বাংলা কবিতা সংগ্রহ সম্পাদনা করছিলেন, তিনি নিজেকে আবিষ্ককার করেন এক বিপুল আয়রনির মধ্যে। তাঁর নিজস্ব আধুনিকতার ধারণার সঙ্গে তাঁর সহযাত্রী-অনুগামীদের মিল নেই এবং তাঁর আত্মতা ও অহংনির্ভর কলাকৈবল্যবাদ কোনো পরিসর পায়নি বাংলা আধুনিক কবিতায়। ওই সংকলনটির সম্পাদনা বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্বের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হলেও এক অর্থে তাঁর নিজের কাব্য-বঃযড়ং-এর মর্মান্তিক পরাজয়ের স্নারকও বটে। নাহলে, কিমাশ্চর্যম, তিনি জসীমউদ্দীনের কবিতাকেও তাঁর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন! তিনি বিস্নয়বিস্কারিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন যে, আধুনিক বাংলা কবিতা তাঁর প্রকল্পিত অতি-নান্দনিকতার পথে মোটেই এগোয়নি, বরং বহু বিরুদ্ধপ্রবণতার প্রবল সংঘাতে ও মিথস্ক্রিয়ায় এক আশ্চর্য জটিল রসায়ন হয়ে উঠেছে−যার অংশভাক্ হওয়ার সাধ্য তাঁর আর ততদিনে অবশিষ্ট নেই।
বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতাকে ও সেই সঙ্গে আধুনিক কবিদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছিলেন, এ রকম একটি সযত্নরচিত মিথ প্রবল হয়েছে দীপ্তি ত্রিপাঠীর গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাঙলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রায় ধর্মগ্রন্েথর মতো এ বইটি পাঠ করে। তাঁদের চিন্তায় অনপনেয় মুদ্রিত হয়ে যায় একজন কাব্য-ক্রুসেডারের ছবি, যিনি বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্রনাথের ‘কুপ্রভাব’ থেকে মুক্তি দিয়ে আধুনিকতার আঙিনায় মেলে দিয়েছেন; যেন তিনি সেই অপেক্ষিত ভগীরথ, যার অবর্তমানে বাংলা কবিতার স্রোতস্বিনী শুকনো চড়ায় আটকে যেত। ‘প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে প্রগতি পত্রিকায় তিনি আধুনিক কাব্য-যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন এবং বাধাবিঘ্ন সত্ত্বে আজও নৈষ্ঠিক ঋত্বিকের মতো সে-অগ্নি রক্ষা ক’রে চলেছেন। অজস্র কবিতা তিনি রচনা করেছেন, একমাত্র কবিতার জন্যই বিশ বছরের অধিক কাল পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন, কাব্য আলোচনার মাধ্যমে আধুনিক বহু কবিকেই রসিকসমাজে পরিচিত করেছেন এবং সহূদয়হূদয়সংবাদী পাঠকগোষ্ঠি সৃজন করেছেন।’ অনস্বীকার্য যে, বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবি ও কবিতার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁর রচনাবলির বিশালত্ব ও বৈচিত্র্যও তাঁর বিরাট প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু সেইজন্য তাঁকে তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলা যায় না। তাঁর নিজের কবিতায় আধুনিকবাদের যে রূপটি তিনি ধারণ করেছেন, সেটি তিরিশের অন্য কবিদের থেকে আলাদা। আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রার্থিতও বটে, কিন্তু যে ব্যাপারটি বিস্নয়কর সেটি হলো, অন্য সব কবির কাব্যাদর্শ, ভাষা ও আঙ্গিক ক্রমবিবর্তমান হলেও এবং শৈল্পিক পরিণতির দিকে অগ্রসরমাণ হলেও বুদ্ধদেবকে মনে হয় এক জায়গায় স্থির; তাঁর কোনো বিবর্তন নেই। একই প্রগল্ভ উচ্ছ্বাস বন্দীর বন্দনা থেকে মরচে পড়া পেরেকের গান পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত মানসিক দ্বন্দ্ব যা আধুনিক কবিতার একটি মৌল লক্ষণ। জীবন ও ভালোবাসার অদ্বৈতে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব বসু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছেন শরীরী প্রেমের কবি; নারী ও বাণীরে তাঁর এক মনে হয়েছে সারা জীবন। কিন্তু জীবন মানেই নারী অথবা নারীর প্রেম−এটি একটি বিষম সমীকরণ, একটি একদেশদর্শিতা। জীবনের আরও বহুতল আছে, আছে মানুষের নানাবিধ আস্তিত্বিক-সামাজিক সংকট। তিরিশের অন্য কবিরা, এমনকি সুধীন্দ্রনাথের মতো নিবিষ্ট প্রেমের কবিও সেইসব প্রস্তাবনাকে কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর বেলা অবেলা কালবেলা ও সাতটি তারার তিমির পর্যায়ে মহাপৃথিবী ও মহাকালের অনুধ্যান করেছেন। বুদ্ধদেব বসু প্রেমের কবিই থেকে গেছেন আজীবন−ব্যাপারটি এক অর্থে সংবর্ধনাযোগ্য হলেও সামূহিক বিচারে মনে হয় বুদ্ধদেবের মতো বিরলপ্রতিভ মানুষের জন্য এক বিরাট অপচয় এবং বাংলা কবিতার ক্ষতি। এর একটি কারণ, প্রেমের কবিতাতে তিনি নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারেননি, আনতে পারেননি এমন কোনো সুর যা আমরা রবীন্দ্রনাথে শুনিনি, কেবল রিরংসা ও দেহবাদিতার ফ্রয়েডবাহিত অনুষঙ্গটি ছাড়া। অবশ্য সেটিও কল্লোলের কবিকুল তথা মোহিতলালের কবিতায় প্রবলভাবেই মূর্ত হয়েছিল। এলিয়টপ্রেমী বুদ্ধদেব তাঁর গুরুর কাছাকাছিও আসতে পারেননি আধুনিক চৈতন্যের দ্বিধাসংকট চিত্রায়ণে: এলিয়টের প্রুফ্রক যে দ্বিধার করাতে দ্বিখন্ডিত, যে ক্ষণিক উৎসাহ এবং পরক্ষণের অনিবার্য নির্বেদ ও নৈরাশ্যের কাঁটায় ‘কলে-পড়া জন্তুর মতো অসহায়’ মোচড়ায় সে (‘Do I dare/Disturb he universe?/In a minute there is time/For decisions and revisions which a minute will reverse.’) তা বুদ্ধদেবের প্রেমিক-কথকের চিন্তার বাইরে। এমনকি জীবনানন্দের লোকেন বোসও প্রুফ্রকের মতো সময়ের দ্বিরাচারে দীর্ণ: ‘সুজাতাকে ভালবাসতাম আমি−/এখনো কি ভালবাসি?/সেটা অবসরে ভাববার কথা/অবসর তবু নেই.../সে-ও কি আমায়−সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?/আজো ভালোবাসে না কি?/ইলেক্ট্রনেরা নিজ দোষগুণে বলয়িত হ’য়ে রবে;/কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে?’ (‘লোকেন বোসের জার্নাল’) কিন্তু বুদ্ধদেবের প্রেমিকের মনে এ রকম কোনো ‘overwhelming questions" উত্থিত হয় না; তাঁর নির্দ্বিধ স্বস্তিবোধ আধুনিক মানসতার সুচক মনে হয় না, মনে হয় যেন এক প্রশ্নহীন কিশোরসুলভ মুগ্ধবোধের উচ্চারণ: ‘কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;...তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,/ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তা-ই দেখতে।/গাড়ি চ’লে গেলো! −কী ভালো তোমাকে বাসি, কেমন ক’রে বলি।’ (‘চিল্কায় সকাল’) সারা জীবনের কাব্যসাধনাকে তিনি যথার্থই এবং সততার সঙ্গে, বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘যা কিছু লিখেছি আমি−হোক যৌবনের স্তব, অন্ধ জৈব/আনন্দের বন্দনা হোক না−/যা-কিছু লিখেছি, সব, সবই ভালোবাসার কবিতা,/...আজ যদি ভাবি মনে হয়/ নারীরে, বাণীরে এক মনে হয়।/মনে হয় আমার তনুর তন্তুর সীবনে/যে-কবিতার ভালোবাসা ছিলো, তারই শ্বেত শিখার পদ্মেরে/ফুটিয়েছি মনে মনে নারীরে মৃণাল ক’রে;’ (‘মৃত্যুর পরে: জন্েনর আগে’, শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর)
অনেক সমালোচকই এমন প্রেমসর্বস্ব বুদ্ধদেব বসুকে ছেড়ে কথা বলেননি। একজনের মূল্যায়ন এমন: ‘(বুদ্ধদেব বসুর) নারী-চেতনাও মুখ্যতঃ প্রেম-নির্ভর, এবং সে-প্রেমও আবার সর্বাত্মক যৌনতা-নির্ভর।...কিন্তু প্রেম ছাড়া জগতের আর কিছু সম্পর্কে অন্ধতা, কিংবা নারীর পরিচয় একমাত্র প্রেমে, এবং প্রেমের পরিচয় একমাত্র যৌনতায় লুটোপুটি খাওয়ায়, একি আধুনিক মনের জগৎ সম্পর্কে ত"গত দৃষ্টিভঙ্গি? বুদ্ধদেব অত্যন্ত শক্তিশালী কবি, তাঁর কবিতা কবিত্বের দিক দিয়ে অতুলনীয়ভাবে সার্থক; তাঁর চিত্রকল্প, শব্দসম্ভার, অনুপ্রাস, অলঙ্কার, কাব্যরীতি মৌলিক, আত্মপ্রতিষ্ঠ, অভিনব, অপূর্ব বস্তুনির্মাণক্ষম প্রজ্ঞার পরিচায়ক। কিন্তু সব সত্ত্বেও জীবনের আরও বিভিন্ন দিকের বিচিত্র লীলা ও বিবিধ প্রকাশকে উপেক্ষা করা−এ কি আধুনিক সচেতন নিরাসক্ত মানসের পরিচয়বহ?’−(বারীন্দ্র বসু, কবিতা আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতা, রত্নাবলী, কলকাতা ১৯৮৭, পৃ: ৭৯-৮০) কৌতুকের ও স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বুদ্ধদেবের কবিতা তখনই শাণিত ও আধুনিক মননস্পর্শী হয়েছে, যখন তিনি প্রেম ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাঁর স্নরণীয় কবিতা ‘ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা’, ‘ব্যাং’, ‘ইলিশ’, ‘টাইগার হিলে সুর্যোদয়’, ‘মাছ ধরা’, ‘ইকারুস’, ‘বেশ্যার মৃত্যু’ ইত্যাদির বিষয় প্রেম-রিরংসার বাইরে।
বস্তুত, বুদ্ধদেব বসু তাঁর লেখালেখি ও পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে এবং তাঁর প্রবাদপ্রতিম শিষ্যায়নক্ষমতার মাধ্যমে আধুনিক কবিদের যেমন প্রতিষ্ঠ করেছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি করতে চেয়েছেন নিজের কাব্যাদর্শের প্রতিষ্ঠা, যে কাব্যাদর্শ মডার্নিজমের একটি বিশেষ, সংকুচিত রূপ। ইংল্যান্ডের প্রি-র্যাফায়েলাইট-কবিকুলবাহিত, ওয়াল্টার-পেটারের ঈস্েথটিসিজমের আদর্শে পরিপুষ্ট নান্দনিকবাদ বা কলাকৈবল্যবাদ যার নাম। তাঁর সমস্ত কাব্যকর্মে অমোচনীয় লেগে আছে তাঁর অনড় নান্দনিকতত্ত্ব: তিনি যে আনন্দবাদী সাহিত্যের সাধনা করেছেন, সেখান থেকে সমাজ-সংসার প্রায় নির্বাসিত−শুধু জেগে আছে তাঁর প্রবলপ্রতাপান্বিত একমেবাদ্বিতীয়ম অহং। অস্িনতাভাবনাকে এতটা তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া একমাত্র বুদ্ধদেবের মতো পাশ্চাত্যকলাভাবিত, পড়ুয়া, বিচ্ছিন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁর এই ব্যক্তিগত, গবাক্ষহীন ঘরে (‘প্রান্তরে কিছুই নেই, জানালায় পর্দা টেনে দে’) শুধু তাঁর প্রিয়তমা কঙ্কার অধিবাস, যেখানে আসঙ্গপিপাসু-রূপবুভুক্ষু একজন ডেকাডেন্ট তাঁর হাতের তালুতে নিয়ে আঘ্রাণ করেন ইন্দ্রিয়ঘনত্বের সুগন্ধি। ‘আমার আকাঙ্ক্ষা তাই কবিত্বের অদ্বিতীয় ব্রত,/সংঘহীন সংজ্ঞাতীত এককের আদিম জ্যামিতি−/স্তব্ধতার নীলিমায় আত্মজাত পূর্ণতার বাণী।’ (‘উৎসর্গপত্র’, দময়ন্তী) সংঘহীন একাকীত্বের আদিম জ্যামিতি জীবনানন্দেরও অনুধ্যেয় ছিল, কিন্তু জীবনানন্দের কথিত ‘নির্জনতা’র সঙ্গে বুদ্ধদেবের আত্মাপসারণের পার্থক্য রয়েছে। জীবনানন্দ নিজের স্বভাবদোষে আলাদা হয়েছেন; তাঁর আত্মমুখিনতা তাঁর স্বভাবজাত ও স্বতঃস্কুর্ত। বুদ্ধদেব শিষ্যপরিবেষ্টিত, নবসাহিত্যান্দোলনের বৈতালিক বসু, সচেতনভাবে, কৌশল হিসেবে বেছে নিলেন, অন্তত কবিতায়, সমাজরিক্ততার, অনঘ আত্মতার পথ। তাঁর ‘রাত তিনটের সনেট: ১’-এর উদ্ধৃতি দিই। কবির প্রশ্ন, ‘যীশু কি পরোপকারী ছিলেন, তোমরা ভাবো? না কি বুদ্ধ কোনো সমিতির/মাননীয় বাচাল, পরিশ্রমী, অশীতির/মোহগ্রস্ত সভাপতি?’ সুতরাং কবির পরামর্শ, ‘জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে;/হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম, আর পুলকে বধির।/যে-সব খবর নিয়ে সেবকেরা উৎসাহে অধীর,/আধ ঘণ্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে।’ বিশুদ্ধ আনন্দের পূজারি বুদ্ধদেব ‘পুলকে বধির’ ছিলেন, কালের সমূহ কলাপ কিংবা ক্রন্দন তাঁর কানে পৌঁছায়নি; তিনি থেকে গেছেন নিরুত্তাপ, নিরুত্তেজ রূপসাধক। তবে কালের কৃপাণের সামনে প্রবলপ্রতাপী সম্রাটকেও দাঁড়াতে হয়। বুদ্ধদেব বসুকে কেন যেন মনে হয় আত্মবিশ্বাসহীন ও সশঙ্ক−অন্তত আধুনিক বাংলা কবিতার ভুমিকায় তাঁর দ্বিধাদীর্ণ দোলাচল আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে না।
***
বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ : অন্য মূল্যায়ন
লেখক: কবি ও ব্লগার সৈকত হাবিব, সামহোয়্যারইন ব্লগ
তাঁর জন্মশতবর্ষে এসে উত্তরসূরিদের এ কথা স্বীকার করা প্রয়োজন, বুদ্ধদেব বসুর ঋণ শোধ করার যোগ্যতা এককভাবে আমরা এখনো খুব বেশি অর্জন করতে পারিনি। কারণ তিনি বাংলা কবিতার এমন এক আশ্চর্য চিরনতুন শিক্ষক, যার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আমাদের খুব সহজে ফুরোবে না। বাংলাদেশে কবির সংখ্যা চিরকালই বেশি, উত্তম কবির সংখ্যাও সুপ্রচুর। অথচ কবিতার খাঁটি শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। এর কারণ হয়তো এই, কবিরা তাদের পাঠ, দেখা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যা কিছু অর্জন করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল তাদের কবিতার ভেতর দিয়েই প্রকাশ করেন। ক্বদাচিৎ গদ্যচর্চা করলেও, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের মধ্যে কবিতার মতো সমান বা তীব্র সাধনা খুব কম ক্ষেত্রেই দৃষ্টিগোচর। কিংবা কবির গদ্য হয়তো অনেক ক্ষেত্রে তার চিন্তার সেই অবশেষ, যা তিনি কবিতায় প্রকাশ করতে পারেন না বলে গদ্যের আশ্রয় নেন। অথবা সেগুলো হয়তো উপলরক্ষের লেখা।
কিন্তু কবি বুদ্ধদেব বসুর শিল্পচর্চার অপরাপর মাধ্যমও যে সমান তীব্র এর প্রকৃষ্ট প্রামাণ্য তার প্রবন্ধ ও অনুবাদসকল। তিনি তার কবিতার সমান তাড়না নিয়েই অসামান্য সব গদ্য লিখেছেন এবং অসম্ভব সুন্দর বহু অনুবাদ করেছেন।
আমরা যখন তার অনুবাদে বোদলেয়ারের বিস্ময়কর সব পঙ্ক্তিগুচ্ছ পাঠ করি :
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ...চলিষ্ণু মেঘ...ঐ উঁচুতে... ঐ উঁচুতে...
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
অথবা,
আক্ষেপ, আক্ষেপ শুধু! সময়ের খাদ্য এ-জীবন,
যে-গুপ্ত শত্রুর দাঁতে আমাদের জীবনের ক্ষয়
বাড়ায় বিক্রম তার আমাদেরই রক্তের তর্পণ।
কিংবা হ্যেল্ডার্লিন থেকে :
তবে এসো, মধুর, কোমল সুপ্তি! হৃদয়ের অভিলাষ
অত্যধিক, অসম্ভব। কিন্তু শেষে, হে যৌবন, অস্থির, স্বপ্নিল,
তুমিও হারাবে তাপ, আর ধীরে বার্ধক্য আমাকে
দেবে শান্তি, সান্ত্বনা, বিরাম।
কিংবা রিলকে থেকে :
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে, শূন্য থেকে ঝ`রে প`ড়ে যায়,
যেন দূর আকাশে বিশীর্ণ হ`লো অনেক বাগান;
এমন ভঙ্গিতে ঝরে, প্রত্যাখ্যানে যেন প্রতিশ্রুত।
এবং পৃথিবী ঝরে প্রতি রাত্রে গতিপথচ্যুত,
নত্রশৃঙ্খল ছিঁড়ে-- নিঃসঙ্গতায়।
আমরাও ঝ`রে যাই। এই হাত-- তাও পড়ে ঝ`রে।
দ্যাখো অন্য সকলেরে : সকলেই এর অংশীদার।
কিংবা পাস্তারনাক থেকে :
তোমার কঠিন পণ ভালোবাসি আমি,
আমার ভূমিকার অভিনয়ে আছি সম্মত।
কিন্তু এবার এক ভিন্ন পালা শুরু হ`লো;
এই একবারের মতো দাও আমাকে নিষ্কৃতি।
কিন্তু অঙ্কগুলির পারম্পর্য অনড়
আর পথের শেষ আমাকে মুক্তি দেবে না;
নিঃসঙ্গ আমি; সব ডুবে গেলো ধর্মান্ধের শঠতায়।
মাঠ পেরোনোর মতো সহজ নয় বেঁচে থাকা।
তখন এইসব অসামান্য ও সপ্রাণ পঙ্ক্তিগুচ্ছ আমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন, প্লাবিত, মুগ্ধ করে যে, মনে হয় কোথায় অনুবাদ, কোথায় বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রিলকে বা পাস্তারনাক-- এ যেন কবি বুদ্ধদেব বসুরই এক অন্তর্গত প্রগাঢ় স্বর। এর কারণ সম্ভবত একটাই, বুদ্ধদেব অনুবাদেও তার কবির চৈতন্যকেই বহাল রেখেছেন। নিজের কবিতার জন্য তিনি যে অপত্য স্নেহ লালন করেন, অন্য ভাষার, সুদূরের, অন্য সময়ের কবির কবিতার প্রতিও একই মমত্ব পোষণ করেন। আর এটা বড় পষ্টভাবেই অনুভব করা যায় তার করা অনুবাদ বইগুলির ভূমিকাসকল পাঠ করলে (যেমন : কালিদাস, বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন, রিলকে)। এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি, বুদ্ধদেব বসু যে সময়ের কবির কবিতাই অনুবাদ করুন না, কবিতার বিষয়মূলকে অক্ষুন্ন বা অ-ব্যাহত রেখেও, তিনি বাংলায় এর রূপ দিয়েছেন তার সমকালীন ও নিজস্ব কাব্যভাষায়। ফলে, তার কবিতা ও অনুবাদ হয়ে উঠেছে অনেকটা সমার্থবোধক। এ প্রসঙ্গে তার নিজেরই এক ধরনের স্বীকারোক্তি রয়েছে কোনো এক গদ্যে, যেখানে তিনি বলেছেন, যখন দিনের পর দিন কবিতা লিখতে পারতেন না, তখন, তার স্বভাবজাত সৃষ্টিতাড়না, অনুসন্ধান ও পাঠস্বভাবহেতু, ভিনভাষী কবিদের কবিতার রস আস্বাদন করতেন এবং কখনো-সখনো অনুবাদ করতেন। এগুলোও অনেকটা তার নিজস্ব কাব্যবন্ধ্যাকালেরই সৃষ্টি, কিন্তু এগুলোর উৎস আর অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বহুমাত্রিক উপাদান নয়, বরং তার পূর্বজ ভিনভাষী কবিদেরই সৃষ্টি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোনো কোনো একচক্ষু অধ্যাপক-সমালোচক মনে করেন, তার নিজের কবিতাও নাকি অনেকাংশে এসব কবিতারই অবশেষমাত্র। তবে এমত ধারণার নেপথ্যে বুদ্ধদেব নিজেও খানিকটা দায়ী। কারণ, তিনি অনুবাদেও এত বেশি নিখুঁত, সযত্ন, সহৃদয় আর বাঙালি যে, যদি ওইসব কবির নিজদেশী উপাদান, চরিত্র ও পুরাণকে তিনি যথাযথ ব্যবহার না করতেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকেও তার নিজের কবিতা বলেই চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু আমরা এখনো পর্যন্ত পশ্চিমকেই উন্নত ও শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবি, তাই আমাদের অজান্তেই বুদ্ধদেবকে ছোট করে দেখি। তার সৃষ্টিশীলতা, নিষ্ঠা ও সততার কথা আমাদের মনেই থাকে না। অথচ তিনি তার প্রতিটি অনুবাদ-বইয়ে যেভাবে ভূমিকা ও টীকাভাষ্য দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য যে ধরনের মেধা ও শ্রম তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার দিকে নজর দিলেই টের পাওয়া যায় তাকে কী অসাধ্যসাধন করতে হয়েছে। তবে প্রভাবের কথা বলতে হলে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি ঋণ কেবল পশ্চিম থেকেই নেননি, তার মতো সর্বভূক শিল্পসাধক আধুনিক-প্রাচীন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সবখান থেকেই তার অন্তর্জগৎ সমৃদ্ধ করেছেন। সেক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই ইউরোপ থেকে তার গ্রহণের পরিমাণটা বেশি। কিন্তু এই কূপমণ্ডুক জাতির ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা তা হলো তিনি নিজেকেই কেবল ঋদ্ধ করেননি, নিজ ভাষায় নিজ জাতির জন্য সেগুলো আমৃত্যু দু হাতে অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এবং নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রগাঢ় শিক্ষক। কারণ বুদ্ধদেব বসুর ব্যাপারটা এমন নয় যে, তিনি মাস্টারির দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে উদ্ধারের মিশন গ্রহণ করেছিলেন (যদিও তিনি পেশাগতভাবেও জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক! বরং বলা উচিত, ভারতবর্ষে একাডেমিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছে তারই নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে)।
আসলে তার এই শিক্ষক হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ঘটনার মতো। `প্রাকৃতিক' এই অর্থে যে, প্রকৃতির যে সূত্রে তিনি কবি, সে অর্থেই তিনি কবিতারও শিক্ষক। এ দায়িত্ব তাকে কেউ অর্পণ করেনি, কিংবা তিনি যে শিক্ষকতা করছেন এই মাস্টারি-মনোভাব নিয়েও তিনি কবিতার শিক্ষকতা করতে নামেননি। বরং বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তার যে স্বভাবজাত স্নান ও ডুব দেওয়া এবং সেখান থেকে তার যে নিবিড় আহরণ, এবং পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষের জন্য সহৃদয়হৃদয়সংবাদী করে উপস্থাপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটিই তাকে পরিণত করেছে এক গভীরতর শিক্ষকে।
কবিতা যে কেবল ভাব দিয়ে রচিত হয় না, একটি কবিতার কবিতা হয়ে উঠার জন্য যে অনেকগুলো অভাব মেটাতে হয়, এ কথাটি এই একুশ শতকে এসেও অনেকে বুঝতে চান না। আবার কবিতার জন্য যে শিক্ষা ও দীক্ষা প্রয়োজন এটিও কবি ও পাঠক উভয়েই বিস্মৃত হয়ে পড়েন। শিল্পকলার অপরাপর মাধ্যম যেমন : সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও লেখালেখির, কবিতার স্কুল আমাদের দেশে ছিল না কোনোকালে। কিন্তু স্কুল থাক বা না থাক, না থাক প্রশিক্ষণশালা, যে জাতির রবীন্দ্রনাথ আছে, যার মধ্যে অতীত ও আগামীর অপূর্ব মিলন ঘটেছে, যিনি শুধু শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার এক গভীর সমুদ্র ছিলেন না, বরং স্বজাতির জন্য খুব সহজ করে সেসব উপস্থাপনও করে গেছেন, সেখানে কোনো স্কুলের দরকারও তো হয় না। সেগুলো একটু কষ্ট করে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করলেই তো হয়ে যায়। এর বাইরে প্রাচীন-নতুন অপরাপর জ্ঞান-চিন্তা-তত্ত্ব তো আছেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো সে অজ্ঞানতার আঁধার গেল না। আশ্চর্য ব্যাপারটা হলো, এই আক্ষেপ প্রায় সত্তর বছর আগে (১৯৩৮ সালে) বুদ্ধদেব বসু তার এক লেখায় যেভাবে করেছেন, আজও প্রায় একই ভাষায় আমাদেরও আক্ষেপটা করতে হয় (দ্রষ্টব্য : `লেখার ইস্কুল', কালের পুতুল)। এবং এর ফল এই যে, বুদ্ধদেব বসুর মতো দ্রষ্টা-শিক্ষকের কাছে আমাদের ঋণ ক্রমাগত বেড়ে চলে।
এর মানে এই নয় যে, আমরা বুদ্ধদেব বসুদের পর আর এগোইনি। বরং বাংলা কবিতা আরো বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। তার অনেক শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই যে অগ্রগতি (যদিও তা প্রশ্নাতীত নয়, এবং আমাদের কবিতা, বিশেষত তিরিশ ও এর পরবর্তী মূলধারার কবিতায় পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ নিয়ে যে বিতর্ক, তার কথা মনে রেখেও), তার নেপথ্যে যদি কাউকে যথাযথ শিক্ষকের অভিধা দিতে হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই দিতে হবে বুদ্ধদেব বসুকে। রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যেমন নতুন সম্ভাবনায়, চিন্তায়, ভাষায় আরো উত্তুঙ্গতায় পৌঁছে দিয়ে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার নতুন দরোজা খুলে দিয়েছেন, আর সেই দরোজায় তার সমসাময়িক ও উত্তরকালের কবি-সমালোচক-পাঠকের অবাধ প্রবেশ করার জন্য যিনি সবচে বেশি জীবনপাত করেছেন তিনি বুদ্ধদেব বসু। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেড় দশক আগে উচ্চারিত বাংলা কবিতার নীরব সাধক পঞ্চাশের দশকের কবি আজীজুল হকের একটি মৌখিক উক্তি : তিরিশের কবিতা যে আজকের বাংলা কবিতার মূলধারা, তা যতটা সে সময়ের কবিদের কবিতার জন্য, ততটাই এর সপক্ষে বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি-গদ্যকারদের নিরন্তর গদ্যরচনার জন্য।
আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি, যখন এমনকি রবীন্দ্রনাথও ঠিক তাঁর প্রতিভা বুঝে উঠতে পারেননি, বরং তার কবিতা সম্পর্কে দায়সারাভাবে বললেন `তোমার কবিতায় তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে', `শব্দ নিয়ে এত জবরদস্তি করো কেন বুঝিনে', তখন তরুণ বুদ্ধদেব বসুই প্রাথমিক জীবনানন্দকে গভীরভাবে আবিষ্কার করলেন এবং জীবনানন্দের বহু সাহিত্যশত্রুর বিরুদ্ধে প্রায় একাকী কলম চালিয়ে তাকে সাহিত্য-অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। `প্রাথমিক জীবনানন্দ', কারণ, বুদ্ধদেব বসু, পরিণত জীবনানন্দ দাশকে কখনো কখনো ভুল পাঠ করেছেন, বিশেষত, বুদ্ধদেব ধূসর পাণ্ডুলিপি-বনলতা সেন পরবর্তী জীবনানন্দর ওপর অজ্ঞাত কারণে খুব নাখোশ হয়েছিলেন এবং জীবনানন্দকে রীতিমতো আক্রমণ করে লিখেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে আবার তিনি তার আস্থা ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষণিক এই ভ্রান্তির কারণে তার অবদান খাটো হয়ে যায় না, কেননা, জীবনানন্দ দাশের জন্য তার যে একক শ্রম, তা এখনো অনেক জীবনানন্দ-গবেষকের চেয়েও বেশি এবং জীবনানন্দর কবিতার ক্ষেত্রে তার অনেক বিশ্লেষণ চিরন্তনতার মাত্রা পেয়ে গেছে।
একইভাবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার বহুমাত্রিক ও আবিষ্কারধর্মী নানা মূল্যায়ন অনেক ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব। তিনি যে বললেন, `বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হ`য়ে আছেন তিনি, বাংলা ভাষার রক্তে-মাংসে মিশে আছেন; তাঁর কাছে ঋণী হবার জন্য এমনকি তাঁকে অধ্যয়নেরও আর প্রয়োজন নেই তেমন, সেই ঋণ স্বতঃসিদ্ধ ব`লেই ধরা যেতে পারে-- শুধু আজকের দিনের নয়, যুগে-যুগে বাংলা ভাষার যে-কোনো লেখকেরই পক্ষে। আর যেখানে প্রত্যভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘ`টে যাবে, সেখানেও, সুখের বিষয়, সম্মোহনের আশঙ্কা আর নেই; রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হ`য়ে, বিচিত্র হ`য়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে।'
[`রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক`, সাহিত্যচর্চা]
এই উক্তির মধ্যে ভক্তির চেয়ে পাঠ বেশি, আবেগের চেয়ে দূরদৃষ্টি বেশি। বুদ্ধদেব ১৯৫২ সালে এই উক্তি করার পর আরো পঞ্চান্ন বছর কেটে গেছে। এখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই আমাদের রক্তের গভীরের জিনিস হয়ে উঠেছেন, তাকে ছাড়া আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর চলে না, যেমন করে বাতাস অদৃশ্য হলেও তাকে আমাদের অস্তিত্বের জন্যই প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়।
বুদ্ধদেবের ভাষার এমন এক মাধুর্য আছে, আছে এমন এক পেলবতা আর অক্ষরবৃত্তিক গতি, এর মোহ কাটানো বড় মুশকিল। যদিও অনেক সমালোচক তার ভাষার কমনীয়তা ও রমণীয়তা নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, কিন্তু তারা বোধহয় এই কথাটি ভুলে যান যে, এই ভাষার গুণেই তিনি আমাদের প্রতি শিক্ষকতাটি প্রকৃষ্টভাবে করতে পেরেছেন। কারণ, ভাষার এই গুণটি তার না থাকলে আমাদের বঞ্চনার পরিমাণ বৃদ্ধি ছাড়া কমত না এবং তার ভাষার স্বাদই আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে যায়, যা ছাড়া ওই বিষয়গুলোতে হয়তো আমাদের আগ্রহই জন্মাতো না।
খটখটে পাণ্ডিত্য জিনিসটি হয়তো বুদ্ধদেব বসুর ধাতে কখনোই সইত না। তাই বিষয় যত কঠিনই হোক, বোঝা ও অনুভব করার গুণে সেগুলো তার ভাষায় বাংলাদেশের জল-হাওয়া-মাটির মতোই সহজ ও সজল হয়ে প্রকাশিত হতো, এই মাটির সন্তান হওয়ার কারণে স্বভাবেও আসলে তিনি ছিলেন এমনটিই। এর একটি চমৎকার উদাহরণ, ১৯৫২ সালে রচিত তার একটি বিশ্লেষণী ও আত্মউপলব্ধিমূলক গদ্য `হেমন্ত' (সঙ্গ-নিঃসঙ্গতা : রবীন্দ্রনাথ)। লেখাটিতে আমরা দেখি, বাংলার একটি অবহেলিত ঋতু বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন বাংলার ঋতুগুলোরই সজীব ইতিহাস। পাশাপাশি ঋতুটিকে ঘিরে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যর প্রকৃতি-সমাজ-সাহিত্যের এক তুলনামূলক বয়ানও হাজির করেন তার অনবদ্য ভাষায় এবং ক্রমাগত নিজেকে খন্ডন করতে করতে তিনি পৌঁছতে চান এই সত্যে যে, হেমন্ত নিয়ে তিনি এতকাল যে মনোভাব পোষণ করেছেন, তা ছিল একপেশে ও খন্ডিত। এই মধ্যবয়সে এসে তিনি এর সত্যিকার রূপ সন্দর্শন করলেন।
অন্যদিকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইউরোকেন্দ্রিকতা ও তিরিশি বিতর্কের অন্যতম অভিযুক্ত নায়ক বুদ্ধদেব বসু। তাকে আক্রমণ করা সহজ, কেননা এই তাত্ত্বিক লড়াইয়ের জন্য নানাভাবে তিনিই সবচেয়ে বেশি উপাদান আমাদের যোগান দিয়ে গেছেন। তাদের পাঁচ নায়কের মধ্যে, তিনিই সাহিত্যের সব শাখায় ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। ফলে তাকে সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব বসুরা যে আধুনিকতা বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন, তা ইউরোপীয় আধুনিকতা। তার যে সময় ও নগরচেতনা তারও কেন্দ্রে আছে ইউরোকেন্দ্রিকতা। রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে যাওয়ার নামে তারা দ্বারস্থ হয়েছেন পশ্চিমের কাছে এবং সেখানকার বহু উপাদান অবলীলায় বাংলা কবিতায় আমদানি করেছেন এই ভূগোলের মাটি-মানুষ-শেকড় ও ঐতিহ্যের কথা ভুলে গিয়ে। ফলে তিরিশ ও এর পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতা, হয়ে উঠেছে, বাংলা ভাষায় রচিত ইউরোপীয় কবিতা। অভিযোগ সঠিক হলেও এ উক্তি যেরকম মোটা দাগে উচ্চারিত হয়, ব্যাপারটা এত স্থূলভাবে দেখার মধ্যে একটু সমস্যা আছে। এই দায় কতটা তাদের, পরবর্তীকালের কবিরাই বা এ থেকে উত্তরণের জন্য কী করেছেন এবং এই সময়ের কবিতাই বা কতটা মোহমুক্ত ও শেকড়সংলগ্ন হতে পেরেছে, এসবেরও প্রকৃত বিচার করা কর্তব্য।
কিন্তু এই তত্ত্বজটিল প্রসঙ্গটি অন্যত্র আলোচনার জন্য তুলে রেখে এবং ইতিহাসের এই দায় থেকে তাদের মুক্তি না দিয়েও বুদ্ধদেব বসুর সপক্ষে কিছু সাধু কথা উচ্চারণ করা বাস্তবসঙ্গত ও ন্যায়োচিত।
বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে উপনিবেশিত হওয়া অনেকটা নিয়তির মতো, যে নিয়তির আগ্রাসনে একদিন ইউরোপই ইউরোপের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল (যেমন : জার্মানদের মধ্য থেকে ইংরেজদের পত্তন, ফরাসি জাতির ইংল্যান্ড আগ্রাসন, ইংল্যান্ডের আয়ারল্যান্ড দখল। গ্রিক-রোমান সভ্যতার চিন্তা ও ভাষাগত আধিপত্য। আপাতত তোলা থাক অন্য মহাদেশে তাদের দখল-হত্যা-লুণ্ঠন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক আধিপত্যর কথা।)। কিন্তু এতো সব নেতি উপাদানের পরও ইউরোপ থেকে তিনি যে শৈল্পিক-মানবিক গুণগুলো আত্মীকৃত করেছেন, সেগুলোর মূল্য না দিলেও বড় ধরনের অবিচার করা হবে। বুদ্ধদেব বসু অন্ধ ইউরোপপন্থি ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের মাত্রাজ্ঞান তার কী মাত্রার ছিল, তার জন্য তার মেঘদূত বইটির ভূমিকাই উৎকৃষ্ট সাক্ষী। পরন্তু শিল্পের স্বয়ম্ভুতা, যুক্তির বোধ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের যে তুলাদণ্ড তার প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেজন্য ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রতি তার আগ্রহকে আমরা বরং খানিকটা শ্রদ্ধা জানাতে পারি। কারণ, প্রত্যক্ষ উপনিবেশ লোপ পেলেও আমাদের মনোজগৎ এখনো পশ্চিমা উপনিবেশের দখলে। আজও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের যথেষ্ট কম ও নিজস্ব জ্ঞান-ঐতিহ্য-সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের চেতনবোধও পশ্চিম থেকেই আমদানিকৃত। যথেষ্ট পরিমাণ ইংরেজি জানা এবং ততটাই কম মাতৃভাষা জানা আমাদের শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যর উচ্চ মানদণ্ড। অন্য ভাষার সাহিত্য ইংরেজি অনুবাদে পেলে আমরা যতটা উল্লসিত হই, সরাসরি বাংলায় অনুবাদ হলেও আমরা ততটা উৎসাহী হই না। পশ্চিমের ডিগ্রি এখনো মহার্ঘ্য ও পূজনীয় বস্তু। তাদের বহুমুখী আধিপত্য এখন বরং উপনিবেশ আমলের চেয়ে বহু গুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু বরং উপনিবেশকালের মানুষ হয়েও এতটা গদগদ ছিলেন না, বরং গ্রহণ-বর্জনের একটা নিজস্ব প্রক্রিয়া তার ছিল, যা পক্ষান্তরে স্বদেশ ও ভাষার পক্ষে অনেক অনুকূল ছিল। এ দিক থেকেও তিনি পরোক্ষভাবে আমাদের একজন অন্তর্গত শিক্ষক। অন্যদিকে উদারতা বুদ্ধদেব বসুর একটি বড় গুণ। যেটা যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি শিল্পগত ক্ষেত্রেও। কারণ তিনি যেভাবে তার পূর্বসূরি বা সমসাময়িক কবিদেরই নয়, বরং উত্তরসূরি কবিদেরও ক্ষান্তিহীনভাবে মূল্যায়ন আলোচনা ও সমালোচনা করেছেন, এটা এখনকার দিনে খুব বিরল ঘটনা। বরং এখনো আমরা অনেক বেশি আত্মপর। মূল্যায়ন তো পরের কথা, সমকালীন সতীর্থদের পাঠ করতেও আমাদের অনেক অনীহা। এক্ষেত্রেও তিনি আমাদের জরুরি শিক্ষক।
রবীন্দ্রনাথের পর শিল্পের নানা মাধ্যমে এত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ যেমন খুব কম লেখক করতে পেরেছেন, তেমনি নিরন্তর আত্মপাঠ-আত্মমূল্যায়ন-আত্মচেতনার মধ্য দিয়ে আমৃত্যু নবীন ও প্রবহমান থাকার ক্ষমতাও খুব কম লেখকেরই ছিল। রবীন্দ্র-পরবর্তীদের মধ্যে এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার বৈধ অধিকার রাখেন। অন্যদিকে, শুধু বাংলা কবিতার বিস্তার, বিকাশ ও বিশ্লেষণে তার যে সাধনা ও অবদান, এর জন্যই তিনি আমাদের চিরপূজনীয় হতে পারেন।
কিন্তু আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণতার কারণেই হোক আর অজ্ঞানতা বা অমনোযোগের কারণেই হোক, তিনি আজও অনেকটাই অবহেলিতই রয়ে গেলেন। তাঁর জন্মের শতবর্ষ পরে এখন আমাদের সামনে এক সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে তাকে ফিরে দেখার, মূল্যায়ন করার ও শ্রদ্ধা জানাবার। আর তা করা দরকার শাদা চোখে ও বাস্তবতার নিরিখে। কেবল ভক্তি বা বিরোধিতা দিয়ে বিচার করতে গেলে তা হবে আমাদের আত্মপ্রতারণারই আরেক প্রকাশ।
***
বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সাম্প্রতিক বিবেচনা
লেখক: নূরুল হক
সৌজন্যে: Bangladesh News 24x7.com
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বসাহিত্যে যে পরিবর্তন সূচিত হলো, তার দোলা কবিতাকেই সবচেয়ে বেশি এবং সার্থকরূপে আলোড়িত করেছিল। সে আলোড়নে রোমান্টিক কবিকুল অনেকটা বিচলিত হয়েছিলেন। রোমান্টিক কবিকুল আধুনিক কাব্যের যুগলক্ষণ শনাক্ত করতে অসমর্থ ছিলেন এবং সে পরিবর্তনে ব্যথিত হয়েছিলেন। ইউরোপের টি এস এলিয়ট, ইয়েটস এবং বোদলেয়ারের কবিতায় সে নৈরাশ্যচেতনা, অবক্ষয়ের করুণ চিত্র তা সমকালীন বাঙালী কবিকে বিমোহিত করে। বাঙলা কবিতায় তখন প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একচ্ছত্র আধিপত্য। সে আধিপত্যকে স্বীকার করেও প্রথম দ্রোহী হয়ে ওঠেন কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহে যতটা শিল্প বর্তমান ছিল, তা চাপিয়ে রাজনৈতিক দ্রোহ বড় হয়ে উঠেছিল। তবু রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রথম সাহস কাজী নজরুল ইসলামই অর্জন করেছিলেন। সে সাহসকে পুঁজি করে কাজী নজরুল ইসলাম নতুন কাব্যবলয় নির্মাণ করার পরই ত্রিশের পঞ্চপা-বের অভিষেক ও বিকাশ। পঞ্চপা-বের সবাই কি ব্যাপ্তিতে, বিশালতায় ও গভীরতায় একই মানের ছিলেন? পঞ্চপা-বের বাইরে কি আর আধুনিক ও মৌলিক কবি ছিলেন না? যারা দীপ্তি ত্রিপাঠীর আধুনিক বাঙলা কাব্যপরিচয় গ্রন্থে স্থান পেতে পারতেন? দীপ্তি ত্রিপাঠীর প্রসঙ্গ এখানে, প্রাসঙ্গিক। কারণ আজ পর্যন্ত আধুনিক বাঙলা কবিতার বিচারের ক্ষেত্রে তারই কাব্যবোধকেই সমালোচককুল মূল ভিত্তি মেনে সমালোচনা শুরু করেন।
দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতামত আজ আর সর্বাংশে মেনে চলার মতো যুক্তিসঙ্গত কী কারণ আছে? ত্রিপাঠী চিহ্নিত আধুনিকতার যে লক্ষ্মণ ও বৈশিষ্ট্য, তাতে বুদ্ধদেব বসুকে আধুনিক কবি বলা কতটা সঙ্গত? যদি ত্রিপাঠীর সূত্রাবলীকে উপেক্ষা করার মতো যুক্তিসঙ্গত কোন যুগলক্ষ্মণ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়, তাহলে বুদ্ধদেব বসু আধুনিক, কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আধুনিক। শেষোক্ত দুই কবি আধুনিক যুগমানসের যন্ত্রণা ও জীবনযাত্রার নানা জটিল গ্রন্থিমোচন করেছেন ত্রিপাঠী বর্ণিত আধুনিক কবিদের চেয়ে ঢের বেশি। সে প্রসঙ্গ প্রলম্বিত এবং বহুতল যুক্তিতর্কের স্তর পার হওয়ার পর অমীমাংসিত প্রপঞ্চ হিসেবে স্থিত এবং অনড়। কারণ, যুগমানসের ধর্ম এই-ইথঅতীতের, নিকট অতীতের কিংবা সমকালের কোন বিশেষ প্রতিভাবান, প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বের সিদ্ধান্তকে দৈববাণীর মতো গ্রহণ করা এবং সশ্রদ্ধচিত্তে লালন করা। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন প্রতিভাবান নতুন চিন্তকের যৌক্তিক ও স্বাভাবিক অভিষেক ও আত্মপ্রতিষ্ঠা না ঘটে। যে বুদ্ধদেব কালস্রোত কবিতায় আমি হেথা বসে আছি/বসে আছি শুধু,/স্তব্ধচিত্ত, মৌন, ভাষাহীন।/ কালের অধীর নদী অলক্ষিতে যেতেছে বহিয়া/ অনাদির উৎস হতে বাহিরিয়া অসীমের, অশেষের টানে। বলে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেন বলাকার রবীন্দ্রনাথের সমগোত্রীয় কবি হিসেবে, সে বুদ্ধদেব বসুই মানুষ কবিতায় শুনিনু, মানুষ শুধু জীবসৃষ্টিযন্ত্রমাত্র নহে,/ক্ষুদ্র খর্ব পশুসম ক্ষীণজীবী নহে তার প্রাণ; বিধাতারও চেয়ে বড়ো শক্তিমান, আরো সে মহান,/নিজের নতুন করি গড়িয়াছে আপন আগ্রহে। বলে চণ্ডিদাসের হাত ধরে নজরুলের মানুষ কবিতারই প্রতিধ্বনি করেন তাকে স্ববিরোধী না বলে উপায় কী?
তার কাব্যকীর্তির প্রধান অনুষঙ্গ প্রেম। সে প্রেম শাশ্বত প্রেম নয়। বরং দেহজ কামনাসিক্ত শারীরিক প্রেম। যা ব্যক্তিমানুষের শারীরিক বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিমনে হাহাকার আর আত্মশ্লাঘার জন্মই দেয়। নশ্বর বিশ্বচরাচরে শরীরের মতো প্রেমেও ক্ষয় আছে এবং সে ক্ষয় কালক্রমে অনুতাপ ও পাপবোধের জন্ম দেয়। জীবনানন্দ দাশ প্রেমকে যেমন দেখেছেন, নারীর সহমর্মিতা, সমবেদনা, পুরুষের আত্মনিবেদনের ভেতর, বুদ্ধদেব বসু দেখেছেন ঠিক তার বিপরীত মেরুতে। যে অর্থে রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথ এবং আধুনিক জীবনানন্দ ভাববাদীপ্রেমিক, সে অর্থে বুদ্ধদেব বসু ভোগবাদী। তার প্রেমবিষয়ক কবিতায় উপভোগের উপচারের চেয়ে ভোগের অনুষঙ্গ কি বড় হয়ে ওঠে না? প্রেমিক, প্রেমিকের প্রার্থনা কবিতা সে প্রমাণই বহন করে। নির্মম যৌবন কবিতায় বুদ্ধদেব বসুকে দেখি এই উপলব্ধিতে উপনীত হতেথহিরন্ময় পাত্রে ঝরে সুবর্ণ মদিরা। কিন্তু কেন, সে প্রসঙ্গও এ কবিতায় বিশদে বর্ণনা আছে। সে বর্ণনা একান্ত বিবরণ ধর্মিতাকে গ্রাস করে নয়; বরং যাপিত জীবনের যে সুবর্ণ সঞ্চয়, সেখানে যে বাঁক ও তার ঢেউ তাকে কবি জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে উপলব্ধি করতে অনুপ্রাণিত হন যে, যৌবন আসলে মানবজীবনের এক পরাক্রমী ক্ষয়িষ্ণু অধ্যায়ের নাম। যেখানে তার অযত্ন ও অবহেলা সেখানে তার রুদ্রমূর্তি। যেখানে তার সযত্ন আসন পাতা সেখানে সে প্রাণবন্ত ও সৌন্দর্যের স্মারক। আবার দ্রোপদীর শাড়ি কবিতায় তারই অন্যরূপ দেখি। এ কবিতায় কবি স্মৃতিভারাতুর। আপন যৌবনের বৈরীরূপ এসে এখানে সমাহিত, নিজের উত্তরাধিকারের ভেতর আপন রক্ত ছলকে ওঠে; অথচ তাকেই আপন যৌবনকালের সমতলে ও সমমর্যাদায় আবহনে তার প্রাজ্ঞমনের সম্মতি মেলে না। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ প্রেমে আত্মতৃপ্তি ও আত্মঅহংকে বড় করে তুলেছেন; বুদ্ধদেব শরীরের চাহিদাকে অনিবার্য জেনেছেন। কারণ বুদ্ধদেব যৌবনের পূজারী। সে অর্থে বুদ্ধদেব বসুকে কি কামুক বলা অসঙ্গত? ব্যক্তিমানুষের মস্তিষ্কে যৌনকামনার বিপুল আলোড়নে আভিজাত্য, ঐতিহ্য পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের বিশ্বাসের জগতের এক বিরাট অঞ্চল জুড়ে কামনা ও লাম্পট্যকে প্রায় অভিন্নার্থে গ্রহণ করে। একার্থক বিষয় নিয়ে মানুষের মনোজগতে কোন প্রকার ভাবনার অবস্থান্তর ঘটে না। যৌন কামনা আধুনিক সম্পন্ন মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। সে অনিবার্য আচরণকে অস্বীকার করার মধ্যে মহত্ত্ব কী? স্বীকার করে নেয়াই কি যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত নয়? সে অর্থে বুদ্ধদেব বসু স্ববিরোধী আধুনিক। যার যৌবনে কামনার সংযোগ, প্রৌঢ়ে সৌন্দর্যে ও চিত্ত প্রশান্তির সংরাগ এবং বার্ধক্যে আত্মশ্লাঘা ও হাহাকারের ঘনঘটা।
দীপ্তি ত্রিপাঠী থেকে শুরু করে অশ্র“কুমার শিকদার হয়ে ড. হুমায়ুন আজাদ প্রত্যেকে বুদ্ধদেব বসুর ‘ইলিশ’ কবিতার প্রশংসা করেছেন এবং এ কবিতাকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কবিতাগুলোর অন্যতমও বলেছেন। বুদ্ধদেব বসুর যে প্রতিভা, প্রতিভার যে গভীরতা, ব্যাপ্তি ও বিশালতা তার নিরিখে ‘ইলিশ’ কবিতাটিকে যদি আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর একটি ধরি, তাহলে তার কবিত্ব শক্তি নিয়ে আজকের পাঠকের মনে সংশয় জন্মে। কারণ ‘ইলিশ’ কবিতাটি নিতান্তই বর্ণনাধর্মী একটি সাধারণ কবিতা। এ কবিতাকে তার কবিত্বের স্মারক হিসেবে উপস্থাপন করলে তার মর্যাদা বাড়ে বলে মনে হয় না, বরং কবি হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বেরর আসনটিকে অবজ্ঞা ও অবহেলায় ঠেলে দেয়া হয় মাত্র। কবি হিসেবে তার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি নিঃসন্দেহে কালীদাসের মেঘদূত কাব্যের অনুবাদ ও বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ। এছাড়াও তার কবিত্বের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ ঘটেছে ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’, ‘মৃত্যুর পরে : জন্মের আগে’, ‘একখানা হাত’, ‘রূপান্তর’ কবিতায়। এর মধ্যে ‘মৃত্যুর পরে : জন্মের আগে’ কবিতাটি দীর্ঘ ও জটিল হওয়ায় অনেকেরই হয়ত পাঠভীতি জন্মে। সে অপাঠজনিত কারণে এ দীর্ঘ কবিতাটি পাঠক-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয় না। অথচ এ একটি কবিতাই তার মৌলিক কবি প্রতিভার স্বাক্ষর আঁকার পক্ষে যথেষ্ট। এ কবিতা মানবজীবনের যে অতলস্পর্শী চেতনার গহনতলের কথা প্রকাশ করা হয়েছে, তার সমতুল্য কবিতা বুদ্ধদেব সারাজীবনেও আর একটি লিখতে পারেননি। কারণ মহৎ কবিতা লেখা সম্ভব নয়, তা দৈববাণীর মতোই অকস্মাৎ কবির কলমে বেজে ওঠে। যিনি সৎ কবি তিনি সে দৈববাণীকে অক্ষরের ফ্রেমে আঁকতে সমর্থ হন, ব্যর্থ ও দুর্বল কবি সে বাণীর কথা প্রচার করে আত্মরতিতে ভোগেন মাত্র।
বুদ্ধদেব বসু সামাজিক দায় আপন কাঁধে স্বপ্রণোদিত হয়ে নিতে অনীহ ছিলেন। কবিতা তার মানসে বিশুদ্ধ শিল্প। সামাজিক কমিটমেন্ট, রাজনৈতিক চেতনা সে¬াগান ও উচ্চৈঃস্বরের চেঁচামেচির সমতুল্য ছিল? তবে কি বুদ্ধদেব কবিতাকে রমণীয় উপচার কিংবা অবসরে বিনোদনের উপকরণ বিবেচনা করতেন? সমাজের কোন অবক্ষয়, বিশ্বচরাচরের কোন ক্ষয়িষ্ণু অনুষঙ্গ তার মনে কোন ক্ষোভ ঈর্ষা কিংবা ক্রোধ উৎপাদন করতে পারেনি। তিনি রাজহাঁসের মতো পঙ্কে নেমেছেন, সাঁতার কেটেছেন; অথচ তার পালকে কোন আঁচড় লাগেনি। তিনি এতটা নির্মোহ, নিস্পৃহ ও নির্লিপ্ত ছিলেন? কিন্তু কেন? তার ভেতর কি কোন ধার্মিক বাস করতেন? না হলে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলো তার ভাবালুতাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি কেন? তিনি আদিম মানবসমাজের প্রাচীন অনুভূতিকে সযত্নে লালন করেছেন এবং নিজের ভেতর তার পরিচর্যা করেছেন নিরন্তর। তবে কি বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলীকে সন্দেহ করতেন? তাহলে তার কবিতায় প্রজ্ঞার অনুশাসন ও বৈদগ্ধের স্বাক্ষরকে নির্মম উপেক্ষার অন্যতর কারণ কী? বুদ্ধদেব বসু কবি-পশ্চিমের বোদলেয়ারের এক সার্থক ও উজ্জ্বল উপনিবেশ। এ সত্যে কারও মর্মাহত হওয়ার মতো কোন কারণ নেই। পৃথিবীর প্রত্যেক কবিকে মৌলিক ও সার্বভৌম হতে হবে এমন শর্ত কে কখন কোথায় বলে গেছেন? বুদ্ধদেব বসু প্রজ্ঞার শাসনকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেননি; বিচার করেননি হৃদয়ার্তির সামীপ্যে রোমান্টিক মানসকেও। অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুর সামগ্রিক কবিসত্তা জুড়ে সঞ্চরণশীল ও ক্রিয়াশীল সম্ভ্রান্ত রোমান্টিক মানস এবং আধুনিকতার প্রশ্নে প্রচ্ছন্ন স্ববিরোধ। কিন্তু ঘটনাচক্রে দীপ্তি ত্রিপাঠীর মুগ্ধপাঠে পরিচিত হয়ে উঠেন নিরঙ্কুশ আধুনিক কবি হিসেবে। কবিতার পাঠককুল কি চিরকাল দীপ্তি ত্রিপাঠীর মূল্যায়নকে আপ্তবাক্য মেনে চলবেন? যুগের পরিবর্তনে রুচির বিবর্তনে নতুন মূল্যবোধের প্রশ্নে নতুন চেতনায় নতুন চিন্তা করার সকল পথ কি পাঠকের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে? যদি নতুন মূল্যায়নের পথ থাকে, তাহলে বুদ্ধদেব বসুকে আধুনিক কবি বলা বর্তমানে কতটা যুক্তিসঙ্গত?
***
উইকিপিডিয়ায় বুদ্ধদেব বসু
বুদ্ধদেব বসু (জন্মঃ নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ - মৃত্যুঃ মার্চ ১৮, ১৯৭৪) ছিলেন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সমালোচক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরী করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
বুদ্ধদেব বসুর জন্ম হয় কুমিল্লায়। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর পিতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘন্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয় কুমারী ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ-মাতামহীর কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। পুলিশ অফিসার বা দারোগা চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন তাঁর পিতামহ। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়।
১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষূণ্ণ আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করতঃ কলকাতায় অভিভাসন গ্রহণ করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯৩৪ সালে খ্যাতিমান লেখিকা প্রতিভা বসু'র (বিবাহ-পূর্বঃ প্রতিভা সোম) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
কর্ম জীবন
অধ্যাপনার মাধ্যমেই তাঁর কর্মময় জীবন শুরু। জীবনের শেষাবধি তিনি নানা কাজে-কর্মে ব্যাপৃত রেখেছেন। শিক্ষকতাই ছিল জীবিকা অর্জনে তার মূল পেশা। কর্মময় জীবনের শুরুতে স্থানীয় কলেজের লেকচারের পদের জন্য আবেদন করে দু'বার প্রত্যাখ্যাত হলেও ইংরেজি সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পরিণত বয়সে তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। বাঙলা ভাষার তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার ক্ষীণস্রোতকে তিনি বিস্তৃত ও বেগবান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫২ সালে দিল্লী ও মহিশূরে ইউনেস্কোর প্রকল্প উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গের পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
এছাড়াও, তিনি উচ্চ মানের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বুদ্ধদেব বসু প্রভুগুহ ঠাকুরতা, অজিত দত্ত প্রমূখকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। এ সময় ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২৭ - ১৯২৯ পর্যন্ত সচিত্র মাসিক 'প্রগতি' (১৯২৭) মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন এবং 'কল্লোল' (১৯২৩) গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কলকাতায় বসবাসকালে তিনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায় ১৯৩৫ সালে ত্রৈমাসিক কবিতা (আশ্বিন ১৩৪৪) পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পঁচিশ বছরেরও অধিককাল তিনি পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্যআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা (আশ্বিন ১৩৪৪) থেকে বুদ্ধদেব ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (চৈত্র ১৩৪৭) থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়, সদিচ্ছায়, অনুশাসনে এবং নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বাংলা কবিতা তার যথার্থ আধুনিক রূপ লাভ করে। এটি কবি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশে কবিতা পত্রিকার ভূমিকা দূরসঞ্চারী। আধুনিক বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কবিতার তুলনারহিত।
১৯৩৮ সালে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ত্রৈমাসিক চতুরঙ্গ সম্পাদনা করেন। ১৯৪২ সালে ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের আন্দোলনে যোগদান করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির একজন সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। বুদ্ধদেব বসু'র গদ্য ও পদ্যের রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কাব্য ধারার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। গদ্যশিল্পী হিসেবে সমধিক সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতময়তা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সমালোচনামূলক সাহিত্য রচনায়ও মৌলিক প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্য গঠনের ভঙ্গী গ্রথিত করে বাংলা ভাষাকে অধিকতর সাবলীলতা দান করেন তিনি।
বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন:
“আধুনিক বাংলা-সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় 'কল্লোল যুগ' সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে যখন 'কল্লোল' প্রকাশিত হয় তখন বুদ্ধদেবের বয়স মাত্র পনেরো। কলকাতায় কল্লোল (১৩৩০) এবং কালিকলমে'র (১৩১৩) মতো ঢাকায় 'প্রগতি' ছিল সে যুগের আধুনিকতার মুখ্য বার্তাবহ। গ্রন্থকার হিসেবে বুদ্ধদেবের জীবনে ১৯৩০ সালটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বৎসরেই তাঁর বন্দীর বন্দনা (কাব্য), সাড়া (উপন্যাস), অভিনয় নয় (ছোট গল্প-সঙ্কলন) প্রকাশিত হয়। তখন তিনি সবেমাত্র একুশ বৎসর অতিক্রম করেছেন।’’
সাহিত্যে অবদান
ছাত্রজীবনে ঢাকায় তিনি যে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন প্রৌঢ় বয়সেও সেই এক্সপেরিমেন্টের শক্তি তাঁর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। তাঁর প্রথম যৌবনের সাড়া এবং প্রাক-প্রৌঢ় বয়সের তিথিডোর উপন্যাস দু'টি দুই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তাঁর চল্লিশোর্ধ বয়সের রচনাগুলোর মধ্যে - গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত নানা চিরায়ত সাহিত্যের উপমার প্রাচুর্য্য দেখা যায়। অতি আধুনিক উপন্যাসের গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। রচনার অজস্রতা এবং অভিনব লিখনভঙ্গীর দিক দিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তাতে মনঃস্তত্ত্বের বিশ্লেষণের পরিবর্তে কাব্যোচ্ছাসের প্রাধান্য বিদ্যমান। অকর্মণ্য, রডোড্রেনড্রন গুচ্ছ, যেদিন ফুটল কমল প্রভৃতি উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিথিডোর, নির্জন স্বাক্ষর, শেষ পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি উপন্যাস নতুন জীবন-সমীক্ষা-রীতির পরিচয়বাহী।
বুদ্ধদেব বসু'র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পৃথিবীর প্রতি (১৯৩৩) 'বন্দীর বন্দনা'র পরিপূরক গ্রন্থ। উভয় গ্রন্থেই শরীরী প্রত্যয়ে প্রেমের অভিব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। কিছুটা স্বাদের ব্যতিক্রম এসেছে - 'কঙ্কাবতী' (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থে। পদ ও বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে একটি ধ্বনি আবর্ত নির্মাণ করে বুদ্ধদেব বসু যৌবনের আনন্দগানকে স্বাগত জানিয়েছেন।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। সুকুমার সেনের ভাষায়: “তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং 'আধুনিক' কবিতা লেখকদের পক্ষ সমর্থন করা।’’
সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনামূলক সাহিত্যে তাঁর সাফল্য সমপর্যায়ের। তিনি বাংলা গদ্যরীতিতে ইংরেজি বাক্যগঠনের ভঙ্গী সুপ্রসিদ্ধ করেছেন। পরিমার্জিত সঙ্গীতমগ্নতা ও পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততা বুদ্ধদেব বসু'র গদ্যের বৈশিষ্ট্য। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নাটক, কাব্যনাটক, অনুবাদ, সম্পাদনা, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে বসু'র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬টি।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পত্তনে যে কয়েকজনের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয় বুদ্ধদেব বসু তার মধ্যে অন্যতম। তাকে কল্লোল যুগ-এর অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলা কবিতায় আধুনিক চিন্তা-চেতনা এবং কাঠামো প্রবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে পশ্চিমা সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্যক পরিচয় ছিল। ফলে ইউরোপীয় এবং মার্কিন সাহিত্যের কলা-কৌশল বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতায় তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন কবিতাভবন যা হয়ে উঠেছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তীর্থস্থান। ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি দশক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার প্রভাব ছিল অবিসংবাদিত। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি কাজ করেছেন।
জীবনের শেষের দিকে তিনি নাট্যকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেকট্রা ও সত্যসন্ধ, কালসন্ধ্যা, পুনর্মিলন, অনামী অঙ্গনা ও প্রথম পার্থ প্রভৃতি নাট্যকাব্য বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শিল্পরূপে জন্ম দিয়েছে। জগদীশ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন: “বস্তুত শুধু নিজে অজস্র রূপ ও রীতির কবিতা লিখেই নয়, সহযাত্রী এবং উত্তরসূরি আধুনিক কবি সমাজকে কবি মর্যাদায় সমুন্নীত করে কবিতা সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু একালের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন।’’
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
• কবিতাঃ মর্মবাণী (১৯২৫), বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), পৃথিবীর পথে (১৯৩৩), কঙ্কাবতী (১৯৩৭), দময়ন্তী (১৯৪৩), দ্রৌপদীর শাড়ি (১৯৪৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৩), শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮), দময়ন্তী: দ্রৌপদীর শাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৬৩), মরচেপড়া পেরেকের গান (১৯৬৬), একদিন: চিরদিন (১৯৭১), স্বাগত বিদায় (১৯৭১)
• উপন্যাসঃ সাড়া (১৯৩০), সানন্দা (১৯৩৩), লাল মেঘ (১৯৩৪), পরিক্রমা (১৯৩৮), কালো হাওয়া (১৯৪২), তিথিডোর (১৯৪৯), নির্জন স্বাক্ষর (১৯৫১), মৌলিনাথ (১৯৫২), নীলাঞ্জনের খাতা (১৯৬০), পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭), রাত ভর বৃষ্টি (১৯৬৭), গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮), বিপন্ন বিস্ময় (১৯৬৯), রুক্মি (১৯৭২)
• গল্পঃ অভিনয়, অভিনয় নয় (১৯৩০), রেখাচিত্র (১৯৩১), হাওয়া বদল (১৯৪৩), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯), একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু (১৯৬০), হৃদয়ের জাগরণ (১৩৬৮), ভালো আমার ভেলা (১৯৬৩), প্রেমপত্র (১৯৭২)
• প্রবন্ধঃ হঠাৎ-আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), কালের পুতুল (১৯৪৬), সাহিত্যচর্চা (১৩৬১), রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫), স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭), সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩), প্রবন্ধ-সংকলন (১৯৬৬), কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬)
• নাটকঃ মায়া-মালঞ্চ (১৯৪৪), তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬), কলকাতার ইলেক্ট্রা ও সত্যসন্ধ (১৯৬৮)
• অনুবাদঃ কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭), বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৭০), হেল্ডালিনের কবিতা (১৯৬৭), রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০)
• ভ্রমণ কাহিনীঃ সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১), জাপানি জার্নাল (১৯৬২), দেশান্তর (১৯৬৬),
• স্মৃতিকথাঃ আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩), আমার যৌবন (১৯৭৬)
• সম্পাদনাঃ আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৬৩)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:১১