- ০১ -
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী আসছে সামনে।
ছোট্ট মুনীর পাড়ার বিজয় মঞ্চে গান গাইবার জন্য ডাক পেয়েছে।
১৯৯৬ সালের সেই ষোলই ডিসেম্বর বিকেলে মুনীর লাল টুকটুকে গেঞ্জি পড়ে ঘরময় ছোটাছুটি করছে, আয়নার সামনে গিয়ে একবার চুল এদিকে সিঁথি করছে, আরেকবার ওদিকে উলটে দিচ্ছে।
গম্ভীর মানুষটি ওকে কাছে ডাকলেন।
- কি গান শিখেছিস একটু শুনি??
মুনীর কোন এক অজানা কারণে এই মানুষটাকে একটুও ভয় পায় না। সাবলীল ভঙ্গীতে সে মাথা নেড়ে নেড়ে গাইতে শুরু করলো -
উজ্জ্বল সবুজের বুকে ঐ,
লাল রঙ সূর্য আঁকা।
ঝিরঝির বাতাসে উড়ছে,
আমাদের বিজয় পতাআকাআ...
মানুষটা মুচকি হাসলেন, ওর হাতে একটা বাদামী কাগজের প্যাকেট তুলে দিলেন। মুনীর খুব একটা পাত্তা দিলো না, তার পিচ্চি ধুকপুকানো মনটা বিজয় মঞ্চের অনুষ্ঠানে তার আসন্ন বিরাট (!) অবদান নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত।
মানুষটা এবার নিজেই বাদামী প্যাকেটটা দুহাতে খুলে ফেললেন। ভেতর থেকে বের হলো সবুজ রঙের একটা চারকোণা কাপড়। মাঝে টকটকে লাল রঙে সেলাই করা একটা সূর্য। মুনীরের চোখ চকচক করে উঠলো। প্রায় কেড়ে নিলো সে পতাকাটা, মাথায় জড়িয়ে নিলো, মুখ দিয়ে ঠাঠাঠাঠা বন্দুকের আওয়াজ করতে করতে ছুটলো সে, এবং সরাসরি ঘরের আলমারির দরজায় গিয়ে ধুরুম করে ধাক্কা খেলো।
সেদিন সন্ধ্যায় কপালে মুনীরের বিশাল এক গোলআলু, সেটা ঢাকতে সেই চকচকে পতাকাটা অনেক কাজে এসেছিলো।
- ০২ -
১৯৯৭। লাল রঙের বড়ো রেডিওটা বসার ঘরের টেবিলের উপরে, সবাই ঘিরে বসে আছে ওটাকে, চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা।
এইমাত্র আইসিসি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে অপ্রতিরোধ্য পাকিস্তানকে হারিয়ে দিলো টিম টাইগারস। মুনীরের বড়োপা ঝাঁপ দিয়ে কোলেই তুলে নিলো ওকে, কোনমতে হাঁচড়েপাঁচড়ে কোল থেকে নেমে যেতেই এবার ধরলো মেঝোপা, সেই পতাকাটা বেঁধে দিলো ওর মাথায়।
লাফাতে লাফাতে দরজা খুলে নেমে যাবার আগে মুনীরের কাছে মনে হয়েছিলো কেউ তার রঙের বাক্সের সবকয়টা রঙ গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের পুরান ঢাকার এই গলির ভেতরে। চারপাশে উল্লাসিত চিৎকার, ছোট্ট মুনীর হকচকিয়ে থমকে দাঁড়ায়, পেছন থেকে সেই গম্ভীর মানুষটা এসে দুইহাতে কাঁধে তুলে নিলেন ওকে।
ছ ফুট লম্বা একজন মানুষের কাঁধে চড়ে মুনীর দেখতে পেলো অন্য রকম এক বিজয় উৎসব।
- ০৩ -
সন ২০০৮, মার্চের তিন তারিখ।
আকাশ অন্ধকার, যেকোনো মুহূর্তে দশদিক ছাপিয়ে নিয়ে যাবে কালবৈশাখী। একজন বীর যোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হচ্ছে। কিশোর মুনীরের দৃষ্টি ঘুরতে লাগলো সামনে দাঁড়ানো মানুষ গুলোর মুখের ওপর।
হায়দার চাচা, একসেকেন্ডের জন্যও হাসি মুছতোনা তাঁর মুখ থেকে, আজ বিদায় দিচ্ছেন সহযোদ্ধাকে, মুখে হাসি নেই।
নোমান আঙ্কেল, মুনীরকে দাবা খেলা শেখানোর সময় দাঁড়িতে আঙুল চালাতেন চিরুনির মতো করে। মুঠো করে দাঁড়ি ধরে রেখেছেন আজ, চেহারা হতবিহবল।
মুনীর পকেটে হাত ঢোকালো। আঙুলে বাঁধলো খসখসে একটা কাপড়, মুঠোর ভেতর শক্ত করে চেপে ধরলো সে পতাকাটা।
- ০৪ –
০৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩। এক নরপিশাচের দেখানো বিজয় চিহ্নের প্রতি ধিক্কার জানাতে পথে নেমে এসেছে ঢাকার সব তরুণ। মুনীর জানে, মা তাঁর ছেলে কে আঁচলের তল থেকে ছাড়তে চাইবেন না, তাই মাকে না জানিয়েই পা বাড়িয়েছে রাজপথের উদ্দেশ্যে।
- “জঅঅঅঅঅয় বাংআলা”...।
ওর বলিষ্ঠ গলার রগ ফুলে ফুলে ওঠে, মুঠি বদ্ধ ডান হাত প্রচন্ড শক্তিতে উঠে যায় আকাশের দিকে, কবজিতে জড়ানো বয়সী এক পতাকাও সেদিন তার সাথে ঊর্ধ্বপানে ছুটে যায় তারুণ্যের শক্তিতে ভর করে, বয়সের ভারে সবুজ রঙ ফীকে হয়ে এসেছে, ফুটি ফুটি ছিদ্র হয়ে আছে এখানে ওখানে, তবু রাজাকারের ফাঁসির দাবীর মশাল মিছিলে মুনীরের সাথে শামিল হয় বাবার কিনে দেয়া সেই পতাকা।
- ০৫ –
উল্লাসিত মুনীর কম্পিউটারের সামনে বসে, স্কাইপেতে ডায়াল করে প্রিয় বন্ধুকে, খুশি ভাগ করে নিলে নাকি আরও বেড়ে যায়, বাবা বলতেন।
- “উশটা মানবী, আমরা জিতে গেছি রেহ। নিউজিল্যান্ডকে এক্কেবারে বাংলাওয়াশ !!”
ওর কাঁধে জরাজীর্ণ পতাকা বাঁধা দেখে ওপাশের মানুষটা বলেই ফেলে,
- এবার ঢাকায় এসেই তোকে একটা নতুন পতাকা কিনে দেবো।
মুনীর মুচকি হাসে, বলে,
- আগে আয়, তার পর দেখা যাবে।
মনে মনে ভাবে, নতুন চকচকে পতাকায় কি বাবার স্পর্শটা থাকবে???
- ০৬ –
১১-১২-২০১৩, রাত ১২টা বেজে পঁচিশ সেকেন্ড। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরা ছেঁড়া পতাকাটা মুনীরের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে নড়ে উঠছে। ক্ষয়ে আসা কাপড় আর ধুয়ে আসা রঙ আজ বড়ো নতুন, বড়ো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। মুনীর হালকা কাঁপছে।
শতাব্দীর নৃশংসতম নরপিশাচের ফাঁসি উদযাপন করার জন্য মুনীর, আর মুনীরের বাবার পতাকা, প্রস্তুত।