আরেকটি মৃত্যু, অতিব্যস্ত আমরা আর কিছু সুশীল গল্প
দু'তিন বছর আগের কথা। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সামনে কোন এক বিকেলে আমি রিকশায় বাড়ি ফিরছিলাম। মতিঝিলের ঐ এলাকাটা কিরকম ব্যস্ত সেটা কমবেশি সবাই জানেন। বড়-ছোট সবরকম বাসই একটু ফাকা পেলেই যেভাবে টান দেয় সেটাও কমবেশি রাস্তাঘাটে বের হলে সবাই দেখেছেন। সবাই বলতে বুঝাচ্ছি বাস রিক্সাই যাদের ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা। গল্পে ফিরে যাই। হঠাৎ দেখলাম আমার রিকশাটা উল্টে যাচ্ছে। রিকশার চাকার ওপরে যে অংশটা থাকে, সেটা বাসের জোড়াতালি দেয়া বডির কোন একটা ফাকফোকড়ে আটকে গিয়ে বাসের সাথে চলতে শুরু করল, আর ব্যালেন্স হারিয়ে একদিকে কাত হয়ে পুরোপুরি উল্টে গেল। সেই অবস্থায় বাস মনেহয় চলছিল কিছুক্ষণ, মানুষজনের হৈচৈ এ থামালো শেষ পর্যন্ত।
রাস্তা থেকে উঠে (তখন এতটাই ফুসছিলাম রাগে যে নিজের দিকে তাকাইনাই) বাসের জানালার পাশে গিয়ে চিৎকার করছিলাম, কি বলে মনে নাই। জবাবদিহিতা চাচ্ছিলাম হয়তোবা। বাস ড্রাইভার বড়ভাই ভুল হয়ে গেছে বা এইটাইপ কিছু বলছিল, মজার ব্যাপার হল, বাসের ভেতরে যারা ছিল, মানে যাত্রীরা, তারা বলতে লাগলো ভাই যান, দোষ ওমুকের, ড্রাইভারের নয় ইত্যাদি। আমি পুরা তাজ্জব বনে গেলাম। আমি অন্তত: আশা করছিলাম বাস যাত্রীরা আমার পক্ষে থাকবে/আজকে কিছু একটা করা যাবে - সেই বয়সে মাথা বেশি গরম ছিল একটু।
কিছু করার না পেয়ে অন্য একটা রিকশায় চড়ে টের পেলাম হাটুর নিচ থেকে জিন্সটা লাল হয়ে গেছে।
বাইরের মানুষগুলোই বাস থামিয়েছিল। ভেতরের মানুষগুলো বদলে গেল কেন? আসলে আমরা সবাই তো ওমন। আমি যদি ঐ একই বাসের ভেতরে থাকতাম, তাহলে কি ভাবতাম যে ছেলেটা তো আর যাই হোক মরে নাই, এখন আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলেই হল! হ্যা, আমরা সবাই ভাবি নিজেদের নিয়ে। নিজে শক না পেলে, বা একান্ত পরিচিত কেউ না মরলে, আমাদের অতিব্যস্ত টনকটা নড়ে ওঠার কোন প্রয়োজন দেখে না। শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে, আর নিজের অবস্থানটুকুতে কেউ বাগড়া না দিলে, আমাদের অতিব্যস্ত, অতিমূল্যবান সময়ের কাছে জীবনের দামও আধুলির চেয়ে বেশি কিছু হয় না।
আমার গল্প শেষ। গল্পটা বলার কারণ বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কথা শোনাতে নয়, কথাগুলো বলার একটাই উদ্দেশ্য নিজেদের দিকে একটু ফিরে তাকাতে। গল্পের প্লটে বাসের ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের কি উচিত ছিলনা ড্রাইভার আর হেল্পারদের উচিত শিক্ষা দেয়া? যেই লোক এরকম রেকলেস চালায়, সে দু'দিন পরে আরেকজনের সাথে লাগাবে এটাতো পরিষ্কার। বাসের যাত্রী বলেই কি তাদের এই নির্লিপ্ততা? যে এখন বাস থেমে থাকা মানেই ক্যাচাল, বাড়ি ফিরতে অযথা দেরী, সময়ের অপচয়? হ্যা, এই সময় বাচিয়ে বাক্সে জমিয়ে আরেকদিন অন্য কোন বাস বা টেম্পোর তলায় পড়ে যখন পরিবারকে পথে বসিয়ে কবরে যাবেন তখন পোটলা ভরে সময়টাকেও নিয়ে যায়েন, খোদাতাআলা খুশি হয়ে যদি কিছু দেয় এই আশায়।
বঙ্গবাজার সামনের রাস্তাটা দিয়ে, নিউমার্কেট পর্যন্ত অনেক "লেগুনা" বা টেম্পো চলে। সপ্তাহের ৬টা দিনই আমার যাতায়াত এই রোডটা ধরে। যারা দেখেননি এই টেম্পোগুলো, তারা এগুলো কিভাবে চলে আর কারা চালায় - দুটোই দেখলে অবাক হবেন। যাত্রী ভরেই শা শা করে টান দেয়, রিকশা-গাড়ির ফাক দিয়ে পুরোপুরি সর্পিল একটা গতিপথ ধরে তুফানের বেগে এদের জয়যাত্রা। এই যাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া টেম্পোগুলোর দুমড়ানো মুচড়ানো বডি দেখলেই বুঝতে পারবেন। যারা চালায় এই গাড়িগুলা, তাদের তো আর গাড়ির প্রতি মায়াদয়া নাই, আর গাড়ির সাথে লেগে অন্য গাড়ি বা পাবলিকের কি হবে, সেটা চিন্তা করার মতও মানসিক সুস্থতা নাই। চেহারা দেখে নেশাগ্রস্থ মনে হয়। কেয়ারলেস একটা ওয়েতে চালায়, মাঝে মাঝে চালায় ড্রাইভারের সহকারীরা। লাইসেন্স আছে এদের? যে লাইসেন্সের কথা বললাম, সেই লাইসেন্স কেমনে পাওয়া যায় জাননে? আমার নিজেরই চোখে দেখা। চেনাজানা কেউ হলে, বা কোন খাতির পাওয়ার আশায় ড্রাইভিং পরীক্ষায় না বসেও লাইসেন্স পেয়ে যেতে দেখেছি। পুরো সিস্টেম টাই যখন এমন, তখন আমরা সুশীল (বা সাধারণ) জনগণ কি করবো?
হ্যা, আমরা সাধারণ জনগণ সুশীল হয়ে যাব, যতক্ষণ না আমাদের গায়ে আচড়টা লাগছে খুব যত্ন করে এসব দেখে না দেখার ভান করে, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। সাহায্যের সময় এগিয়ে আসে রাস্তায় থাকা ঐ লোকগুলোই যাদের আমরা সুশীল জনগণ অচ্ছুৎ জ্ঞান করি। কারণ ওদের আমাদের মত এত সময়ের ব্যস্ততা নেই, ওদের এত নামী দামী কাজ নেই যার জন্য মরতে বসা একজনকে দেখে দেশ ও সিস্টেমকে একটা গালি দিয়েই নিজের দায়িত্বপালন সম্পন্ন জ্ঞান করবে। আর আমাদের পাশে আছে হলুদ সাংবাদিকতার বিষবাষ্প, কিছু সুশীল পত্রিকা। তিলকে তাল না বানালে যাদের কাটতি বাড়বে না। কালকে বুয়েটের প্রথমবর্ষের ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর (খুন) খবরে টক-ঝাল লাগিয়ে মুখরোচক বাস ভাংচুরের খবর বের করলো তারা, তাও যেখানে ৭-৮টাও গাড়ি ভাংচুর হয়েছে কিনা সন্দেহ, সেখানে তাদের রিপোর্টে বলে দিল ৩০টার বেশি গাড়ি। আজকে আবার দেখলাম লিখেছে ২৫টা গাড়ির কথা। ছেলেটা কেন মরলো, সড়কপথের অবস্থা , এসব নিয়ে এদের মাথাব্যথা নাই, মাথাজুড়ে আছে এদের চকচকে প্যাকেটে আগুন খবর পরিবেশনের চিন্তা, উত্তেজনাপূর্ণ ছবি, সোজাকথায় 'অন্যরকম কিছু' যা হটকেক বানিয়ে বাজারে ছাড়া যাবে। একটা জীবনের মূল্য আর কয়েকটা গাড়ির মূল্য যাদের কাছে সমান (হয়তোবা কম?!)
আমার আর কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে না। প্রথম আলো সাইট থেকে কয়েকটি প্রতিক্রিয়া তুলে দিলাম:
"খুবই দুঃখজনক ঘটনা, তবে বাংলাদেশের বুয়েটের ছাত্ররা যদি মনে করে দুঘর্টনা ঘটলেই ভাংচুর করতে হবে, তবে তা বুয়েটের জন্য লজ্জাজনক। অবশ্য বাংলাদেশে লজ্জা জিনিসটি খুবই বিরল।"
হ্যা, আমাদের, বাঙালিদের লজ্জ্বা, ইগো আর আত্মসম্মানবোধ এতই বেশি, যে এক্সপোর্ট করা গেলে আমরা কোটিপতি বনে যেতাম। মন্তব্যকারীর ছেলে বা রক্তের সম্পর্কের কেউ যদি আজ এই ঘটনাটির শিকার হত (আল্লাহ না করুক) তাহলে উনার প্রতিক্রিয়াটাকি এমনই সুশীল হত?
রোগ যেন অন্যের শরীরে, খুব সচেনতভাবে রোগীটাকে মরতে দিয়ে চলে যাই, এইটা ভাবিনা যে রোগটা একটু পর আমাকেও ডেথবেডে শুইয়ে দেবে, আর তখন আমিও পাশে পাবনা কাউকে!
"এটা কোন ধরনের প্রতিবাদ যে ৩০ টা গাড়ি ভেঙ্গে ? আমি জানতে চাই , যে বাস টা বুয়েট ছাত্র কে চাপা দিয়েছে সে বাস টা কি ভাঙ্গা হয়েছে ? "
বাহ, যেন ঘাতক বাসটিকে ভাংলেই সব মিটেচুকে গেল, ঘাতক ড্রাইভার বা প্রশাসনের দুর্বলতা - কিছুই না! হায় আমরা কবে সত্যিকারের শিক্ষিত জাতি হব? আমরা খুব স্মার্ট জাতি হয়েছি, কাঠি দিয়ে খাবার খাওয়া শিখেছি কিন্তু ভেতরের মনুষ্যত্ববোধ মনে হয়টাও মনে হয় বিক্রিযোগ্য হয়ে গেছে।
একটু পড়ুন প্লিজ:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://bit.ly/d5ojsL
প্রথম আলোয় নিউজ: Click This Link
চাঁদ গাজীর ব্যান তুলে নিন/ ব্লগ কর্তৃপক্ষ ‼️
আমি যদি গাজী’ ভাইয়ের যায়গায় হতাম জিবনেও সামু’তে লেখার জন্য ফিরে আসতাম না।
হয় বিকল্প কোন প্লাটফর্ম করে নিতাম নিজের জন্য। অথবা বাঁশের কেল্লার মত কোথাও লিখতাম।
নিচে ব্লগার মিররডডল-এর করা পুরো... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করা এবং বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা বরাবরই সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের কাজ হলো সত্য প্রকাশ, জনমতের প্রতিনিধিত্ব এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ উঠেছে যে, বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন
ব্লগার সাজিদ কমেন্ট অফ রাখায় এখানে লিখছি (সাময়িক)
সাজিদের বিদায় পোষ্ট দেখলাম, কমেন্ট সেকশন বন্ধ রাখায় ভাবলাম এখানেই লিখে যাই।
জানিনা কি বলবো, হয়তো এটাই দেখা বাকি ছিলো।
চলে যাবার কারণ জানিনা কিন্তু অনুমান করতে পারছি।
Man! you shouldn't leave.
ব্লগে... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হতে যাচ্ছেন?
আজকাল মানুষ চেনা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তা বুঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে এই কথা আরো বেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন
কখনো বিদায় বলতে নাই
ব্লগে কিছুদিন ধরে অনিয়মিত হওয়ায় কখন কি ঘটে জানি না।
কিছুক্ষণ আগে মিররডলের একটা পোস্টে জানতে পারলাম , ব্লগার আমি সাজিদ ঘোষণা দিয়ে ব্লগ ছেড়েছেন । তার সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন