মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ করা হচ্ছে।
পত্রিকায় খবরটি পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেল্লেন ফারুক সাহেব। তার বয়স প্রায় ৫৫, আর দুইবছর পরই তাকে অবসরে যেতে হবে। সেদিন যদি ঐ সিদ্ধান্তটি না নিতেন, তাহলে আজকে তিনিও ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত চাকুরী করতে পারতেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবার সম্মান পেতেন, সবচেয়ে বড় কথা ১৯৭১ সালে যাদের কোন খবর ছিল না, মুক্তিযুদ্ধে যাবার বদলে যারা পালিয়ে গিয়েছিল ভারতে, সেইসব “মুক্তিযোদ্ধা”র সামনে আজকে তাকে মাথা নিচু করে দাড়াতে হত না!
আনমনা হয়ে গেলেন ফারুক সাহেব..................
....................................
আগস্ট ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে পরিকল্পনাহীন ও অপ্রস্তুত মুক্তিবাহিনী ততদিনে সংঘটিত হয়ে সারাদেশে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। ফারুক মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু ওর বয়স কম বলে ওদের এলাকার আলোয়ার ভাই, যিনি যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক ছেলেদের ভারতে ট্রেনিং নিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, তিনি ওকে নিতে রাজি নন। যদিও ফারুককে দেখে মনে হয় না ওর বয়স মাত্র ১৫, বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা-চওড়া সে। তারপরও আনোয়ার ভাই রাজি হন না।
--আরে শোন ব্যাটা, এই যুদ্ধ কি এত সহজেই শেষ হবে রে! কত্তদিন চলবে! তুই আরেকটু বড় হ, তখন তোকে নিয়ে যাব।
আনোয়ার ভাইয়ের এমন আশ্বাসেও ফারুকের মন ভরে না, যুদ্ধে যে ওকে যেতেই হবে!
তার এই মনোভাবের কথা বাসার সবাই জেনে গেছে। সবাই তো হতবাক, এই পিচ্ছি ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়! ওর আব্বার কড়া নির্দেশে বাসার সবাই ওকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। ফারুকের মনোকষ্ট আরো বাড়ে!
সেপ্টেম্বর ১৯৭১। একদিন হঠাৎ ও খবর পায় আনোয়ার ভাই রাজাকারদের চোখে পরে গেছেন, ওরা তাকে সন্দেহ করা শুরু করেছে। তিনি আজ রাতেই তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন। আনোয়ার ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা করতে ছুটল ফারুক।
--ভাই,আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলেন ভাই, প্লিজ! আমি আপনার সাথে সাথে থাকতে চাই, যুদ্ধ না হয় না-ই করলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ফুট-ফরমায়েশ খাটতে পারলেও আমি খুশি!
এমন আব্দার আর ফেলতে পারলেন না আনোয়ার ভাই।
ঐদিন রাতে বাসার সবার চোখ ফাকি দিয়ে ফারুক ওর এক চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে আনোয়ার ভাইয়ের সাথে পালিয়ে যায়।
এরপরের কাহিনী যেন অনেক দ্রুত ঘটে যায়। ইন্ডিয়ায় ক্যাম্পের কমান্ডার ফারুককে দেখে ওকে গেরিলা ট্রেনিং নেয়ার পারমিশন দিয়ে দেন। ২টা মাস যেন চোখের পলকেই চলে যায়। পুরো ২মাস ট্রেনিং নেয় সে। কি যে কষ্ট করেছে এই দুইমাস! ও একটু মোটা ছিল বলে শুরুতে খুব কষ্ট হত ওর। কিন্তু যুদ্ধ করবে, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশ স্বাধীন করবে-এই খুশিতে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে ও। পোকা আর কাকরযুক্ত ভাত-রুটি খেয়েছে, অনেকসময় না খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে কত রাত! দাড়ি-গোফের জংগল চাপা ভেঙ্গে যাওয়া মুখটা ডেকে দিয়েছে। তারপরও হাল ছাড়েনি ও। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগের যুদ্ধ!
ডিসেম্বর, ১৯৭১। ০৫ ডিসেম্বরে ওর ট্রেনিং শেষ হয়। দেশে ঢুকে যুদ্ধ করার পারমিশন পেয়ে যায়। ও এখন সব পারে; স্টেনগান চালাতে পারে, থ্রীনট থ্রী চালাতে পারে, গ্রেনেড ছুড়তে পারে প্রায় নিখুত নিশানায়! নিজেকে পুরোদস্তুর মুক্তিযোদ্ধা লাগছে এখন ওর।
দেশে প্রবেশ করে ও ১০ ডিসেম্বর। ততদিনে দেশের অনেক অঞ্চল স্বাধীন হয়ে গেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার কাছাকাছি চলে গেছে।
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ফারুকরা এখন যে এলাকায় আছে সেটা পাকবাহিনীর দখলে থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদের তুমুল সংঘর্ষ চলছে। ফারুকরা এসেছে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে, যদি অগ্রগামীরা ব্যর্থ হয়, তখন ওদের ডাক পরবে।
পুরো একদিন অপেক্ষা করার পরও ফারুকদের ডাক আর আসে না। তার আগেই অগ্রগামীরা পাকিদের হারিয়ে দেয়। অনেক আনন্দের মাঝেও সরাসরি যুদ্ধ করতে না পারায় কিছুটা হতাশ হয় ফারুক।
ফারুকদের অন্য একটা জেলায় যাওয়ার নির্দেশ আসে। সেখানে পৌছায় ওরা ১৫ ডিসেম্বর রাতে। খবর আসে মিত্র বাহিনী ঢাকা দখল করেছে। পাকিদের আত্মসমার্পন এখন সময়ের ব্যপার।
১৬ ডিসেম্বর রাতে যখন ওরা অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই খবর আসে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে!
আহা কি আনন্দ! ফারুকরা ফাকা গুলি ফুটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে! দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, আমরা এখন মুক্ত!! সরাসরি যুদ্ধ করতে না পারার হতাশা এই ব্যপক আনন্দে চাপা পরে যায়।
গ্রামে ফিরে আসে ফারুক। ওকে নিয়ে সবার মাঝে আনন্দ। সবাই শুধু জানতে চায় ও কয়টা পাকি মেরেছে, কয়টা যুদ্ধ করেছে, কি করেছে না করেছে-এসব। শুধু ট্রেনিং নিয়েছি, যুদ্ধ করার সুযোগ পাইনি-ওর এই জবাবে কিছুটা হতাশ হয় সবাই। কয়েকজন মুরুব্বী তো বলেই ফেলেন, “তাইলে কি যুদ্ধে গেলা বাবা!”
এসব নেতিবাচক কথায় হতাশ ফারুকের হতাশা আরো বাড়তে থাকে। আসলেই তো, কিসের মুক্তিযোদ্ধা ও! ট্রেনিং নিলেই কি মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়!
এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। মাথা গরম করে ফারুক ঠিক করে অস্ত্র জমা দিতে ও নিজে যাবে না, আনোয়ার ভাইয়ের কাছে অস্ত্র দিয়ে আসবে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকাতেও নাম ওঠাবে না!
রক্তগরম ফারুককে তার সিন্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না আনোয়ার ভাইসহ কেউই!
................................................
..................
আজকে ৪০ বছর পর এসে সেই অপরিনত বয়সে নেয়া সিদ্ধান্তটার কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায় ফারুক সাহেবের। যখন দেখেন যুদ্ধ বা ট্রেনিং করা তো দুরের কথা, ভারতে আশ্রয় নেয়া কিছু সুবিধাবাদী লোকজন , যারা যুদ্ধ পরবর্তী কালে মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাংগিয়ে দেশে লুটপাট চালিয়েছে, সেই তারাই যখন সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়, তাদেরই নাম যখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শোভা পায়, তখন তিনি হতাশ হন। তার হতাশা ক্রোধে পরিনত হয় যখন দেখেন সেই সময়ের কুত্তা রাজাকাররাও আজকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবী করেন নিজেদের! ঘেন্না হয় নিজের উপর, কেন তখন একটা রাজাকারও মারতে পারলেন না!
এই হতাশা, নিঃস্ফল ক্রোধ আর ট্রেনিংয়ের সময়কার কিছু স্মৃতি—এই নিয়েই এখন বেচে আছেন এই অপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা......
____________________________
________________________________
উপরে বর্ণিত গল্পটি বানানো নয়, ফারুক সাহেব আমার পিতা। তিনি নিজেকে হতভাগ্য মনে করেন, কিন্তু আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করি! তিনি সরাসরি যুদ্ধ না করলেও তার মত আর কয়জন সাহসী কিশোর একাত্তরে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য এত অস্থির হয়েছিল? ট্রেনিংয়ের কষ্টকর ধাপগুলো কয়জন পার হতে পেরেছিল?
কাগজে-কলমে তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হতে পারেন, কিন্তু আমার কাছে তিনি অন্যসব মুক্তিযোদ্ধার মতই একজন, তিনিই আমার হিরো!
স্যালুট টু হিম!