নাস্তিকতা একটা মতবাদ - নাকি একটা আন্দোলন এই নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু নাস্তিকতা যে বিবর্তনের শিকার তা নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। নাস্তিকরা স্থান কাল পাত্র ভেদে বিবর্তিত হয়। আমরা দেখেছি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক যুগে নাস্তিকতা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ঘাড়ে চেপে বসে প্রচুর অনাসৃষ্টি করেছে। পরে যখন সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতন হলো - এরা বিবর্তিত হয়ে পুঁজিবাদের ঘাড়ে চেপে বসলো। নাস্তিকরা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রের শিবিরে থাকলেও এখন চলমান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে (ইসলামের বিরুদ্ধে) যুদ্ধে পুঁজিবাদের শিবিরে যোগ দিয়েছে। এরা পুঁজিবাদীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে (ইসলাম) ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আগে এরা শ্লোগান হিসাবে ব্যবহার করতো "ধর্ম আফিম" এর প্রভাবে শ্রমের অপচয় হয় - উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। এখন পুঁজিবাদের সাথে সুর মিলিয়ে শ্লোগানও বিবর্তিত হয়েছে - এখন বলা হচ্ছে - "সম্ভবত মৃত্যুর পর কিছুই নাই - সুতরাং জীবন উপভোগ করো" - অর্থাৎ ভোগবাদী হও - বাজারের যাও - ক্রয় করো পুঁজিবাদকে সচল রাখো।
(২)
উপরের বিবর্তন আন্তর্জাতিক নাস্তিকতার ক্ষেত্রে প্রযোগ্য হলেও - বাংলাদেশী নাস্তিকদের মধ্যে বিষয়টা ভিন্ন ভাবে দেখছি। এরা সংরক্ষনবাদী ও মৌলবাদী ভুমিকায় আছে। বামরাজনীতির সরুগলিতে আটকে যাওয়া মিছিলের ভিতরে নিজেদের আটকে রেখে এরা নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমান করার চেষ্টা করছে। কারন এখনও বাংলাদেশে ৬০ দশকের ট্রেন্ড - বাম মানেই প্রগতিশীলতা - এই ধারনা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। পুঁজিবাদের ঘাড়ে এখনও সওয়ার হতে পারেনি। তবে চিন্তা ভাবনায় এরা বিবর্তনের শিকার হচ্ছে বটে। ১০ বছর আগে দেখতাম বাংলাদেশী নাস্তিকরা প্রচার করতো - বিজ্ঞানমনষ্কত মানেই নাস্তিকতা। মানে বিজ্ঞান পড়লেই মানুষ নাস্তিক হয়ে যাবে - এইটা একটা স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া মাত্র - এই ধরনের প্রচুর তর্ক বিতর্ক দেখতাম বাংলাভাষী নাস্তিকদের ওয়েব সাইটগুলোতে। কিন্তু বর্তমান কালে সাহিত্যজগতে অনেক বিজ্ঞানের শিক্ষকের পদচারনার কারনে বিজ্ঞানে ঠিকাদারী নাস্তিকদের হাত থেকে চলে গেছে। যেমন - ড. জাফর ইকবাল বা উনার ভাই জনপ্রিয় লেখক ড. হুমায়ুন আহমেদ নাস্তিকদের দলে না ভিড়ে সাতন্ত্র্য অবস্থান থেকে লেখার কারনে অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয় পাঠকরা সহজ ভাষায় জানতে পারছে। জানতে পারছে - বিজ্ঞান যেহেতু নিশ্চিত না হয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেয় না - এবং যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়ে বিজ্ঞান নিম্চিত ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি - সেই কারনে বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্থিত্বের বিষয়ে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করার যুক্তি নেই। কিন্তু এখনও নাস্তিকরা ডারউইনকে টেনে এনে নাস্তিকরা দাড় করায় ধর্মের বিরুদ্ধে - ডারউইন দিবস পালন করে (আইস্টাইন দিবস নয় কেন?)। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ পাঠকদের সহজ ভাষায় জানান যে কোরানের বলা আছে - সকল প্রানই পানি থেকে এসেছে। অথবা যখন বিগব্যাংগ থিয়োরীকে ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেস্টা করেন - তখন একনজন বিজ্ঞানে শিক্ষক জানান যে - কোরানের আল্লাহ বলছেন - ওরা দেখেনা যে মহাবিশ্ব এবং পৃথিবী এক সময় এক ছিলো এবং আমি তাকে আলাদা করছি। তখন বিজ্ঞানকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাড় করানো কষ্টকর বটে। বিজ্ঞান অবশ্যই যুক্তির উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয় - বিজ্ঞানমনষ্কতা মানুষকে জ্ঞান অর্জণের লক্ষ্যে প্রশ্ন করতে সাহায্য করে - এই ক্ষেত্রে মানুষ বিজ্ঞান অনুসরন করে বড়জোর সংশয় প্রকাশ করতে পারে - কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার মতো যথেষ্ঠ সিদ্ধান্ত এখনও মানুষের কাছে নেই। সুতরাং নাস্তিকরা যে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে যখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে - তারা আসলে বিজ্ঞান এবং ঈশ্বর দুই বিষয়েই অল্প জ্ঞানের ভিত্তিতে নিজেদের প্রতারিত করে।
(৩)
বিজ্ঞানের ঠিকাদারী হারিয়ে এখন বিবর্তিত নব্য নাস্তিকতার প্রচারক একজন বলছেন - আমি মানুষকে নাস্তিক হতে বলিনা - তাদের যুক্তিমনষ্ক হতে বলি। যুক্তিমনষ্ক হলে মানুষ অটমেটিক নাস্তিক হয়ে যাবে বলে উনি বিশ্বাস করেন। এইতো দেখছি নাস্তিকতার বিবর্তনের আরেক ধাপ। লক্ষ্যনীয় যে - একজন নাস্তিককে যুক্তিমনন্ক হলেই যুক্তিগুলো নেতিবাচক হতেই হবে - কারন ঈশ্বরের অস্তিত্বতের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়েই যুক্তি দিয়ে অস্বীকার করছে। সে খোলামনে মতের বিপক্ষে যুক্তির পক্ষে না গিয়ে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষেই যুক্তির জন্যে সাহিত্য নির্ভর হবো - বুদ্ধি দিয়ে প্রতিপক্ষকে প্যাঁচে আটকাবো - খঁড়কূটো খুঁজবে - যদিও সে জানে সে যা বলছি তার বিষয়ে আমি পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এইটা এক হিসাবে ভাল যে বিজ্ঞানে অপব্যবহার দেখার যন্ত্রনা থেকে পাঠকরা বেঁচে গেলো।
(৪)
আসলে কি যুক্তিদিয়ে কি শুধুই অস্বীকার করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আমাদের একটু ভাবতে হবে যুক্তি কি? যুক্তি হলো জ্ঞানের ভিত্তিতে তথ্য এবং তত্ত্ব দিয়ে কোন বিষয়ের উপস্থাপন। ধরা যাক - একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্যে উপস্থাপিত হলো - তখন বিষয়ে পক্ষে যথেষ্ঠ প্রমানাদি সহ উপন্থাপিত হলেও নানান বিষয়ে যাচাই বাছাইয়ের জন্যে আলোচনা হয় - সেখানে পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্ততর্ক চলে। অবশেষে সিদ্ধান্ত আসে। এখানে লক্ষ্য রাখতে হবে এই বিতর্কের ভিত্তি হবে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা। অনেক দিন আগে একটা ঘটনা লেখেছিলাম - আমার গ্রামের কাসেম ভাই বিশ্বাস করেন না যে চাঁদে মানুষ অবতরন করেছে। উনাকে গ্রামের ছেলেরা যুক্তি দিয়ে বুঝানো চেষ্টা করলো - কিন্তু যেহেতু কাসেম ভাই এবং ছেলেদের কারো কাছেই যথেষ্ঠ জ্ঞান ছিলো না - তাই সকল বিতর্ক এবং যুক্তি ছিলো শ্রেফ তর্ক। কাসেম ভাই মারা গেছেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে - চাঁদে মানুষ যায়নি। লক্ষ্যনীয় যে - কাসেম ভাই নিজেই স্বল্প জ্ঞানে ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন - এবং তার পক্ষে যথেষ্ঠ যুক্তি তৈরীও করেছিলেন - যেমন বর্তমান কালের নাস্তিকরা রাত জেগে যুক্তি তৈরী করেন তাদের নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে। উনারা কখনই বিপক্ষে যুক্তিকে আমলে নেন না - কারন যেহেতু সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়ে গেছে - এর পরিবর্তন করা কঠিন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যুক্তি কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্রাথমিক টুলস হতে পারে না।
আরেকট বিষয় লক্ষ্যনীয় যে - বিবর্তিত নাস্তিকদের সর্বশেষ দাবী যুক্তিমনষ্কতাই নাস্তিকতার পথে নিয়ে যাবে। কথাটা মোটেও সত্য নয়। কারন মানুষ স্বভাবতই যুক্তিবাদী। পৃথিবী সবচেয়ে জঘন্য কুকর্মের পক্ষে যুক্তি তৈরী করার মতো দুইচারজন মানুষ পাওয়া যাবে। ইরাকযুদ্ধের মতো অনৈতিক যুদ্ধের পক্ষে যুক্তির প্রদর্শনীও দেখেছি আমরা। তাই যুক্তি আসলে কোন পথ দেখায় না - একটা পূর্ননির্ধারিত পথে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে যারা বিশ্বাস করেন - তারাও যে যুক্তি ছাড়াই ঈশ্বর বিশ্বাস করেন - এই ধারনাটাও ভুল। একজন মানুষের - যেহেতু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি নির্ভর চিন্তা করে - পক্ষে যুক্তি ছাড়া কোন মতাদর্শ অনুসরন সম্ভব নয়। অবশ্যই যুক্তির পথেই হাঁটতে হবে তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে টিকে থাকার জন্যে। মুসলমানদের জন্যে অবশ্যই বিষয়টা আরো সঠিক - তাদের বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে ভাবার জন্যে। যেমন কোরানে মুহাম্মদ (সঃ) কে ঘোষনা করতে বলা হয়ে যে উনি ইব্রাহিমের (আঃ) এর পথ অনুসরন করেন। ইব্রাহিম (আঃ) পথটা কি? দেখবো ইব্রাহিম (আঃ) বাবদাদার চিরাচরিত মূর্তিপূজার পথ কে অস্বীকার করছেন ধাপে ধাপে যুক্তি দিয়ে। উনি ঈশ্বর চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে আকাশে সূর্য্য, চন্দ্র, তারকারারজি আর মূর্তির প্রতি আনুগত্যকে যুক্তি দিয়ে অস্বীকার করে কিভাবে আল্লাহর আনুগত্যে শিরনত করেছেন - তা বিশবাসীদের জন্যে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত বটে। প্রতিটি বিশ্বাসীকে চিন্তা ভাবনা করে আল্লাহ অস্তিত্ব উপলদ্ধি করা এবং আনুগত্য করার কথা কোরানে বহুবার বলা হয়েছে। সুরা আর-রহমানতো পুরোটাই যুক্তির প্রয়োগ দেখানো হয়েছে।
তাই যদি কারো মনে হয় - বিশ্বাসী অন্ধ - যুক্তি দিয়ে ভাবে না - তারা ভুল করে। অবশ্যই বিশ্বাসীরাও সমান ভাবে যুক্তিনির্ভর - তারা যুক্তি দিয়ে তাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে যেমনটা অবিশ্বাসীরা তাদের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তির লড়াই চালায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:১৪