ব্রিটিশ রাজনৈতিক তথ্য বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন নাইন ইলেভেন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আল কায়েদার সন্দেহভাজন অর্থায়নকারীদের বির"দ্ধে মামলা দাঁড় করাতে সহায়তা করেন। তিনি বিবিসির প্রামান্যচিত্র ‘এ কোশ্চেন অফ লীডারশিপ’-এ কাজ করেন যাতে নেতৃস্থানীয় ব্রিটিশ মুসলিম ও উগ্র ইসলামবাদী রাজনীতির সম্পর্ক দেখানো হয়। বর্তমান নিবন্ধটি তিনি ২০০৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ইউএন প্লাজা হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘সন্ত্রাসবাদ, গণতন্ত্র ও বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ণ
সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন’-এ উপস্থাপন করেন। ৩ কিস্তিতে অনুবাদ করেছেন অমিতাভ মহালদার
জামাতে ইসলামী দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারকারী একটি উগ্র ইসলামী আন্দোলন। সংগঠনটির প্রধান শাখা পাকিস্তানে। সেখানেই মওলানা আবুল আলা মওদুদী এই দলটির গোড়াপত্তন করেন। নাইন-ইলেভেন হামলার পর জামাতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো বেশি গতিশীলতা লাভ করে। সন্ত্রাসবাদের বির"দ্ধে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের অভিযান অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যর্থ- ইসলামী মৌলবাদীদের এই সফল অপপ্রচার এর কারণ। বাংলাদেশে জামাত তাদের শরিয়া আইনভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড যথেষ্ট সংহত করতে পেরেছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে আড়াল করে তারা সরকারেও গুর"ত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করতে সমর্থ হয়েছে, যে জঙ্গিবাদ কিনা সরকার ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে এবং পাল্টে ফেলতে চাইছে।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, আলকায়েদা ও আইআইএফ (ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট)-এর সঙ্গে যুক্ত একটি মহলের জন্য মুদ্রা পাচারেও জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ জড়িত। ভারত এবং বাংলাদেশে
জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সম্পৃক্ততা আছে বলেও মনে করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে জামাতের প্রধান সমর্থক হচ্ছে ইসলামিক সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা (আইসিএনএ) এবং মুসলিম এইড (ইউকে)। উভয় সংগঠনই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দাতা সংস্থার মর্যাদা নিয়ে কাজ করছে। এই সংগঠনগুলো মুসলিম স¤প্রদায়ের স্বার্থের কথা বলে সারা বিশ্বের দানশীল মুসলিম স¤প্রদায়ের কাছ থেকে জাকাত সংগ্রহ করে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী এবং বসনিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়ার সন্ত্রাসী গ্র"পগুলোর সঙ্গে আইসিএনএ ও মুসলিম এইডের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।
‘সন্ত্রাসের বির"দ্ধে যুদ্ধের’ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই গুর"ত্বপূর্ণ। কারণ দেশটি হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম গণতন্ত্র। এখানে ১৪৪ মিলিয়ন লোকের বাস যাদের সিংহভাগই মুসলিম। অর্থাৎ পৃথিবীর মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশেরই বাস এই দেশে। কাজেই আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় বাংলাদেশকে ইসলামী উগ্রবাদীদের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না, তা হলে এটা এ অঞ্চলে উগ্রপন্থী মোকাবিলার কৌশলগ্রহণের পথে একটা বড়ো সমস্যা হয়ে উঠবে। একটি সবল, ধর্মনিরপেক্ষ, স্থিতিশীল বাংলাদেশের পক্ষে অবশ্যই পশ্চিমাদের সমর্থন থাকা উচিত, যা বাংলাদেশকে উদারনীতি ও সহনশীলতার একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে সহায়তা করবে। দারিদ্র্য, দুর্নীতি, বন্যা, মিলিটারি ক্যু, ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান Ñ এসব নিয়ে অবশ্যম্ভাবী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বে একটি আশার প্রতীক হওয়ার মতো সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক দেশ হিসেবে টিকে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি লাগাতার সংগ্রাম। এর প্রতিফলন রয়েছে দেশটির সংবিধান ও ইতিহাসে।
পশ্চিমা বিশ্বে জামাত
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী রয়েছেন। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রভাব নিঃসন্দেহে ঐসব দেশে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যেও পড়বে। ‘ডায়াসপোরিক ন্যাশনালিজম’ এবং ‘ট্রান্সন্যাশনালিজম’-এর তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশে বিদ্যমান ঝোঁক সন্দেহাতীতভাবে প্রবাসের বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও প্রতিফলিত হবে এবং তাদের নতুন আবাসভূমির রাজনীতিতেও ছড়াবে। আরেকটি গুর"ত্বপূর্ণ ব্যাপার, যুক্তরাজ্যে প্রভাবশালী ধর্মীয় সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে জামাতে ইসলামী। এর অর্থ হলো, যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটিতে জঙ্গিবাদ সম্ভবত বাংলাদেশের চেয়েও আরো বেশি হারে বিস্তার লাভ করবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইউকে, ইস্ট লন্ডন মস্ক, মুসলিম এইড ইউকে, দাওয়াতুল ইসলাম এবং ইউকে ইসলামিক মিশনের মতো জামাতি সংগঠনগুলোর পুরোপুরি প্রভাব নিয়ে এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো স্টাডি করা হয়নি, তবে জানা যায় এই গ্র"পগুলো আগ্রাসীভাবেই জামাতের সেকুলারিজম-বিরোধী এবং পশ্চিমাবিরোধী প্রকাশনা ও আদর্শ প্রচার করছে। যুক্তরাজ্যে জঙ্গি সম্পৃক্ততার দায়ে আটক মোয়াজ্জম বেগ গং এবং সাত জুলাইয়ের বোমা হামলাকারীদের অনেকের অতীতই জামাত রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের। ভারতসহ কিছু দেশ বিশ্বাস করে, পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টিলিজেন্স (আইএসআই)-এর সঙ্গে জড়িত গ্র"পগুলো বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থান করে ভারতের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। এতে করে দেশটি ভবিষ্যতে খুব সম্ভবত পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর জন্য ‘ফ্লাশ পয়েন্ট’ হিসেবে অবির্ভূত হবে। মনে করা হয়, শ্রীলঙ্কা এবং বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসবাদের উত্থানের নেপথ্যেও রয়েছে ঐ দুই দেশের পরোক্ষ (প্রক্সি) যুদ্ধ।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে আমি দেখি, মানবতার জন্য একটি বড়ো সংগ্রাম Ñ একটি মাইলফলক হিসেবে। নিপীড়ন এবং বঞ্চনার বির"দ্ধে মানুষ সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। সেই সংগ্রামের উত্তরাধিকার এবং তার প্রভাব এখানো বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং নাগরিক জীবনে রয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নবাগত হলেও আমি দ্র"তই সবকিছু বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছি। আমি আশা করি, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দেশটি একটি সাফল্যের নিদর্শন হতে পারে, হতে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আদর্শস্বরূপ। কিš' এই দেশটির অগ্রগতি এবং সাফল্যের পথে একটি বড়ো বাধা রয়েছে এবং আমার মতে সেটি হলো, জামাতের উত্থান, জঙ্গিবাদে জামাতের মদদদান এবং ঐ অঞ্চলে হিংসার রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা।
জামাত : পটভূমি
জামাতে ইসলামী দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক একটি উগ্র ইসলামবাদী আন্দোলন। এর সাংগঠনিক শাখা রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, কাশ্মীর, শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তানে। ১৯৪১ সালে মওলানা আবুল আলা মওদুদীর হাতে পাকিস্তানের লাহোরে এই দলটির জন্ম। মওদুদীর মনে হলো, মুসলিম দেশগুলো, তার বিশ্বাস মতো, জাতীয়তাবাদ, নারী স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের মতো বিকৃত আদর্শগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। মওদুদী বিশ্বাস করতেন, একটি পুরোপুরি ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের তার যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়নে ইসলামের শিক্ষাকে অংশতঃ ব্যবহার করতে হবে। মওদুদী আরো বিশ্বাস করতেন, মুসলিম রাষ্ট্র হবে ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের একটি সংকর, যেখানে একটি অনির্বাচিত ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জনজীবনের সর্বক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করবে। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রগতির কোনো জায়গা থাকবে না, বলবৎ থাকবে কঠোর শরিয়া আইন ।
মওদুদী মধ্যপ্রাচ্য-কেন্দ্রিক ইখওয়ান আল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড) দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। মৌলবাদী ইসলামী নেতা সায়েদ কুতবের বন্ধু এবং তার রচনার পাঠক ছিলেন মওদুদী। কুতব কথা বলতেন একটা বিপ্লবী ইসলামি শক্তির পক্ষে, যারা মৌলবাদী ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের পরিকল্পনার বির"দ্ধবাদীদের বির"দ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করবে। মওদুদীও এতে বিশ্বাস করতেন। কিš' তিনি এটিকে একমাত্র পন্থা মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটা রাজনৈতিক দল দরকার, যাদের কিছুটা অন্তত বৈধতা থাকে এবং তারা যেন প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই তাদের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে পারে। ‘জিহাদ ইন ইসলাম’ (সাবিলিল্লাহ) বইয়ে লিখেছেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে আমেরিকায় অবস্থানরত কমিউনিস্টদের মতো অবস্থান নিয়ে থেকে তারা যদি রাষ্ট্রের বির"দ্ধে সাবোটাজ বা সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য জোর তৎপরতা না চালায়, তাহলে হয়তো তারা সরকারের নজরদারিতে খুব একটা পড়বে না। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করতে থাকলে তারা প্রচলিত ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের আন্দোলন সুচিত করার জন্যও সুযোগ পেয়ে যাবেন। এবং যখনই সময় উপযুক্ত বিবেচিত হবে এবং জিহাদের প্রতি পর্যাপ্ত সমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে, তখনই সশস্ত্র জিহাদে নামা হবে। জামাত হলো এমন একটি সংগঠন যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে তাদের কার্যক্রম চালালেও তাদের কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। দাওয়া ও ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে সমাজের ইসলামীকরণ করে তারা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধ্বংস করতে চায়।
(ভোরের কাগজের সৌজন্যে)