তাই এবার সিধান্ত নিয়েছিলাম বের হলে অফসিজনেই বের হব। যেই বলা সেই কাজ। প্রথমে গন্তব্যস্থল নিয়ে বেশ খানিকটাই সিধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। সিলেটের দিকে যাব নাকি কক্সবাজারের দিকে যাব? সদ্য বিবাহিত এক বড় ভাই এসে বললেন বীচে নাকি ক্লেমনের উৎসব চলছে তাই ওদিকে যাওয়াটাই ভাল। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নব দম্পত্তির আবদারের বিষয়টি মাথায় রেখে কক্সবাজারকেই গন্তব্য হিসেবে বেছে নিলাম। যাত্রা পথে আরও বেশকয়েকজন সঙ্গী হলেন, তাদেরকে পরিবারের লোক হিসেবেই ধরা যায়।
নিজেদের গাড়িতে রওয়ানা হলাম, পথে বার তিনেক গাড়ির চাকা নষ্ট হওয়া বাদে উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটল না। তবে সবচেয়ে বিরক্তকর ছিল ড্রাইভারের সিটের পাশের সিটে বসে থেকে ড্রাইভারের ঘুম ভাঙ্গানোর দায়িত্ব পালন করা। এটা ড্রাইভিং এর চেয়েও বিরক্তকর।
টানা এক রাত এবং এক দিন চলতে চলতে কক্সবাজার গিয়ে পৌছালাম সন্ধ্যার পর। হোটেল কল্লোলে উঠবার ইচ্ছা থাকলেও গিয়ে উঠলাম মোটামুটি বেনামি এক হোটেলে। সারাদিনের ক্লান্তির কারণে বেশ গভীর রাতের আগে আর বীচে যাওয়া হয়ে উঠল না।
রাত এগারটাও দিকে বীচে গেলাম। এইবার প্রথম বীচে এসে কেমন যেন বিরক্ত লাগল।
পরের দিন, সফরসঙ্গীদের ইচ্ছানুযায়ী একশ ফুট সোনার মূর্তি দেখতে বের হলাম। বলা বাহুল্য কক্সবাজার এসে সি এন জি ছেড়ে তেলে চলছে গাড়ি আর খরচে বেরে চলেছে তি তি করে। উপলব্ধি করলাম, এর চেয়ে হানিফে অথবা স্ক্যানিয়াতে আসলেই বোধকরি ভাল হত।
যাইহোক সবাই একশ ফুটি বৌদ্ধমূর্তি দেখতে মন্দিরে গেলেন এবং মোটামুটি হতাশ হলেন আশেপাশের পরিবেশ দেখ। যদিও আমার মত ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট রামুর মন্দির দেখার পক্ষে, পরে সবাই টের পেলেন যে ওটাই বোধকরি ভাল ছিল। সময় কম থাকায় গাড়ি রওয়ানা করল হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। মাঝে যাত্রা বিরতি করলাম মারমেইডের কাছে। এখানকার বিচটা বোধকরি এখনো আধুনিকায়নের কষাঘাত এড়িয়ে কোন রকমে নিজস্ব স্বকীয়াতা নিয়ে বেঁচে আছে।
এরপর, হিমছড়িতে গাড়ি না থামাতে সফরসঙ্গীদের প্ররোচিত অথবা প্রভাবিত করে সফল হয়ে ইনানির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
কিন্তু সে আশায়ও গুড়ে বালি। ইনানিতে গিয়ে সেই সফরসঙ্গীদের পিক তুলতে তুলতে হাত ব্যথা! কেউ স্বীয় নিতিম্বের নিচে অস্তীয়মান সূয্যিমামাকে রেখে, কেউ বা আবার তার কব্জির ভেতর মামুকে রেখে নানা ঢংয়ে শট দিলেন আর আমাকেও গাধার মত তা তুলতে হল। এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, যদি নেহাত ছবি তুলবার উদ্দেশ্যে কোথাও যাওয়ার দরকার পড়ে, তাহলে এমন লোকদের সাথে যাওয়া উচিত না যারা ফটোগ্রাফির 'ফ' ও বুঝে না! ফটোগ্রাফি যারা করেন তাদের সাথেই যাওয়া ভাল নতুবা যাদের এস.এল.আর আছে তাদের সাথে যেতে হবে এতে করে আপনাকে কেউ ডিস্টার্ব করতে পারবে না! কথা কর্কশ শোনালেও যারা এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছেন তারা এটার মর্ম বুঝতে পারবেন।
যাই হোক, সফরসঙ্গীদের ফটোসেশন করছি, এমন সময় এক আগন্তুক এসে বললেন,'ভাই আমাদের কিছু পিকচার তুলে দেন'। বেশত, খারাপ কি!, করছিতো এই কাজই! তারও কিছু ছবি তুললাম! এরপর তিনি দুজন ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বললেন,' একজন আমার ওয়াইফ আরেকজন শালি, তাদেরও কিছু ছবি তুলে দেন'। সেটাও করলাম! হঠাত তিনি আমায় অবাক করে দিয়ে বললেন,'আমার শালিকে আপনি ইম্প্রেস করুন'...!!! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি দারুণভাবে ধাক্কা খেলাম এবং কি করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না! বলাবাহুল্য লোকটির শালিও লাজুক প্রকৃতির হওয়ায় আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হল না, লোকটির ইমেইল নাম্বার নিয়ে কেটে পড়লাম। শালী দেখতে কেমন ছিল সেটা বোধকরি নাই বললাম! ইথিক্স বলে কিছু না থাকলে ভাবি আর শালি দুজনের পিকই দিতাম। কিন্তু এতে করে প্রাইভেসি নষ্ট হতে পারে তাই দিলাম না। ফেরার পথে এই পরিবারের সাথে আবার দেখা! ভাবিতো ডাক দিয়েই ফেললেন,'এই ফটোগ্রাফার, তুমি আমাদের সাথে আমাদের গাড়িতে আস!" আমি দ্বিতীয়বার টাস্কি খেলাম! সত্য বলতে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেলাম। আমার বন্ধু তো এক লাফেই তাদের সাথে যেতে রাজি হয়ে গেল! কিন্তু আমি বিষয়টার আপেক্ষিকতা তাকে বুঝানোর পর সে পিছু হঠল!! বেঁচে গেলাম! এবং হোটেলে ফিরলাম!
রাতে বীচে গেলাম আবারো, যদিও পথিমধ্যে কাঁকড়া খাবার জন্য একটু থামলাম। এখন কাঁকড়াগুলোতেও বোধকরি ফরমালিন ব্যবহার করে, সেই স্বাদ আর নেই। আতশবাজির খেলা দেখছিলাম বীচে। হঠাত ছোটকালের এক বান্ধবী ফোন করল মার্কিনমুল্লুক থেকে, এবং খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবে তার বিয়ের খবর জানাল! পাত্র একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তারই সাথে শিক্ষকতা করে। বেশ ভাল! দুজনেই সমান যোগ্যতাসম্পন্ন! বলাবাহুল্য এই রমণীই ছিলেন আমার জীবনের একেবারে প্রথম প্রেম! বুকের ভেতরটা ধুঁক করে উঠল! একেই বোধ হয় বলে প্রথম জীবনের প্রেম যায় না ভোলা! ঠিক সে সময়ই কে যেন গেয়ে উঠল,
"নিস্ব করেছ আমায় সীমাহীন ছলনায়.........ফিরিয়ে দাও হারানো প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও!" শরীরের একটা স্রোত বয়ে গেল মনে হল! তাকিয়ে দেখি মাইলসের কনসার্ট হচ্ছে! কি দারুণ কম্বিনেশন! ঠিক এ সময়ে তো এই গানই দরকার ছিল!!!! আর মনে হল জীবনে কিছু কিছু জিনিস না পাওয়াটাই ভাল-এতে করে সারাজীবন এর কদর থাকে!!!
পরদিন ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে বলতে গেলে এক রকম হঠাত করেই বান্দরবন গেলাম। বান্দরবন যাওয়ার পথে সবচেয়ে বিরক্ত লাগল এটা দেখে যে এখানকার গ্যাসে প্রেসার এতই কম যে গাড়ি নিয়ে নীল গিরি যাওয়াটা একবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তারপরও এক জায়গা থেকে একশ প্রেসারে গ্যাস নিয়ে বান্দরবন পৌছালাম অবশেষে আর উপলব্ধি করলাম, কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়াটা হল এখন গুলিস্তানে জনস্রোত উপভোগ করবার মত একটা বিষয়! শান্তি চাইলে এই পাহাড়েই ফিরে আসতে হবে। বান্দরবনে পাহাড়িক তে উঠলাম। ভাড়া এখন একেবারেই কম! ওইদিন আর কোন ঝামেলায় না যেয়ে পরের দিন ঘোরার উদ্দেশ্য নিয়ে শুতে গেলাম।
শেষদিন গ্যাসের প্রেসারের সমস্যা কারণে নীলগিরি যাওয়ার প্লান পরেরবারের জন্য সিকেয় উঠিয়ে রাখলাম।
যাই হোক ফেরার পথে মেঘালয়ে গেলাম...বানানো জিনিসের আবদার আমার কাছে কোন কালেই ছিল না আর থাকবেও না! যাই হোক একটা জিনিস লক্ষ করলাম যে এই এতটুকু মেঘালয় পাড়ি দিতেই আমা দুজন প্রমীলা সফরসঙ্গীর যায় যায় অবস্থা! বুঝলাম, এদের নিয়ে বগালেকে গেলে যে কি রকম বিপদে পড়তে হত তা আল্লাহই মালুম! এটা খুবই রেসিস্ট একটা কথা শোনাতে পারে, তবে সত্য হল, নীলগিরি বা বগালেক যাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে, আমাদের স্টার জলসা দেখা মা বোনদের ঘরে রেখে আসাই ভাল! তারা সিরিয়াল দেখাতেই পটু, পাহাড় ডিঙ্গাতে নয়! যারা ডিঙ্গান তাদেরকে কুর্নিশ করি...!!!
ফেরার পথে আবারো যাত্রা বিরতি, গেলাম মীরসরাই রাবার ড্যামে। সময় স্বল্পতার কারণে ঝরনার ধারে আর যাওয়া হল না, এপারে থেকেই ছবি তুলে সন্তুষ্ট থাকতে হল! ট্রাইপড না নেয়াতে কোন এইচডিয়ার তোলার সুযোগ পেলাম না! এটা খুবই পরিতাপের বিষয়!
অবশেষে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, কিছু কিছু যায়গায় আসলে নিজের সার্কেল থেকে বের হয়ে মোটামুটি গা ছাড়া ভাব নিয়ে যেতে হয়, তাতে কিছু অদ্ভুদ আনন্দ পাওয়া যায়!