somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৭১-এর বিজয় ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রত্যেক জাতির জীবনেই বিশেষ কিছু গৌরবময় দিন থাকে যা অত্যুজ্জল হয়ে থাকে মানুষের মনের মনিকোঠায় এবং মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে সেসব দিবস উদযাপন করে। বাংলাদেশে বিজয় দিবস এমনি একটি মর্যাদাপূর্ণ ও গৌরবময় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালী জাতির বিজয় সাধিত হয়েছে আর সেই সাথে বিশ্বের মানচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানচিত্র। আমরা অর্জন করেছি সবুজের মাঝে রক্তিম লাল সূর্য খচিত একটি গৌরবময় স্বাধীন দেশের পতাকা। এই বিজয় আমরা একদিনে অর্জন করিনি। বিজয় অর্জন করতে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সকলের তাজা প্রাণ আর অসংখ্য মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। অর্জন করেছি স্বাধীনতা। কিন্তু এর বীজ বাঙালীর মনে বপিত হয়েছিল আরোও অনেক আগে। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রাম; মুক্তির সংগ্রাম।

৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহসিক ভাষণ- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম!' বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণের বাণীতে কোটি কোটি বাঙালীর তিমিত রক্ত টগবগ করে ওঠে। মুক্তি নেশায় শিহরণ জাগে প্রতিটি মানুষের প্রাণস্পন্দনে। এ ভাষণ কেবল ভাষণই ছিলনা, এটি ছিল বাঙালীর বিজয় অর্জনের চালিকা শক্তি; স্বধীনতার মূলমন্ত্র। এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই বাংলার মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামের পর বিজয় অর্জন করে। বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া সরকার ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে সাবেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সাবেক ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, যুবক, কৃষক-শ্রমিক প্রভৃতি গোষ্ঠির সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তি বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা নামে মাত্র ট্রেনিং নিয়ে অদম্য সাহসিকতার সাথে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পন করে। এভাবেই অর্জিত হয় আমাদের গৌরবময় বিজয়।

'স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন' এর সত্যতা বাঙালী জাতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে। যে চেতনা ও সাহস নিয়ে বাঙালী মুক্তিযুদ্ধ করেছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে সেই মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ ও পর্যাপ্ত প্রতিফলন এবং প্রতিভাস পড়েনি। বরং জাতীয় জীবনের অনেক স্তরেই আজ মিথ্যার কালিমা লেপ্টে আছে। এর ফলে আমাদের সব গৌরবই যেন অনেকাংশে ঢেকে যেতে বসেছে। মানবিক মূল্যবোধ প্রায় নিঃশেষিত ও বিপন্ন। বিবেক ও মনুষ্যত্ব আজ লাঞ্ছিত ও অপমানিত। এমতাবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত বিজয় আজ কতটুকু অটুট ও অক্ষত আছে ? নয় মাস ব্যাপী অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কী অমানবিক নির্যাতন চলেছিল তার কোন স্মৃতি আমাদের আছে বলে মনে হয় না এবং নতুন প্রজন্মকেও আমরা হস্তান্তর করিনি সেই অভিজ্ঞতা ঘটনা পঞ্জি। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তথা বাঙালীর ত্যাগ তিতিক্ষা ও বীরত্বের সঠিক ইতিহাস ধোয়াচ্ছন্ন।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ প্রতিফলন ঘটেনি। এজন্যই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভুলুন্ঠিত হতে চলেছে। সাধারণ মানুষ আজ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল ও মূল্যস্ফীতির ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যায়, অবিচার, অনাচার ও অসত্য আজ সমাজে দেদীপ্যমান।

বিজয় অর্জনের এতোটা বছর পরে এসে আমরা বিজয়ের স্বা’দ কতটা গ্রহন করতে পারছি ? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গণাদের আজও কী আমরা দিতে পেরেছি তাদের প্রাপ্য অধিকার ? আজও ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ! দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে বিচারপতিদের শপথ গ্রহনকে কেন্দ্র করে চলে পেশী শক্তির মহরা ! ব্যক্তিস্বার্থকে তরান্বিত করতে হরতালের নামে চলছে জালাও পোড়াও সংস্কৃতি ! ধংস হচ্ছে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ। অপরাজনীতির নির্মম থাবায় অকালে ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় তাজা প্রাণ ! দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল ! প্রতিদিন সকালে পত্রিকা খুললে এখনো দেখি পত্রিকার সিংহ ভাগ দখল করে আছে খুন ধর্ষণ আর রাহাজানির সংবাদ ! মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ ছিল পরাধীনতার বলয় থেকে জাতিকে মুক্ত করে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা আজও কী পেয়েছি মৌলিক অধিকার ? এখনো দু’মুঠো ভাতের জন্য আমাদের মা বোনদের প্রতিনিয়ত করতে হচ্ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য মজুরি। প্রাপ্য বেতন ভাতা আদায়ের দাবীতে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে আমাদের মা বোনেরা অহরহ পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিজয়ের উনচল্লিশ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে এসেও পুলিশি হেফাজতের নামে নিরিহ মানুষকে জিম্মি করে কতিপয় বিপদগামী পুলিশ সদস্য কতৃক চলছে ঘুষ বাণিজ্য। এলিট ফোর্স হিসেবে স্বীকৃত র‌্যাব এর ভুল টার্গেটে বলী হচ্ছে বাপ্পীরা।বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাবা থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষে ব্রিটেন ও ভারতের মত দেশ যখন ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করছে। ঠিক তখনই আমাদের মত উন্নয়ণশীল দেশে এম.পি. মন্ত্রীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সেই সাথে চলছে এম.পি. ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের জন্য বিলাস বহুল গাড়ি আমদানীর মহড়া। অপর দিকে এনজিও’র খোলসে কতিপয় সুদী কারবারীদের সুদের বোঝা পরিশোধ করতে গিয়ে সল্প আয়ের মানুষগুলো শেষ সম্বর ভিটে মাটি বিক্রি করে ভাসমান জনতায় পরিণত হচ্ছে। কেউ কেউ সুদের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

পক্ষান্তরে আমাদের অর্জনও নেহায়েত কম নয়। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মত বিশাল সম্মান আমাদের ঝুলিতে জমা হয়েছে। আমাদের ছেলেরা জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মূলধারার রাজনীতিতে আমাদের সন্তানরা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রেখে চলেছে। বিশ্ব ক্রিকেটে শক্তিধর অবদান রাখার ফলে বাংলাদেশে ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এর আসর। অমর একুশে বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অবদানের জন্য বিশ্ব আমাদের ঝুলিতে গুজে দিয়েছে বিশেষ স্বীকৃতি।

বিজয়ের ৩৯ বছর পর আমাদের আর নতুন করে কোন অঙ্গীকার করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। যে আদর্শ ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বিজয় অর্জন করেছে সেই আদর্শকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই আমরা দেখতে পাবো আমাদের স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা। প্রতি বছর বিজয় দিবস আমাদের কর্ণকুহরে যে পরিবর্তন ঘটায় বাস্তব জীবনে তা থেকে আমরা আর বিচ্যুত না হই। আমরা যেন বিজয়ের চেতনাকে মশাল করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য চেষ্টায় মেতে উঠি। আসুন আমরা সেই আশায় বুক বেধে সফলতার জন্যে অপেক্ষা করি। আসুন আমরা বাঙালী জাতির বিজয়ের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে একতাবদ্ধ হই। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান স্বাধীনতার খোলসে মোড়ানো স্বেচ্ছাচারীতার ভূতটাকে দূর করি। কারণ প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া কোন জাতি গৌরবের আসনে উন্নীত হতে পারেনা। আমরা চাই বাঙালী জাতির মানবিক বিজয়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×