*
১৯৭২ সালে শেখ মুজিব রাঙামাটি সফরে গেলে তার কাছে ৪টি দাবী উত্থাপন করেছিলেন পাবর্ত চট্টগ্রামের গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা। দাবীগুলো ছিলঃ ১. পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন ২. পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ১৯০০ সালের ম্যানুয়েল বহাল রাখা ৩. তিন জাতির চীফের দপ্তর অব্যাহত রাখা ৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি আবাদিদের অনুপ্রবেশ রোধ করা। শেখ মুজিব তাতে কর্ণপাত ত করলেনইনা, উপরন্তু বললেন, তোরা বাঙালি হইয়া যা! শেখ মুজিবের ঐ উক্ত শোনার পরই পাহাড়ে সক্রিয় হয়ে উঠে শান্তিবাহিনী। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। মানবেন্দ্র লারমা তাতে সই করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বললেন, আপনারা আপনাদের জাতীয়তা অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। আমি একজন চাকমা, বাঙালি নই। আমি বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশি, আপনারাও বাংলাদেশি, কিন্তু আপনাদের জাতিয় পরিচিতি হচ্ছে বাঙালি...তারা (পাহাড়ীরা) কখনো বাঙালিতে পরিণত হতে পারে না। তার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। যে যুক্তিতে বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল, সেই একই যুক্তিতে অস্ত্র ধারণ করল পাহাড়ীরা, আর তাদের দমাতেও নেয়া হল পাকিস্তানি কৌশল। এমনিতে ১৯৫৭ সালে কাপ্তাই বাঁধের জন্য চাকমাদের ৫৪০০০ একর চাষের জমিসহ প্রায় ৪০০ বর্গমাইল এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় প্রায ১ লক্ষ পাহাড়ী শরণার্থীতে পরিণত হয়েছিল। তার মধ্যে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সময়ে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে প্রায ৪ লক্ষ বুভুক্ষু বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয় রীতিমত দাওয়াত দিয়ে। উদ্দেশ্য তাদের পুনর্বাসন নয়, তাদের দিয়েপাহাড়িদেরকে মোকাবেলা করানো। এইসব লোক আবাদি নামেই পরিচিত। আবাদিদের মাঝে অতঃপর গড়ে তোলা হয় সশস্ত্র আনসার ভিডিপি নামে স্বেচ্ছাসেবক দল। এছাড়াও পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনী এমনভাবে মোতায়েন করা হল যেন সেখানে রীতিমত একটি যুদ্ধাবস্থা চলছে।
১৯৮০ সালে কাউখালিতে শান্তিবাহিনীর এ্যামবুশে মারা যায় ২২ জন সৈন্য। এরপর থেকে শুরু হয় সাধারণ পাহাড়িদের উপর উন্মত্ত নিপীড়ণ। অভিযোগ আছে যে এসময় কাওখালি ও সংলগ্ন ২৪টি গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৩০০ সাধারণ পাহাড়ি নারীপুরুষ হত্যা করা হয়। এই হত্যা,গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন হয়ে উঠে নিয়মিত ঘটনা। দানিয়াল, ইব্রাহিম নামের সেনা কর্মকর্তারা তখন নির্যাতনের জন্য পাহাড়িদের কাছে টিক্কাখানের সমতূল্য হিসাবে বিবেচিত। ১৯৯২ সালে সংগঠিত হল লোগাং হত্যাকান্ড। সরকার স্বীকার করল যে মাত্র ১৩ জন লোক মারা গেছে। প্রকৃত নিহত সংখ্যা শতেক হবে বলে পাহাড়িদের অভিযোগ। এসময় খাগড়াছড়িতে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন এরশাদের দক্ষিণ হস্ত হিসাবে পরিচিত ব্রিগেডিয়ার শরীফ। তিনি লাশগুলোকে পুড়িয়ে সব প্রমাণ নষ্ট করে ফেললেন।
*
ওদিকে পাহাড়িরাও বসে ছিল না। তাদের উৎপাতে বাঙালি আবাদিরা পাহাড় ছেড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয শহরতলীর গুচ্ছগ্রামে। অবশেষে প্রায ২৫০০ নীরিহ জনগণনসহ আনুমানিক ৮৫০০ মানুষের লাশের উপর দাঁড়িয়ে ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর স্বাক্ষরিত হল শান্তিচুক্তি। এই শান্তি চুক্তি সামরিক বাহিনীর একাংশের পছন্দ ছিল না। তাদের লাই পেয়ে সংগঠিত হল ১৯৯৯ সালে বাবু ছড়া হত্যাকান্ড, সেখানে হত্যা করা হল তিনজন পাহাড়িকে।
*
অনেক বাঙালির পাহাড়িদের উপর নির্যাতনের স্বচ্ছ ধারণা নাই। পার্বত্য এলাকায় অন্তত ৬ মাস বসবাস না করলে তাদের দুঃখবেদনা ভালভাবে উপলব্ধী করা কষ্টকর। পাহাড়ে জাতিগত ও জমিগত বিরোধের অবসানের ব্যবস্থা না করলে, সেখানে যে কোন দিন দুঃখজনক ঘটনার অবতারণা হতে পারে। বিশেষত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য সরকারের ভেতরেই রয়েছে শত্রু ও ষড়যন্ত্রকারী। তারা পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চায় না। সেখানে শান্তি স্থাপিত হলে তারা শান্তকরণের নামে লক্ষ লক্ষ টন গম আত্মসাৎ করতে পারেনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য বরাদ্ধকৃত ফান্ড থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে পারেনা, বনাঞ্চল উজার করে নিজেদের ফ্লাট সুশোভিত করতে পারেনা। তবে আশা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। শেখ মুজিব পাহাড়িয়া অঞ্চলে যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন, আমাদের আশা শেখ হাসিনা তাতে ঝর্ণার করুণাধারা ঢেলে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে প্রদান করেবেন নিরাপত্তা ও শান্তি এবং জনগণকে দেবেন পার্বত্য অঞ্চলের অপরূপ নৈসর্গিক শোভা নিঃশংক চিত্তে ভোগ করার অবারিত সূযোগ।
পাহাড়ে শান্তি আনয়নে আমার দুটো প্রস্তাবঃ ১.পার্বত্য অঞ্চলে পরোক্ষ সেনাশাসন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা ২. জিয়া এবং এরশাদের আমলে যাদেরকে সেখানে প্রবেশ করানো হয়েছিল, তাদেরকে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা। এজন্য সমুদ্র উপকূলে জাগা নিঝুমচরহ পদ্মামেঘনাযমুনার জাগ্রত চরগুলোর কথাও ভাবা যেতে পারে। এসব আবাদি যতদিন পার্বত্য এলাকায় থাকবে,ততদিন সেখানে শান্তি স্থাপনের সম্ভাবনা খুবই কম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:২৯