আনসারের সশস্র ট্রেনিং পাওয়া চব্বিশ বছরের স্বল্প শিক্ষিত টগবগে তরুন খোকা মিয়াকে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে দু'বার ভাবতে হয়নি। সুনামগঞ্জের নারায়ণতলা গ্রামের সাদাসিধে এ মানুষটি ১৯৭১ এর ২৭ মার্চই যোগ দেন যুদ্ধে, আশেপাশের গ্রামের আরও অনেকের সাথে।
ভাগ্যবান পিতা ও কন্যা, এমন একজন মুক্তিসেনার সান্বিদ্ধ পেয়ে..
মুক্তিযুদ্ধে তো যোগ দেয়া হল, কিন্তু হাতিয়ার কোথায় পাওয়া যাবে? মনে পড়ে গেল আনসার ট্রেইনিং ক্যাম্পে অনেকগুলো টি থ্রী-নট-থ্রী রাইফেল আছে। সবাই মিলে গেলেন তাঁরা এসডিও সাহেবের কাছে, কিন্তু সরকারী মাল কিছুতেই দিলেননা সরকারী সেই আমলা। অগত্যা খেলেন গণধোলাই। এসডিও-র বুদ্ধীমতি মাতা ত্রানকর্ত্রীর ভূমিকায় ছেলেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালালেন! 'বাবাসকল, আমার ছেলে সরকারের চাকরি করে, সে কিভাবে তোমাদের হাতে সরকারী অস্ত্র তুলে দিবে বল? তোমরা গুদামের তালা ভেঙ্গে নিয়ে যাও যা ইচ্ছে'। মুহুর্তেই লুঠ হয়ে গেল হাতিয়ার। নিরস্ত্র মুক্তিসেনারা হলেন সশস্ত্র!
এর পরের কাহিনীতো সবারই জানা। ব্যার্থতা আর সফলতার মিশেলে এগিয়ে চলল স্বাধীনতার যুদ্ধ। সুনামগঞ্জে আসা প্রথম এগার জন পাক সেনাকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করে পরাস্থ করা হলো সে কাহিনী যখন তিনি বলছিলেন তখন চোখে তাঁর ভিন্ন দৃষ্টি। তিনি যেন ফিরে গেলেন সেই একচল্লিশ বছর আগের দিনটিতে। আমারা বাপ-বেটি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম তাঁর সময় পরিভ্রমনকৃত দৃষ্টিটি!
তিনি একে একে বলতে থাকেন কিভাবে সহযোদ্ধারা বিভিন্ন যুদ্ধে পরম সাহসিকতায় আত্মত্যাগ করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। একেকটি খন্ডযুদ্ধ কেড়ে নিচ্ছিল দু-তিনটি যোদ্ধার তাজা প্রাণ। খন্ডযুদ্ধ শেষে সৎকারের জন্য লাশগুলো পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল নারায়নতলা গ্রামটিতে। বর্ডারের সংলগ্ন হওয়ায় গ্রামটি কিছুটা নিরাপদ ছিল তখন। তাই হয়তো শহীদদের কবর হিসেবে বেছে নেয়া হল এই গ্রামটিই। মোট আটচল্লিশ জন শহীদের লাশ কবর দেয়া হলো গ্রামটির একই জায়গায়, যার ভেতর ছিলেন ছয়জন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তির সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় জাত্যাভিমান অথবা ভিন্নতাটি বড় হয়ে উঠতে পারেনি!
আটচল্লিশজন বীর শহীদের নামই লেখা আছে সমাধিটিতে..
কবরগুলোকে আরেকটু স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টা করেছি এখান থেকে
বিজয়ের পর ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী-র কাছে গেলে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার কথা বলেন খোকা মিয়াকে, অন্য অনেকের সাথে তিনি তিন বছরের সিনিওরিটি সহ যোগও দেন সিপাহী হিসেবে। কিন্তু সাত বছরের মাথায় খোকা মিয়া মাটির টানে আবার ফিরে আসেন নারায়নতলা। ফিরেতো এলেন কিন্তু কি করবেন তিনি। জমিজমাও অতি অল্প। শত অভাবেও কারও কাছে হাত পাতেন না। দিনের বেশীরভাগ সময়ই খোকা মিয়া কাটান আটচল্লিশ শহীদের সমাধী চত্বরে। এভাবেই একদিন তিনি হয়ে উঠলেন শহীদ সমাধীর অফিসিয়াল কেয়ারটেকার, তাও মাত্র পাঁচশত টাকা বেতনে!
মানচিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সবগুলো সেক্টরের অবস্থান। ৫ নম্বর সেক্টরটি উপরের দিকে ডান কোনা বরাবর..
মুক্তিযোদ্ধা খোকা মিয়া স্বভাবে সাদা-সিধে। নেই কোন উচ্চাভিলাষ তাঁর। কারও প্রতি নেই কোন অভিযোগ। তাই বলে কি কারও কিছু করার থাকবেনা? কে দেবে এর উত্তর? চলছে দেশ অথর্ব দের কাঁধে সওয়ার হয়ে। এগিয়ে যদি কেও আসেই তবে হয়তো কোন একদিন তরুণ প্রজন্মই আসবে এগিয়ে। আমরা যারা অথর্ব তারা তরুণদের জানানোর দায়িত্বটুকু যেন অন্তত অবহেলায় না এড়িয়ে যাই।
তরুন বন্ধুরা, দেখে নিতে পারেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সবগুলো সেক্টর ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের নামসহ কিছু দরকারী তথ্য । দেশকে হয়তো প্রায় সবাই ভালবাসি আমরা। তবে চলুন একটু বুঝেশুনে ভালবাসি!
উৎসর্গ: খোকা মিয়া, বীরমুক্তিযোদ্ধা, পাঁচ নম্বর সেক্টর। আপনারা দেশ স্বাধীন করার আসল কাজটি করে গেলেও বাকী কাজগুলো আমরা আজও করতে পারিনি। আমরা যে অথর্ব..