দুরে একটা কবরস্থান তখনো আছে। দু চারটে ভাঙা এপিটাফ। রিসিতাকে বলছিলাম, দেখ, একটা সময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে বলে মানুষ খুব কাঁদতো। এই চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে কত গান, কবিতা, কত গল্প।
রিসিতা তখন অনমনস্ক হয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা শিশুদের দেখছিল। ওর বিয়েটা ভেঙে গেছে দেড় বছর আগে। তারপর আমার সঙ্গে থেকে যেন নতুন করে বাঁচতে চাইছে। ডাক্তার বলেছিল ওর একটা মানসিক অসুখ আছে - রেইনস ডিসঅর্ডার। এই রোগে মেয়েরা অকারণে সন্তানশোকে ভোগে। স্কুলের শিশুগুলো দেখে তার মনটা হুহু করছিল। আমার কথা শুনে ফিরে তাকায়। চোখটা টলটলে। সে চায় বিয়ে করি তাকে। এই যুগে এমন সন্তানপাগল হতে কাউকে দেখিনি। হাত ছুয়ে বললাম, আমার কথাগুলো তুমি শোননি। আমি সুদীর্ঘ বছর বেঁচে আছি স্মৃতির বোঝা নিয়ে। আমারও সন্তানের সাধ ছিল কোন এক গর্ভে । সেই ইচ্ছেগুলো আর পূর্ণ হয়নি। এখন মানুষের সন্তানকে নিজের ভেবে সাস্ত্বনা পাই।
রিসিতা নতুন প্রজন্মের মানুষ। আমার ভিতরটা যেমন থুর থুরে বুড়ো হয়ে অনেক শতাব্দী বেঁচে আছে, সে তেমন নয়। প্রথম জন্মে দাদাকে বিদায় দিয়েছি, খুব কেঁদেছিলাম তখন। তারপর চলে গেছে নানী, বড় মামা, মেজ খালা। মৃত্যু ছিল তখনকার অমোঘ নিয়তি। কেউ কি ভেবেছিল পরের জেনারেশন অমর না হওয়ার জন্য বিষাদগ্রস্থ হবে?
এখন বিষয়গুলো কতো সোজা! ক্লিনিকে ক্লিনিকে জৈব প্রযুক্তিতে মানুষের শরীর তৈরী হয়। শোরুমে বলে দিলে হয় কেমন হাত পা, চোখ নাক চাই। কোন বয়সের লুক পছন্দ, সেটাও নির্বাচন করা যায়। অবশ্য সবাই স্বকীয়তা ধরে রাখতে নিজের চেহারাটাই ফিরিয়ে আনে। মৃত্যুর পর গাড়ি এসে তাকে নিয়ে যায়, আর আকাঙ্খিত শরীরে জীবিত মানুষ ফিরিয়ে দিয়ে যায়। অমরত্ব নিয়ে গাছগাছড়া আর মৃতসঞ্জিবনী রস তৈরী করেছে মানুষ। সেই ফারাওদের যুগ থেকে। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী নিউটন তার কাজে বেঁচে আছে অথচ শরীরটাকে অমর করার ইচ্ছে ছিল তারও। আলকেমিস্টদের দুর্বোধ্য বই ঘেঁটে মৃতসঞ্জীবনী সূধা প্রস্তুত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি, মাঝ থেকে ক্যালকুলাসের মূল্যবান রাতগুলো নষ্ট হয়েছে।
রিসিতাকে বললাম, তুমি শুনলে অবাক হবে ২১০০ খৃষ্টাব্দের আগে মগজের ডিজিটাল ব্যাকআপ নেয়ার কথা শুধু কল্পনাই ছিল। এখন ব্রেইনব্যাঙ্কের হিমশীতল কক্ষে মস্তিস্ককে অবিকৃত রেখে দেয়া যায়। মাইক্রোফর্ম্যাটে ডিজিটাল প্রতিলিপি সংরক্ষণ করা যায়। জীবনের সঞ্চিত সব স্মৃতি, চিন্তা ভাবনাকে ব্রেইনব্যাঙ্কে রেখে দেয়ায় মানুষ আর হারিয়ে যায় না। যখনই শরীর মরে যায় চট করে নতুন দেহে প্রতিস্থাপিত করে জীবনে ফেরত আসে।
অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। হাটতে হাটতে নগরের এক প্রান্তের উদ্যানে ঢুকে পড়েছি। কমলা ম্যাপল গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে। ওক গাছেরা সবুজ থেকে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ হলে মেয়েটা আমার সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে । পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ পেলাম। দীর্ঘসময় মনযোগী শ্রোতা থেকে একসময় মুখ খুললো, প্রিতম তোমার প্রথম শরীরটার জন্য কি মায়া লাগে? ওটা শেষে কী হয়েছিল?
-হ্যা, মায়া হয়। তবে সেটা ২১৩৫ সালের ঘটনা, অর্গানিক মৃত্যুটার ঘটনাটা তোমাকে বলবো। তার আগে শুরুটা বলি।
(চলবে )
---
ড্রাফট ১.০/ভুলগুলো শুদ্ধ হয়নি এখনো