ইমন ভাই সম্পর্কে কোন কিছু বলতে গেলে আজ থেকে ১২-১৩ বছর পেছনে ফিরে যেতে হয়। স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট নাইন। তখন কেবল বাংলা আন্ডারগ্রাউন্ড মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সেদিকে ঝুঁকে পড়ছি। আমাদের ছোট্ট একটা ব্যান্ড ও ছিলো। মাঝে মাঝে জ্যামিং করি। আন্ডারগ্রাউন্ডের কয়েকটা ব্যান্ডের গান শুনি। অর্থহীন, ক্রিপটিক ফেইথ, আর্টসেল। কিন্তু কী যেন একটা মিসিং। ঠিক মন মত হয়ে ওঠেনা। একদিন অনিক (আমার ইয়ারমেট। ও আমি আর আমি আলাদা স্কুলে পড়তাম। টিউশন আর খেলার মাঠে দেখা হত) আমাকে বলল, ব্ল্যাকের গান শুনিস? না তো! এইটা কোন ব্যান্ড? ও বলল- আরে গাধা! ব্ল্যাক শুনিস না তো কী শুনিস! আজকেই অ্যালবাম কিনবি। "উৎসবের পর"।
কেনা হলো। গান গুলো শুনি। একটু অন্যরকম সমসাময়িক বাংলা ব্যান্ডের গানের তুলনায়। কি মিউজিকে - কি লিরিকে, কি গায়কীতে! আমার তখন চলছিলো ব্ল্যাক-গ্রস্থতার পালা। ওদের প্রথম অ্যালবাম "আমার পৃথিবী"। কিনে ফেললাম। একে একে কয়েকটা মিক্সড অ্যালবাম এ ব্ল্যাকের সিঙ্গেলস রিলিজ পেয়েছিলো, সেগুলোও জোগাড় করা হয়ে গেলো। সারাদিন গানগুলো উল্টেপাল্টে শুনতাম। আমার তখন অল্পবিস্তর কলম দিয়ে কাগজে খুটিনাটি- অর্থাৎ লেখালিখি করার অভ্যেস হয়েছে। ডায়েরী রাখি। ক্লাসের খাতার পেছনে গল্প লিখি। কেন জানিনা, ব্ল্যাকের লিরিক গুলোয় ভয়াবহ আচ্ছন্ন হলাম। শুনতাম আর ভাবতাম সুর স্রষ্টা দের তো সামনে দেখতে পাচ্ছি। একেবারেই অন্যধাচের এই লিরিক গুলো যিনি লেখেন, তিনি কে? সিডির ফ্ল্যাপে পড়ে জেনেছি ওনার নাম জুবায়ের হোসেন ইমন। কে তিনি?
এই লোকটি আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেললেন তাঁর লিরিক দিয়ে, আমি বেশ কিছু লিরিক লিখে ফেললাম। বাসায় আব্বু গানবাজনা পছন্দ করে না- কি করবো? চলতে থাকে আব্বুর চোখ এড়িয়ে গীটার শেখা, জ্যামিং, লিরিক লেখা আর ব্ল্যাকের গান শোনা। লিরিক লিখে জমাই আর ভাবি একদিন ঠিকই ইমন ভাইয়া কে দেখাবো আমার লেখা! কিন্তু যার লেখা গানে আমার মধ্যে এত উৎসাহ, এত প্রেরণা, সেই ইমন ভাই কে তো দেখলাম না! প্রায়ই ভাবতাম অ্যালবাম এর ফ্ল্যাপে লিরিসিস্ট এর ছবি ক্যানো দেয়া হয় না! আমার কাছে তখন ছবিই অনেক...
এরমধ্যে একদিন ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটে গেলো। ক্লাস টেনের শুরুতে মনে হয়। এক ক্লাসমেটের সাথে ঝগড়া। বিষয় খুব সামান্য। ব্ল্যাকের গান বোগাস। ওদের গান বেসুরো। একথা ওকথার পর ও বলে বসল জন ভাই নাকি গাইতেই জানেনা। একথা শোনার পর আমার কী হল কে জানে, সারাজীবন শান্তশিষ্ট বালক হয়ে থাকা এই আমি ওই ক্লাসমেট কে সজোরে ঘুষি বসালাম। দাঁত ভেঙ্গে গেলো। রক্তারক্তি অবস্থা! হেডস্যারের কাছে বিচার গেলো। স্যার আমাকে চিনতেন, তিনিও অবাক। আমার তো এমন করার কথা না! সাত দিনের ডিটেনশন গেলো। এরপর স্কুলে ফেরা।
কারো জন্মদিন এলেই ব্ল্যাকের সিডি কিনে দিতাম। তখনো অনেকের ঘরে সিডি প্লেয়ার এভেইলেবল না। তাদের ক্যাসেট। ব্ল্যাকের গান তাদের ভালো লাগুক বা নাই লাগুক। আমার পাগলামীটা কতটা শক্ত ছিলো সহজেই অনুমেয়। আমার ক্লাসের একটা অংশকে ব্ল্যাকের ফ্যান বানিয়ে ফেললাম। আর আমি- ততদিনে জুবায়ের হোসেন ইমন নামের মানুষটাকে মেন্টরের আসনে বসিয়ে ফেলেছি।
স্কুল কলেজ পর্ব পেরোলাম এভাবেই, দিনে দিনে বাড়লো ব্ল্যাক-গ্রস্থতা! এইচ এস সি পরীক্ষা শেষে কয়েক টুকরো অবসর। সামুতে আসা হয় নিয়মিত। তখনো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়নি। নাফিস ইফতেখার ভাইয়ের লেখাগুলো নিয়মিত পড়া হয়। হোমপেজে একদিন পোস্ট পড়তে পড়তে আটকে গেলাম একটা নামে। ইমন জুবায়ের। লেখাটা পড়লাম। বুঝে উঠতে পারলাম না ইনিই কি সেই ইমন ভাই! আগের বেশ কিছু পোস্ট ঘেটে দেখা হলো। আরে, ইনিই তো! বিশ্বাসই হচ্ছিল না ইমন ভাইকে ব্লগে এসে পেয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে অ্যাকাউন্ট খুললাম। লেখাও শুরু করলাম- জেনারেল না হলে তো ওনার ব্লগে কমেন্ট করতে পারছি না। একসময় পেলাম কমেন্ট একসেস। ভাইয়ার একা ২ নিয়ে করা পোস্টেই বোধ হয় প্রথম কমেন্ট করেছিলাম।
আমি কল্পনা করতে ভালোবাসি। আমার কল্পনায় ইমন ভাইয়া ছিলেন দাড়িগোফে ঢাকা একজন। কাচাপাকা চুল। চোখে মোটা রীমের চশমা। কিছুটা রবীন্দ্রনাথ টাইপ! খুব রাগ করে থাকলে তাকে যেমন দেখায়, খুব খুশীর সময়েও একই রকম দেখায়, এটাই ছিলো আমার ধারণা! তো তখনো ব্লগের কেউ ইমন ভাইয়ার ছবি দেখেন নি। আমি একটা পোস্ট লিখলাম, মিথ্যা - ইমন জুবায়ের ভাইয়ের সেই গান... পোস্টটা পড়ে ইমন ভাই নিজে থেকেই ওনার ছবি দিয়ে গেলেন, আর ওনাকে প্রথম দেখলাম। দেখলাম কল্পনার সাথে কোন মিলই নেই! হাঃ হাঃ। সেটা ছিলো ২০০৯ এর আগস্টে।
এর মধ্যেই ফেবুতে ভাইয়াকে বন্ধু হবার অনুরোধ পাঠালাম। ভাইয়াও সাড়া দিলেন। মোবাইল নাম্বার ও নেয়া হলো। কিন্তু ফোনটা সাথে সাথেই দেয়া হয়নি। সেটা নিয়ে শুরুতে ভাইয়ার কিছুটা অভিমানও ছিলো মনে হয়। ব্লগেই আমাদের মিথস্ক্রিয়া চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে ফেসবুকে অদ্ভুত সব কথোপকথন। এরমধ্যে আকাশ পাগলার কথা না বললেই নয়! ওও ছিলো ভাইয়ার ফ্যান। আমি আর মিলে ভাইয়ার ব্লগে কমেন্টের ঝড় তুলতাম! ভাইয়ার আমার দেশেরবাড়ি রাজশাহী। রাজশাহী ভাইয়ার নানুবাড়ি। সেই ১৯৮৪ সালের পরে আর যাননি। খুবই মিস করতেন রাজশাহী! প্রায়ই এসব খুঁটিনাটি নিয়ে কথা হতো। প্রায়ই আমাকে অনেক অনেক পিডিএফ দিতেন। কত রকম যে বই! আ ব্রিফ হিস্টোরি অফ আটলান্টিস, পামিস্ট্রির বই, অ্যাস্ট্রোলজির বই, বাংলার ইতিহাস নিয়ে বই। উনি ছিলেন খুব পড়ুয়া। নাক মুখ গুঁজে বই পড়েতেন আর দুহাতে লিখতেন।
ব্লগার রাইসুল জুহালা একবার বলেছিলেন, " আমার প্রায়ই মনে হয় ইমন জুবায়ের কুড়ি পচিশ জনের একটা অফিসের নাম। একা একজনের পক্ষে তো নিয়মিত এত বিভিন্ন রকমের পোস্ট দিয়ে যাওয়া সম্ভব না।" সত্যিই, কী ছিলো না ভাইয়ার ব্লগে! ইতিহাস, ঐতিহাসিক গল্প, কবিতা, গান, গৌতম বুদ্ধ, চিত্রকলা, জীবনানন্দ, দর্শন, ধর্ম, প্রবন্ধ/নিবন্ধ, বই পরিচিতি, বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বিদেশি ভাষার কবি ও কবিতা, মরমীবাদ, মিথ, যন্ত্রসংগীত, রবীন্দ্রনাথ, রাগ সংগীত, লালন, জেন দর্শন... আরো কত কিছু। মৌলিক গল্প আর কবিতা / লিরিক তো ছিলোই। ভাইয়া সকাল সকাল ঘুমোতে যেতেন। ভোরে উঠতেন। উঠেই প্রথমে ব্লগের সবার কমেন্টের জবার দিতেন। কোন কোনদিন হয়ত এমনও গিয়েছে, রাতে ঘুমাইনি, সকালে উঠে ভাইয়ার ব্লগে করা কমেন্টের জবাব দেখে ঘুমাতে যাবো। বার বার পেজ রিফ্রেশ দিতাম....
ব্লগে এই লেখালিখির স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১তে ডয়েচে ভেলে ব্লগ বাংলা ব্লগ প্রতিযোগে মনোনীত হয়েছিলেন সামু থেকে। পরে নির্লজ্জ্ব ভোটচুরির শিকার হয়ে জেতা হয়ে ওঠেনি। ভাইয়াকে সেটা নিয়ে কখনো আক্ষেপ করতে দেখিনি। খুবই নির্লিপ্ত আর নির্বিবাদ মানুষ ছিলেন। এত এত পড়াশোনা আর লেখালিখি করতেন এসব কিছুর জন্যে না, নিজের ভেতরের একটা ভালোলাগা থেকে। ব্লগে সেসময় বিভিন্ন রকম ক্যাচাল। সেসবে কোনদিন জড়াননি। সব মতের ব্লগারদেরই প্রিয় মানুষ ইমন জুবায়ের। ২০১১র শেষে বাংলা ব্লগ দিবসে সামুর শ্রেষ্ঠ ১০ জন ব্লগারের ভেতর একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওনাকে বলেছিলাম একটা বই বের করেন বইমেলায়। হেসেছিলেন- "আমার বই কে পড়বে?" একটা বইয়ের কাজ অবশ্য ভাইয়া এগিয়ে নিয়েছিলেন যতদূর মনে পড়ে। হয়ত কোন সন্ধ্যায় এক বইমেলায় জন ভাই এর হাতে মোড়ক উন্মোচন হতে পারত সেই বইয়ের- আমি জানি সেই মানুষটা জন ভাই ই হতেন।
ইমন ভাই কোন একটা কারণে আমাকে খুব পছন্দ করতেন। এটা আমি প্রথমে বুঝি নি। অনেক পরে বুঝেছিলাম। খুব প্রকটভাবে বুঝেছিলাম আরো, যখন ভাইয়া আমার জন্মদিনে আমাকে নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন! আমি আমার জন্মদিনে এর চেয়ে ভালো উপহার আজ পর্যন্ত পাইনি। পাবো বলেও মনে হয় না। প্রচন্ড খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছিলো। ভাবছিলাম আরে, ভাইয়া আমাকে এত ভালো বোঝে কিভাবে! আমার সাথে তো ওনার দেখাই হয়নি কখনো! সেই পোস্ট আমি যাকেই পেতাম তাকেই পড়তে দিতাম। আম্মু আব্বুকেও জোর করে পড়িয়েছিলাম। কাছের বন্ধুদেরো! এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন লেটেস্ট গ্যাজেট নিয়ে শো অফ করে, আমি শো অফ করতাম ওই পোস্ট নিয়ে। ছেলেমানুষি রকমের একটা ভালোলাগা কাজ করত! ভাবখানা এমন, দেখ! আমারে নিয়ে ভাইয়া পোস্ট দিসে! তোরে নিয়ে দিসে??
ভাইয়া প্রায়ই অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতেন। নিজের ব্যাপারে বলতেন- আমি জনবিষণ্ণ। জিজ্ঞেস করলাম,জনবিষণ্ণতার সুফল কী? ভাইয়া বলেছিলেন- নো সুফল। অনলি পেইন! মজা করে কথা বলতে পারতেন। ভাইয়া রাশিতে খুব বিশ্বাস করতেন। আমি কর্কট। জন ভাই ও। ভাইয়া বলতেন- কর্কটরা ভারি ইনট্রোভার্ট হয়; মানসিকতা বেশ অতল । বারোটি রাশির মধ্যে এই রাশিটির প্রতিই আমার সবচে বেশি আস্থা আর ভক্তি। এর ঠিক সবার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। কিন্তু যার সঙ্গে মেশে, ভীষণ সিরিয়াসলিই মেশে। কথাটা অন্যদের জন্য কতটা সত্যি জানিনা, আমার জন্যে অনেক সত্যি। ব্ল্যাকের ব্যাপারেও অনেক অনেক কথা হতো। তাহসান কিন্তু ইমন ভাইয়ার কাজিন। কিন্তু জন ভাইকে ভাইয়া ভয়ংকর রকম ভালোবাসতেন। ব্ল্যাকের শুরুর দিকে ইমন ভাইয়ের যে কত কন্ট্রিবিউশন আছে! জন ভাই আসলে নতুন গান হলে আমাকে জানাতেন। আমার কাছে ব্ল্যাকের জন্য লেখা ভাইয়ার বেশ কিছু আনরিলিজড লিরিকও আছে। সঙ্গত কারণেই আমি সেগুলো কখনো প্রকাশ করিনি। করবোও না। ভাইয়া আমাকে জন ভাইয়ের নাম্বার ও দিয়েছিলেন। কী এক আড়ষ্টতায় আমি কখনো ফোন করতে পারিনি!
তখন ২০১২। জন ভাই ব্ল্যাক ছেড়ে গেছেন! তখন খুব অল্প সময়ের জন্যে একটা ফেসবুক পেজ খুলেছিলেন। সেখানে ভবিষ্যতে কিছু একটা করার ইঙ্গিত দিলেন। আমি সেই পেজে জন ভাইয়ের সাথে অল্পসল্প কথাবার্তা জমিয়েছিলাম। এ লেখা যদি কখনো ভাইয়ার চোখে পড়ে- মনে পড়বে কিনা জানিনা। আমি জ্বালাতাম জন ভাইকে খুব। ওনার প্রিয় খাবারদাবার থেকে শুরু করে টিভি সিরিয়ালও জানা হয়ে গেলো। ভাইয়া আমাকে একটা টিভি সিরিয়াল রিকমেন্ড করেছিলেন। সন্স অফ অ্যানার্কি। সাথে সাথেই দেখা শুরু করি। এখনো চলছে।
ইমন ভাইয়া আমাকে বলেছিলেন "ইন্ডালো"র কথা। জন ভাইয়ের নতুন ব্যান্ড। তখনো ওয়ার্মআপ চলছিলো সম্ভবত। ২০১২'র জুলাই। বলেছিলেন- I think you have right to know this; but do not tell this to anybody.O.K? অদ্ভুত খুশি লেগেছিলো! আমি সবার আগে জানি! বাচ্চাদের মত খুশির কারণ, আমি জানি। কিন্তু আমার খুশি লেগেছিলো। বছরের শেষ দিকে ইন্ডালোর কনসার্ট হলো- প্রথমবারের মত স্রোতাদের সামনে এল ওরা। তখন একটু আধটু ফটোগ্রাফি করা শুরু করেছি। ক্যামেরা বাগিয়ে চলে গেলাম। বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। বাসায় এসে ইমন ভাইকে দেখালাম! অনেক খুশি হয়েছিলেন!
ভাইয়া আমার লেখা পছন্দ করতেন। একবার বলেছিলেন, আমার একটা লেখায় নাকি নিজের লেখার ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। সেদিন গর্বে বুকের ছাতি ৪ ইঞ্চি ফুলে গিয়েছিলো! একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভালো লেখক হবো কিভাবে? ভাইয়া বলেছিলেন, ঘর আঁধার করে বসে থাকবা। মানুষের সাথে কথাবার্তা কম বলবা। হাঃহাঃ আমিও এভাবেই হয়েছি। ভাইয়ার ঠাট্টার মাঝে কিছুটা সত্যি মিশে ছিলো, ধরতে পেরেছিলাম সহজেই। ব্লগে নতুন লেখা লিখলেই আমি দুজনের মন্তব্যের জন্যে উশখুশ করতাম। ইমন ভাই আর হাসান মাহবুব ভাই। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্ল্যাকের অই গানটার নাম ৬ই সেপ্টেম্বর ক্যানো? ভাইয়া বলেছিলেন দেখা করো, তাহলে বলবো। আরো অনেক কিছু বলবো তোমাকে।
তখন ২০১২, ডিসেম্বরের শেষ দিকে। সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। রাজশাহী গিয়েছি। ঠিক করলাম এবার ঢাকা ফিরেই ভাইয়ার সাথে দেখা করতে হবে। বললাম ভাইয়াকে। ভাইয়া বললেন- ফোন দিয়ে এসো। আর ব্ল্যাকের সব গান আনবা পেনড্রাইভে করে! হাসলাম- আচ্ছা!
আরো কিছু কথাবার্তা হয়েছিলো। পুরোটা তুলে দিই বরং-
ভাইয়াঃ খাজা আনবা রাজশাহী থেকে।
আমিঃ তিলের?
ভাইয়াঃ হু।
আমিঃ আচ্ছা আনবো! আপনার পছন্দ?
ভাইয়াঃ হ্যাঁ! তিলের খাজা আনলে যে কোনও প্রশ্ন করতে পারবা। নইলে কর্কট রাশির মতন ফরমাল থাকব কথাবার্তায়!
এরকম মজা করে কথা বলতেন সবসময়। আমি আলাদা করে চিনি আর গুরের তৈরী তিলের খাজা কিনে রেডি হলাম। ভাইয়ার সাথে এবার জমিয়ে আড্ডা দিতে হবে। এই তো প্রথম দেখা! কথা যে জমে আছে- কত কিছু যে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করা লাগবে! ভাইয়াও নিশ্চয়ই আমাকে অনেক কিছু বলবেন। জানুয়ারীর ৫ তারিখ ফিরবো ঢাকা। কত প্ল্যান মাথার ভেতর। গানের খাতাটা নিয়ে যাবো সাথে। ভাইয়াকে দেখাবো।
সৃষ্টিকর্তার সম্ভবত এতে সায় দিতে মন চাইলো না। জানুয়ারীর ৪ তারিখ- মানুষটা না ফেরার দেশে চলে গেলেন। উপরের এই কথাগুলোই ভাইয়ার সাথে আমার শেষ কথা।
জন ভাইকে সম্ভবত এই দূঃসংবাদটা আমিই প্রথম দিয়েছিলাম। সেই যে পেজটায় আমাদের কথা হত, ইনবক্সে। সকালে আমি নিজেই খবরটা পেয়ে বিমুঢ়। ভাবলাম জন ভাই হয়ত বলবেন আরে নাহ! ভুয়া নিউজ। আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করছিলাম জন ভাই যেন তাই বলেন। কিন্তু আমার মতই জন ভাইও বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। উনি জানতেন না তখনো...
আমি এর আগে বহুবার এই লেখাটা লিখতে চেয়েছি। কোনবারই পারিনি। কোনও একটা অদ্ভুত কারণে লেখাটা শেষ করতে পারিনা। স্ক্রীণ ঝাপসা হয়ে ওঠে। কীবোর্ডে আঙ্গুল এগোয় না। এবারো হয়ত শেষ হবেনা। জন ভাই তো ইমন ভাইয়ার জন্যে একটা গান করেছিলেন। আমি তো লেখা ছাড়া আর কিছু পারিনা। একটা মানসিক যন্ত্রণা থেকে এই লেখটার জন্ম।
জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন, জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন।
সেই মুগ্ধতা সাথে নিয়েই চলে গেলেন। সত্যসন্ধ, নির্লিপ্ত আর একা। উনি আমার কে ছিলেন, কী ছিলেন, এটা আমিই জানি শুধু। কাউকে কখনো বোঝাতে পারবো না, এটাই দুঃখ। এই মানুষটা আর নেই আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনা। প্রায়ই মনে হয় ফেবুর চ্যাটে সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠবে- ভাইয়া টুপ করে বলবেন- আরেহ মজা নিচ্ছিলাম তোমাদের সাথে। তিনটা বছর চলে গেলো ইমন ভাই! কোথায় লুকিয়ে আছেন? রাতের আড়ালে, সময়ের পেছনে? শিখলেনই বা কোথায় এভাবে হারিয়ে যাওয়া? রাস্তাটা বলে যাবেন তো!
ইমন ভাই, নীলগিরি দেখা হলো না আপনার চোখে! জানেন, সেদিনের পর থেকে আমি আর খাজা খাইনি। ইমন ভাই, জানেন আমি এখনো এই ছায়াপথে ঘুরে বেরাই, একা, রুদ্ধবোধে! পরাহত এই শরবিদ্ধ শরীরে কে যেন চিহ্ন রেখে যায়। ইমন ভাই, এখনো ভুল করে ডায়াল করি আপনার পুরনো নাম্বারে। সাড়া মেলেনা।
জানেন তো কর্কটদের অনেক অভিমান! আমার কত অভিমান আপনার উপর জানেন? একদিন খুঁজে বের করে ফেলবো। একদিন ঠিক দেখা হয়ে যাবে দেখবেন ইমন ভাই! বৃষ্টি ভিজে লালন শোনা হবে, কোন ভুল নেই। গানের খাতাটা নিয়ে গেছেন? নতুন কী লিখলেন দেখাবেন.......
ইমন ভাই। ব্লগের সবার দেখা সেই প্রথম ছবিটা
আমার তোলা "ইন্ডালো"র ছবি। গেলো সেপ্টেম্বরে ওদের অ্যালবাম লঞ্চিং এ
ইমন ভাই চলে যাবার পর জন ভাই ওনার একটা গানে নতুন করে সুর করেছিলেন। যদিও সেই ২০০৯ সালেই গানটা সুর করা হয়েছিলো। তখন রিলিজ হয়নি।
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
সামুর মডারেশন প্যানেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইমন ভাইয়ের ব্লগটা আগে প্রথম পাতায় স্টিকি করে দেয়া হয়েছিলো। এবারের নতুন ডিজাইনে সেটার কোন জায়গা হয়নি। উনি এই ব্লগের ইতিহাসকে যেভাবে সম্বৃদ্ধ করেছেন, তার জন্যে হলেও ওনার ব্লগটাকে আজীবন স্টিকি করে রাখা উচিত। বিনীত অনুরোধ রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১৬