অ্যাসক্লেপিয়স ছিলেন জিউস পুত্র দেবতা অ্যাপোলো'র সন্তান। নিখুঁত শরীরী সৌন্দর্য্যের অধিকারী অ্যাপোলো ছিলেন ওরাকল, সূর্য্য (বা আলো), ওষুধ, চিকিৎসা এবং সংগীতের দেবতা। অ্যাপোলোর অনেকগুলো ক্ষমতার মধ্যে অ্যাসক্লেপিয়স রোগীকে সুস্থ করে তোলার ক্ষমতাটি উপহার পেয়েছিলেন বা মতভেদে সুচারুভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। ভেষজ ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে অ্যাসক্লেপিয়সের ছিলো অনেক জানাশোনা। মানব সভ্যতার কাজে লাগাবার জন্য নিজের সমস্ত জ্ঞান তিনি ছড়িয়ে দিতেন তরুণদের মাঝে। চিকিৎসক এবং শল্যবিদ হিসেবে দারুণ সুনাম ছিলো তার।
অ্যাসক্লেপিয়াস যদিও ডিভাইন গড ছিলেন না, তিনি ছিলেন ডেমি গড। অর্থাৎ দ্বিতীয় স্তরের দেবতা। এর কারণ তিনি অ্যাপোলোর সন্তান হলেও তার মা ছিলেন সাধারণ মানুষ। অবশ্য অ্যাসক্লেপিয়াস তার জীবদ্দশায় দেবতার জীবন উপভোগ করে যেতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পরই তিনি পরিপুর্ণ দেবতা রূপে স্বীকৃতি পান।
অ্যাসক্লেপিয়সের মা ছিলেন থেসেলি'র রাজকন্যা করোনিস। অ্যাপোলো একবার তাকে রেখে দৈববানী প্রচারে দূরে যাত্রা করলেন। এদিকে একলা করোনিস কে পেয়ে বসল কামনায়। এক রাজকুমারের প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। গর্ভে অ্যাপোলোর সন্তান অ্যাসক্লেপিয়স বেড়ে উঠছে ততদিনে। অ্যাপোলো নিজের অনুপস্থিতি তে করোনিসের পাহারায় রেখে গিয়েছিলেন প্রহরী সাদা কাক জাতীয় পাখিকে। সেই পাখি খবর পৌঁছে দিলো অ্যাপোলোর কাছে, করোনিসের মতি ভ্রষ্ট হয়েছে, তিনি মনুষ্য প্রজাতির একজন কে স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে চলেছেন। খবর পেয়ে রাগে জ্বলে উঠলেন অ্যাপোলো। (বলা হয়ে থাকে এই খবর শুনে রাগে পাখিটির পালক পুড়িয়ে কালো করে দেন তিনি। তাই এখনো পর্যন্ত কাকেদের রঙ কেবল কালোই হয়।) প্রতিহিংসায় পুড়তে পুড়তে জমজ বোন দেবী আর্টেমিস কে পাঠালেন করোনিস কে হত্যা করতে। আর্টেমিস ভাইয়ের কথা মত কাজ করলেন। চিতায় তোলা হলো করোনিসের মৃতদেহ। আগুনের শিখা করোনিসের ঔরসজাত শিশুকে গ্রাস করার আগেই সেখানে পৌছে গেলেন অ্যাপোলো। বলা হয়ে থাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের সর্বপ্রথম সি-সেকশন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মৃত করোনিসের জঠর থেকে অ্যাসক্লেপিয়সকে বের করেন তিনি।
পুত্রকে উদ্ধাররত অ্যাপোলো
অ্যাসক্লেপিয়স অর্থ- এমন কিছু যা কেটে বের করা হয়েছে। এজন্য তার নাম এমন রাখা হয়। শিশু অ্যাসক্লেপিয়স কে সঠিক ভাবে পরিচর্যার জন্যে তুলে দেয়া হয় বিজ্ঞ সেন্টর কাইরনের কাছে। শৈশবে কাইরনের কাছেই শিকার ও চিকিৎসাবিদ্যার দীক্ষা নেন তিনি।
বয়সকালে অ্যাসক্লেপিয়স বিয়ে করেন এপিওনি কে। এপিওনির ঘরে তার ৬ টি কন্যা ও ৩টি পুত্র সন্তান (মতভেদে ৫ কন্যা আর ২ পুত্র) জন্ম নেয়। এরা হলেন হাইজিয়া, মেডিট্রিনা, প্যানাকিয়া, অ্যাসেসো, ল্যাসো আর অ্যাগ্লিয়া এবং ম্যাকাওন, পোডালেইরিওস আর টেলিস্ফোরোস। অ্যাসক্লেপিয়স এর মেয়েরা সবাই একত্রে সুস্বাস্থের দেবী। যেমন হাইজিয়া পরিচ্ছন্নতার দেবী, মেডিট্রিনা ওষুধপত্রের দেবী ইত্যাদি। ভাইদের মধ্যে ম্যাকাওন আর পোডালেইরিওস ছিলেন বিখ্যাত শল্যবিদ। ট্রোজান যুদ্ধে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখেন দুই ভাইই। মহাকবি হোমার রচিত ইলিয়াডে ম্যাকাওন আর পোডালেইরিওসের কথা আছে। ম্যাকাওন ইউরিপাইলাস এর হাতে ট্রোজান যুদ্ধের দশম সালে নিহত হন।
অ্যাসক্লেপিয়স চিকিৎসক ও শল্যবিদ হিসেবে দারুণ সুনাম অর্জন করেন, একে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে আসেন। অ্যাসক্লেপিয়স ওরাকলের মাধ্যমে পিতা অ্যাপোলোর কাছ থেকে চিকিৎসা ও ওষুধপত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতেন ও পরবর্তীতে নিজ সন্তান ও ছাত্রদের মাঝে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেন। দেবী এথেনা অ্যাসক্লেপিয়সের এহেন দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে গর্গন বোনদের একজন মেডুসা’র রক্ত উপহার দেন। মেডুসার মস্তিস্কের বাম দিকের শিরা থেকে প্রবাহিত রক্ত মানবকূলের বিনাশের কারণ। কিন্তু ডান দিকের শিরা থেকে প্রবাহিত রক্ত দারুণ সঞ্জিবনী শক্তি সঞ্চার করে মানব শরীরে। মানবদরদী অ্যাসক্লেপিয়স মেডুসা’র মস্তিস্কের ডান দিকের রক্ত ব্যবহার করতে লাগলেন চিকিৎসায়। এই রক্ত এতটাই শক্তিশালী ছিলো যে মৃত মানুষ কেও জীবন ফিরিয়ে দিতে লাগল। মানুষের মৃত্যুহার শুণ্যের কোঠায় নেমে গেলো।
থিসিয়াসের সন্তান হিপ্পোলিটাস দেবী আর্টেমিসের প্রিয়ভাজন ছিলেন। তার করুণ মৃত্যু হলে আর্টেমিস অ্যাসক্লেপিয়স কে অনুরোধ করেন তাকে জীবিত করে তুলতে। বলাই বাহুল্য অ্যাসক্লেপিয়স সে অনুরোধ ফেলতে পারেননি।
পরলোকের রাজা হেডিস অ্যাসক্লেপিয়সের কর্মকান্ডে দারুণ নাখোশ হলেন। তার মনে হলো এভাবে চলতে থাকলে একসময় পরলোকে আর কোন আত্নাই প্রবেশ করবে না নতুন করে। তিনি অভিযোগ করলেন ভাই দেবরাজ জিউসের কাছে। সব শুনে জিউস ভয় পেয়ে গেলেন, কারণ বস্তুত অ্যাসক্লেপিয়স তার ক্ষমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিলো তার বধ করা কিছু শত্রুকে পুনঃরুজ্জীবিত করে! তাই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করার অপরাধে জিউস তার বজ্রবাণ হেনে অ্যাসক্লেপিয়স কে হত্যা করলেন।
এদিকে প্রিয় পুত্রকে হত্যা করা প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠলেন দেবতা অ্যাপোলো। কিন্তু দেবরাজের উপর তো কারো ক্ষমতা খাটে না, আর কেই বা তাকে ভয় পায় না! তাই ক্ষুদ্ধ অ্যাপোলো সাইক্লোপস কে তীর ছুঁড়ে হত্যা করলেন। সাইক্লোপস জিউসের জন্য বজ্রবাণ তৈরী করতেন।
স্বর্গের অমর দেবতা হয়েও স্বজাতি হত্যার দায়ে অ্যাপোলো কে দোষী সাব্যাস্ত করে থেসেলির রাজা অ্যাডমিটাসের কাছে এক বছরের জন্য দাসত্বের সাজা দেয়া হয়। সাজার মেয়াদ শেষ হলে অ্যাপোলো কে অলিম্পাসে ফিরিয়ে নেন জিউস, আর মৃতের জগত থেকে জীবিত করে তোলেন সাইক্লোপস কে। এতে অ্যাপোলো দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে অ্যাসক্লেপিয়স কে আবার জীবিত করে তুলতে বলেন। জিউস জানিয়ে দেন সেটি সম্ভব নয়, তবে তিনি অ্যাসক্লেপিয়স কে দেবতা হিসেবে আকাশের তারাদের মাঝে স্থাপন করতে পারেন। অ্যাপোলো এতেই রাজী হন। তখন জিউস মিল্কি ওয়ের উত্তর-পশ্চিম আকাশে অ্যাসক্লেপিয়স কে অরফিউকাস হিসেবে স্থাপন করেন।
রাতের আকাশে অরফিউকাস
কেপলারের আঁকা অরফিউকাস
এটি হারকিউলিসের খুব কাছাকাছি, স্করপিয়ন্স এর ঠিক উপরে। অরিয়ন বা কালপুরুষের ঠিক উল্টোপাশেই এর অবস্থান। গ্রীষ্ম এলে অরফিউকাস কে সবচেয়ে স্পস্ট দেখা যায়।
ট্রিকালা, থেসেলি, গ্রিস
ধারণা করা হয় থেসেলিতেই প্রথম বীর হিসেবে অ্যাসক্লেপিয়সের বন্দনা শুরু হয়, যদিও এখন অব্দি এখানে অ্যাসক্লেপিয়সের কোন উপাসনা কেন্দ্র খুজে পাওয়া যায়নি। থেসেলি’র ট্রিক্কা (বর্তমানে ট্রিকালা) নগরেই তার জন্ম বলে মিথোগ্রাফাররা মনে করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০ সাল থেকে অ্যাসক্লেপিয়স বন্দনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ সালে এসে তা পূর্ণতা পায় এপিডারুসে। এখানেই প্রথম অ্যাসক্লেপিয়স কে দেবতা হিসেবে বন্দনা করা শুরু হয়।
প্রচীন এপিডারুস
অ্যাসক্লেপিয়সের উপাসনার স্থানগুলোকে অ্যাসক্লেপিয়ন বলা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২০ সালে স্থাপিত এথেন্সের অ্যাক্রোপলিসের দক্ষিণ ঢালে আরেকটি সুপরিচিত অ্যাসক্লেপিয়ন রয়েছে। এসব স্থানে আরোগ্য লাভের আশায় পূণ্যার্থীরা আসত এবং রাত্রী যাপন করত। রাত্রীকালে তারা যে স্বপ্ন দেখত তা পরবর্তী সকালে অ্যাসক্লেপিয়নের দেখভালকারী যাজকের কাছে খুলে বলত। যাজক তাদেরকে সমাধানের উপায় বাতলে দিতেন। একপ্রকার সাপ যেহেতু অ্যাসক্লেপিয়সের প্রতি নিবেদিত, তাই অ্যাসক্লেপিয়ন গুলোতে নির্বিষ সাপ ব্যবহার করা হতো রোগমুক্তির বিভিন্ন ধাপে। এমনকি অ্যাসক্লেপিয়নের ডর্মিটরি গুলোতে যেখানে রোগীরা থাকত, সেখানে সাপগুলো নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াত।
এপিডারুসে অবস্থিত অ্যাসক্লেপিয়নটির অবশিষ্টাংশ
অ্যাসক্লেপিয়ন গুলোকে হাসপাতালের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে। এপিডারুসে অবস্থিত অ্যাসক্লেপিয়নটিতে তিনটি বড়সড় মার্বেল পাথরের স্লেট রয়েছে, যাতে রোগমুক্তি লাভের আশায় আগমণকারী পূণ্যার্থীদের নাম ও তাদের কেস হিস্ট্রি লেখা থাকত। কিছু কিছু অ্যাসক্লেপিয়নে অ্যাসক্লেপিয়সের সাথে সাথে তার কন্যাদেরও (মূলত হাইজিয়া ও মেডিট্রিনা) উপাসনা করা হতো বলে ঐতিহাসিকরা দাবী করেছেন।
বাবার সাথে সর্প বাহক পরিচ্ছন্নতার দেবী হাইজিয়া
ডোডিক্যানিজ দ্বীপপূঞ্জের কস নামক দ্বীপে একটি সুপরিচিত অ্যাসক্লেপিয়ন রয়েছে। বলা হয়ে থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রিটাস এখানেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের দীক্ষা লাভ করেন। তিনি নিজেও অ্যাসক্লেপিয়সের উপাসনা করতেন।
কস এ অবস্থিত অ্যাসক্লেপিয়ন
হিপোক্র্যাটিক শপথ, যা পৃথিবী জুড়ে চিকিৎসকরা উচ্চারণ করে থাকেন চিকিৎসা বিদ্যা কে মানবকল্যাণের কাজে লাগানোর প্রত্যয়ে, ধারনা করা হয় এটি হিপোক্রিটাস নিজেই লিখেছেন, অবশ্য ভিন্নমতও রয়েছে। হিপোক্র্যাটিক ওথে অ্যাসক্লেপিয়সের নাম রয়েছে। দীর্ঘ শপথটি শুরু হয়েছে এভাবেঃ I swear by Apollo the Physician and Asclepius and Hygieia and Panaceia and all the gods, and goddesses, making them my witnesses, that I will fulfill according to my ability and judgment this oath and this covenant:
সর্প পরিবেস্টিত একটি লাঠি সবসময় অ্যাসক্লেপিয়স বহন করতেন। একে স্টাফ অফ অ্যাসক্লেপিয়স বা অ্যাসক্লেপিয়ান বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে চিকিৎসা খাতের অনেক যায়গায় অ্যাসক্লেপিয়ান কে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার কর হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO সহ বিশ্বের বহু চিকিৎসা সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতীক হিসেবে স্টাফ অফ অ্যাসক্লেপিয়স ব্যবহার করে থাকে। তবে কিছু কিছু যায়গায় স্টাফ অফ অ্যাসক্লেপিয়স এর বদলে দেবতা হার্মেস এর বহনকৃত ক্যাজিউসিয়াস নামের দুটি সর্প পরিবেস্টিত একটি ডানাওয়ালা দন্ড ব্যবহার করতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে এটির চিকিৎসাখাতের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, বরঞ্চ ব্যবসা-বানিজ্যের প্রতীক এটি। অনেক সময় ভুল করে এটি চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বিশেষত উত্তর আমেরিকায়। স্টাফ অফ অ্যাসক্লেপিয়স কে কেবল একটি সাপ জড়িয়ে থাকে এবং এতে কোন ডানা নেই।
অ্যাসক্লেপিয়ান হাতে অ্যাসক্লেপিয়স
দেবতা হার্মেসের ক্যাজিউসিয়াস
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র লোগো
বোটানিতে Asclepias জেনাস বা গণ নামটি অ্যাসক্লেপিয়সের নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে, যে গণের সদস্যগণ সাধারণত মিল্কউইড নামে পরিচিত। এই গণের সদস্য সংখ্যা ১৪০। এদের থেকে পাওয়া যায় বেশ কিছু মসলা, প্রাকৃতিক রাবার ও ওষুধি।
আধুনিক ট্রিকালায় স্থাপিত অ্যাসক্লেপিয়সের ভাস্কর্য
তথ্য সূত্রঃ
উইকি
গ্রিক মেডিসিন ডট নেট
স্টারটিস্টিক্স সহ
বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ক্যাথেলিন লাইন্স সম্পাদিত "গ্রিক লিজেন্ডস"।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:০৭