খুব বেশীদিন আগের কথা না। গত বছর জানুয়ারীর ১৪ তারিখে আমার জীবন উলট পালট হয়ে যায়। বান্দরবানের থানচিতে সেই ভয়াবহ বাস এক্সিডেন্টে আমি আমার দুইজন সোউল মেইট হারাই। সেই এক্সিডেন্টে আমিও আহত হই। আমার দুই পা, মেরুদন্ড ভেঙে যায়। চোখ আর শরীরের ভিতরে ইন্টারনাল ব্লিডিং এ কাহিল হয়ে মুহুর্তের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর আমার আর কোন হুস ছিল না। চার-পাঁচ দিন পর যখন আবার মোটামোটি সুস্থ হয়ে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মোবাইল দিয়ে ফেসবুক আর ব্লগের এই ভার্চুয়াল জগতে ফিরে আসি তখন পুরাই বেকুব হয়ে যাই।
আমার মত একজন সাধারনের জন্য ফেসবুক আর ব্লগে এসব কি হচ্ছে। সামহোয়ারইন ব্লগে আমাদের এই এক্সিডেন্টের উপর একটা স্টিকি পোস্ট। সেখানে আমার শারীরিক অবস্থা একটু পর পর আপডেট করা হচ্ছে। আমার কখন রক্ত লাগবে, কত ব্যাগ রক্ত লাগবে, কে কে রক্ত দিবে তার সব কিছু...হাসপাতালে জানা আপু সহ কত জন ব্লগার যে দেখা করতে এসেছিল তাদের সবার নাম লিখলে আলাদা একটা পোস্ট হয়ে যাবে। ব্লগার দের সেই দোয়া আর ভালবাসার প্রতিদান দেওয়া দূরের কথা, সৌজন্যতার সুবাদে তাদের কখনো ধন্যবাদ ও জানাই নি। কারন সামুর পুরো পরিবার কেই আমি আপন মনে করি।
আর ফেসবুকের কথা তো আর বললামই না। আমি আজকে এই অবস্থায় বসে বসে যে লিখতে পারছি সেই জন্য ফেসবুকের অবদান ও অনেক। বান্দরবানের যেই ডাক্তার আমাকে প্রথম রক্ত দিয়েছিলেন উনি ফেসবুকেই আমার কথা জানতে পারেন। আর আমাকে সাহায্য করতেই হাসপাতালে ছুটে আসেন। এতদিন পর আজকে যখন এই ব্যাপার টা নিয়ে লিখলামই তখন আরেকজন এর নাম আমাকে নিতেই হবে। জাফর ভাই...উনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমাকে আর আমার পরিবার কে দিন রাত যে ভাবে সাহায্য করে গেছেন সেটা অকল্পনীয়। মাঝরাতে আমার জন্য রক্ত সংগ্রহ থেকে শুরু করে আমার বোনের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা পর্যন্ত সব দিকে উনার নজর ছিল। সেই জাফর বেইগ সেই সময় আমার শুধুমাত্র ফেসবুক বন্ধু ছিল।
স্যার, বিপদের সময় সবাই লাইক দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করে না।
দুই.
ধর্মীয় গোড়ামী অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু সেটা আমিও মানি। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি- মারামারি আর হানাহানি দেখলে শুধু আপনি না আরও অনেকেই আছে যারা কষ্ট পাই। প্রসঙ্গক্রমে বলিঃ
রামু আর রাঙামাটির ঘটনা টা নিয়ে আমি একটা স্ট্যাটাস লিখেছিলাম। সেটা পরে আমার ফ্রেন্ড লিষ্টের অনেকেই লাইক দেয়ার পাশাপাশি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। কিছু একটা করবে। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবে। তারই ফল স্বরুপ আমরা কয়েকজন শহীদ মিনারে মৌন অবস্থান নেই। আমাদের বিশ্বাস ছিল "মৌনতাই শক্তি". সংখ্যায় আমরা খুব বেশী ছিলাম না। আমাদের এই গুটি কয়েকজন গলায় প্ল্যাকার্ড আর পিছনে ব্যানার নিয়ে যে প্রতিবাদ করেছিল সেটা কোন মিডিয়ায় না আসলেও পুলিশ রিপোর্ট ঠিকই হয়েছিল। আর মিডিয়াতে আসবেই বা কেন? আমাদের মধ্যে আপনার মত কোন পাবলিক ফিগার ছিল না। তাই আপনি জানতেও পারেন নাই। ফেসবুকের অনেক গ্রুপ রামুতে ত্রান সহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগীতা নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল। অনাকাঙ্খিত আর অবিশ্বাসের সেই পরিবেশের মধ্য থেকেই তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গেছে নিঃস্বার্থে...তাদের কথাও মিডিয়াতে আসে নি। আর আসবেও না কোনদিন...কারন যারা দায়িত্ব পালন করে তারা পাবলিসিটি স্ট্যান্ট করে বলে আমার কখনই মনে হয় নি।
ধর্মীয় আর জাতিগত সহিংসতা নিয়ে আপনি সব সময়ই আতঙ্কে থাকেন। তাই হয়ত আপনার মনে হয় এই দেশের তরুন মাত্রই মৌলবাদী হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আপনার উচিৎ এখনই ব্লগ আর ফেসবুকে বিনামূল্যে একটা একাউন্ট খুলে ফেলা। তাহলে আপনি দেখতে পারবেন, পাকিস্থানে আমাদের ক্রিকেট টীমের সফর বাতিল করার জন্য এই ফেসবুক থেকেই কতজন রাস্তায় নেমে গেছে। কতজন মানুষ নিজেদের উদ্যোগে উত্তরাঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরন করে যাচ্ছে। কতজন মানুষ নিজেদের টাকা খরচ করে দূর্গম দ্বীপে একটা স্কুল খুলেছে। এইসব খবর আপনি ইজি চেয়ারে বসে পেপারে পড়তে পারবেন না।
তিন.
কয়েকদিন আগে আমার জন্মদিন ছিল। আমাকে অবাক করে দেয়ার জন্য কয়েকজন প্রিয় মুখ কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেসনে আমাকে জন্মদিনের সারপ্রাইজ দেয়। কেকের সাইজ দেখে আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থাঃ এক পাউন্ডের ছোট্ট একটা কেক। আর যেটা দেখে আমি সত্যি সত্যি ভিরমি খেয়েছি তা হল ছোট্ট একটা কেকের উপর এতদিন দুনিয়ায় কাটানো পুরো ২৫ বছর এটে গেছে। না তারা কেউ ছোট্ট একটা কেকের উপর ২৫ টা মোমবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করে নাই। কেকের উপর মাত্র দুটা মোমবাতি ছিল। ২ আর ৫ ...এই দুটা সংখ্যা দিয়েই তারা পঁচিশ লিখেছিল। যদি এতদিন বেঁচে থাকি তাহলে আমি ছোট্ট কেকের উপর দুই সংখ্যা দিয়ে ৬০ লিখা চাই। চারপাশের অন্ধকার হয়ত দূর হবে না। তবে আমি ঠিকই কেকের উপর লিখা টা পড়তে পারব।
স্যার বিনয়ের সাথে আপনাকে একটা প্রশ্ন করছিঃ আমাদের দেশে প্রতিদিনই নানা রকমের অরাজকতা হচ্ছে। আপনি এসব নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখিও করেন। প্রতিদিন পেপার খুললেই আপনি নিশ্চয়ই পড়েন, আজকে মেয়ে কে ধর্ষন করা হচ্ছে, সীমান্তে কতজন বাংলাদেশীকে আজকে বিএসএস গুলি করে মারলো, পদ্মা সেতু নিয়ে কি হচ্ছে না হচ্ছে, কিভাবে অসম্প্রদায়িক ছাত্র শক্তির হাতে বিশ্বজিতের সাদা শার্ট লাল হয়ে গেল...
এসব পড়ে কখনো কি আপনার মনে হয় নি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করি? আপনি রাস্তায় নামলে আপনার ছাত্র আর ভক্তদের দিয়ে কি সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত না? যারা আপনার জন্য ৬০ টা মোমবাতি নিয়ে আসে তাদের ৬০ জন কে কি আপনি সাথে পাবেন না? কসমোপলিটান, অসম্প্রদায়িক আর মানবিক শক্তি কি আপনার জন্যই একজোট হতে পারত না? আর কেনই বা আপনি আপনার এই জনপ্রিয়তার ব্র্যান্ডিকে কর্পোরেট এর মত ইউজ করছেন? সুখী-সমৃদ্ধ আর বিজ্ঞানমনষ্ক বাংলাদেশ গড়ার যেই স্বপ্ন আপনি দেখেন আর দেখান, সেই স্বপ্নের প্রতি আপনার দায়িত্ববোধ কি তাহলে প্রথম আলোতে একটা কলাম লিখেই শেষ হয়ে যায়?? তাহলে আপনার আর আমার মত যারা ফেসবুক-ব্লগে লাইকবাজি আর চোপাবাজি করে বেড়াই তাদের মধ্যে পার্থক্য টা কি রইল??
স্যার, আমি বিশ্বাস করি- লুমেন যদি জাতের হয়, তাহলে একটা মোমবাতি দিয়েই অন্ধকার দূর করা সম্ভব। আপনার জায়গায় আমি হলে সেই ৬০ টা আলাদা মোমবাতি গলিয়ে একটা বিশাল মোমবাতি বানানোর চেষ্টা করতাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:১৯