...ঘুম ভাঙ্গলো চরম ঠান্ডায়। ঢাকায় যখন গরমে প্রান ওষ্ঠাগত তখন শীতের ঠ্যালায় ঘুম ভেঙে গেছে, বিশ্বাস হয়?? কাঁপতে কাঁপতে খেয়াল করলাম কে জানি আমার কম্বল টান দিসে।আমিও ফিরতি টান দিয়ে কম্বল উদ্ধার করে আবার ঘুম দিলাম। ৫টার এল্যার্ম দেয়া হইসিলো, সবাই উঠতে উঠতে সাড়ে ৬টা। মাঁচায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তন্দ্রার মত চলে আসছিল, কি যেন ভাবতেছিলাম এখন ঠিক খেয়াল করতে পারছিনা। হঠাৎ কেন জানি চমকে উঠলাম, হাত থেকে দাঁতের ব্রাশ নীচে পড়ে গেল, মুখ ভর্তি ফেনা নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম আমার দাঁতের ব্রাশ নিয়ে দুটা শুকর কাড়াকাড়ি শুরু করছে। ট্রিপ টা খুব জব্বরভাবে শুরু হইসে, প্রথমে হারাইলাম স্যান্ডাল, এখন দাঁতের ব্রাশ- এখন পুরা জংলি হয়ে গেলাম। সামনে কি অপেক্ষা করছে আল্লাহই জানে...
শুকনা চিড়া-গুড় মুখে পুড়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাকলাই পাড়ার উদ্দেশ্যে। jhijjঝিড়ি ধরে আমরা হাটা শুরু করলাম। খালি পায়ে ঝিড়িতে হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। নুড়ি পাথর গুলা পায়ের পাতায় বিঁধতে ছিল। পিচ্ছিল এক বোল্ডার গুলা পার হতে গিয়ে খাইলাম আছাড়। দুই পাথরের ফাঁকে পা আটকে গেল। হাঁটুর চাকতি ফুলে আলু হয়ে গেল। পিছনে থেকে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না, যত কষ্টই হোক, হাটঁতে হবেই। কিছুক্ষন হাঁটার পর ব্যাথা ভুলে গেলাম এই ঝর্না টি দেখে-
কিছুক্ষন পর আমরা পৌছে গেলাম কাইথং পারায়। তাড়াতাড়ি চুলা বের করে কফির পালা শেষ করেiiiই আবার হাটা ধরলাম। ঝিড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই শর্টকাট নেয়ার জন্য পাহাড়ে উঠে যেতে হয়, আবার নেমে যেতে হয়। ঝিড়ি অনেক সময় প্যাচানো থাকে, ঝিড়ি দিয়ে হেটে গেলে অযথাই বেশ ঘুরতে হয় (বগা লেকের ঝিড়ি ট্রেইলে যারা ট্রেক করেছেন তারা ব্যাপার টি বুঝতে পারবেন)। তো কিছুদূর গিয়ে আমরা ও কেমন ই এক পাহাড়ে উঠে গেলাম। প্রায় ২০০ফুট উঠে যাবার পরেও নামার কোন পথ দেখা যাচ্ছিলো না। বুঝতে পারলাম আমরা রাস্তা ভুল করে ফেলেছি। পুরো টীম নেমে গেল, আমরা তিন জন আর নামলাম না। পাহাড় ডিঙিয়েই যাব। রাস্তা নি থাকলে রাস্তা করে নিবো। সাথে আছে মাইনুল ভাই, তাই কোন চিন্তা নাই।
- "আমরা যদি বাক্লাই একদিন পরে পৌছাই কিংবা যদি নাই পৌছাই তাইলে কোন সমস্যা আছে???"
- না ভাই, চলেন হাঁটা দেই।
বুক ফুলায়া বলে তো দিলাম চলেন হাঁটা দেই, এদিকে পায়ের অবস্থা ১২টা। আমরা যে রাস্তা দিয়ে হাটছি এটা আসলে শিকারীদের রাস্তা। ২-৩বছর আগে হয়ত জুম চাষ হয়েছিল। এখন পুরো জঙ্গল হয়ে গেছে। লজ্জাবতীর কাঁটা ফুটে পায়ের পাতা রক্তারক্তি। এখন না পারি সহ্য করতে আর না পারি কিছু বলতে। পুরো রাস্তার বর্ননা দেয়া আমার সাধ্যের বাইরে। তিন টা নব্বই ডিগ্রি খাড়া ক্লিফ নামতে হয়েছিল। একটা ক্লিফ গাছের ডাল ঝুলে নেমে গেলাম। আর একটা প্রায় ৫০ফুটের ক্লিফ নামার জন্য gacheগাছে রশি বেঁধে নেমে গেলাম, এটাই আমার প্রথম রক ক্লাইম্বিং।বেশ থ্রিলিং ছিল অভিজ্ঞতা টা। এরপর শুধুই নেমে যাওয়া, ছনের ক্ষেতে লাফ দিয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছিলাম। ছনের ধারাল পাতায় হাত পা কেঁটে যাচ্ছিলো। প্রায় ২ঘন্টা পাহাড়ের সাথে যুদ্ধ করে ঝিড়িতে পৌছে গেলাম। আহ- শান্তি। এর চেয়ে আরামের আর কিছু হতে পারে না। আধা ঘন্টা রেস্ট নিয়েই আবার উঠা শুরু করলাম। আমাদের এখন টার্গেট বাকী টীমের আগেই বাকলাই পৌছে যাওয়া। বাকলাই পারা একটি উঁচু ক্লিফে অবস্থিত। পাশেই বেশ বড় একটি আর্মি ক্যাম্প আছে। আর্মি ক্যাম্পকে পাশ কাটিয়ে পারায় উঠে যেতে হবে। আর্মিরা অযথাই অনেক বিরক্ত করে। উঠতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। হাঁটু টনটন করছিল। কিছুক্ষন পরপরই রেস্ট নেয়ার জন্য থেকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু দূর উঠেই দেখলাম আমাদের বাকী টীম রেস্ট নিচ্ছে। বিকালের আগেই আমরা বাক্লাই পৌছে গেলাম। পাহাড় চূড়ায় চমৎকার একটি পারা। পারা ঘুড়ে দেখার মত পায়ের অবস্থা তখন ছিল না। বাঁশের একটি বেঞ্চের উপর শটান শুয়ে পায়ের চিকিৎসায় লেগে গেলাম।
নুড্যুলস খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের বেস ক্যম্প বাকলাই পারার একটি জুম ঘর। পারা থেকে প্রায় ঘন্টা খানেকের পথ।জুম ঘর টা ঠিক বাকলাই ঝর্নার বিপরীতে। এখান থেকে ডাটা সংগ্রহের কাজ করতে সহজ হবে।পারা থেকে সাথে নিয়ে নিলাম সবার জন্য কম্বল, একটা মোরগ আর পানির জেরিক্যেন। জুম ঘরে পানির কোন সোর্স নাই। পানি আনতে হলে আবার এক ঘন্টার হাটা পথ।তাই বুঝে শুনে খরচ করতে হবে, এক কথায় পানির রেশনিং-প্রতি ঢোক পানির জন্য জবাবদিহি করা লাগবে।
হাটতেসি তো হাটতেসি, জুম ঘর আর আসে না। এদিকে সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার নেমে আসল। শেষ পর্যন্ত আশার বানী শুনতে পারলাম- "এখন শুধুই নেমে যাওয়া"
যারা পাহাড়ে ট্রেক করেন তাদের কাছে এই "নেমে যাওয়া " শব্দটা বেশ পছন্দের। যদিও পাহাড়ে উঠার চাইতে নামতে একটু কষ্ট বেশী ই মনে হয়।
বাকলাই জুমের ঐ নামা আমার আজীবন মনে থাকবে। অন্ধকারে চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। শুধু মাইনুল ভাইয়ের টর্চের আলো ফলো করে যাচ্ছি। শুধুই খাঁড়া নেমে যাওয়া, প্রতিটা ডাল প্রায় ৭০ ডিগ্রিত মত। পাশে খাদ আছে না কি আছে সেটা ও দেখতে পাচ্ছিলাম না।একজন খাদের পড়ে গেল, আল্লাহর রহমতে বাশঁ গাছে সাথে আটকে গেছিলো। নামার সময় প্রায় ৭৪কেজির ওজন আমার হাঁটুতে পড়ছিল। একটু থাকলেই হাটূ কাপাঁর ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো থামলেই পড়ে যাব। তাই দৌড়ে দৌড়ে নেমে গেলাম। আধা ঘন্টার পর খাঁড়া নেমে যাবার কষ্ট শেষ হল। টর্চের আলোয় যখন একটা জুম ঘরের আদল ভেসে উঠল- এত খুশি শেষ কবে হয়েছিলাম মনে করতে পারব না। আমার পা তখন আর আমার সাথে নাই।ঘামে ভেজা টি-শার্ট টা খুলে মাচায় শুয়ে পড়লাম.........।
এক্টু রেস্ট নিয়েই সবাই রান্নার কাজে জুটে গেলাম। মোরোগ কাটা, পেঁয়াজ কুচিকুচি করে কাটা, জুম থেকে মরিচ, ধনে পাতা ছিড়ে আনা, চুলা জ্বালানো....। পাহাড়ী শুকনা মরিচের গূড়া একটু মনে হয় বেশীই পড়ে গেছিলো তরকারীতে। পানি রেশনিং এর জ্বালায় মন মত খেতেও পারলাম না। পুরা খাদ্যনালী তখন দাউ দাউ করে জ্বলতেসে।
পায়ের ব্যথা আর পেটের জ্বালা নিয়ে মাচায় শুয়ে পড়লাম। একদিকে বাকলাই ঝর্নার গর্জন আরেক দিকে আকাশে তারার মেলা। ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড ইফেক্টের সাথে কালপুরুষ আর সপ্তর্ষীর খেলা দেখতে দেখতে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমায় পড়লাম......।
সকালে উঠে যা দেখলাম
এটাই সেই জুম ঘর যেখানে জীবনের শ্রেষ্ঠ ২রাত কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল
জুম ঘর ২
জুম ঘর ৩
জুম ঘরের উপরে মেঘের নাচন
জুম ঘরের মাচা থেকে দেখা যাচ্ছে অতিকায় বাকলাই ফলস
বাকলাই ফলস ১
বাকলাই ফলস ২
বাকলাই ফলস ৩
[চলবে]
2924সর্বোচ্চ জলপ্রপাতের খোঁজে [পর্ব এক]- Click This Link