টানা ৭ দিন এই জং ধরা শহরে থাকলে আমার দম আটকে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে, চোখে কিছু দেখি না, মন বসে না পড়ার টেবিলে।।এক কথায় মন আনচাল করে। সবসময় মন উড়ুউড়ু করে, কবে একটু ছুটি পাব আর দৌড় দিব পাহাড়ে, জংগলে,নদীতে না হয় সাগরে...। কিন্তু মন যা চায় সবসময় তা হয় না- একদিকে সময়ের টানাটানি আর একদিকে পকেটের ফোঁপানি। ২দিনের জন্য কই যাওয়া যায় ?? টাকাও যেন খুব কম লাগে? অনেক চিন্তা করে বের করলাম সিলেটেই যাই...আবার। সিলেটে বন আছে, পাহাড় আছে আবার লেকও আছে। একই জায়গায় সব...পুরা প্যাকেজ। খরচ কমাতে হবে তাই বাংলাদেশ রেলওয়েই ভরসা। ঢাকা-কুলাউড়ার টিকেট কাটলাম ১২০টাকা করে। রাত ১০টার ট্রেন ছাড়ল ১০.৪৫মিনিটে। ট্রেন লেট হলেও সমস্যা নাই আমাদের, যত লেট হয় ততোই ভাল। কারন হোটেলে থাকার মত টাকা নাই পকেটে। ট্রেন কুলাউড়া পৌছানোর কথা রাত ৩টায়, সেটা পৌছালো রাত ৪টায়। এখন ৩ ঘন্টা পাড় করতে হবে, স্টেশনে।সকাল ৭টার আগে মাধবকুন্ড যাওয়ার কোন বাস নাই। কি আর করার, বসে গেলাম টুয়ান্টি-নাইন খেলতে। কাপের পর কাপ চা খেতে খেতে, ট্রেনের ঝিকঝিক আর মশার ভন ভন শব্দ শুনতে শুনতে রাত পার করে দিলাম।
কুলাউড়া রেলস্টেশন, রাত ৪টা
কুলাউড়া রেলস্টেশনের ফুট ওভার ব্রীজ, রাত ৪.৩০টা
কুলাউড়া খুব ছোট আর ছিমছাম শহর। একটাই মেইন রোড। সকালের নাস্তা শেষ করেই উঠে বসলাম মুড়ির টিনে। উঠে তো বসলাম মাগার পা তো রাখতে পারি না। অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হল না, শেষ পর্যন্ত না পারতে বাসের ছাদে উঠে গেলাম। এক চাচা মিয়ার সিলোটি গান শুনেতে শুনতে মাধবকুন্ড যাওয়ার মোড়ে নেমে গেলাম (জায়গা টার নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না, খুব সম্ভবত কাঠাল বাজার বা এই রকম কিছু )।যাই হোক, এখান থেকে cng করে মাধবকুন্ড যেতে হয়। ভাড়া ১২০টাকা, আগের বার ১০০টাকা ছিল। এইখানে cng দের সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী, তাই দরাদরি করে বিশেষ লাভ হয় না। ২০ থেকে ৩০ মিনিটেই পৌছে গেলাম মাধবকুন্ড। এত সকালে কেউ আসে নি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত দেখতে। কোন যান্ত্রিক কোলাহল নেই, একদম নির্জন, শুধু মাত্র দূর থেকে ভেসে আসা পানি পতনের গর্জন আর পাখির কলরব। প্রকৃতির সৌন্দর্যের বর্ননা দেয়া আমার পক্ষে খুব কঠিন। আমি প্রকৃতিকে যেভাবে দেখি ঠিক সেভাবে কোনদিন লিখে প্রকাশ করতে পারব না। এর ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।
পথে পথে চলতে চলতে
সামনেই জলপ্রপাত
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত- মাধবকুন্ড
জলপ্রপাতের পানি এভাবেই বয়ে চলে ছড়া হয়ে
মাধবকুন্ডের কথা সবাই জানে, কিন্তু এর পাশেই যে আর একটা ফলস আছে এটা আমরা অনেকেই জানি না। এই ফলস এর নাম পরীকুন্ড। ছোট হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে এটা ও কোন অংশে কম না। বিশেষ করে পরীকুন্ডে যাওয়ার ট্রেইল টা অসম্ভব রকমের সুন্দর। পরীকুন্ড যাওয়ার রাস্তা টা বাইরে থেকে দেখা যায় না। মন্দির টার ঠিক বিপরীত দিকে একটা ট্রেইল আছে। মাধবকুন্ডের পানির ছড়া টা পাড় হলেই এই ট্রেইল টা দেখা যাবে। পানি আর ছোট ছোট নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে হাটা লাগবে। এখানকার পাথর গুলো অনেক পিচ্ছিল, তাই খুব সাবধান।
পরীকুন্ডের পথে
পরীকুন্ড ট্রেইল
পরীকুন্ড
উত্স থেকে চারিদিক
উপর থেকে জলপ্রপাত
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত টা পুরোটাই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। চারিদিকের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পাহাড়ী ঘড় বাড়ী। দেখতে খুব সুন্দর লাগে। জলপ্রপাতের উত্তস খুজঁতে পাহাড়ে উঠা শুরু করলাম আর সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। পাহাড়ী পথ কাদা হয়ে গেলে উঠতে খুব কষ্ট হয়। বারবার আছাড় খাওয়ার ভয় থাকে। মাধবকুন্ডর উতস খুব বেশী উচুতে না। মাত্র ২০০ফুট। তাই উঠতে বেশীক্ষন লাগল না। উপর থেকে ভয়াবহ সুন্দর লাগে জলপ্রপাত। মানুষ গুলোকে লিলিপুট মনে হয়। খেয়ালী পাহাড়ী বৃষ্টি নিমিষেই গায়েব। পাহাড় থেকে নীচে নেমে তাড়াতাড়ি লাফালাফি করে নিলাম। কখন যে ঘড়িতে ২টা বেজে গেল টেরই পাইনি। তাড়াতাড়ি করে cng ড্রাইভার কে ফোন দিলাম, ড্রাইভার আসার ফাঁকে লাঞ্চ সেরে নিলাম। তারপর আবার সেই কাঠাল বাজার। পাক্কা ২০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কোন বাস আসল না। এদিকে আমাদের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে, শ্রীমংগলের ট্রেন ধরতে হবে। সিলেট থেকে ট্রেন ৩টায় ছেড়ে আসে, কুলাউড়ায় ৪টার দিকে পৌছায়। কুলাউড়া থেকে শ্রীমংগলের ভাড়া মাত্র ২০টাকা। টাকা বাচাঁনোর জন্য এত দৌড়াদৌড়ি। শেষ পর্যন্ত একটা টেম্পু আসল। সেটায় চড়েই কুলাউড়া বেল স্টেশন পৌছে দেখি ট্রেন প্রায় ছাড়ে ছাড়ে অবস্থা। টেম্পুর ভাড়া দিতে দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। টিকেট না কেটেই সবাই ট্রেনের পিছন পিছন দৌড়। সবার শেষে আমি দিলাম ফিল্মের হিরোর মত লাফ। উফফফ...
পরের পর্বে বাংলার রানী শ্রীমঙ্গল।