বিশেষ করে সামনে পরীক্ষা থাকলে ত আর কথাই নাই, পড়া বাদ দিয়ে সারাদিন শুধু প্লান করি...এইবার কই যাওয়া যায়, কিভাবে আর একটু রোমাঞ্চ আনা যায় এই জীবনে...
গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে থিউরি পরীক্ষার পর ৭দিন ছুটি পাইলাম। এরপর ল্যাব পরীক্ষা। একটা পরীক্ষা ও ভালো হয় নাই, মন পড়ে ছিল বান্দারবানের কোন এক পাহাড়ের কোনে। ৭দিন ছুটি পাইয়া মন আন-চান কইরা উঠল। আর থাকতে পারলাম না। কোন কিছু চিন্তা না কইরাই আমরা ৬জন রওনা দিয়া দিলাম বান্দারবানের কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে।
পরদিন ভোরে ইউনিক এর বাস আমাদের বান্দারবান নামায় দিল। এখন কই যাওয়া যায়... বগা লেক??...কেওক্রাডাং??...উহু...এইবার আর এই ট্রেইলে যাইতে ইচ্ছা করতেসে না। গত ২ বছরে ৫বার কেওক্রাডাং সামিট করসি, আর কত? চল এইবার তাজিনডং (তাজিনডং কিন্তু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পিক না) সামিট করে আসি।...চিন্তা কে আর বেশি প্রশয় না দিয়া থানচি যাওয়াই ঠিক করলাম। আমার এক বন্ধু এই প্রথমবার বান্দারবান আসছে, তার খায়েশ যাওয়ার পথে চিম্বুক, নীলগিরি আর শৈলপ্রপাত দেখবে তাই ধুমধাম চোপাবাজী কইরা ২৮০০ টাকায় একটা চান্দের গাড়ি রিসার্ভ কইরা ফেললাম।এত টাকা দিয়া রিজার্ভ করতে খারাপ লাগতেসে কিন্তু কিছু করার নাই, লোকাল চান্দের গাড়ীতে চড়লে এই স্পট গুলা আর দেখা যাইত না। তবে মজা কিন্তু লোকাল চান্দের গাড়ীর ছাদেই...
চিম্বুক, নীলগিরি আর শৈলপ্রপাত দেখে থানচি তে যখন পৌছলাম তখন শেষ দুপুর। পথ যে কিভাবে শেষ হয়ে গেল টের ও পাই নাই। পরীক্ষার জন্যে গত ১ সপ্তাহ ঘুমাইতে পারি নাই, কালকের রাত টাও বাসে শয়তানি করে পার করসি, তাই কখন যে ঘুমায় গেসি টের ও পাই নাই।
দুপুরের খাওয়া শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে গেল। এখন আর তাজিন্ডং এর দিকে ট্রেক করা টা সেফ হবে না। এমনিতেই শীতের সময়, একটু পর ই রাত ঘনায় আসবে। আজকের রাত টা থানচি তে থাকতে একটু ও ইচ্ছা করতেসে না আমাদের। হঠাত খেয়াল হইল...আরে থানচি থেকে ত তিন্দুতেও যাওয়া যায়। এইখানে আমরা কেউই যাই নাই। জায়গাটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানিও না। অনেকদিন আগে একটা আর্টকেল পড়সিলাম ডেইলি স্টারে। তখন ছবি গুলো দেখে আমার বিশ্বাস হয় নাই যে এটা আমার বাংলাদেশ।
তিন্দুতে যাওয়ার জন্যে খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম। বাজারে ঘুরে ঘুরে ২টা মাঝি ও ঠিক করে ফেললাম। কিন্তু বাধা দিল সেইখান কার বিডিআর। তারা কিছুতেই আমাদের পারমিসান দিবে না। আর এই দিকে আমরা ও নাছোড় বান্দা ...যাই হোক যাবই। বিডিআর এর পারমিসান ছাড়া যাওয়াও যাবে না। তারা অনেক চেষ্টা করসে, শান্তির লোমহর্ষক অনেক কাহিনী শুনাইসে...কিন্তু কোন লাভ হয় নাই...আমরা যাবই। শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হইল পারমিসান দিতে...আমরা রওনা দিয়ে দিলাম তিন্দুর উদ্দেশ্যে...
থানচি বাজার
খরস্রোতা সাংগু
উজানের দিকে উঠছি
নদীর গভীরতা সব জায়গায় সমান না। কোথাও পানি হাটু পর্যন্ত, কোথাও বা ৪০ ফুট এর মত গভীর। পানির মধ্যে ছোট-বড় অনেক পাথর। বার বার আমাদের নৌকা পাথরের মধ্যে তীব্র ভাবে ঘষা খাচ্ছিলো। এইবুঝি নৌকা উল্টায় গেল...
মাঝে মাঝেই নৌকা বড় পাথরের খাঁজে আটকে যায়। তখন এভাবেই মাঝি টেনে জায়গাটা পার হয় আর আমরা নদীর কনকনে ঠান্ডা পানি পাড়িয়ে সামনে আগাই।
তীব্র স্রোত আর কনকনে ঠান্ডা পানিতে হাটা মোটেও আরামদায়ক কিছু না...তার উপর আবার শেওলা পরা পাথর
প্রকৃতির অপার রুপ উপভোগ করতে করতে পথেই সন্ধ্যা নেমে গেল। সেই সাথে বাড়তে থাকল ঠান্ডা। হু হু সাইবেরিয়ান জেট এর মাঝে পাইলাম নিজেদের।হাত পা পুরা জমে গেসে।
কখন যে রাত ৮টা বেজে গেসে টের ও পাই নাই। শেষ পর্যন্ত আমরা পৌছে গেলাম তিন্দু। দূর পাহাড়ে আগুন জ্বলতেছিল। মাঝিরা বলল এটাই তিন্দু বাজার, আপনার সামনে আগান, আমরা নৌকা বাইধা আসতেসি। ঘুট ঘুটা অন্ধকার। আকাশে চাঁদ তারা কিছু নাই। সামনে শুধু একটা অগ্নিকুন্ড, এটাকেই স্থির করে আমরা সবাই এক লাইনে হাটা দিলাম। আমি মোহাবিষ্টের মত আগুনের দিকে তাকায় ছিলাম। হঠাত একটা তীব্র চিতকারে চমক ভেঙ্গে গেল। আশপাশে তাকায় দেখি কেউ নাই। আমরা ৬জন ৬ দিকে চলে গেসি। চিতকার করে একজন আরেকজন কে ডাকলাম। একটু ধাতস্ত্ব হয়ে দেখলাম মাহফুজ একটা ঝিরির তীব্র স্রোতের ঘূর্নিতে পড়ে গেসে।
শেষ পর্যন্ত আমরা গ্রামে এসে পড়লাম। সেখানের মহিলা মেম্বারের (ইউনিয়ন পরিষদ) বাসায় রাতে খাওয়ার ও থাকার ব্যবস্থা করলাম। এইদিকে আমাদের হাতুর নিচ থেকে সব জমে গেসে। বরফের পানিতে হাটতে হইসে। আর এত্ত শীত...মরে যাওয়ার মত অবস্থা। কোনমতে রাতের খাওয়া শেষ করে যত্ত কাপড় নিয়ে আসছিলাম সব গুলো পড়ে এক পাইট এক-চোলাই মেরে ঘুমায় গেলাম। সারারাত শৈত্যপ্রভাহের অত্যাচারের হাত থেকে চোলাই এর কল্যানে বেঁচে গেলাম।
মেম্বারের ২তলা বাড়ী। আমরা রাতে চিলেকোঠায় ছিলাম
ভোরেই আমরা রওনা দিলাম, রাজা পাথর দেখতে। কুয়াশায় ঢাকা পুরো উপত্যকা। কি যে অপরূপ লাগছিল, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা আমার কম্ম না। অনেকবার বান্দারবান আসছি। এমন কিছু দেখি নাই। এটা কি আসলেই বাংলাদেশ ?? মন্ত্রমুগ্ধের মত এর রূপ শুধু আশ্বাদন করে গেছি।
পাথুরে রাজ্য ১
পাথুরে রাজ্য ২
বাংলার রূপ
নদীর মাঝে বিশাল বিশাল পাথর। এর ফাঁক দিয়েই এগিয়ে চলা
পাথুরে রাজ্য ৩
এমন জায়গা দেখলে কি আর স্থির থাকা যায়??
মনে হয় দেশের কোথাও আছি?
রাজা পাথর
এটাই জীবনের আসল মানে
জইমা গেলাম
এই উপত্যকায় একটা ঘর বানাইতে মনচায়
পাথুরে রাজ্য ৪
ডায়নাসোর এর মেরুদন্ড লাগতেসে??
ট্রেকিং 101
এই হইল তিন্দুর কিছু ছবি। তিন্দু থেকে আমরা রেমাক্রি গেসিলাম। রেমাক্রি অভিযান এর কথা এর একদিন বলব...আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।
কিভাবে যাবেন তিন্দু (বাংলার ভূ-স্বর্গ)