প্রতিদিনের মত আজকের সূর্য্য মাথার উপর চলে এসেছে। আজ সূর্য্য মামা মনে হয় রেগে আছে। ডিউটিতে আসার আগে মামীর সাথে একপ্রস্থ ঝগড়াঝাটি হয়ে গেছে সে তার উত্তাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রোদটা যেন খাড়াভাবে পৃথিবীর উপর পড়েছে। গাছের ছায়ায় বসা পীরালী ফকির ঘামে একদম ভিজে গেছে। ময়লা গামছাটা মেলে সে মুখ মুছে নিল। আকিকার দিন বাপে জোড়া খাসি জবাই করে নাম রেখেছিলেন পীর আলী। পীর মানে যে শিক্ষক এটা পীরালি কি তার বাবা কোনদিনই জানতো। তার বাপের ধারণা ছিলো পীর মানে আল্লাহর ওলি টাইপের কিছু একটা। জানলে কি কেউ দুই খাসি জবাই করে নাম রাখে শিক্ষক আলী! কালের ঘূর্ণিচক্রে পড়ে সেই নামটা আজ মানুষের মুখে হয়ে গেছে পীরালী। পেশা তার ভিক্ষাবৃত্তি। চার রাস্তার মোড়ে বড় শিরিষ গাছটার নিচে তাকে প্রায়ই দেখা যায়। সুর করে গজল গায়, মানুষকে আখিরাতের লোভ দেখিয়ে আল্লা-রসূলের নামে ভিক্ষা মাগে। আমি মানুষটা বড়ই লোভী। সওয়াবের আশায় পকেটের সিকি আধুলি তার প্লেটে ছুঁড়ে দেই। টিনের থালায় ঠকাস করে শব্দ হয়। পীরালী চোখ তুলে তাকায়। পান্ডুর সেই চাহনী দেখে বুঝতে পারিনা সে খুশী হল কিনা। পীরালী হাঁটতে পারে না। পঙ্গু দেহটা নিয়ে সে সাইকেলের চাকা লাগানো গাড়িটাতে চড়ে বসে। হাবিবুল্লা নামে একটা ছেলে সেই গাড়িটা ঠেলে আনে প্রতিদিন। হাবিবুল্লা পিরালির ড্রাইভার কাম হেলপার সবকিছু। দুজনের মাথায় ময়লা রঙের সাদা টুপি। পিরালী গাইতে গাইতে থেমে গেলে হাবিবুল্লাহ তার সুর ধরে, ‘বলো আল্লা-নবীজির নাম’। ছেলেটার গলা চমৎকার।
নামের মত পীরালীর জীবনটাও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে দিনদিন। কেন জানিনা এই গ্রীষ্মের দুপুরে আজ পেছনের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। বড় সুখের ছিল সেই দিনগুলো। আর দশজনের মত তারও ছিল দুখানা সবল হাত, বলিষ্ঠ পা। বড় বড় পা ফেলে গ্রামের মাঠে সে হেঁটে যেত। কৈশোরে সেই পা নিয়েই সে দোস্তদের সাথে হাডুডু খেলেছে সরদারদের বড় খোলেনে। বাপের কাছ থেকে পাওয়া বিঘে খানেকজমি ছিল। যৌবনে সেটাতে চাষ দিয়ে সে সোনার ফসল ফলাত। সোনা রঙের পাকা ধানে মাঠ ভরে যেত। সেই দৃশ্য দেখে পীর আলীর বুক আনন্দে নেঁচে উঠতো। কয়েক বছর ভেতরে ঋণ-পান শোধ করার পরেও হাতে বেশ টাকা জমলো। পাশের গ্রামে বিয়ে করলো। ঘর তার আলো করে রেখেছিল পরীর মত নতুন বউ। বউয়ের নামও পরী। প-য়ে প-য়ে মিল থাকায় এক মেঠো কবি সেটা নিয়ে কবিতা বাঁধলো। কিন্তু গাঁয়ের লোকে সে কবিতা খেলো না। কবি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে নতুন কবিতা বাঁধার চেষ্টা করতে লাগলো। পীরালী মাঠ থেকে গৃহে ফিরে দেখত নতুন বউ তার জন্য ভাত নিয়ে অভূক্ত অবস্থায় বসে আছে। মাথায় এক কোশ সরিষার তেল ঢেলে দুহাতে ঢেউ দিয়ে পুকুরের পানা সরিয়ে ফস করে গা ধুয়ে আসে সে। ছোট্ট রান্নাঘরে পিঁড়ে পেতে দুজনে খেতে বসে। বউ পিরালির শানকিতে ভাত বেড়ে দেয়। আজ বউ কাঁচকি মাছ দিয়ে রান্না করেছে আলু দিয়ে। বউয়ের হাতে রান্না কাঁচকি মাছ যেন অমৃত। পীরালী আয়েশ করে খায়। রাত গভীর হলে পশ্চিম বিলে যখন ধবধবে জ্যোৎস্না নামে তখন তারা দুজন ফিসফিস করে গল্প করে। আশেপাশে কোন প্রতিবেশী নেই। শুনে ফেলার মত কেউ ছিল না। তবু তারা ফিসফিসিয়ে গল্প করত। যেদিন সে জানতে পারে নতুন বউ পোয়াতি হইছে তার মনে শালিক খালী নদীতে যেমন জোয়ারের বান ডাকে ঠিক সেরকম আনন্দের ঢেউ জাগলো তার মনে। মনে হল পৃথিবীর সব সুখ নেমে এসেছে তার চালা ঘরে।
সুখ কখনো পীরালীর সাথে বেশীদিন সহবাস করেনা। এবারও করল না। দেশে শুরু হল যুদ্ধ। তারা বলত গন্ডগোল। শেখ সাহেব আর ভুট্টো সাহেবের মধ্যে গদি নিয়ে গন্ডগোল। গ্রামে গ্রামে খান সেনারা এসে তাম্বু গাড়ল। খানেরা সব উচু তাগড়া জোয়ান। ভাত খায় না। গোস্তের ঝোলে রুটি ডুবিয়ে খায়। পীরালিরা আগে যুদ্ধ-টুদ্ধ কোন দিন দেখে নি। গ্রামের বৃদ্ধরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলে। সেও তাদের দেখা নয়। শোনা কথা।
গ্রামের চেয়ারম্যান শান্তি বাহিনীর হেড হয়ে গেল। সবাইকে সে পরামর্শ দিল তৈরী থাকতে। ‘পবিত্র এসলামের জইন্য, এসলামের জোলুশ বাড়ানির জইন্য খুব শীঘ্রি মালাউনগো বিরুদ্ধে জিহাদ করা লাইগবো। যারা পবিত্র পাকিস্তানের বিরুদিতা করে তারাও মালাউন, ফরজে কতল। তাগোও মাইরে ফেলতি হবে’। পীরালীর পড়ালেখা ছিল না। দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম বা ক্ষমতার লড়াই এসব তার বুঝে আসার কথা না। মাঝে মাঝে বোঝার সে চেষ্টা করে। আশ-পাশের গাঁ-গ্রামে খান সেনাদের কথা সে শুনেছে। কথা নেই বার্তা নেই ঠুস করে গুলি করে মারছে। পাকবাহিনীর নৃশংসতা তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। ইচ্ছে করছে ধান কাঁটা এই কাঁচি দিয়ে পাকি গো দ্বিতীয়বার সুন্নতে খাৎনা দিয়ে দিতে। সপ্তাহ না পেরোতেই তার গ্রামেও এল খান সেনা। মানুষ খুব ভয় পেল। জোয়ান বুড়োরা সব ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে লাগল। মাথার উপর প্লেনের বোঁ বোঁ শব্দ শুনলে প্রাণ লাফ দিয়ে ওঠে। এই বুঝি ‘বোম-টোম’ কিছু ফেলে বসে আকাশ থেকে। কেউ জানের ভয়ে আর কেউ ক্ষমতার লোভে শান্তি কমিটিতে নাম লেখাল। চ্যারম্যান সাহেব পীরালীকেও ডেকেছিলো। পীরালী দূরে দূরেই থাকতে লাগল।
চারদিকে কেমন একটা খাঁখাঁ ভাব। হাট-বাজার বলতে গেলে আর সেভাবে বসেই না। ঘরে বাজার সদাই নেই। ধামাটা হাতে নিয়ে পীরালী গিলেবাড়ীর হাটে গেল। অল্প কয়েকটা দোকান খুলেছে। দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। জিনিস-পত্তরের দাম খুব বেড়ে গেছে। পাঁচ টাকা জিনিসের দাম পঁচিশ টাকা চায়। দেশের দোকানদার গুলো হারামী পাকিস্তানীদের থেকে কোন অংশে কমে যায় না। এখনো এদের টাকা কামানোর লোভ যায় নাই। ‘মেলেটারি আইসে যদি ঠুস করে গুলি করে তালি টাকা সাথে নিয়ে কি গোরে যাবা?’ পীরালী কবরের কথা বলায় দোকানিও ক্ষেপে গেলো। ‘যাওতো মিয়া ইহানতে। ব্যান বেলা ক্যাচাল কইরো না। আমাগে গুলি করবে না। দুকানে পাকিস্তানের ফিলাগ লাগাই রাখিছি’। পীরালি দোকানের দিকে লক্ষ্য করে দেখে চাঁদ তারা আঁকা পতাকা ঝুলছে। কোনমতে কেনাকাটা করে পীরালী বাড়ির পথ ধরল। গাঙ্গ পেরোনো লাগে। পাটনি মাঝি আক্ষেপের সুরে বলল, “সারাদিনি চাইরজন মানুষ পার কল্লাম। এইরাম হলি আর বাঁচতি হবেনা। না খায়ে মুরা আর গুলি খায়ে মুরা কোনডা বেশী কষ্টের কতি পার মিয়া।” পীরালী কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। সন্ধ্যার আঁন্ধার নামার আগে সে বাড়ির ব্যাড়ে পৌঁছে গেল।
অন্যদিন হাঁট থেকে ফেরার সময় হলে বউ ব্যাড়ের ধারে ঐ নিম গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। কতদিন সে বউকে বলেছে, “ওই রাম করে নিম গাছে তলায় দাঁড়ায় থাকপা না বউ। নিম গাছের ভূত এসে তোমার ঘাড়ে উঠবো।’ স্বামীর বোকামিতে বউ হাসে। ‘কি বোকা মানুষ। নিম গাছে কি ভূত থাহে নাই! নিম পাতা হইলো তেঁতো। তেঁতো জিনিস ভূঁতের খুব অপছন্দ। দেখোনা কাউরে ভূতে ধরলে নিম গাছের ডাল দিয়ে ভূঁত তাড়ায়’। পীরালি হার মানে না। ‘ভূঁত না থাক জিন তো থাকপার পারে’। বউ হার মানে। নিজে হার মেনে ভালোবাসার মানুষটিকে জিতিয়ে দিতে পারাটাও নিজের জয় এটা পরীবানু জানে। আজ ব্যাড় ফাঁকা। পীরালি মনে মনে বললো, বউ কোথায়! এমন তো হয় না।
উত্তরের তাল গাছে দুটো শকুন বসে আছে। শকুন দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তালগাছ তিনটায় কয়েকপুরুষ ধরে শকুনেরা বসবাস করে আসছে। ক্ষ্যান্ত বুড়ি এসে মাঝে মাঝে বলে যায়, ‘শকুন হল অলক্ষী প্রানী, বাড়ীর সীমানায় শকুন থাকলি অমঙ্গল হয়। সময় থাকতি তাড়ায়ে দে’। অত উচু গাছের মাথা থেকে শকুন তাড়াবে কিভাবে সে ভেবে পায় না। এক কাজ করা যায়, গাছ দুটো কেটে ফেলা। বাপ-দাদার হাতে লাগানো গাছ। সে কাটতে পারে না। আবার শকুন গুলোকে তাড়াতে সত্যিকারে তার মন টানে না। ঘরের ‘দোর’ হাট করে খোলা। পরীবানু কোথাও নেই সারা বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। পুকুর ঘাটে নেই। সে লাউয়ের মাচানের তলায় উঁকি দিয়ে দেখল। সেখানেও নেই। গেল কোথায়! কারো বাড়ি গেলো নাকি? বউ তো কারো বাড়ী খুব একটা যায় না। তার এক সই আছে। কিন্তু এই পোঁয়াতি অবস্থায় সইয়ের বাড়ি যাবে কেন!
পীরালী খুঁটিতে মাথা রেখে মাটির বারান্দায় বসে আছে। দুপুরে গ্রামে পাক সৈন্যরা হানা দেয়। নতুন বউয়ের মত অনেকের খোঁজ পায় না কেউ। নতুন বউ আর কখনো ফিরে আসেনি। পীরালীর তপ্ত বুকে মাথা রেখে কেউ আর ফিসফিসিয়ে গল্প করে না।
তিনদিনের দিন পীরালী পালিয়ে গেল। সোজা বর্ডার পেরিয়ে ভারতে। যোগ দিল যুদ্ধে, বনে গেল মুক্তি। প্রতিহিংসার অনলে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো তার হৃদয়। খানেদের রক্তে কেবল শীতল হতে পারে সেই জ্বালা। যশোর এলাকায় যুদ্ধ করতে পাঠানো হল পীরালীদের। যুদ্ধের সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে আজও ছলকে ওঠে বুকের রক্ত। যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। শত্রুর পোঁতা মাইনে উড়ে গেল পীরালীর এক খানা পা। বাম হাত খানা প্রায় অকেজো। বাঁচার আশা ছিল না। তবুও কি করে যেন বেঁচে গেল।
তারপর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশের লালসবুজের পতাকা পতপত করে উড়তে লাগলো সোনার বাংলায়। মাস কয়েক পরে অনেক কষ্টে লাঠিতে ভর করে গ্রামে ফিরল পীরালী। খোঁড়া পা নিয়ে বাড়ির দাওয়ায় সে একাকি বসে থাকত। কোন কোন দিন ক্ষ্যান্ত বুড়ি পাশে এসে বসে। যুদ্ধে এত মানুষ মরল কিন্তু সেই চেয়ারম্যানের কিছু হল না। কোন জায়গা থেকে যেন মুক্তির সার্টিফিকেট জোগাড় করে আনল। নিজেকে সে মুক্তি বলে পরিচয় দিতে লাগল। পাকিস্তান জিন্দাবাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে জয় বাংলা। শেখ মুজিবের জন্য সে এখন জান-প্রাণ উৎসর্গ করে দেবে এমনই ভাব। কয়েকদিনের মধ্যে তার নতুন সাগরেদ জুটে গেল। এসব নিয়ে পীরালীর মাথা ব্যাথা ছিল না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে চেয়ারম্যানের চেলাবেলারা তার বাড়ি দখল নিতে এসেছে। সে নাকি চেয়ারম্যানের কাছে তার বসত ভিটে বেচে দিয়েছে। গ্রামের কেউ কেউ ঘুষ খেয়ে চেয়ারম্যানের পক্ষে সাক্ষী দিলো। সেদিন পীরালীর পাশে কেউ দাঁড়ায় নি। পীরালি পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। ক্ষ্যান্ত বুড়ি তার শতচ্ছিন্ন শাড়ীর আঁচলে চোখ মোছে। তালগাছে শকুনদের সুখের ঘরকন্নার দিন শেষ হলো। শকুন হলো অলক্ষী। চেয়ারম্যান তালগাছ তিনটে কাটার ব্যবস্থা করলো। ভাঁটায় ইট পুড়িয়ে নতুন কোটাবাড়ি করবে। পীরালি ভাসতে ভাসতে সে চলে এল খুলনা টাউনে এলো। কোন উপায় না করতে পেরে মানুষের কাছে হাত পাততে হলো। প্রথম প্রথম কষ্ট হত। এখন হয় না। পীরালীর মনে হয় এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে একসিডেন্টের দিনেই মরে যাওয়া বোধহয় অনেক ভাল ছিল। বোধহয় কেন আসলেই ভাল ছিল।
পীরালীর পাশে কেউ বসে না। তবু পীরালী মাঝে মঝে পুরান দিনের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে। হাবিবুল্লাই তার গল্পের শ্রোতা। ছেলেটা এতিম। চারকূলে কেউ নেই। বছর চারেক হল সে পীরালীর সাথে আছে। পীরালী ছেলেটাকে বেশ স্নেহ করে। খাওয়ার পাশাপাশি কিছু টাকাও দিত। ছেলেটা আগে পীরালীর কথা বেশ মান্যি-গন্যি করত। কিন্তু আজকাল খুব বেয়াড়া হয়ে গেছে। সারাক্ষন টাকার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে। টাকা না দিলে পীরালীকে ফেলে চলে যাবার হুমকি দেয়। কিন্তু যায় না। পীরালী ভাবে তাকে ভালবাসে বলেই যায় না। আসলে লোকে ভিক্ষা দেয় পীরালীর পঙ্গু পা দেখে এই গূঢ় সত্যটা হাবিবুল্লাহ জানে বলেই তাকে ছেড়ে যায় না। পীরালী বাধ্য হয়ে টাকা দেয়। ইচ্ছা করলে নতুন কাউকে সে রাখতে পারে। প্রতিদিন কত শত হাবিবুল্লা ভেসে যায় এই টাউনের বুকে। কিন্তু হাবিবুল্লার প্রতি তার একটা মায়া জমে গেছে। নিজের ছেলের মত মায়া করে তাকে। খাওয়া-দাওয়া খরচের পর যদি টাকা বাচে তাহলে সে সেটা একটা পুটলির ভিতর জমিয়ে রাখে। বর্ষার দিনের জন্য কিছু সঞ্চয় তাকে রাখতেই হয়। মাঝে মাঝে নতুন বউয়ের কথা মনে পড়ে। নতুন বউ কি বেঁচে আছে!
হাবিবুল্লা ছেলেটা নেশা ধরেছে। যৌবনের ফুল না ফুটটেই সে বাজারের মধুবালাদের খোঁজ পেয়ে গেছে। সে আরো টাকা দাবি করে। পীরালী তো আর টাকার গাছ না। কোন জায়গা থেকে টাকা দেবে সে। হাবিবুল্লার ধারণা পীরালীর অনেক জমানো টাকা আছে। সে রেগে যায়। যা তা বলে মুখ চালায়। পীরালী নিজেকে সামলাতে পারে না। সেও গালি দেয়।
পরদিন সকালে পীরালীর ঘুম ভাঙ্গে তার ছোট্ট খুপরিতে। নিয়মমত সে বালিশের তলায় হাত দেয়। টাকার পুটলিটা সে ওখানে রাখে। আজ সে পুটলিটা খুঁজে পেল না। হাবিবুল্লাহকেও খুঁজে পায় না। সর্বস্ব হারানো পীরালী আজ আরেকবার নিঃস্ব হল। সকালের খাওয়ার কিছু কেনার মত একটা পয়সা নেই তার কাছে। পাশের খুপরীতে থাকে ছবুর। সে কুলিগিরি করে। সব শুনে সে পীরালীকে চৌরাস্তার মোড়ে দিয়ে গেল।
যুদ্ধ হয়েছে সেই কত কত দিন আগে। চল্লিশ বছর তো হবে। বিষন্ন চোখে বসে আছে পীরালী। চায়ের দোকানের টিভিতে খবর হচ্ছে। কোন মন্ত্রী নাকি সেতু বানানোর টাকা নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছে। চা খেতে আসা লোক গুলো বলাবলি করছে কিভাবে মন্ত্রী মিনিষ্টার গুলো দেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। পীরালী অবাক হয়। দেশও কি আজ তার মত সব হারিয়ে নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ। অর্থহীন দৃষ্টি মেলে কালো পথের উপর চেয়ে থাকে পীরালী। পথের উপর রিকশার চাকা গড়িয়ে চলেছে।
প্রতিশব্দ
দোর = দরজা
মুরা = মরা
কতি পার = বলতে পার
খুল্লে টাউনে = খুলনা শহরে