বাংলাদেশের নবাব পরিবার ছিল শীল্পে বেশ আগ্রহী। তারা সাহিত্য এবং সংকৃত সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমান আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ঢাকায় তখন আলোকচিত্র ধারন করাটাই মস্ত বড় বিলাসিত,ছায়াছবি নির্মানের কথা কেউ ভাবেনি,চলচিত্র নির্মানের মতো ব্যায়বহুল ও অসাধ্য কাজ করার আগেই নবাব পরিবার পুর্ব্বঙ্গের মানূষের জন্য অনেক কিছু প্রথমবারের মতো করেছিলেন। এই দেশে বিদ্যুতের প্রচলন এই পরিবারের আবাসস্থল আহসান মঞ্জিল থেকেই ১৯০১ সালে হয়েছিল। বিশুদ্ধ পানি সরবারহ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এই পরিবারের অসামান্য অবদান রয়েছে। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠীত হয়েছে প্রধানত নবাব পরিবারের দান করা পারিবারিক জমির উপরে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল নবাব পরিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল শিক্ষায়াতনের ক্রমবিকাশের ফলাফল।
এই পরিবার প্রথম বাংলায় ফ্রিজ ক্যাপ নামের একজন বিদেশীকে ডেকে এনে স্টুডিও তৈরী করেন। সেখানে স্থির চিত্র ধারন করা হতো। নবাব পরিবার তথা পুর্ব্বঙ্গে ফটোগ্রাফির আগ্রহ আসে কোলকাতা থেকে। আগ্রহ থেকে ফটোগ্রাফি একরকম চর্চায় পরিনত হয়। ১৮৯০ সালে কোলকাতায় ফটোগ্রাফিক স্টুডিও নির্মান করে হীরালাল সেন। তিনি পুর্ব্বাংলার মানিকগঞ্জের সন্তান ছিলেন। ওইসময়ে নবাব পরিবারের কেউ কেউ কোলকাতায় গিয়ে ছবি তুললেও চর্চাটা সিমীত ছিল। নবাব আহসানুল্লাহ ( ১৮৪৬-১৯০১) জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিজ ক্যাপ কোলকাতা থেক ঢাকায় নিয়ে আসেন। এবং প্রতিষ্টিত পাটুয়াটুলির স্টুডিওটি ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যুর পর নিলামে উঠে ছিল।নবাব সলিমুল্লাহ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার আজীবন সদস্য ছিলেন। ১৮৯০ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রধানত নবাব পরিবার ও সরকারি অনুষ্ঠানাদির ছবি তিনিই তুলেছিলেন।
এই উপমহাদেশে প্রথম চলচিত্র প্রদর্শিত হয় ১৮৯৬ সালে। এর ঠিক দুই বছর পরেই ১৮৯৮ সালে ঢাকার ছেলে হীরালাল বাংলায় চলচিত্র প্রদর্শন করেন। তিনি প্রথম এদেশে ( পুর্ব বঙ্গে) চলচিত্র পদর্শন করেন এবং ঢাকা ও ভোলাসহ সারা বাংলা ছড়িয়ে দেন। ঐসময়ে ঢাকার এত নামডাক ছিলনা। তখন কোলকাতাকেই বেশী প্রাধান্য দেওয়া হতো। এই বাংলার অনেকেই তখন কোলকাতায় গিয়ে চলচিত্র নির্মানে আগ্রহী হয়ে পরেন। সেইরকম ভাবে ঢাকার ছেলে হীরালাল ও কোলকাতায় চলচিত্র নির্মানে ব্যস্ত ছিল।তিনি প্রথম তথ্যচিত্র এবং বিজ্ঞাপন চিত্রের প্রচলন করেন। উপমহাদেশের জনক হীরালাল। বংগভঙ্গের আগেই তিনি বেশ কয়েকটা চলচিত্র নির্মান করেছিনেল। ১৯০২ সালে " এ ট্রিপ টু ড্য মুন " নির্মান করেছিলেন ফরাসি চলচিত্রকার জর্জ মেলিয়স। এটাকে নির্বাকযুগের প্রথম পুর্নাংগ চলচিত্র বলে ধরা হয়। এর পর থেকে ১৯০৫ এর মধ্যেই পুর্নাংগ চলচিত্র এদেশে আসে। অর্থাৎ শুরু থেকেই এদেশ চলচিত্রের আধুনিকতার ছোয়া পায়।
এর পরে অনেক চলচিত্র আসলেও সেগুলো পুর্নাংগ ছিলনা। উপমহাদেশে প্রথম পুর্নাংগ চলচিত্র হয় মুম্বাইয়ে। হিন্দি ছবির নাম " রাজা হরিসচন্দ্র "। পরিচালনা করেছিলেন দাদা সাহেব ফালকে ১৯১৩ সালে।
প্রথম বাংলার চলচিত্র ( পুর্নাংগ নয়) ধরা হয় বিল্বমঙ্গলকে। ( নির্মান সাল জানা যায় না)। এটা কোলকাতায় হয় এবং এরপর থেকে চলচিত্র ব্যাপারটা কোলকাতামুখি হয়ে যায়। কলকাতায় একেরপর এক চলচিত্র নির্মিত হতে থাকে।
১৯২৭ সালে মার্কিন চলচিত্র পরিচালক আলান ক্রসল্যান্ড " দি জাজ সিঙ্গার " নামে একটা চলচিত্র নির্মান করেন। যা চলচিত্র ইতিহাসকে চমকে দেয়। কেননা এটা ছিল প্রথম সবাক চলচিত্র। এই সময়েই প্রথমবারের মতো বর্তমান বাংলায় চলচিত্র নির্মান করা হয়। হীরালাল ঢাকার হলেও তিনি কোলকাতায় চলচিত্র নির্মান করেছিলেন। পরীক্ষামুলকভাবে নির্মিত এই ছবির পরিচালক অম্বুজ গুপ্ত এবং ছবির নাম " সুকুমারি"। এটা ব্যর্থ হয়, কোন সিনেমা হলে চলেনি, এর কোন প্রিন্টও নেই। কিন্তু যেহেতু প্রথম বাংলাদেশী চলচিত্র সেক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ত্ব অনেক।
" দ্যি জাজ সিঙ্গার " অবশ্যি একটা চমক ছিল। কিন্তু এটার দেখাদেখি একরকম হিড়িক পড়েনি কোথাও। কেননা এককথায় সেটা অধিকাংশের জন্য ছিল অসম্ভব। কিন্তু এর হাত ধরেই একটু একটু করে বিশ্ব চলচিত্র সবাক যুগে পদার্পন করে। এর ঠিক ৪ বছর পর ১৯৩১ সালে উপমহাদেশে সবাক চলচিত্র এসে যায়।মুম্বাইয়ের হিন্দি ভাষায় আর্দেশীয় ইরানী এবছর " আলম আরা " নামক একটা ছবি নির্মান করলেন। একই বছরে ১১ই এপ্রিল মুক্তি পেয়েছিল " জামাইষষ্ঠী"। কলকাতায় নির্মিত আর জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবিটিই প্রথম বাংলার সবাক চলচিত্র। এই ১৯৩১ সালেই ঢাকায় একটা চলচিত্র নির্মান করা হয়। নাম " দ্যি লাষ্ট কিস "। এটি পুর্ব্বঙ্গের ২য় চলচিত্র হলেও পুর্নাজ্ঞ চলচিত্র হিসেবে প্রথম ছিল। এটি ছিল এদেশের প্রথম পুর্নাংজ্ঞ নির্বাক চলচিত্র। ( এটা এদেশের প্রথম ও শেষ পুর্নাংগ নির্বাক ছবি)। এর পরিচালক ছিল " সুকুমারি" এর পরিচালক অম্বুজ গুপ্ত।
* বিশ্ব চলচিত্রের ( ১৯০২) যাত্রারম্ভের ( কাহিনীচিত্র অর্থে) প্রায় তিনদশক পরে
* উপমহাদেশীয় প্রথম কাহিনিচিত্র নির্মানের (১৯১৩) প্রায় ২৮ বছর পরে
* প্রথম বাংলা কাহিনীচিত্র নির্মানের ( ১৯১৯) প্রায় ১২ বছর পরে
* বিশ্ব চলচিত্র সবাক যুগে প্রবেশ করার ( ১৯২৭) সাড়ে তিন বছর পরে
* ভারতীয় এবং বাংলা চলচিত্র সবাক যুগে প্রবেশ করার বছর ( ১৯৩১)
বাংলাদেশ পূর্নাংগ নির্বাক চলচিত্র নির্মিত হয়েছিল।
" দ্যি লাষ্ট কিস" ছবিটি সাধারনের প্রদর্শনের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। এর দর্শকও বেশ হয়েছিল। অসংখ্য দর্শকের মধ্যে একজন ছিলেন যার নাম নাজীর আহমেদ।ইনি একরকমের লিজেন্ড। ইনিই বাংলাদেশে পুর্নাংগ সবাক চিত্র নির্মানের একজন পথিকৃৎ।
সুকুমারি এবং দ্যি লাষ্ট কিস চলচিত্র নির্মিত হয়েছিল বাংলার নবাব পরিবারের কল্যানে। অন্যকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয় স্রেফ এই নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থ সাহায্য না পেলে এই চলচিত্র নির্মান করা সম্ভব হতো না।অম্বুজ গুপ্ত নাটকের সাথে যুক্ত ছিলেন, শরীর চর্চার শিক্ষক ছিলেন, সর্বোপরি নবাব পরিবারের সুদৃষ্টিতে ছিলেন। তাই তিনি এদেশের প্রথম কাহিনিচিত্রের ( নির্বাক) পরিচালক হবার মতো ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেন।
আগামী পর্বে আসবে সবাক চলচিত্রের বিস্তারিত
আমার কথাঃ
বাংলাদেশের চলচিত্রের পিছনে নবাব পরিবারের একটা বিশাল সাহায্য আছে। তাই বিষয়টা না রেখে পারলাম না। অনেকের কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে। সেইরকম কিছুর জন্য আমি দুখিত।
সুত্রঃ
১। হীরালাল সেন- সৈকত আসগর
২। সোনার দাগ ( পত্রিকা) - গৌরাঙ্গ প্রাসাদ ঘোষ
৩। রুপোলি ফিতে- আলী ইমাম
৪। বাংলাদেশের চলচিতের ইতিহাস- অনুপম হায়াৎ
৫। নওয়াব পরিবারের ডাইরিতে ঢাকার সমাজ ও সংকৃতি- অনুপম হায়াৎ