
নতুন বছরে সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
আজ আপনাদের আমার মার কথা জানাব।
আমার মাকে আমি খুব ভালবাসি। সবাই তাদের মাকে খুব ভালবাসে!...তবে সবার মত আমি আমার মাকে আমার কাছে পাই না। আমার মা আমাদের থেকে দুরে থাকেন। তাকে ফিরে পাওয়াটা আমাদের উভয়ের কাছে ঈশ্বরের অসীম আশীর্বাদ।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জেনে এসেছি আমাদের মা নেই-মারা গেছেন। তবে খুব ছোটবেলার কথা ভাবলে স্বপ্নের মত দেখতাম একজনকে যার বয়স্কাট চুল, হালকা শাড়ির আঁচল উড়ছে, হিলতোলা জুতো- যা আমার চারপাশের কাকি-পিসিদের সাথে একদম মিলতো না। আমি জানতাম স্বপ্নই। আরো মনে পরত- কাঁচের ঘর, বেতের আসবাব, ছোট্ট কাঠের সিংহাসনের সামনে আমি আর একটি বাচ্চা মেয়ের কোলে বসে -‘ ওম্ জয় জগদীশ হরে’ গান গাওয়া হচ্ছে, সুন্দর ধূপের গন্ধ।
একটু বড় হতে পিসির কাছে মাঝে মাঝে শুনতাম আমাদের পাপা নিয়ে আসে যখন, আমরা তখন ছোট্ট পুতুলের মত। দমদম বিমানবন্দরে সবাই নিতে যায়। পাপার কোলে তোয়ালে মোরা ভাই আর একটি কাজের ছেলের কোলে ছোট্ট আমি।
আসতে আসতে জানতে পারি আমার মা বাঙালি ছিলেন না। পাপা আমাদের নিয়ে আসেন। একটু বড় হতে আর একজন মা আসেন।
এভাবে চলছিল। হঠাৎ একদিন সকালে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। আমি আর ভাই শুয়ে আছি বেল বাজতে উঠে দেখতে গেলাম কে। দেখি বাইরে একটি বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর একজন মহিলা হিন্দীতে জানতে চাইছেন পাপা আছে কিনা। আমার তাকে দেখে কি একটা শিহরন লাগলো। চট্ করে ঘরে এসে বাপ্পাকে তুলে বললাম বাইরে কারা যেন এসেছেন।
জানলাম সেই মহিলা আমার মাস্তুতো দিদি। তিনি তার স্বামীর সাথে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমরা সবাই খুব অবাক হয়ে গেছি। দিদি সেটা বুঝতে পেরে খুব ধিরে ধিরে আমাদের সব বলতে লাগলেন। তারা মিজোরাম থেকে এসেছেন। তার স্বামী অফিসের কাজে কলকাতায় এসেছিলেন। এর আগেও কয়েকবার এসে আমাদের খোঁজা হয়। এবার ঠিকানা পাওয়া গেছে। জামাইবাবু শুরু থেকেই একটা মুভি ক্যামেরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
আমরা সেদিন জানতে পারি আমাদের মা বেঁচে আছেন। পনেরো বছর অসুস্থ ছিলেন।
তার কাছ থেকে টুকরো টুকরো কথা জুরে জামাইবাবু আমাদের খুঁজে বার করেছেন। তার সখই হল পরিবারের যারা দুরে ছরিয়ে গেছে তাদের খোঁজ় করা। দিদি জামাইবাবু আমাদের নিয়ে একটু ঘুরে আসতে চাইলেন। পাপার অনুমতি পাওয়া গেল। সারাদিন আমরা দিদি, জামাইবাবু ও তাদের ছেলে মেয়েদের সাথে আনন্দে কাটালাম।
সেদিন আমার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল!...আমার মা আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমাদের তার কাছে যেতে বললেন।
পাপা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাদের আঙ্কেল মানে মেসো আমাদের মার কাছে নিয়ে যান। বিমানবন্দরে যখন নামি তখন আঙ্কেল দেখান কত মানুষ আমাদের নিতে এসেছেন। বেরিয়ে প্রথমেই মাকে দেখি। সবাই ঘিরে আছে আমাদের – কেউই কথা খুঁজে পাই না। গাড়ি গাড়ি করে এত লোক এসেছেন। সবাই মাকে অনেক কিছু বলছেন।
আমরা গাড়ি করে পাহাড়ী পথে রওনা দিলাম। এর আগে অনেক পাহাড় দেখেছি কিন্তু এই সবুজ পাহাড়গুলোকে দেখে মন যে কি আনন্দে ভরে উঠছিল কি বলবো। এরা যেন আমার কত আপন, অথচ কত দুরে ছিলাম আমরা, আজ যেন আমদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে চায়।
আমার মা ও আমাদের আদর করত। আমার খুব লজ্জা লাগতো। মা আমায় জিজ্ঞেস করতো কত কথা। কষ্ট হয় কিনা, কেউ বকে কিনা-আরো কত কি!...আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে মাথায় এত চুল কম কেন। একটু কোথাও কাটা দেখলে আঁতকে ওঠে, বলে কে মেরেছে! আমার কি যে আনন্দ হয়! কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। লজ্জা লাগে। আমার ভাই কিন্তু একদম উল্টো। ও দিব্যি মার কোলে মাথা রেখে সারাদিন ঘুমায়। মা সারাদিন ওর মাথায় বিলি কাটে। আমাদের এক দিদি আছে। যে সরকারী চাকরি করে। একটু গম্ভীর প্রকৃতির, খুব সুন্দরী। সেই আমার স্বপ্নে আসত। তার সাথেও বাপ্পার খুব বন্ধুত্ব। দিদি আর বাপ্পা গাড়ি করে ঘুরে বেড়ায়। আমি মার সাথে থাকি।
একুশদিন মত আমি মাকে কাছে পাই। সেই একুশটি দিন যেন সোনায় মোড়া। প্রতিদিন গির্জা থেকে ফাদাররা আসতেন, প্রার্থনা হত। আঙ্কেল পাঞ্জাবী, তিনি একটি শিব মন্দির করেছেন সেখানেও পুজো হল। কত দুর দুর থেকে আত্মীয়রা দেখা করতে আসতেন। আমারা চারজন তাদের বাড়ি ঘুরতে যেতাম। দিদি খুব জোরে গাড়ি চালাতো।
আমি ছোট থেকে একটু বেশি ভুগী, পাপা সারাদিন আমায় ফোন করত শরীর ভাল আছে কিনা জানতে। মা তাই চিন্তায় থাকতো। আমি সেভাবে কিছু চাইতাম না। কিন্তু একটু কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে সেটা করা চাই। ওখানে সন্ধ্যেবেলায় রাতের খাওয়া হয়ে যায়। তারপর খিদে পেলে ফল খাও। একদিন রাতে কি একটা খুঁজছি, ঘরে নেই-মা সঙ্গে সঙ্গে সেটা আনতে হন্তদন্ত হয়ে মাসির বাড়ি ছুটলো, শত অনুরোধ করেও আটকান গেল না। পাহাড়ি পথ, এত রাত! সামান্য একটা জিনিস মুখ ফুটে চাইতে কেউ এভাবে আমার জন্য করতে পারে, ভাবতে পারিনি! এমন স্নেহ তো কোনদিন পাই নি! পাপার স্নেহ অন্য রকম। পাপা অনেক করতেন কিন্তু মা কি যেন সেদিন বুঝলাম।
আসার সময় মা প্রচন্ড কান্নাকাটি করতেন। বাজে আবহাওয়ার জন্য দু’বার বাড়ি ফিরে যাই-মায়ের সে কি আনন্দ!
আমার মাকে আমি খুব মিস্ করি। কিন্তু সেখানে গিয়ে থেকে যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। মাও এখানের পরিবেশে মানাতে পারবেন না।
তাতে কি, আমি জানি মা আমার সাথে সব সময় আছেন। মা আজও সকালে আমাদের জন্য প্রার্থনা করলেন।
মহান প্রভুর কাছে আমার প্রার্থনা মাকে আমার খুব ভাল রেখো ......একদিন আমরা সবাই যেন এক সাথে থাকতে পারি..
উৎসর্গ : সকল মাকে