
বাগানের মধ্যে বেঞ্চিতে বসে ছিল মিশুৎকা আর স্তাসিক। গল্প করছিল।
তবে সে গল্প ঠিক অন্য ছেলেদের মতো নয়। খাঁটি সব আষাঢ়ে গল্প; কে হারে কে জেতে।
মিশুৎকা বললে, ‘বয়স কত রে তোর ছোঁড়া?’
‘পঁচানব্বুই। তোর?’

‘আমার একশ চল্লিশ। আগে আমি ছিলাম মস্ত বড়ো, বরিস কাকুর মতো। তারপর ছোটো হয়ে গেলাম।’

স্তাসিক বললে, ‘আর আমি ছিলাম এইটুকুন। তারপর বড়ো হয়ে গিয়ে ফের ছোট্ট হয়ে গিয়েছি। শিগগিরই আবার দেখবি বড়ো হয়ে যাবো।’
‘আর আমি যখন বড়ো ছিলাম, তখন গোটা নদীটা সাঁতরে চলে যেতাম।’
‘ফুঃ! আমি সাগর পেরতে পারতাম।’
‘ভারি তো সাগর! আমি মহাসমুদ্র সাঁতরে পেরিয়ে গেছি!’

‘মহাসমুদ্র সাঁতার ওতো সোজা!’
‘সত্যি! দুটো হাঙর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটা আমার পা দুটো খেয়ে নিল!’
‘তাহলে ও দুটো তোর কাছে আবার এলো কি ভাবে?’
‘গজাল আবার।’
‘তোফা ছাড়লি বটে,’ হিংসে হচ্ছিল স্তাসিকের। ইচ্ছে হল মিশুৎকার চেয়েও খাসা কিছু একটা বলে।

বললে, ‘তবে এ আর কী! আমি একবার না – গিয়েছিলাম আফ্রিকা। কুমীরে খেয়ে ফেলে আমায়।’
‘মিথ্যুক কোথাকার!’ মিশুৎকা হেসে উঠল।
‘মাইরি, সত্যি!’
‘তবে বেঁচে রইলি কী করে?’
‘পরে আমায় উগরে দিল যে!’
মিশুৎকা ভাবল একটু। ইচ্ছে ছিল স্তাসিককে ছাড়িয়ে যাবে। ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত বললেঃ

‘একদিন জানিস, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, চারি দিকে ট্রাম বাস লরি...’
স্তাসিক চেঁচিয়ে উঠল, ‘জানি, জানি। বলবি তো যে ট্রাম তোকে চাপা দিয়ে গেল। ও গপ্প তুই আগেই বলেছিস।’
‘মোটেই না, সে গপ্প নয়।’
‘বেশ, বল তা হলে কী হল।’

‘আমি তো চলেছি। গা বাঁচিইয়ে। হঠাৎ একটা বাস। লক্ষ্যই করি নি। পা দিয়ে মাড়াতেই – ব্যস, একেবারে চিঁড়েচ্যাপটা।’
‘হা, হা, হা, মিথ্যুক কাঁহিকার।’
‘মোটেই নয়।’
‘বাস তুই পা দিয়ে চেপেছিস! তাই কখনও হয়?’
‘বাসটা যে একেবারে এই টুকুনি, খেলনা বাস! দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল একটা ছেলে।’

এই সময় এল পড়শীদের ছেলে ইগোর; বেঞ্চিতেই বসলো ওদের সঙ্গে।
মিশুৎকা আর স্তাসিকের গপ্প শুনেটুনে বললেঃ
‘গুল মারছিস, লজ্জাও করে না!’
স্তাসিক বললে, ‘আমরা তো কাউকে ধাপ্পা দিচ্ছি না, বানিয়ে বানিয়ে বলছি শুধু, গপ্প বলার মতো।’
‘গপ্প!’ মুখ বাঁকাল ইগোর, ‘ভারি কাজ জুটিয়েছিস বটে!’
‘তুই কি ভাবিস বানিয়ে বানিয়ে বলা খুব সহজ বুঝি?’
‘নয়ত কী!’
‘বেশ, বানিয়ে বল দেখি একটা।’
ইগোর বললে, ‘বেশ তো... দাঁড়া...’
মিশুৎকা আর স্তাসিক নড়ে চড়ে বসল শুনতে।
‘দাঁড়া... এ্যাঁ-এ্যাঁ... হুঁ... হুম... এ্যাঁ-এ্যাঁ...’
‘কী বল! এ্যাঁ-এ্যাঁ করছিস কেন।’
‘দাঁড়া, একটু ভেবে নিই।’
‘বেশ ভেবে নে।’
‘এ্যাঁ-এ্যাঁ-এ্যাঁ,’ ফের শুরু করল ইগোর, আকাশের দিকে তাকাল, ‘দাঁড়া – এ্যাঁ-এ্যাঁ...’
‘বললি খুব সোজা, তো অতো ভাবছিস কী?’

‘দাঁড়া না... হ্যাঁ শোন! একদিন না আমি একটা কুকুরের পেছনে লেগেছিলাম। কুকুরটা খপ করে আমার পা কামড়ে দিলে। এই দেখ এখনো দাগটা আছে।’
‘তা এর মধ্যে বানালি কী তুই?’ জিজ্ঞেস করল স্তাসিক।
‘কিছুই না। যা হয়েছিল তাই বললাম।’
‘তবে যে বড়ো বললি বানিয়ে বলার ওস্তাদ তুই।’
‘ওস্তাদ তো বটেই! তবে তোদের মত নয়। তোরা কেবল বাজে সময় নষ্ট করিস। আমি কাল যা বানিয়ে বানিয়ে বলেছি তার একেবারে হাতেনাতে ফল।’
‘কী রকম ফল?’

‘তবে শোন। কাল সন্ধ্যেবেলা না, মা-বাবা সব বেরিয়ে গিয়েছিল, ঘরে কেবল আমি আর ইরা। ইরা ঘুমিয়ে পড়ল। আমি আলমারি খুলে আধ বয়াম জ্যাম মেরে দিলাম। পরে ভাবলাম যদি ধরা পড়ি! করলাম কী, ইরাটার ঠোঁটে খানিকটা জ্যাম মাখিয়ে দিলাম। মা এসে বললে, “কে জ্যাম খেয়েছে?” আমি বললাম, “ইরা।” মা দেখল সত্যি ওর ঠোঁটে জ্যাম লেগে আছে। আজ সকালে মা-র কাছ থেকে বকুনি খেল ইরা আর আমায় আরো জ্যাম দিলো। দেখলি তো কেমন ফল!’
‘তার মানে তোর জন্য অন্য কেউ বকুনি খেল, আর তুই দাঁত ক্যালাচ্ছিস!’ মিশুৎকা বলে।
‘তাতে তোর কী?’
‘কিছুই না, তবে তুই হলি একটা... সেই যে কী বলে? ... একটা মিথ্যেবাদী! বুঝলি?’
‘তোরাই মিথ্যেবাদী!’

‘যা ভাগ এখান থেকে! তোর সাথে এক বেঞ্চিতে বসব না আমরা।’
‘তোদের সাথে বসতে আমার নিজেরই ভারি বয়ে গেছে!’
ইগোর উঠে চলে গেল। মিশুৎকা আর স্তাসিক ও বাড়ির পথ ধরল।
রাস্তায় দেখল আইসক্রীম বিক্রি হচ্ছে। পকেট হাতড়ে দেখতে লাগল ক’টা পয়সা আছে। দেখা গেল দু’জনের যা আছে তা মিলিয়ে কেবল একটি আইসক্রীমই কেনা যায়।
স্তাসিক বলল, ‘একটাই কিনি, আধাআধি করে খাব।’
দোকানী মেয়েটা একটা আইসক্রীম ওদের দিল।
মিশুৎকা বলল, ‘চল বাড়ি যাই, ছুরি দিয়ে কেটে ভাগ করব। একেবারে সমান সমান হবে।’
‘তাই চল।’
সিঁড়ির গোড়ায় দেখা গেল ইরা দাঁড়িয়ে আছে। কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলা।
‘কাঁদছিস যে?’ জিজ্ঞেস করল মিশুৎকা।
‘মা আমায় রাস্থায় যেতে মানা করেছে।’
‘কেন?’
‘জ্যামের জন্যে। আমি কিন্তু খাই নি। ইগোর আমার নামে লাগিয়েছে। ওই খেয়েছে বোধ হয়, দোষ দিয়েছে আমার।’
মিশুৎকা বলল, ‘ইগোরই তো খেয়েছে। ও নিজেই বলেছে। কাঁদিস না ইরা, চল তোকে আমার ভাগের আইসক্রীম দেব, আয়।’
‘আর আমি তোকে দেব আমার ভাগ। একবার এই একটূখানি চেখেই দিয়ে দেব,’ কথা দিল স্তাসিক।
‘কেন, তোরা নিজেরা খাবি না?’
‘উঁহুঃ, মুখ মরে গেছে। মিশুৎকার সঙ্গে আজ আমি গোটা দশেক আইসক্রীম খেয়েছি, কিনা!’

ইরা বলে, ‘তার চেয়ে এক কাজ করি, তিনভাগ করা যাক আইসক্রীমকে।’
‘ঠিক বলেছিস!’ স্তাসিক বলল, ‘তুই যদি একাই সবটা খেয়ে নিস, তবে গলায় ঠান্ডা লেগে যেতে পারে, বুঝেছিস...’
ঘরে ফিরে তিন ভাগ করা হল আইসক্রীমটাকে।
মিশুৎকা বলল, ‘ভারি মিষ্টিরে! আইসক্রীম পেলে আর আমি কিছু চাই না। জানিস, একবার আমি পুরো এক বালতি আইসক্রীম খেয়েছিলাম।’
‘যতো বাজে কথা,’ হেসে উঠল ইরা, ‘এক বালতি আইসক্রীম খেয়েছ বললেই অমনি সবাই বিশ্বাস করবে আর কি!’
‘বারে, বালতিটা যে এইটুকুনি, কাগজের বালতি, যাতে করে আইসক্রীম বিক্রি হয়!’

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১০ বিকাল ৫:৩৮