সিনেমায় বিখ্যাত কাপল বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মহানায়ক উত্তম-আর তুলনাহীনা সুচিত্রার "এই পথ যদি আর শেষ না হত তবে কেমন হত তুমি বলত...না না তুমি...না তুমি..না তুমি..." এইরকম কিছু রোমান্টিক দৃশ্যপট। হলিউডের ক্ষেত্রে অড্রে হেপবার্নের রাজকন্যা থেকে একদিন পথে নেমে এসে গ্রেগরি পেকের সাথে অসম এবং অসম্ভব প্রেমের "রোমান হলিডে", অথবা টাইটানিকের ক্যাপ্রিও-উইন্সলেট এর সেই হৃদয় বিদারক শেষ দৃশ্য! মোটকথায় সিনেমাতে প্রেমিক-প্রেমিকা মানেই ভালোবাসায় টইটম্বুর পুকুর, দর্শকের চোখের জল নাকের জল একাকার করে ছেড়ে দিয়ে টিস্যুপেপার ব্যাবসায়ীদের পসরা বাড়ানো!
এইবেলা আসুন কিছু অন্যরকম জুটির কথা শুনি, যাদের কেউ (অথবা দুজনাই) সাইকো, অথবা ব্যাঙ্কডাকাত, অথবা গ্যাংস্টার কিন্তু তাদের ভালোবাসা চিরায়ত রোমান্টিক জুটিদের চেয়ে কোন অংশে কম না!
True Romance
ক্ল্যারেন্স এবং এ্যালাবামার প্রথম পরিচয় হয় একটি পানশালায়। প্রথম দর্শনেই প্রেম, যা পরে বোঝা যায়। এরপরে একটা ফাঁকা সিনেমাহলে কাকতালীয়(!)ভাবে আবারও দুজনের দেখা। তারা একসাথে বসে পপকর্ন খেলো, সিনেমা দেখলো এবং প্রেম হয়ে গেলো! প্রেমটা একটু জোরালো হবার পর ক্ল্যারেন্স জানতে পারে যে এ্যালাবামা একজন দেহপোজিবী! এটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই ক্ল্যারেন্স একটু থতমত খেলো। এইখানের ডায়ালগগুলো মজার!
Clarence: You're a whore?
Alabama: I'm not a whore. I'm a call-girl. There's a difference, you know? (অত্যন্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে)
যাই হোক সেই ডিফারেন্সটা নিয়ে ক্ল্যারেন্স আর মাথা ঘামায় নি। চলতে থাকলো তাদের উদ্দাম প্রেম।এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে বিয়ে করবে। কিন্তু বিয়ে করতে তো অনেক টাকা দরকার। কী করা যায়? এ্যালাবামা জানালো যে ওর দালালের কাছে এক ব্রিফকেস ভরা কোকেইন আছে, সেটা নিয়ে আসতে পারলে আর কিছু লাগে না। তারপর ক্ল্যারেন্স সেই আস্তানায় আক্রমণ চালিয়ে বীরদর্পে ব্রিফকেস হস্তগত করে নিয়ে আসলো এবং এ্যালাবামাকে উদ্বেলিত চিত্তে সুসংবাদটি জানালো। কিন্তু এ্যালাবামা শুনে খুশী হবে কী, কাঁদা শুরু করল! কারণ কী?
"It was so romantic!"
এরপর থেকে শুরু হয় তাদের অভিযান, কোকেইন বিক্রী করে টাকা তোলার পথে নানারকম বাধাবিপত্তি এবং জীবননাশের হূমকি। ইতালিয়ান মাফিয়ারা খুঁজে বেড়াচ্ছে, পুলিসও খোঁজ পেয়ে গেছে, বন্ধু হিসেবে পাশে একমাত্র ডিক রিচি ,যে স্বপ্ন দেখে হলিউডের বিগশট হবার কিন্তু আদতে একজন তৃতীয়শ্রেণীর অভিনেতা।
বন্ধুর পথে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে এই ক্রেইজি কাপলকে, কিন্তু তারা ছিলো ড্যাম কেয়ার! ইতালিয়ান এক মাফিয়া যখন এ্যালাবামাকে ব্রিফকেসটার খোঁজে মারতে মারতে অর্ধমৃত করে ফেলে তখনও সে হিহিহি করে হাসতে হাসতে মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, কিন্তু ক্ল্যারেন্সের হদীশ বলে না। একেবারে খাঁটি ক্রেইজি ভালোবাসা!
এই মুভিটার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল, হলিউডের মেগাস্টাররা এখানে খুব ছোটখাটো পার্ট করেছেন। স্যামুয়েল এল জ্যাকসন, ভ্যাল কিলমার, ব্র্যাড পিটদের রোলগুলি ছিলো ক্যামিও।
যারা ডার্ক কমেডি পছন্দ করেন তাদের জন্যে মাস্ট সি। ওহ বলতে ভুলে গিয়েছি, এটার স্ক্রিন রাইটার টারান্টিনো!
Natural Born Killers
এটার স্ক্রিন রাইটারও টারান্টিনো। পরিচালক অস্কারবিজয়ী অলিভার স্টোন। এই ছবিটা আগেরটার মত পপকর্ন চিবুতে চিবুতে বসে দেখার মত না। অনেক নৃশংস, ভাবনা উদ্রেককারী, এবং জটিল।
এই ছবিতে মিকি এবং ম্যালোরি একে অপরকে ভালোবাসে। ভালোবাসার শুরুটা বিচ্ছিরি এক পরিবেশে। ম্যালোরি বড়ই অশান্তিতে ছিলো তাদের পরিবারে। তার পারভার্ট বাপ সুযোগ পেলেই তার শরীর হাতাতো। আর সারাক্ষন মদ্যপান চিৎকার চেচামেচি। মা দেখেও না দেখার ভান করত। ছোট ভাইটা চুপচাপ সবকিছুর সাক্ষী। তো এরকম এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পারিবারিক পরিবেশে মিকি এলো পিজা ডেলিভারি দিতে। ঠান্ডা চোখে দেখলো বিকৃত অভিভাবকের নষ্টামি, চিৎকার চেচামেচি, দেখলো কুঁকড়ে যাওয়া ম্যালোরিকে। তারপর খুন করে ফেললো অভিভাবকদ্বয়কে। মিকির এই খুন করা দেখেই ম্যালোরির অন্তর্গত ভায়োলেন্স জেগে উঠলো ভালোবাসার রূপে। তারা ছোটভাইটাকে মুক্ত করে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল এক সাইকোডেলিক হত্যা অভিযানে। তারা যেখানে যেতো সেখানকার সব মানুষকে খুন করে একজনকে রেখে দিয়ে বলত "যাও, সবাইকে বলে দাও মিকি আর ম্যালোরি এসব করেছে"।
একসময় তারা মিডিয়ার বদৌলতে সুপারস্টার হয়ে উঠলো। পরিচালক এখানে চমৎকারভাবে আমেরিকান মিডিয়ার ক্রাইম গ্লোরিফিকেশন তুলে ধরেছেন। মুভির মূল বক্তব্য এটাই। অলিভার স্টোনের পরিচালনা অসাধারণ! বিশেষ করে ড্রাগস নেয়ার পর যে সাইকোডেলিক অনুভূতি, তার চিত্রায়ন অসম্ভব ভালো হয়েছে।
তবে দুঃখের কথা, স্ক্রিপ্ট রাইটার টারান্টিনো পছন্দ করেন নি তার ডিরেকশন। এ নিয়ে নাকি ভালো ঝামেলা হয়েছিলো।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটা একটা অসাধারণ মুভি। অলিভার স্টোনের অস্কার পাওয়া ছবি 'প্লাটুন' এর চেয়েও ভালো।
Bonnie and Clyde
এবার একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক! ১৯৬৭ সালের ছবি। বনি এবং ক্লাইড। ইনারা হচ্ছেন ব্যাংক ডাকাত। বেশ কিছু ব্যাংক ডাকাতি করে খবরের শিরোনামে আসেন। ইনারা নিয়ম ভেঙে এবং অপরাধ করে নির্মল আনন্দ পেতেন। আরো মজা পেতেন পুলিস তাদের নাগালে না পেলে। ছবিটায় ভায়োলেন্সের সাথে কমেডির সমাহার হয়েছে চমৎকারভাবে। এই ধরনের মুভির ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। উপরিল্লিখিত ছবিগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে সমালোচক প্রশংসিত। আইএমডিবি রেটং ও অনেক- ৮। ছবিটি দুটো অস্কার জিতে নেয়, বেস্ট এ্যাকট্রেস ইন আ লিডিং রোল এবং বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি বিভাগে।
Sid and Nancy
এটি সত্যি কাহিনী অবলম্বনে রচিত। সত্তরের দশকে বৃটেনের পাঙ্ক রক মুভমেন্টে ঝড় তোলে সেক্স পিস্তলস নামের একটা ব্যান্ড। ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীতকে ব্যঙ্গ করে যারা গান গেয়েছিলো, এনার্কিজমের সূচনা করার সদম্ভ ঘোষণা দিয়েছিলো, টিভি শো তে উপস্থাপককে যা তা বলে খবরের শিরোনাম হয়েছিলো। সেই ব্যান্ডের বেজিস্ট সিড ভিশিয়াস, আর চিয়ারলিডার ন্যান্সি স্পাঞ্জেনের প্রণয়াপাখ্যান নিয়ে তৈরী এই ছবিটি। সিড ছিলো একজন অমেধাবী বেজিস্ট। অনেকসময় কনসার্টে তার গিটারে 'এ্যাম্প' দেয়া হত না। কারণ তার গিটারওয়ার্ক ছাড়াই দিব্যি জমে যেত কনসার্ট। তবুও সিড ছিলো একজন পাঙ্ক আইকন। তার রিয়াল পাঙ্ক গেটআপ, ড্যাম কেয়ার মনোভাব এবং ফ্যাশনের কারণে। একসময় ন্যান্সির সাথে সিড আলাদাভাবে বসবাস শুরু করে। সত্যিকারের জাঙ্ক লাইফ! ঘোরের ঘরে বন্দী জীবন! মাঝেমধ্যে ক্ষেপ মেরে এসে সেই টাকায় মাদকসেবন, এর বেশি তারা কিছু চাইতো না। কিন্তু এই দুই নিস্পাপ বা নির্বোধ বালক-বালিকা একসময় জীবনের কঠিন ছুরিতে বিদ্ধ হয়।
ছবিটার শেষে হয়তো বা আপনার মন খারাপ হবে, হয়তোবা না। পাঙ্ক-জাঙ্ক-ড্রাঙ্ক বলে হয়তো বা অবজ্ঞা করবেন! তবে তাদের ভালোবাসা ছিলো সুতীব্র। পাঙ্ক রকের মতই।