"...... আমরা খনি শিল্পের বিরুদ্ধে নই কিংবা মনটগোমারী কাউন্টিটিতে খনি খননেরও বিরোধী নই। এটাতো নিশ্চিত যে একটা খনি হওয়া মানে নতুন কিছু কর্মসংস্থান তৈরী হওয়া এবং আমাদের কাউন্টির অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটা- এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত। আমরা সবাই যে বিষয়টির বিরোধিতা করছি তা হলো লং ওয়াল মাইনিং পদ্ধতির- কেননা এ পদ্ধতি সরাসরি ভূমিধ্বস ঘটায় যার ফলে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কবরস্থান, জল-প্রবাহ এবং জলসম্পদ ইত্যাদির মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়। আমরা মাইনারদেরও বিরোধী নই, তাদের কর্মসংস্থান কিংবা জীবন-জীবিকার ক্ষতি হোক তাও চাই না, শুধু দয়া করে একটু বোঝার চেষ্টা করুণ, বছরের পর বছর পরিশ্রম করে যে জমি আমরা তৈরী করেছি, যে জমির উপর ভিত্তি করে আমাদের সংসার চলে, সেটাকে আমরা জলাঞ্জলি দিতে চাই না। কয়লার যে প্যানেলগুলো ৩ থেকে ৬ ফুট গভীর, ১০০০ ফুট চওড়া আর মাইলের পর মাইল লম্বা, (কয়লা তুলে নেয়ার পর) সে প্যানেলের উপর জমিগুলো যখন ভেঙে পড়বে, তখন এটা ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই যে আমাদের কাউন্টির ভূমি বিন্যাস(টপোগ্রাফি) আগের মতই থাকবে। রুম এন্ড পিলার মেথড হলে আমরা সেটাকে স্বাগত জানাতাম কেননা এর ফলে ভূমির নীচে ঠেকা দিয়ে রাখা হয় এবং এ পদ্ধতিতে কর্ম সংস্থানও বেশী হয় কেননা লং ওয়াল মেশিনের বদলে কয়লা আহরণের কাজ তখন করে মানুষ। এতে তো মনে হয় সবার জন্যই ভালো হবে- বেশী বেশী কর্ম সংস্থান, বেশী বেশী আয় আর ভূমিধ্বসও তুলনামূলক ভাবে কম। আমরা খনি কিংবা কর্মসংস্থান কিংবা এর অর্থনেতিক সুফল কোনটাকেই ঠেকিয়ে রাখতে চাই না! আমরা শুধু সরাসরি ভূমিধ্বস ঘটায় যে লং ওয়াল পদ্ধতি সেটাকে ঠেকাতে চাই। এটাই আমাদের সোজাসাপ্টা দাবী-আর কিছু নয়।"
হিলসব্রো জার্নালের সম্পাদক বরাবার এই চিঠিটি লিখেছিলেন মন্টেগোমারি কাউন্টির অধিবাসী স্কট স্ক্লাকেবেইর (Scott Schluckebier) ২০০৬ সালের মার্চ মাসের ২৭ তারিখে (সূত্র:http://www.nolongwall4us.com/ScottLtr1.htm)। স্কট যখন এই চিঠিটি লিখছেন তিনি ততদিনে জেনে গেছেন লঙওয়াল মাইনিং এর ফলে ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্টের পশ্চিম ভার্জিনিয়া, ওহাইয়ো, পেনসিলভানিয়া, দক্ষিণ ইলিনয়ের ম্যাকোপিন, ফ্রাংকলিন সহ বিভিন্ন কাউন্টিতে কেমন ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া তৈরী করেছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন স্খানে উন্মক্ত খনির মতই আন্ডার গ্রাউন্ড লং ওয়াল মাইনিং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছে-তারা নিজেরাও Citizens Against Longwall Mining (CALM) গঠন করে আন্দোলন শুরু করেছেন। অবশ্য স্কট জানেনা সূদুর বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষীরাও একই ভাবে জল-জমি-জীবন ধ্বংস করে খনি কার্যক্রম চালানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করছেন- ফুলবাড়িতে তারা এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত খনি প্রকল্প ঠেকিয়ে দিয়েছেন আর বড়পুকুরিয়াতে তারা লড়ছেন লং ওয়াল মাইন পদ্ধতিতে পরিকল্পিত ভূমি ধ্বসের বিরুদ্ধে।
তাই এই চিঠি এক অর্থে বড়পুকুরিয়ার অধিবাসীদের চিঠি, রুম এবং পিলার পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের এই দাবী বড়পুকুরিয়ার আন্দোলন কারীদের দাবী।
লং ওয়াল পদ্ধতি: পরিকল্পিত ভূমিধ্বস
আন্ডার গ্রাউন্ড পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের যতগুলো পদ্ধতি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো এই লং ওয়াল মাইনিং পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পুরো খনি অঞ্চলকে কতগুলো প্যানেলে ভাগ করা হয়। একেকটি প্যানেল ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার প্রশস্ত এবং ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ মিটার বা আরও বেশী লম্বা হতে পারে। একটা শিয়ারার বা কাটিং মেশিং প্যানেলের প্রস্থ বরাবর ডান থেকে বাম দিকে আবার বাম থেকে ডান দিকে যাওয়া আসা করতে করতে মাংসের স্লাইস কেটে নেয়ার মতো করে কয়লার বেড থেকে কয়লা পৃথক করতে থাকে যেগুলো কোন ঘুরন্ত কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে খনির বাইরে চলে যায়। কাটিং মেশিং একবার ডান থেকে বাম দিকে চলাচলের ফলে কয়লার বেড থেকে কয়লা কমতে থাকে। ফলে একই সাথে দুটো ঘটনা ঘটে- প্রথমত, একদিকে প্যানেলের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে অর্থাৎ কাটিং মেশিন ডান বাম করে কয়লা কাটতে কাটতে প্যানেলের দৈর্ঘ্য বরাবর এগিয়ে যেতে থাকে। এভাবে মেশিনটি সপ্তাহে ৫০ থেকে ১০০ মিটার এগোতে পারে। দ্বিতীয়ত, যতটুকু বর্গক্ষেত্রের কয়লা কোল বেড থেকে কেটে কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে বাইরে পাঠানো হয়, ঠিক ততটুকু পরিমাণ স্থানে শূন্যতা তৈরী হয়, এ শূন্য স্থান কে বলা হয় গুফ। মাটির উপরের স্তরকে সাপোর্ট বা ঠেকা দিয়ে রাখতো যে কয়লা স্তর, সেটা পুরোটাই কেটে সরিয়ে নেয়ার ফলে উপরের স্তরের মাটি পাথর ইত্যাদি মাটির গভীরের শূন্যতা পূরণ করতে নীচের দিকে নেমে আসে অর্থাৎ ভূমি ধ্বস ঘটে। কাটিং মেশিন যতক্ষণ কোন একটি স্থানের কয়লা কাটতে থাকে ততক্ষণ সেস্থানের উপরে একটি হাইড্রোলিক কৃত্রিম ছাদের( ক্যানোপি) মাধ্যমে উপরের মাটিকে ঠেকা দিয়ে রাখে। মেশিনটি কয়লা কাটতে কাটতে সামনে এগোয়, সাথে সাথে ক্যানপিও সামনে এগোয়। কয়লা কেটে নেয়ার পর সেস্থান থেকে ক্যানপি সরিয়ে নেয়ার পরপরই ভূমি ধ্বস ঘটে- লং ওয়াল মাইনিং পদ্ধতির সাথে এ ভূমিধ্বস পদ্ধতিগত ভাবেই জড়িত- যেকারণে এটাকে বলা হয় পরিকল্পিত ভূমি ধ্বস বা প্লানড সাবসিডেনস।
রুম এন্ড পিলার পদ্ধতিতে এ ভূমিধ্বস যেন না ঘটে সে জন্য মাটির নীচ থেকে পুরো কয়লা না কেটে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর কতগুলোর পিলারের আকারে কয়লা রেখে দেয়া হয় যেগুলো উপরের মাটিকে ঠেস দিয়ে রাখে, ফলে ভূমি ধ্বসে পরে না। এভাবে পিলারের আকারে স্থানে স্থানে কয়লা রেখে দেয়ার ফলে কয়লা আহরণের পরিমাণ কমে যায়- যে কারণে পুরো কয়লা উত্তোলণ করে অধিক মুনাফা অর্জনের লোভে কয়লা কোম্পানীগুলোর কাছে আজকাল রুম এন্ড পিলার পদ্ধতির চেয়ে লং ওয়াল পদ্ধতি জনপ্রিয়। ঠিক এ বিবেচনা থেকেই বড়পুকুরিয়াতে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রুম এন্ড পিলার পদ্ধতির বদলে লং ওয়াল পদ্ধতি ব্যাবহার করে এই ভূমিধ্বস ঘটানোর আয়োজন করা হয়েছে।
অন্যান্য ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া:
খনির গর্তে যে শূন্যতা তৈরী হয় তা একটা নিম্ন চাপ হিসাবে কাজ করে বলে খনির উপরে থাকা মাটির স্তরের পানি চুইয়ে বিভিন্ন ফাটলের মাধ্যমে নীচে চলে আসে । ফলে খনির উপরের এবং এর আশপাশের পুকুর, কুয়া গভীর/অগভীর নলকূপ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যে কোন আন্ডার গ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতিতেই এ ঘটনা ঘটে কিন্তু যেহেতু লং ওয়াল পদ্ধতিতে উপরের মাটির স্তর পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে বা স্থান চ্যুত হয় এবং সেই সাথে আশপাশের মাটির স্তর ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে এ পদ্ধতির হাইড্রোলজিক্যাল প্রতিক্রিয়া অনেক বেশী তীব্র এবং বিস্তৃত।
বড়পুকুরিয়ায় যা ঘটছে:
১৯৯৬ সালে পেটোবাংলার তত্ত্বাবধানে শুরু হয় বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি উন্নয় কাজ। এরপর দেশীয় প্রযুক্তি না থাকার অযুহাত দিয়ে সিএমসি লিমিটেড এবং এক্সএমসি লিমিটেড নামক দুটি চায়না কোম্পানিকে কে যখন বড়পুকুরিয়ার দ্বায়িত্ব দেয়া হলো তখন কয়লা উত্তোলনের ফলে ভূ-উপরিস্থভাগে কি প্রভাব পড়বে সেসব বিষয় বিবেচনা বা সে বিষয়ে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই শুরু হয় লং ওয়াল মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন। বড়পুকুরিয়া কোল মাইনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আজিজখান নিজেই বলেছেন যে সম্ভাব্য ভূমিধ্বস বিষয়ক কোন গবেষণা বা পরিক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন শুরু হয়েছে- যদি উপযুক্ত গবেষণা হতো তাহলে হয়তো ভূমিধ্বস এবং অন্যান্য ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যেত। ৬০ ফুট পুরু কয়লা স্তরকে ১০ ফুটের ছয়টি স্তরে ভাগ করে প্রথম স্তরটি উত্তোলনের কাজটি চলবে ২০১১ সাল পর্যন্ত। এরপর কাটা হবে পরবর্তী স্তরগুলো। কিন্তু এই প্রথম স্তরের ১০ ফুট কয়লা কেটে উত্তোলনের ফলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ৭ ফুট দেবে যাবে। যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে ইতোমধ্যেই দেবেছে ৪০ একর জমি। ফাটল ধরেছে বসত বাড়িতে। এলাকার গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। তাই এখন চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কয়লাখনির পরিত্যক্ত কালো পানি। কিন্তু এর ফলে ধান ক্ষেতে ধানক্ষেতে কয়লার কালচে আবরণ পড়ে গেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। এলাকার লোকজন ভূমিকম্পের ভয়ে ঘুমোতে পাড়ছেনা। ক্রমান্বয়ে মৌপুকুর, কালুপাড়া, বলরামপুর, ঝিকাগাড়ি, পাতিগ্রাম সহ ২.২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৭ টি গ্রামের পরিণতি একই হবে।
ঝোপবুঝে কোপ:
কিন্তু আমাদের সররকার কি করছে? সরকার এলাকার জনগণকে ফুটন্ত কড়াই থেকে একেবারে জ্বলন্ত চুল্লিতে ফেলতে চাইছে- সরকার চাইছে বড় পুকুরিয়ার ভুমি-ধ্বসের ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে সেখানে লং ওয়াল মাইনিঙের চেয়েও ভয়ংকর উন্মুক্ত খনি তেরী করতে, যে উন্মুক্ত খনি তৈরীর চেষ্টার বিরুদ্ধে ফুলবাড়ির জনগণ তীব্র আন্দোলন করার মাধ্যমে সে প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
সরকারের জ্বালনী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোহসিন বলছেন: ভূ-গর্ভস্থ এবং উন্মুক্ত উভয় পদ্ধিতিরই কিছু সুবিধা অসুবিধা রয়েছ। তবে অভিজ্ঞতা নাকি বলে উন্মুক্ত খনির তুলনায় ভূগর্ভস্থ পদ্ধির ঝুকি বেশী।তাছাড়া অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতি তেমন উতসাহ ব্যাঞ্জক নয়। তার ভাষায়- ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে আমরা মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ কয়লা উত্তোলন করছি। কিন্তু যদি উন্মুক্ত পদ্ধতি হতো তাহলে ৮৫-৯০ ভাগ কয়লা উত্তোলন করা যেত। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন যে ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতির তুলনায় সামজিক এবং পরিবেশ গত উভয় বিবেচনায় উন্মুক্ত পদ্ধতির সমস্যা বেশী।
কিন্ত তারপরেও সরকার বড়পুকুরিয়াকে উন্মুক্ত খনিতে রুপান্তরের ধান্দা করছে। সাপ্তাহিক ২০০০ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় এ বিষয়ে একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে: “সরকার এখন চাইছে এর মাধ্যমে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিংয়ের ত্রুটিকে কাজে লাগিয়ে ওপেন পিট মাইনিং করতে ।“ সরকারের জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক এলাহি চৌধুরী কয়লা নগরী বা কোল সিটি গঠনের মাধ্যমে এলাকার লোকজনকে আবাসন এবং কর্ম সংস্থানের লোভও দেখিয়েছেন। গরু মেরে জুতা দান আর কাকে বলে!
উন্মু্ক্ত পদ্ধতি কয়লা উত্তোলন করতে হলে বড়পুকুরিয়ায় বর্তমান ২.২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গার পরিবর্তে ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে। তাছাড়া এই ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বাইরের এলাকায়ও হবে পরিবেশগত বিপর্যয়। একারণে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে বড়পুকুরিয়া অঞ্চলের মানুষ। এখন ২.২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষের উচ্ছেদ আতঙ্কের সাথে যুক্ত হয়েছে আরও ৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষের আতংক।
এলাকাবাসীর দাবী:
বাংলাদেশে এনার্জি এন্ড পাওয়ার নামে একটা পাক্ষিক পত্রিকা আছে যে পত্রিকায় এখনও মাঝখানের দুটি পাতা জুরে থাকে এশিয়া এনার্জির ফুলাবাড়ীর খনির চাররঙা বিজ্ঞাপন। পত্রিকাটি গত কয়েকটি সংখ্যাজুড়ে ধারবাহিক বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছে আন্ডার গ্রাউন্ড পদ্ধতির মন্দ দিক গুলো নিয়ে। পত্রিকাটি তাদের মার্চ ১, ২০০৯ এর সংখ্যায় লিখেছে:
”কয়লাখনির অসংখ্য উপকার এবং সামান্য জ্বালা আছে। বৃহত্তর কল্যানের জন্য আমাদের কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। উন্মুক্ত খনির ফলে কিছু লোক স্থান চ্যুত হবে, সাময়িক ভাবে কৃষি জমি হারাবে......” কিন্তু বড়পুকুরিয়ার জনগণ এসব ধান্দাবাজির সাথে একমত নয়। এ লেখার শুরুতে মন্টোগোমারি কাউন্টির যে ব্যাক্তির লেখা চিঠির উল্লেখ করেছিলাম এলাকাবসীর দাবী সেরকমই সোজা সাপ্টা-সাপ্তাহিক ২০০০ এর কাছে তারা জানিয়েছেন- বড়পুকুরিয়ায় আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিংয়ের রুম এন্ড পিলার মেথডের মাধ্যমে স্যান্ড ফিলিং (বালু ভরাট) দাবী করেছিলাম- যা ভারত ও অষ্ট্রেলিয়ায় চালু আছে। কতৃপক্ষ সেটা করেনি। এটা করা হলে মানুষকে এলাকা থেকে উচ্ছেদ হতে হতো না, পরিবেশগত বিপর্যয় কম হতো, চাষের জমির সমস্যা হতো না। তারা সেটা না করে আন্ডারগ্রাউন্ড মাস প্রোডাকসন বেছে নিল- যা উন্মুক্ত খনির মতোই ভয়াবহ। তাদের দাবী, অনতিবিলম্বে রুম এন্ড পিলার মেথডের বাস্তবায়ন করে বালু ভরাটের মাধ্যমে বড়পুকুরিয়ার মানুষকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা হউক।
মুনাফার আগে মানুষ না মানুষের আগে মুনাফা:
আমরা বড়পুকুরিয়াবসীর এ ন্যায্য দাবীর সাথে একাত্মতা জানাচ্ছি। সেই সাথে সাবধান করতে চাই রুম এন্ড পিলার পদ্ধতি লং ওয়াল এবং উন্মুক্ত কয়লা খনির চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হলেও একেবারে সমস্যামুক্ত কোন পদ্ধতি নয়। উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন না করলে যেমন: পিলারগুলোর আকার-আকৃতি উপরের মাটির স্তরের ভার বহন করার মতো কি-না কিংবা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক পিলার স্থাপন হলো কি-না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় না নিলে রুম এন্ড পিলার পদ্ধতিতেও ভূমিধ্বস ঘটবে- আজকে না ঘটলেও কয়েকদিন পড়ে ঘটবে। তাছাড়া শ্রমিকের কাজের পরিবেশ নিরাপদ রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বড়পুকুরিয়ার কাজের পরিবেশ শ্রমিকদের অনুকুল নয়। অত্যাধিক উচ্চতাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতার মাঝে শ্রমিকরা সেখানে কাজ করছে। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ ব্রিটিশ খনি বিশেষজ্ঞ আলবার্ট বেনস ডেভিস হিট স্ট্রোকে নিহত হলে সবার টনক নড়ে- পেট্রোবাংলার অধীনে একটা তদন্ত কমিটি হয় যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে জিওলজিক্যাল এবং হাইড্রোলজিক্যাল ডিজাইনের ত্রুটির কারণেই এরকম উচ্চতাপ এবং উচ্চ আদ্রর্তা থাকে। যেখানে কমপক্ষে ৩০-৩৩ ডিগ্রীতে তাপমাত্রা নামিয়ে আনা দরকার সেখানে তাপমাত্রা সবসময়ই ৪০-৪২ ডিগ্রী থাকে। এর আগেও ২০০৫ সালে কার্বন মনোক্সাইড নি:সরণ হয়ে খনির কাজ অনেকদিন বন্ধ ছিল এবং খনি উন্নয়ন কাজের সময় ভূমি ধ্বসে ৩ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। কথা হলো, এগুলো আগে কেন চিন্তা করা হয়না, কেন খনি উন্নয়নের সময় যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় না, কেন এমনকি খনিতে একজন নিয়মিত মাইন ইন্সপেক্টর পর্যন্ত থাকে না? রুম এন্ড পিলার পদ্ধতির ক্ষেত্রেও বিষয়গুলো মাথায় রেখে মানুষকে মুনাফার আগে স্থাপন করে সব পরিকল্পনা করা দরকার।
এ প্রসংগে আমরা আরও কিছু কথা বলে রাখতে চাই। যখনই কোন খনি খনন কিংবা বাধ নির্মাণ কিংবা সেতু নির্মাণের সময় কিংবা এসব ক্ষেত্রে কোন দুর্ঘটনার ফলে লোকজনকে উচ্ছেদ হতে হয়, তখন জাতীয় স্বার্থের কথা বলা হয়, বলা হয় বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগের প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু এ কেমন জাতীয় বা বৃহত্তর স্বার্থ যেখানে ক্ষুদ্রতর এলাকাবসীর কোন অংশদ্বারিত্ব নেই? আর যদি অংশীদ্বারিত্ব নাই থাকে তাহলে কেমন করে সে জাতীয় স্বার্থের সাথে একাত্মতা বোধ করবে কিংবা জাতীয় স্বার্থের জন্য আত্মত্যাগ স্বীকার করবে? সিলেটের টেংরাটিলায় নাইকোর গ্যাস খনিতে যখন অগ্নিকান্ড ঘটল তখন সেখানে আমরা দেখেছি খনির ঠিক পাশেই বসবাস করা এলাকাবাসীর পুড়ে যাওয়া ঘরে মাটির চুলার অস্তিত্ব—অর্থাত বাতির নীচে অন্ধকার! তাহলে টেংরাটিলাবাসীর কাছে জাতীয় স্বার্থ কি খুব বিমূর্ত কোন বিষয় নয় কি? তার কাছে এই জাতীয় স্বার্থ কি জাতীয় শোষণেরই নামান্তর নয়?
আবার যখন কোন একটি বিষয়কে জাতীয় স্বার্থের অনুকুল বলে রায় দেয়া হয় তখন ঠিক কি কি বিষয় বিবেচনায় আনা হয়? ইউনিকল, শেল, কেয়ার্ন, নাইকো ইত্যাদি কোম্পানীর সাথে যে সেব প্রোডাকশন শেয়ারিং কনটাক্ট করা হয়েছে যেখানে আশি ভাগ গ্যাসের মালিক বহুজাতিক কোম্পানী কিংবা বড়পুকুরিয়ায় এই যে স্থানীয় জনগণের ভালমন্দ বিবেচনা না করে দুটি চায়না কোম্পানীকে দিয়ে কয়লা উত্তোলন শুরু হলো--- এসব কোন জাতীয় স্বার্থের অনুকুলে গেছে একটু হিসেব করা দরকার। আবার জাতীয় স্বার্থ কি স্রেফ টাকার অংকে কিছু পাওয়া নাকি অর্থনৈতিক বিবেচনার পাশাপাশি সামাজিক ও পরিবেশগত বিবেচনাগুলোও মাথায় রাখা উচিত? আজকে সুন্দরবন এলাকায় যদি কয়লা বা গ্যাসের খনি পাওয়া যায় এবং সেগুলো উত্তোলন করতে গিয়ে যদি সুন্দরবন ধ্বংস করে ফেলতে হয় তাহলে আমরা কি ভবিষ্যতের বিবেচনা মাথায় না রেখে তাতক্ষণিক স্বার্থে তা-ই করে ফেলব নাকি যতদিন পর্যন্ত নিরাপদ প্রযুক্তি আমাদের হস্তগত না হয় ততদিনপর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর হাতে আমাদের মূল্যবান জাতীয় সম্পদ তুল না দিয়ে বরং জ্বালানী আমদানী করে হলেও তাতক্ষনিক প্রয়োজনটা মেটাবো?
আমরা মনে করি আরও দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এসব প্রসঙ্গের মীমাংসা হওয়া দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১০:১৩