বাসে ওঠার সময় কান্নাকাটি আমাদের ফ্যাশন না, আমরা সবসময় হাসি মুখে হাত নাড়ি সবাই। মোবাইলের হেডফোনে কানে গুজে মার্সিডিজ বাসে মনের আনন্দে ছড়িয়ে মড়িয়ে বসেছি। সমস্যা হলো গানের ভলিউম এমন দিয়েছি, যে হাতপা ছড়িয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে। আরামদায়ক ঠান্ডা। আমার থার্ড রো পুরোই খালি। সমস্ত বাসে আপাতত তিন জন মাত্র যাত্রী। সামনের সারির দুই মাথায় বাকি দুজন। কোনো এক স্টপেজে থামলো বাস - চোখ খুলতে ইচ্ছাও হচ্ছে না। তবু খুললাম, কাল জিন্সের পা একটা এলো সেটা আমাকে পেরিয়ে ফোর্থ রো তে বসলো। চেহারাটা দেখার ইচ্ছা হচ্ছিলো, কারন পাটা বেশ সুন্দর। অদ্ভুত! পায়ের পাতাও দেখতে পাইনি, শুধু পায়ের একটু, তবু সুন্দর লাগলো। গানে মন দেই, কিছুই দেখার আশা নাই, এত কষ্ট করে মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে না। পায়ের হাঁড় সুন্দর হলেই চেহারা ইন্টারেস্টিং হয় না। গাড়ির ফিটফাট সুপারভাইজার নতুন যাত্রীটার কাছে গেলো, তার সীট যে দ্বিতীয় সারিতে সেটা কি তার খেয়াল আছে কিনা সে ব্যাপারেই অতিরিক্ত মিষ্টি করে খোঁজ খবর করতে গেলো। হেডফোন খুলে গান আবার সিলেক্ট করলাম। কালো টিশার্টের গলার আওয়াজ দেখি আমার হেড ফোন আসক্ত কানে ভালো মত রিসিভই করে না। সে এখানে জেনেই বসেছে, আশা করছে তাতে তেমন সমস্যা নাই। কানে হেড ফোন গুজলাম আবার। আচ্ছা লাস্ট সারির সীটে গিয়ে বসলে কেমন হয়? সামনের সব ফাকা সীটগুলোকে বেশ দখল দখল মনে করা যেত কি - আমি যা কিছু দেখি, তা আমার দখলে?
দারুন একটা ঘুম পাচ্ছে, একটা কম্বল চেয়ে নেবো নাকি... ভাবি আরেকটু... তবলা একবার একানে একবার ওকানে ফিসফিসাচ্ছে, অদ্ভুত সুর...। মাটির দিকে চেয়ে আছি, ভাবছি, বোঝার চেষ্টা করছি, কি হচ্ছে ঠিক ব্যাপারখানা, অদ্ভুত সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া হাতে-ঘাড়ে-কানে লাগছে। মাটির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি ঘটনাটা কি! নিচু হয়ে মাটিতে হাত বুলালাম, এটা মাটি না, এটা তেলরং দলা পাকানো, সমস্তটা তেলরং। আমি দাড়িয়ে আছি একটা ছবির ভিতর।
আমি দাড়িয়ে আছি তেলরঙে আঁকা জমিনের উপর, সমস্তটা, যতদূর দেখা যায়, সবটা আঁকা। আমার চারপাশে সব কিছু আঁকা তেলরঙে। নড়নচড়ন নট ক্লিয়ার হয়ে দাড়িয়ে আছি। পায়ের কাছের রঙের দলাটাকে ভালো লাগছে। সমস্ত জমিনটাই এবড়ো থেবড়ো, তবু এই রঙের দলাটাই যেন বেশি বেশি চেনা। এটা একটা স্বপ্ন, আমি স্বপ্ন দেখছি আমি। পরিস্কার বুঝতে পারছি এটা একটা স্বপ্ন। এত ভালো বুঝছি যেন আমি জেগে জেগেই ভাবছি। জেগেই আছি নাকি?
বাতাসটা সুন্দর, এটা মনে সাগরের দিক থেকে আসছে। একপাশে কালো মত পানি মতটা কি সাগর? এমন ডোবা টাইপ কেনো? অন্ধকার আর ভুতুড়ে মত থেমে থাকা কেনো? সমস্ত ছবিটাই বিতিকিচ্ছিরি ঘুপটি মার্কা। আকাশটা। মেঘ বেঁধে বেঁধে সমস্ত আলো আঁটকে রাখা। একটা অন্ধকার ছবি, আলো বেজায় কম কম। ভালো লাগছে না কিচ্ছু। একটা শুকনো পাতা বেশ মজা করে মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেটে হেটে উড়ছে। দেখতে মজা লাগছে। আমি ওটার পিছু পিছু গেলাম।
একটা গাছ। গাছ তলায় একটা রূপালি মাছ বিরক্ত ভাবে দাড়িয়ে একপাশ ফিরে। একটা চোখ দিয়ে কোনদিকে দেখছে কে জানে। আমার দিকে না। সুন্দর মাছ। আমি ওড়নাটা আরেকটু অন্যভাবে পরতে পারতাম। এখন আর কি করা। পাতাটার পিছু পিছু এখানে চলে এসেছি। আসতে আসতে দেখি একটা গাছ তলায় কাত হয়ে দাড়ানো একটা দারুন মাছ। গাছের ডালে একটা টার্কি মুরগি বসে আছে। একদম জঘন্য দেখতে টার্কিটা আমাকে মনে হয় দেখছে, অন্তত মাঝে মাঝে হলেও। মানে সে মাছটার মত একেবারে অচেতন নয় আমার বিষয়ে।
আমি আশে পাশে কি আছে দেখছিলাম। পাশ দিয়ে একটা শামুক যাচ্ছিলো, আমি তাকে দেখছি বলেই মনে হয় সে আমার দিকে বিচ্ছিরি ভাবে ভুরু উঁচালো। মানে ঠিক সেতো আমার পরিচিত না তাই না? নাকি? আর আগে কখনো জানতাম না শামুকদের এত ভুরু থাকে। অল্প একটু থাকে কিনা তাও তো ঠিকঠাক এখন মনে পড়ছে না। শামুকটা যেতে যেতে এবার হাসলো, সে হাটছে কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এত দ্রুত সে যাচ্ছে তবু তেমন আগাতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। হাসিটা দেখে আমি তাকে ভুরু নাচানোর জন্য মনে মনে মাফ করে দিলাম, আমিও অল্প একটু হাসলাম। সে বললো, আমি এখন একটু কাজে যাইতেছি, পরে কথা হইবে, কেমন? বলে আবার একটু হাসলো। আমিও ভালোমানুষের মত বললাম, আচ্ছা। সে খুব ব্যস্ত ভাবে যাচ্ছে। যেতে যেতে সে একটা কচ্ছপ হয়ে গেলো। কচ্ছপ হয়েও সে খুব ব্যস্ত ভাবে যেতে লাগলো।
আমি যে তার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম সেটা বুঝলাম একটু পর। সে আবার শামুক হয়ে গেলো যখন তখন আমি দাড়িয়ে পড়েছিলাম বলে টের পেলাম যে এত সময় আমি তার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। সে এত বদলাবদলির মাঝেও খামেনি। সবার সামনে এমন ভাবে সে যে শামুক থেকে কচ্ছপ, আবার কচ্ছপ থেকে শামুক হচ্ছে , এটা কি একটা লজ্জার বিষয় না? সে এতই ব্যস্ত যে তার মনে হয় কোন কিছুর পরোয়া নাই। আমি চারপাশে তাকালাম।
কাছিম/শামুকটার পিছু পিছু আমি অনেক দুর চলে এসেছি মাছ দাড়ানো গাছটা থেকে। দুরে ঝাউবনের দিকে একটা সাদা মত পাথর দেখা যাচ্ছে। পাথরটা যেনো দুটো মানুষের মূর্তি। কাছে গিয়ে দেখবো নাকি ওরা পাথর নাকি মানুষ, এমন ভাবে দুজন এভাবে আছে কি করে? এমন ফাকা জায়গায় এভাবে কেউ জড়াজড়ি করে থাকে নাকি! মানুষের রূচি-টুচি সব শেষ। কাছে গিয়ে দেখবো নাকি ওরা পাথর নাকি মানুষ? থাক আমার এত জানার দরকারটা কি!
(অসমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:৫৮