শাম্মা ভাইয়ের সাথে দেখা হলে তাঁর যে বৈশিষ্ট্যের জন্য সহজেই তাঁকে মনে থাকবে সবার, সেটা তাঁর মাথার একরাশ কাঁচাপাকা চুল। কাজেই প্রথম যেদিন ভর্তি কোচিং করতে গিয়ে তাঁকে দেখি, কোন সন্দেহই ছিল না এই লোককে অনেক বছর পরেও মনে থাকবে। কিন্তু ঐ পাকা চুল বা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা বা এমনকি ভাল পড়ানোর জন্যও না, শাম্মা ভাইয়ের সাথে খাতির হয়ে গেল তাঁর সহজ ব্যবহার আর একদমই বড়ভাইসুলভ কর্তৃত্ব না থাকা হাসিখুশি চরিত্রের জন্য। বুয়েটের ৯৫ ব্যাচ, সিভিল এন্ঞ্জিনিয়ার, কিন্তু কেন ওমেকাতে পড়াচ্ছেন পূর্ণকালীন, সেটা জিজ্ঞেস করার তখনো সাহস হয়নি, হাজার হোক, তিনি সিনিয়র, আমি সদ্য এইচএসসি দেয়া ছাত্র।
সেই সাহসটা হলো বুয়েটে ভর্তি হবার পর, যখন বাড়তি দু'পয়সা কামাবার ধান্দায় আমি আর আরো অনেক বন্ধুবান্ধবই কোচিংয়ে এসে জুটেছি, অন্যরা একটু এলিট, ক্লাস নেয় হবু বুয়েটিয়ানদের, আমি খাতা দেখি, পরীক্ষা নিই, মাঝে মাঝে ২-১টা ক্লাস পাই। বেশিরভাগ সময়ই এক জায়গায় বসে খাতা দেখতে হয় বলে শাম্মা ভাইয়ের সাথে সারাক্ষনই কথাবার্তা বলি, বাচাল হিসেবে আমার কুখ্যাতি আছে, সেটা কতটা বেশি ভাইয়া হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। বিরক্ত হবার কথা, কিন্তু স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে দীর্ঘ কয়েকটা মাস এই অধমের অত্যাচার সহ্য করে গেলেন। একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, চাকরিবাকরি না করে এখানে কেন? জানালেন, বাজার ভাল না, আর মালিকপক্ষের সাথে বনিবনা হয় না, ক'দিন পরপরই চাকরি ছাড়েন। মাঝে প্রথম আলোতেও নাকি ক'দিন কাজ করেছেন, সেখানেও বনেনি, এখন কোচিংয়ে পড়ান। প্রথম আলো নিয়ে তখন আমরা বেশ অবসেসড, এমন জায়গায় সুযোগ পেয়েও যে ছাড়ে, সে খানিক বেকুব টাইপেরই হবে, ধরে নিলাম।
যাই হোক, এ নিয়ে ঘাঁটালাম না, যার যার ব্যাপার।
তো এহেন শাম্মা ভাই যখন হুট করে একদিন ওমেকার চাকরি ছেড়েও হাওয়া হয়ে গেলেন, অবাক হলাম না। ওমেকার মিজান ভাই ধান্দাবাজ লোক, তাঁর সাথে ঘাড়ত্যাড়া কারো বনিবনা হবার কথা না, শাম্মা ভাইয়ের মত হলে তো কথাই নেই। ফোন করে জানলাম, ঘটনা সেরকমই। এরপর মোবাইল ছিনতাই হলো আমার, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, একমাথা কাঁচাপাকা চুলের লোকটার কথা প্রায় ভুলেই গেলাম।
সময় যায়, বুয়েটে শেষবর্ষে চলে এসেছি, বড় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে জীবনের অনেক কিছু নিয়েই মোহভঙ্গ ঘটেছে ততদিনে। পুরকৌশলীদের চাকরির বাজার নিয়ে যেমন, তেমনি প্রথম আলোর মত সুশীলদের নিয়ে, শাম্মা ভাইয়ের আপাতরূঢ় কথাগুলোর অর্থ বুঝতে শিখেছি অনেক দাম দিয়ে। একদিন আনমনে ক্যাম্পাসে হাঁটছি, হঠাৎ একরাশ কাঁচাপাকা চুল দেখে দৌড় দিলাম, ঠিক সেরকমই আছেন, শাম্মা ভাই কিন্তু দেখেই চিনলেন, কথা শুনে মনে হলো, মাত্রই গতকাল দেখা হয়েছে। এবারে বেশ স্থির হয়ে বসেছেন, একটা স্থায়ী চাকরিও হয়েছে, মাস্টার্স করেন বুয়েটে, স্বভাব অনুযায়ী এখানেও এর মাঝেই একবার একটা ছেড়ে আরেকটায় ঢুকেছেন। কথাবার্তা বলে সান্ত্বনা দিলেন, তাঁর যখন গতি হয়েছে আমাদেরও যে হবে এনিয়ে কোন সন্দেহ নাকি তাঁর নেই। ঠিক আগের মানুষটাই আছেন, দেখে ভাল লাগলো খুব, একটা সময় পাখি ঘরে ফেরেই।
যোগাযোগ হয়েছে এরপরে নিয়মিতই, অফিসেও গেছি, কিন্তু গত প্রায় ৬ মাস ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্যই কোন যোগাযোগ নেই। গতকালকে ফেসবুকে হঠাৎ একটা গ্রুপ থেকে মেইল, সাধারণত এসব মেইল দেখার আগেই ডিলিট করে দেই, প্রথম শব্দটাই "শাম্মা, সিভিল ৯৫" দেখে ঢুকলাম। যা দেখলাম তার জন্য তৈরি ছিলাম না, গত ২১ অক্টোবর, বুধবার, মালিবাগের কাছে শাম্মা ভাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েছেন। বেঁচে গেছেন, কিন্তু ডান পা খানা ৩ টুকরো হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে যদি পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচাতে হয়, কিন্তু অপারেশনের খরচ প্রায় ২০ লাখ টাকা, যেতে হবে ব্যাঙ্কক। দেখার পর মাথা এলোমেলো হয়ে গেল, ওরকম প্রাণবন্ত হাসিখুশি একজন মানুষকে কিছুতেই হাসপাতালের বেডে অথবা পঙ্গু হিসেবে কল্পনা করতে পারলাম না, আমি নিশ্চিত যারা একবার হলেও শাম্মা ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে তারা দুঃস্বপ্নেও সেটা কল্পনা করতে পারবে না।
মেইলটার সাথে একটা অ্যাকাউন্ট নাম্বার আর মোবাইল নাম্বার দেয়া ছিল, তাড়াতাড়ি পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল যা দেখছি সেটা দুঃস্বপ্ন না, নির্মম বাস্তব। মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ এক লোক রাস্তায় নেমে আসে, তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, মোটরবাইকটা তাঁর ডানপায়ের উপর পড়ে হাড় টুকরো করে দিয়েছে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আছেন, ডাক্তাররা
জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এই ধরণের অপারেশনের ব্যবস্থা নেই, ৫-৬ দিনের মাঝে ব্যাঙ্ককে নিয়ে অপারেশন করতে হবে। সময় খুবই কম, দেরি হলে আজীবন এই ভাঙা পা নিয়ে থাকতে হবে তাঁকে। বন্ধুরা চেষ্টা করছেন, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এত টাকার ব্যবস্থা করা যে কারো জন্যই কঠিন ব্যাপার। প্রাথমিক খরচ অর্থাৎ বাইরে যাওয়া, ভর্তি, ওষুধপত্র হিসেবেই ৮ লাখ টাকা লাগবে, কয়েকদিনের মাঝেই। বুয়েটে যাই না অনেকদিন, কিছু করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে, ব্যাচমেটরাও বাইরে, যে ক'জন চেনা লোক আছে জানালাম, কয়েকজন জুনিয়রকেও জানানো গেল। ব্লগার অদ্রোহ আর বোহেমিয়ানকে যখন বললাম, জানালো যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, তবে ব্লগে একটা পোস্ট দিয়ে যেন জানাই, নিশ্চয়ই কারো না কারো সাহায্য পাওয়া যাবে।
কথা শুনে মনে হলো, আগেও এটা ভাবলে পারতাম। আমি ক্ষুদ্র মানুষ হতে পারি, ক্ষমতা সীমিত হতে পারি, কিন্তু সামহোয়্যারইন ব্লগের ২০ হাজার ব্লগারের মাঝে অনেক অনেক বড় মনের মানুষ আছেন, সবসময়ই সেটার প্রমাণ পেয়েছি। আমরা ক'জন সামান্য মানুষ যদি তাদের বড় ভাইয়ের জন্য হাত পেতে দাঁড়াই, আমি নিশ্চিতভাবে জানি তাঁরা আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না। খুব বেশি কিছু করতে হবে না, আমাদের যা সামর্থ্য সেই অনুযায়ী সামান্য দিলেও কিন্তু হয়ে যায়, ২০ হাজার মানুষ ১০০ টাকা করে দিলেও ২০ লাখ টাকা হয়। কারো এক প্যাকেট সিগারেটের দাম, কারো এক বেলা ঘোরাঘুরির টাকা, কারো আড্ডার বাজেট, কারো একটা টিশার্ট কেনার টাকা, কারো এক বেলা ব্যুফে খাবার টাকাটা যদি উৎসর্গ করি, একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়া যায় তাঁর বিনিময়ে, প্রাপ্তির তুলনায় ব্যয়টা তখন খুব সামান্য মনে হয় না?
যতদিন আমরা ভার্সিটিতে ছিলাম, কোন কিছু হলে মাঠে নেমেছি। সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছি অনেক সহৃদয় বন্ধুকে। আজকে ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে, কিন্তু আমরা জানি, মৃত্যু আর অসহায়তার সামনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা যুদ্ধ করবো, আমাদের সহযোদ্ধার অভাব হবে না। সামহোয়্যারের ব্লগাররা, কোন দয়া নয়, শুধু একজন মানুষ যখন পঙ্গুত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন, তাঁর সাথে কাঁধে কাঁধ মেলাতে আপনারাও এগিয়ে আসুন, আপনাদের সহৃদয় হাত বাড়িয়ে দিন একজন যোদ্ধার উঠে দাঁড়ানোর জন্য। আমি জানি, আমরা জানি, আপনারা পিছিয়ে যাবেন না, মানুষ কখনো পিছিয়ে যায় না, মানুষ হারে না, হারতে পারে না।
যারা দেওয়ান আইনুল হক শাম্মাকে বাঁচানোর লড়াইয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান, তাঁদের জন্য নিচের ইস্টার্ন ব্যাঙ্কে শাম্মা ভাইয়ের বন্ধু রেশাদ ভাইয়ের অ্যাকাউন্ট নাম্বার ও মোবাইল নম্বর:
Kazi Reshad Islam
A/C no- 101-102-12687
Eastern Bank Ltd
Dhanmondi Branch, Dhaka-1205
Mobile no - +880 1819 202020
মেইল-- reshad25@gmail.com
যারা আমেরিকা বা অন্যান্য দেশ থেকে টাকা পাঠাতে চান, তারা moneygram বা
Western Union এর মাধ্যমে পাঠাতে পারেন। পাঠানোর পরে কোড নাম্বারটা রেশাদ ভাইয়ের কাছে জানালেই তিনি তুলে নেবার ব্যবস্থা করবেন, অথবা যারা আমেরিকায় আছেন তারা এখানেও যোগাযোগ করতে পারেন:
Jony কন্টাক্ট নাম্বার--- (405 429 9354)
অস্ট্রেলিয়া থেকে কেউ ডোনেশন দিতে চাইলে তাঁদের জন্য:
Australia:
BSB: 012224, AC: 500696251
Account Name: S M Rubayet Ferdous Robin
Mob: 0419740418
রামপুরা বা আশপাশের এলাকার ব্লগাররা যদি কোন সাহায্য করতে চান, আমার এই নম্বরে ফোন করলে, অথবা মেইল করলে নিজ দায়িত্বে সেটা পৌঁছানোর চেষ্টা করবো।
01190-535292
farhan7123@gmail.com
যারা বুয়েটে টাকা জমা দিতে চান, তাঁরা দয়া করে ব্লগার বোহেমিয়ান কথকতার (CSE, Batch 05) সাথে যোগাযোগ করুন। কন্টাক্ট নাম্বার:
01733-731856
ব্লগাররা, সবার কাছেই হাত পাতছি, খুব তাড়াতাড়ি সাহায্য দরকার, দয়া করে আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না।
আপডেট: শাম্মা ভাইয়ের আজকে অ্যাপোলো হাসপাতালে সফল অপারেশন হয়েছে, ডাক্তাররা এখন তাঁকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন, কয়েকদিন পরে বোজা যাবে পরবর্তী চিকিৎসা কি হবে। ব্লগারদের মাঝে কয়েকজন এর মাঝেই ব্যক্তিগতভাবে ব্যাঙ্কে টাকা দিয়েছেন, আমার হাতেও পৌঁছে দিয়েছেন ২ জন। শনিবার থেকে আশা করছি বোহেমিয়ান এবং অদ্রোহ বুয়েটে ফান্ড তোলার জন্য কিছু একটা উদ্যোগ নেবে। আগামী মাসের প্রথম দিকটাতেও যদি কেউ সাহায্য করতে চান, ইস্টার্ন ব্যাঙ্কের যে কোন শাখাতে এই অ্যাকাউন্ট নম্বরের উদ্দেশ্যে টাকাটা জমা দিয়ে দিলেই হবে।