ধুলোধূসরিত পোশাক আর চোখে স্টিলের রিমওয়ালা চশমা পরিহিত একজন বৃদ্ধলোক রাস্তার পাশে বসে ছিল। পাশেই নদীর ওপর একটি ভাসমান ব্রিজ এবং তার উপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি, ট্রাক, পুরুষ, মহিলা এবং শিশুরা পার হয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়ার গাড়িগুলো ঢুলতে ঢুলতে ব্রিজ পার হয়ে ওপাশের তীরের খাড়া জায়গায় পৌঁছুলে, সৈন্যরা সেগুলো ঠেলে উপরে উঠিয়ে নিতে সাহায্য করছিল। গাড়িগুলো তীরে উঠলে অপেক্ষমান ট্রাকগুলো হাঁটু পর্যন্ত ধুলোমাখা যাত্রীদের নিয়ে গড়গড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি সেদিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে অনড় হয়ে বসে থাকল রাস্তায়। সে এতটাই ক্লান্ত ছিল যে আর একচুলও নড়তে পারছিল না।
ব্রিজের ওপারে গিয়ে শত্রুদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে খবর নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। আমি যথাকর্তব্য সমাপন করে ফিরছিলাম। দেখলাম, এখন রাস্তায় গাড়ি তেমন একটা নেই। আর হেঁটে ব্রিজ পার হওয়া লোকের সংখ্যাও কমে এসেছে। তবু বৃদ্ধ লোকটি এখনো পূর্বের জায়গাতেই বসে আছে।
আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কোথা থেকে এসেছ?'
সে হাসল এবং বলল, ‘স্যান কার্লোস থেকে’।
ওটা ছিল তার নিজের শহর। তাই শহরের কথা বলতে গিয়ে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘আমি সেখানে পশুপাখিদের দেখাশোনা করতাম’।
আমি তার কথা পুরোপুরি না বুঝতে পারলেও ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘আচ্ছা’।
সে আবার বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, আমি পশুপাখিদের দেখাশোনা করতাম। আর আমিই সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে স্যান কার্লোস ছেড়ে এসেছি’।
আমি তার ধুলোমাখা কালো পোশাকের দিকে দেখলাম। এবং তার ধূসর মুখ ও স্টিলের রিমওয়ালা চশমার দিকেও। বৃদ্ধ লোকটি দেখতে রাখলের মত নয়; এমনকি পশুপালক বলেও তাকে মনে হয় না। বললাম, ‘তুমি কী কী পশুপাখি দেখাশোনা করতে?’
‘বিভিন্ন ধরনের’ সে ডানে বায়ে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘তাদেরকে ছেড়ে আমাকে চলে আসতেই হল’।
আমি ব্রিজটার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আফ্রিকার মত এই এব্রো ডেলটা দেশটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম - আর কতক্ষণ সময়ই বা আছে শত্রুর মুখোমুখি হবার। প্রায় সাথে সাথেই শুনতে পেলাম শত্রুর আক্রমনের সেই চিরবিস্ময়কর আগমন সংকেত। এবং তখনও বৃদ্ধ লোকটি নির্বাকারভাবে সেখানে বসেই থাকল।
‘তুমি ঠিক কী কী প্রাণি দেখাশোনা করতে?’ আমি কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম।
‘সব মিলিয়ে তিন রকমের’ সে বলল, ‘দুটো ছাগল, একটা বেড়াল আর চারজোড়া কবুতর’।
‘সবকিছুই তোমাকে ছেড়ে আসতে হল?’
সে বলল, ‘হ্যাঁ, কামানের গোলার কারণেই। ক্যাপ্টেন আমাকে খুব দ্রুত সরে যেতে বলেছিল’।
দূরে ব্রিজের শেষ মাথায় কিছু ঘোড়ার গাড়ি দ্রুততার সাথে পথ চলছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আমি বৃদ্ধ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার পরিবারে কেউ নেই?’
সে উত্তর দিল, ‘না, শুধুমাত্র ঐ ক’টি প্রাণি ছাড়া আর কেউ নেই’। তারপর বলল, ‘বিড়ালটি অবশ্যই ঠিক থাকবে। একটি বিড়াল তার নিজের খেয়াল রাখতে পারে। কিন্তু বাকীদের কি হবে আমি ভাবতেই পারছি না’।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কী পলিটিক্স কর?’
‘আমি পলিটিক্সের বাইরে’ সে বলল, ‘আমি সত্তর বছরের বৃদ্ধ। বার মাইল পথ হেঁটে এসেছি এবং আর একটুও যাবার ক্ষমতা আমার নেই’।
আমি তাকে বললাম, ‘এটা থামার মত উপযুক্ত জায়গা নয়। তুমি যদি আর একটু দূরে যেতে পার তাহলে ট্রাকে করে টর্টোসার দিকে যাত্রা করতে পারবে’।
সে বলল, ‘খানিকটা বিশ্রাম নিই, তারপর আমি যাব। ট্রাকগুলো কোথায় যায়?’
‘বার্সিলোনার দিকে’
‘ওদিকের কাউকেই আমি চিনি না’ সে মৃদু স্বরে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তোমাকে সত্যিই অনেক ধন্যবাদ’।
ক্লান্ত এবং শূন্য দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকাল। তারপর কারো কাছে দুঃখ শেয়ার করার জন্যেই হয়তবা বলল, ‘বিড়লটি ঠিক থাকবে, আমি নিশ্চিত। বিড়ালটির সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। কিন্তু অন্যরা! বাকি প্রাণিগুলো সম্পর্কে তোমার কী মনে হয়?’
আমি বললাম, ‘তারাও সম্ভবত ঠিকঠাক থাকবে’।
‘সত্যিই?’
দূরে নদীর ওপারে, যেখানে এখন কোনো ঘোড়ার গাড়ি নেই, সেই তীরের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘কেন নয় !’
‘কিন্তু কামানের গোলার সামনে তারা কীবা করতে পারবে, যেখানে আমাকেই কামানের গোলার কারণে চলে আসতে হয়েছে’।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি কবুতরের খাঁচা খুলে রেখেছিলে?’
‘হ্যাঁ’।
‘তাহলে অবশ্যই তারা ঊড়ে যাবে’।
সে বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তারা উড়ে যাবে। কিন্তু অন্যরা। তাদের সম্পর্কে আর চিন্তা না করাটাই বোধহয় ঠিক’
আমি ব্যস্ত হয়ে তাকে বললাম, ‘তুমি যদি এখানে বসে থাকতে চাও, তো থাক; আমাকে যেতে হবে। নইলে তাড়াতাড়ি ওঠো এবং হাঁটার চেষ্টা কর’।
‘ধন্যবাদ’ বলেই সে উঠে দাঁড়াল। আর এদিকওদিক দুলতে দুলতে আবারো ধুলোর মধ্যে ধপ করে বসে পড়ল। তারপর খুব মৃদু স্বরে – আমাকে নয়, অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল – ‘আমি পশুপাখিদের দেখাশোনা করতাম। আমি শুধুমাত্র পশুপাখিদেরই দেখাশোনা করতাম’।
আসলে তাকে নিয়ে কিছুই করার ছিল না। দিনটি ছিল ইস্টার সানডে এবং ফ্যাসিস্টরা এব্রোর দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছিল। এটা ছিল ধূসর, মেঘলা একটি দিন এবং আকাশে তাদের প্লেনগুলোও দেখা যাচ্ছিল না। এবং আসল সত্যিটা হলো – বিড়ালেরা জানে কিভাবে নিজেদের যত্ন নিতে হয়; আর শুধুমাত্র এটাই ছিল বৃদ্ধ লোকটির জন্যে চিরকালের সান্ত্বনা।
[ গল্পঃ ব্রিজের পাশের বৃদ্ধ লোকটি
মূলঃ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
অনুবাদঃ এস এম মামুনুর রহমান (ডি মুন) ]
আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে (জুলাই ২১, ১৮৯৯ -জুলাই ২, ১৯৬১) ছিলেন মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বিশ শতকের ফিকশনের ভাষার ওপর তাঁর নির্মেদ ও নিরাবেগী ভাষার ভীষণ প্রভাব ছিল। তাঁর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ও জনপ্রিয় ইমেজও পরবর্তী প্রজন্মের ওপর ভীষন প্রভাব ফেলেছিল। বিশ শতকের বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে তিনি তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন এবং ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোট গল্প সংকলন এবং দুইটি নন-ফিকশন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আরও তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোট গল্প সংকলন এবং তিনটি নন-ফিকশন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের অনেকগুলোই আমেরিকান সাহিত্যের চিরায়ত(ক্লাসিক) গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। [উইকিপিডিয়া]
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৫ রাত ৮:৫৯