লেখালেখি আর সময়ের ক্যালকুলাসটা বড় অদ্ভুত। সময় বয়ে চলছে দ্রুততর গতিতে দৃপ্তভাবে। আর লেখালেখির জগতে তার গতি ক্ষিপ্রতা কিংবা বহুরুপিতা যেন আরোও প্রাঞ্জল আরোও প্রকট। নবীন লেখকদের সাহিত্যচর্চা এখন অনেকটাই হয়ে গেছে অনলাইন নির্ভর। কবিতার খাতা মুড়ে কবিতা লেখাটা হয়ে ওঠেনা আর... ডায়েরীর পাতাগুলো যেন মলিন শুকনো পড়ে রয় ....
...অনলাইনে বাংলার জয়জয়কার এখন। একবিংশ শতকের এভাগে এসে আমরা বাঙালীরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং বাংলায় মত প্রকাশের, আলোচনা সমালোচনার দক্ষতায় বাংলাকে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছি অনেক বিস্তৃত পরিসরে। অনলাইনে বাংলা লেখালেখি হচ্ছে বেশ কবছর ধরেই। যদিও খুব লম্বা নয় সময়টি। কিন্তু এ সামান্য সময়েই বাংলা আর বাঙালী লেখকদের অর্জন কিন্তু অসামান্য। অনলাইনের গুণে সাইবার তথা ইন্টারনেট নির্ভর এ বিশ্বায়নের যুগে সমগ্র বিশ্বে বাংলা পরিচিতি পেয়েছে, স্বীকৃতি পেয়েছে, বাহবা কুড়িয়েছে, সম্মান কুড়িয়েছে, পেয়েছে সার্বজনীন গ্রাহ্যতা। বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে বাঙালী লেখক গণ যেমন অতীতেও ছিলেন কলম হাতে সর্বাগ্রে এ সাইবার যুগে এসেও যেন কীবোর্ড হাতে সর্বাগ্রে সম্মুখেই...
বাঙালী লেখকগণ জুড়ে আছেন এসব অগুনতি অর্জনের আর স্বীকৃতির পুরোধা জুড়েই। বাঙালী লেখকগণ যে এখন অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়েছেন, পড়ছেন তা কিন্তু একেবারে অনর্থক কিংবা অবাক করার মত কিছু নয়। নষ্টালজিক ব্যপারগুলো ইদানিং সামনে চলে আসে বারবারেই। কারণ এখন চর্তুদিকে তাকালে দেখি লেখালেখির স্টাইল পাল্টেছে, পাল্টেছে পঠন প্রক্রিয়াও, পাল্টেছে প্রকাশভঙ্গিরও এবং প্রকাশ মাধ্যমও। প্রিন্টিং মিড়িয়া চাপা পড়ে প্রায় হেরেই গেছে ইলেক্ট্রনিক মিড়িয়ার কাছে। ইলেক্ট্রনিক মিড়িয়ার সুবিধা হল লেখা প্রকাশের জন্য অতো বেশী স্ট্রাগল করতে হয় না। তবে প্রকাশের পরে কতোটুকু বাহবা পেলেন সেটা দেখবার বিষয়!
আমাদের শুরুর সময়টা ঠিক এরকম ছিলোনা। সেই ছোট্ট বেলায়, স্কুলের বাৎসরিক সাহিত্য সাময়িকীর জন্য লেখা লিখতে হবে... এখনো মনে পড়ে, আহা কি সে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যেতো ছোট্ট মনে। স্কুলের শিক্ষক থেকে হেড স্যার প্রতিতা মানুষ এমনকি বন্ধুবান্ধবের অভিভাবক পর্যন্ত দেখবে আমার ক্ষুদে হাতের বাঁকাতেড়া লেখা!! একি কম কথা! আকাঙ্ক্ষা, আবেগ আর চাপা উল্লাস নিয়ে লেগে পড়তাম একতা কিছু লিখতে... সেই সে লেখালেখির শুরু... প্রথম প্রথম দু চার লাইন কবিতা বানানোর বৃথা চেষ্টা। ভাবতাম লাইনের শেষে ছন্দ মিললেই বুঝি কবিতা হয়ে যায়! এরপর একটা দুটো করে প্রকাশ পেতে থাকলো প্রতিটা সংখ্যাতেই লেখাগুলোর কোন না কোনটা... একসময় দুর্বার কলেজ জীবনে পা দিলাম, আহা বুকে সে কি সাহস আর পায়ে আঠারোর তেজ! সেই তেজের বসে লেখার ঝাঁঝটাও গেল আরো দু ধাপ বেড়ে। যদিও সেরকম প্রকাশের অভিপ্রায়ে ছোট ছোট কবিতায় আর সীমাবদ্ধ রইলো না লেখাগুলো, হয়ে যেতে লাগলো দানবাকার। তারপর, একদিন অনেক সাহস এক করে নিয়ে কবিতা গল্পে রুপ নিলো। এরপর ইচ্ছা জাগে থ্রিলার উপন্যাস লিখবো, সেবা প্রকাশনীর প্রকাশিত রহস্য উপন্যাস গুলো পড়ার শখ বহু আগে থেকেই...লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম ডিগ্রি লেভেলে পাঠ্য রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, নজরুল, সমরেশ, বঙ্কিম, মুজতবা আলী সহ বাংলা ভাষার নানা কালজয়ী সাহিত্যিক দের লেখা গল্প,রম্য,গদ্য গুলো। উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ হাইস্কুল লেভেলের শুরুতেই একেবারে। কোনটা চেয়ে নিয়ে, কোনটা কলেজ লাইব্রেরীর অতিকায় সব সেলফ থেকে চুরি করে, কোনটা লুকিয়ে কারো বাসা থেকে। কেন জানিনা, ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে গেলে তা সে যেকোন ধরণের জায়গায়ই হোক না কেন আমার মন আঁকুপাঁকু করতো কোন চিপাচাপায় কোন ফাঁকে চমৎকার কোন বই চোখে পড়ে কিনা! এমনিতে কথা বলতাম খুব খুবই কম, আর বই একটা জুটে গেলে তো আর চিন্তাই নেই, আমার বুঝি আর কাউকে দরকারও নেই... লম্বা ডুব দিতাম... সেখান থেকেই বোধহয় প্রথম শব্দ গাঁথুনি, প্রথম উপন্যাস লেখার অভিপ্রায়... আর সেই ধবধবে কাগজে গোটা গোটা অক্ষরের প্রাণবন্ত লেখা গুলো এখন কেড়ে নিয়ে গেল অনলাইন...
অনলাইনে বসে থেকে যাই বা দু চার কথা লেখা হয় তাঁর বেশিরভাগই গভীরতার দাবীদার বেশি প্রাঞ্জলতার কম, কম আবেগের।হাত থেকে পড়ে গেল কলম, চলে এলো কীবোর্ড। শুরু নিজের লেখা নিজের মত সাজিয়ে ইচ্ছেমত পাবলিশ করার... শুরু টুকিটাকি ব্লগিং এর ... শুরু ফেসবুকিং এর... শুরু অনলাইন অ্যাক্টিভিজমের ....
এখনকার জেনারেশনের মধ্যে ফেইসবুকের যে একটা ঝোঁক তৈরি হয়েছে সেটা এর আগে কোন কিছু নিয়ে অতোটা হয়নি। ফেইসবুক যেন হয়ে উঠেছে তাদের জীবন চলার পথে দিন রাতের নিত্য সঙ্গী। রাতে ঘুমেতে যাবার আগ পর্যন্ত আর ঘুম থেকে উঠেই বাসি বিছানায় ফেইসবুকের নিউজফিড-নটিফিকেশন-ইনবক্স চেক করা নিত্য রুটিন। ফেইসবুক ফিডের নীল সাদার জমিতে হামেশাই ফুটছে জীবন চরিত, ফুটছে সম্পর্ক, জীবন গড়া-ভাঙার নানা রং, বিনোদন, আমোদ, খেলাধুলা,প্রযুক্তি ফুটছে সাহিত্য, ফুটছে দর্শন, মতামত বিনিময়, এমনকি বিতর্ক এবং বিশ্লেষনও।
তবে, ইলেকট্রনিক মিড়িয়াতে লেখা প্রকাশ হওয়া যত সহজ সমাদর পাওয়াটা কিছু ক্ষেত্রে ঠিক ততোটাই কঠিন। প্রাসঙ্গিক একটা ছোট্ট উদাহরণ হতে পারে, ফেসবুকের কবিতার আসরগুলো কিংবা গল্প রম্য লেখালেখির গ্রুপগুলো…. এসব গ্রুপ গুলাতে গ্রুপ মেম্বাররাই অনেক সময় অন্যের লেখায় মন্তব্য করে না।
বর্তমানে আমাদের দেশে অনলাইন নির্ভর সাহিত্য চর্চা বা লেখালেখির জন্য ফেসবুকের বাইরে বাংলা ব্লগ প্ল্যাটফর্ম গুলো বেশ জনপ্রিয় ....
তবে এখানেও নতুনরা সবাই খুব সহজে জায়গা তৈরি করে নিতে পারেন না। যারা পুরানো ব্লগার আছেন এবং যারা নিয়মিত ব্লগে থাকেন কারো কারো দৃষ্টিকোন থেকে তাদের কেউ কেউ নাকি খুবই স্বার্থপর ঘরানার হন। যদিও তাঁদের সবাই সেরকম নন বলেই মনে করি, এবং কোয়ালিফায়েড আদর্শ যেকোন অভিজ্ঞ ব্লগার যথেষ্ঠ দায়িত্বশীল এ ব্যাপারে, যথেষ্ঠর চেয়েও বেশি উদার। তাঁরা নতুন ব্লগার দের লেখা পড়েন ধৈর্য নিয়েই, মন্তব্য করেন, সুন্দর গঠনমূলক উপদেশ দেন কিভাবে লেখাটাকে আরোও ফুটিয়ে তোলা যেত, কিভাবে আরোও উপভোগ্য কিংবা পাঠক প্রিয় করা যেত, কিভাবে আরোও রুচিশীল এবং যৌক্তিক উপস্থাপনা সম্ভব হতো, তাঁরা যত্ন নিয়েই শুধরে দেন নতুন লেখক/ ব্লগার দের ভুলগুলো ….
বর্তমান সময়ে ফেইসবুকের প্রবল আগ্রাসণ থেকে মুক্তি নিয়ে অনেকে শত ব্যস্ততার ফাঁকেও একটু সময় করে চলে আসেন ব্লগে। ভালোভালো লেখা লিখেন, লিখবার প্রচেষ্ঠা নেন। কিন্তু সেই প্রবল আগ্রহে ঠাসা নতুন চোখের নতুন নতুন লেখাগুলো প্রথম প্রথম তেমন কেউ পড়েও না। নতুন নতুন ব্লগারের অনেক ভালো ভালো লেখা দেখা যায় বিশ ত্রিশ বার মাত্র পঠিত হয়। কমেন্ট হয়তো দু একটা। এতে করে নতুন ব্লগাররা একসময় ব্লগে লেখালেখি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মনে হয়, ব্লগ বুঝি তাঁদের গ্রহন করতে চায় না বা চাচ্ছে না!
কিন্তু, অন্যের লেখা খুঁটিয়ে পড়া বা মন্তব্য করায় খুব একটা অগ্রসর হননা! যেটা তাঁদের ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়ায় অদক্ষতার প্রতিফলন হিসেবে তাঁদের ব্লগিং কে অপূর্ণই রেখে দেয় নির্মমভাবে!
কেউ এই নির্মমতাকে মেনে নিয়ে হার মানেন, চলে যান লেখালেখির জগত থেকে দূরে কোথাও, কেউবা উৎসাহ হারিয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়েন, কেউ আবার এই কৌশলটি ধরে ফেলেন করে ফেলেন রপ্ত দৃঢ়ভাবেই…..
ফলাফলঃ একে একে তাঁর লেখাগুলোর পাঠক বাড়তে থাকে, মন্তব্য বাড়তে থাকে, একসময় এমন অবস্থান তৈরি হয় যে তাঁর লেখায় আলোচনা, তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায় ……
এই ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়ার আছে নানাদিক। যেমন আছে উন্নত ঘরানার এবং পরিপক্ক লেখনী উন্মোচনের মত দিক, তেমনি আছে ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়ায় পারঙ্গমতার সাথে সাথে ব্লগিয় হিটম্যান কিংবা সেলিব্রিটি তকমা তথা অঘোষিত কিংবা স্বঘোষিত ব্যাজ অঙ্গে জুড়ে নেবার মতো দিকও! এই ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়ার হাত ধরে যেমন উঠে আসতে পারে ভাঙা হাতের কাঁচা, আধা পাকা দু চার কলম লেখা থেকে চমৎকৃত কিংবা আবেশি ক্ষমতাধর কোন লেখকস্বত্বার যিনি, হবেন মননে, সৃজনে, বচনে, মনোজ্ঞতায় এবং উপস্থাপনায় সর্বাঙ্গীণ ভাবে পারদর্শী। ঠিক তেমনি এই ব্লগ গুণটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করেও বেরিয়ে আসতে পারে ব্লগ ত্রাস কিংবা ব্লগ হিটম্যান যেখানটায় সেলিব্রিটি তকমা থাকলেও লেখালেখির সুমিষ্ট সুষমা থাকবেনা।।
তবে, সহ ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়া যে ব্লগিং এ কতোটা গুরুত্ববহ তা লিখে বলে দিতে হয় না বৈকি।
এর সবচে বড় সুফল... সফল এবং সুদক্ষ ব্লগার তৈরিতে।
আর এর সবচেয়ে বড় অভাববোধ এবং আক্ষেপযোগ্য ব্যর্থতা... অকালে ঝড়ে যাওয়া হতাশ কোন অজানা ব্লগ নক্ষত্র!!
একেবারে প্রথমটায়, যখন আমরা অনলাইন কমিউনিটিতে আসি তখন প্রায় সবক্ষেত্রেই আমাদের প্রায় সব নবীন লেখকের জন্যই যে দ্রুব সত্য চিত্রটি দাঁড়ায় তার যথাযথ মোকাবেলাটা একটু কঠিন বৈকি!
এতো এতো সুলেখক, এতো এতো সুপরিচিত লেখকের মাঝে ক্ষুদ্রতায় ঘেড়া, হয়তো সামান্য ছোট ছোট ভুলেও ভরা নতুন নতুন আগ্রহী চোখের নতুন নতুন লেখাগুলো যে অকস্মাৎ জনপ্রিয়তা পাবেনা সেটা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু, জনপ্রিয়তা নাহোক, আনকোড়া নতুন হাতের নতুন চোকের ছোট ছোট কল্পনা, আবেগ, দর্শন, মতাদর্শ, চিন্তাভাবনা আর অগুনতি স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশগুলোয় যে ন্যূনতম সমাদর, গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা কিংবা অডিয়েন্স ফিডব্যাক থাকবেনা সেটা কেন দৃষ্টিকোণ থেকেই কাম্য নয়, হবার অপেক্ষাও রাখেনা। আর যদি হয়ে থাকে তবে সেখানটাতেই বলবো সুদক্ষ এবং যথার্থ ব্লগিয় পারঙ্গমতা কিংবা মিথস্ক্রিয়ার অভাববোধটা প্রকোট!!
নতুন নতুন হাতের সব লেখা গুলোর প্রতি, নিজের কষ্টের আর অনেকখানি জমানো আবেগ, অনেকখানি পুঞ্জিভূত স্বপ্ন তাড়নার ঝালর আর নতুন সৃষ্টির আশা উদ্দিপনা প্রথমেই অনেকখানি চাপা পড়ে কিংবা কারো কারো ক্ষেত্রে একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায় অডিয়েন্স ফিডব্যাক না পেলে .... ফোয়ারা হয়ে চারিদিক সুসজ্জিত, সুষমামন্ডিত করাটা আর হয়ে ওঠেনা ....!
তবে লেখালেখি কিংবা ব্লগিং চালিয়ে যেতে থাকলে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা হয়, ধীরে ধীরে মনের গন্ডিটা অনেক বড় হয়ে যায় ... জ্ঞানের পরিধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসারতাও ....
ফলাফলঃ একজন পূর্ণাঙ্গ লেখক কিংবা ব্লগার
সর্বোপরি, ব্লগ যেন এমন এক সাচ্ছন্দবোধের জায়গা এমনই এক দীক্ষালয়, এমনই এক মন অলিন্দের খোড়াকের আশ্রম যেখানটায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিখছি, মন পাকছে তাতে রং চড়ছে কিন্তু চুল পাকছে না! একটু একটু করে বড় হচ্ছি যেন কিন্তু বুড়ো হচ্ছিনা ...
এই মন্তব্য শূন্যতা কিংবা ব্লগিয় হতাশার ব্যাপারে কথা হয়েছিলো অনেকের সাথেই ... কেউ মত দিলেন, ব্লগ এডমিন প্যানেলের করণীয় সম্পর্কে, কেউ মত দিলেন পুরানো ব্লগার তথা রথি মহারথিদের অনর্থক অহম সম্পর্কে, কেউ বা দোষ দিলেন নবীন লেখকদের অযৌক্তিক অভিযোগকে, কেউ বা পুরানোদের অভিমানকে, কেউ হয়তো বলে বসলেন ব্লগ কর্তৃপক্ষের উচিত অধিক মন্তব্যের যথাযথ পুরষ্কারের ব্যবস্থার কথা ...!
কোনটা কতটুকু দায়ী সে ব্যাপারে না বলতে চাইলেও এটুকু বলা যায়, পুরষ্কার দিয়ে যেকোন কাজকে উৎসাহিত করা গেলেও মন খোড়াকের বারান্দাটা ঠিক সাজানো যায় না।
ব্লগ আয়োজিত পুরষ্কার ঘোষিত হলে, অনেক অযাচিত কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুঁইফোঁড় মন্তব্যকারীর আবির্ভাব হবে বটে কিন্তু প্রাণময় তথা মনের ছোঁয়া যুক্ত বুকের উচ্ছাস মাখা কিংবা গঠনমূলক যৌক্তিক মন্তব্যের সংখ্যা বাড়বে কি আদৌ!?
এগুলো যেহেতু পুরষ্কার ঘোষনা করে করা সম্ভব নয় সেহেতু, এ পন্থায় কোয়ালিফায়েড ব্লগার তৈরি ও ব্লগের পক্ষে সম্ভবপর কিংবা যৌক্তিক নয়!
এখন লেখালেখি অনলাইন নির্ভরই। এর পেছনটায় আছে বহুবিধ বহু বিষয়াদী। সেসব নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাবে লেখা। আগেও বেশ কবার বলেওছি। আর আমার নিজেরও লেখার হাতেখড়ি অফলাইনেই, সেই স্কুল জীবনেই। অসমাপ্ত সহস্র কবিতার আঁকিবুঁকি পাতা সাজিয়ে সাজিয়ে গল্পের খাতা মোড়ার সাহসটুকুও করে ফেলি একদিন-তখনো হাই স্কুলের গন্ডি পেড়িয়েছি কি পেড়ুইনি! এখন আর লেখালেখিটা সেই সুরতে, সেই আদলে বা ধাতে নেই। নিজেও অনলাইন কেন্দ্রিক এমনকি অনলাইন ফ্রিক হয়ে গেছি।
তবে, লেখা প্রকাশ যেভাবেই হোক, যেখানেই হোক, যে প্ল্যাটফর্মেই হোক, যখনই হোক না কেন মুক্ত বিহঙ্গের মতই হওয়া উচিত। প্রতিটা লেখকেরই খোলা একটা আকাশ থাকা উচিত, মুক্তভাবে দেখার আকাশ, মুক্তভাবে ভাবার আকাশ, মুক্তচিন্তা করার আকাশ, মুক্তকলমের লাইন টানার আকাশআর সে আকাশে ভাসা প্রতিটা লেখারই ডানা থাকা উচিত...
এখানে হিট কিংবা সমাদরের বিষয়গুলি একেবারেই তুচ্ছ! যদিও এটা সত্য যে নতুন অবস্থায় যথেষ্ঠ সমাদর না পেলে কিংবা ফিডব্যাক না হলে লেখার স্পৃহা মরে যায় অনেক ক্ষেত্রেই।
কিন্তু বাস্তবতা যে এমনই! তা হোক অনলাইন কিংবা অফলাইন। বরং অনলাইনের ক্ষেত্রে তা আরো প্রবল এবং ব্যাপক। এখানে যেকোন লেখককেই যথেষ্ঠ সমাদর কিংবা ফিডব্যাক পেতে হলে প্রথমে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে হবেই! নতুবা তিনি যত ভালোই লিখুন না কেন- রেস্পন্স কম আসবে- অবশ্যই প্রথমদিকটায়। কেননা, ভালো লেখা, ভালো আর্টের লেখা তার আর্ট দিয়েই পাঠক তৈরি করে নেবে... তা সে যেখানে যখনই হোক।।
ফেসবুকের ব্যাপার গুলো কিছুক্ষেত্রে নোংরামি পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট, কখনোবা ঘোলাটে, এবং বিরক্তিকর! ব্লগেও কিছুকিছু ক্ষেত্রে তাই।
তবে ব্লগের চমৎকার একটা ভালো দিক হচ্ছেঃ-
সেখানে কমন একটা স্টেজে দাঁড়িয়ে প্রতিটা লেখা। নেই উঁচু নিচু বা খাটো মাঝারী প্ল্যাটফর্ম কিংবা ব্যাসমেন্ট। ব্যাকগ্রাউন্ড -সে যাই হোক, প্রতিটা লেখাই ব্লগ দাঁড় করায় সমতানে গাঁথা এক তাল লয়ে। ব্লগ কখনোই কোন লেখক কিংবা লেখাকে ছোট বড় করে পাল্লায় উঠিয়ে উপস্থাপন করে না অডিয়েন্সের কাছে। যা ফেইসবুকে হয় বা হচ্ছেও। ব্লগ বাছবিচার করেনা নতুন কি পুরান লিজেন্ডারি কি প্রাইমারীরও। ব্লগ মাপে না পপুলারিটি, ফেম, কিংবা অনুসারীর সংখ্যাও , ব্লগ দেখেনা পেইড অডিয়েন্স রিচে প্রাপ্ত গুরু লাইক কিংবা ভালোলাগা সূচকও! ব্লগ যা মাপে, তা হচ্ছে রাইটিং স্কিল ক্যাপাবিলিটি কিংবা লিখন যোগ্যতা, লেখার মান কিংবা কিছুক্ষেত্রে দক্ষতার অভিপ্রকাশ। ব্লগ যা দেখে তা হচ্ছে বাক স্বাধীনতার দুয়ার প্রতিটা লেখকের কলমের সামনে উন্মুক্ত অবারিত লাইন টানবার সুযোগ নিশ্চিত হয়েছে কিনা। ব্লগ যা দেখে তা হচ্ছে চিন্তার পরিশীলতা, বহুমাত্রিকতা, উন্মুক্ততা এবং সর্বোপরি যৌক্তিকতাও।
৫-৬ বছরের ব্লগীয় অভিজ্ঞতা আর মিথস্ক্রিয়ায় হাত পাকানো ব্লগারের হাতের কীবোর্ডের লেখা যে পাতায় প্রকাশ করে সদ্য একাউন্ট জেনারেল হওয়া যেকোন নতুন ব্লগারের লেখাও প্রকাশ করে সেই একই পাতায়। যেটা ফেইসবুকে হয়না।
হ্যা, সেখানেও পরিচিতির ব্যাপারটা আছে, হয়তো প্রকটভাবেই আছে- কারণ তা থাকাটা স্বাভাবিক!
এটাকে মেনে নিয়েই এগুতে হবে। কিন্তু নতুনদের অনেকেই মনে করেন, যেটা মেনে নেয়াটা কষ্টকর এবং কিছুটা দুঃখজনকও বটে তা হচ্ছে, পুরানো পরিচিত হাত পাকা, মুখ পাকা ব্লগার দের অহমিকা কিংবা হাস্যকর ভার্চুয়াল এরিস্ট্রোক্রেসি! মনে হয়, উনারা বুঝি লিখতেই জন্মেছেন, শত শত মন্তব্য পেতেই জন্মেছেন, ভালোলাগা পেতেই জন্মেছেন, লেখা পড়তে নয়, মন্তব্য করতে নয়, ভালো লাগলেও ভালোলাগা জানাতে নয়! এ কেমন অহম! নতুন ব্লগারদের ব্লগার কিংবা লেখকদের ভালো লেখাকে কেন তিনি বা তারা সাধুবাদ জানাবেন না, প্রশংসা কিংবা গঠনমূলক সমালোচনা করবেন না-সেদিকটা প্রশ্নবিদ্ধতার সম্মুখীন হয় বটে।।
আসলে ওইসব লেখকেরা যত হিট কিংবা মন্তব্যই পান না কেন, যত সৃজনশীলতার মননশীলতার ডোশিয়ার, সার্টিফিকেট ই পান না কেন ভক্ত সুহৃদের কাছ থেকে, আমি বলবো তাঁদের সে সার্টিফিকেটের একেবারে গোড়াতেই অস্ফুট রয়ে গেছে গলদ!
একজন ব্লগার তখনই মানসম্মত ব্লগার হবেন, যখন তিনি নিজের একটা লেখার পাশাপাশি অন্য দশজনের দশটা লেখা যত্নসহ পড়বেন, চিন্তাভাবনা করবেন, বিশ্লেষন করতে জানবেন, গঠনমূলক এবং যৌক্তিক সমালোচনা করতে পারবেন নিজের একটা চিন্তাভাবনা, দর্শন থিসিস কিংবা কোন টপিক্যাল অ্যানালাইসিস যৌক্তিক উপস্থাপনার সাথে সাথে আরো দশটা উপস্থাপনার পরিমাপ করবার যোগ্যতা রাখবেন।
অন্যদিকে,
একজন লেখকের এজায়গাটায় ঠিক সেরকম কোন বাঁধাধরা নীতি নিয়ম কানুন নেই। কেননা তিনি লিখবেন একেবারেই ইচ্ছামত মনের আনন্দে। রিডার, কমেন্টার কিংবা বিশ্লেষকেরও তাঁর দরকার নেই। অন্য একজন সমসাময়িক লেখকের লেখা পড়বার ও তাঁর কোন বাধ্যবাদকতা নেই। তেমনি প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর লেখা তাঁরই হাতে। যদিও এজায়গাটায় একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, লেখকের লেখা যখন তিনি কোন অনলাইন কমিউনিটি তথা ব্লগে প্রকাশ করবেন তখন তাঁকে ব্লগার বলা যায় বা যাবে কিনা…..?
অবশ্যই অনলাইনে ব্লগে লিখলে তিনি ব্লগার হিসেবে পরিগণিত হবেন ঠিক, কিন্তু শুধুই নিজের জন্য লেখালেখি কিংবা দায়বদ্ধতাহীন অনলাইন এক্টিভিজমের কারণে ব্লগে লিখেও তিনি ভালো লেখক হলেও ভালো ব্লগার হিসেবে গণ্য হবেন না।।
তাঁকে ব্লগ পোস্টগুলোর সুবাদে ব্লগার বলা গেলেও তিনি একপেষে ব্লগার। কেননা পূর্ণাঙ্গ ব্লগার হিসেবে পরিগণিত হতে গেলে অবশ্যই অবশ্যই তাঁকে দায়িত্বশীল ব্লগিং করতে হবে, সেক্ষেত্রে যেকোন বিষয় প্রাধান্য পেতে পারে তাঁর ব্যক্তিগত মতাদর্শ, দৃষ্টিকোণ এবং পছন্দ অপছন্দ অনুসারে কিন্তু অবশ্যই অবশ্যই তাঁকে ভাবতে হবে স্বদেশ নিয়ে তাঁকে এনালাইসিস করতে হবে গুরুত্ববহ নানা জাতীয় আন্তর্জাতিক এবং সমসাময়িক বিষয়াদী এবং সমস্যাবলী নিয়ে। তাঁকে বিশ্লেষন করতে জানতে হবে, নিজ মতের পক্ষে যথার্থ যুক্তি প্রমাণ এবং রেফারেন্স সহ সম্পূর্ণ আঙ্গিকের উপস্থাপনা জানতে হবে। এসবের সবগুলো গুনের একেবারে পরিপূর্ণ না হোক মোটামুটি উপস্থিতি ব্যতিত কখনোই একজন ব্লগ লেখককে পূর্ণাঙ্গ এবং কোয়ালিয়ায়েড ব্লগার বলা যাবেনা।। ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপারটি তো উপরি থেকেই যাচ্ছে এক্ষেত্রে…. ব্লগিয় মিথস্ক্রিয়ায় যিনি যত বেশি পারদর্শী হবেন, ব্লগার হিসেবেও তাঁর অবস্থান ততটা মজবুত এবং পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবে লেখালেখির জগতে যে অলিখিত মৌলিক ধ্রুবসত্যটি বিরাজমান তা হচ্ছে,
লেখক হিসেবে হোক কিংবা ব্লগার হিসেবে হোক, একজন লেখক কিংবা ব্লগার তখনই আদর্শ লেখক কিংবা ব্লগার হবেন যখন সর্বাগ্রে তিনি একজন আদর্শ পাঠক হবেন।
আর ব্লগার হিসেবে একজন লেখক তখনই আদর্শ ব্লগার হবেন যখন সবগুলো যৌক্তিক মতাদর্শ কিংবা লেখার যথার্থ বিশ্লেষণ পূর্বক নিজ মতামত সুচারু এবং বলিষ্ঠ ভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন।
অতএব, এটুকু সহজে বলে দেয়া যায় সামারি আকারে, ব্লগার মাত্রই লেখক বটে, কিন্তু লেখক মাত্রই ব্লগার নন।
তবে, সমসাময়িক নানা দায়িত্বশীলতার এবং প্রয়োজনীয়তার ব্যাপার গুলো বাদ দিলে,একজন প্রকৃত লেখকের অবস্থান অনেক উঁচুতে …
একজন সৃজন শিল্পী যিনি নিজ রুচি এবং মন মননের মিশেলে সৃষ্টি করেন ...
কিংবা একজন চিত্রকর যিনি নিজ মনের রং তুলির প্রতিচ্ছবি তাঁর কলমের আঁচড়ে ফেলেন ...
কিংবা একজন স্থপতি যিনি মনোদুয়ার খুলে দেন... কলমের আঁচড়ে সাজান নতুন সভ্যতার নব রূপরেখার বুনিয়াদ…..
পরিশেষে এটুকুই বলার আছে, ব্লগার কিংবা লেখকের দর্শন কিংবা কর্মপদ্ধতি সে যাই হোক না কেন, সর্বাগ্রে কাম্য হচ্ছে, বাংলার জন্য কাজ করে যাওয়া নিরলসভাবে ...
আমরা তো বাংলা ব্লগের চরমতম উৎকর্ষই কামনা করি মনের একেবারে ভেতরটা থেকেই, যখন বাংলা ব্লগ মাত্র তার কৈশোর টা পেরুচ্ছে ...
এরই মধ্যে বাংলা ব্লগে এসেছে নানা উত্থান-পতন, নানা শিহরণ জাগানো, নানা কল্পনাকেও হার মানানো, নানা চমৎকৃত হবার মত, নানা দুঃখ পাবার মত ঘটনাও ...
এসেছে অগণিত প্রাপ্তি, এসেছে অকল্পনীয় সব অর্জন ...
কিন্তু, এতো কিছুর পরেও বাংলা ব্লগ যেন এখনো বয়স এবং কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এখনো যৌবনে পা রাখেনি ... !
বাংলা ব্লগের এ ঊষালগ্নে এর প্রাণ বাঙালী ব্লগারদের প্রত্যেক কেই একতাবদ্ধ হয়ে, বুকে বাংলাকে ধারণ করে মেধার সবটুকু ঢেলে দিয়ে উচিত বাংলা ব্লগকে সমৃদ্ধ করা এবং বাংলা ব্লগের জন্য কাজ করে যাওয়া নিরলসভাবে ...
কেননা, বাংলা ব্লগের জন্য কাজ করা মানে বাংলার জন্য কাজ করা, আর বাংলার জন্য কাজ করা মানে বাংলাদেশ তথা আমার মাতৃভূমির জন্য কাজ করা ...