

এই লেখাটা মূলতঃ বেশ কিছু দিন আগে, একটা লেখা পড়ে মন্তব্যে বলেছিলাম নেপোলিয়ান নিয়ে আমি লিখবো। সেই কথা রাখতেই এই লেখা। সাথে হিটলার জুড়ে দিলাম। কেন? কেননা, প্যারালাল ভাবে মনে হলো- আসলে দু'জনই নায়ক হলেও দু জনের সমাপ্তিটা করুণ। দুজনই জন্ম নিয়েছিলেন সাধারণ একটা ঘরে। কোনো রাজবংশ থেকে এসে দুনিয়া কাঁপাননি। দুনিয়া কাপিয়েছেন, মেধা আর যোগ্যতা আর বিশ্বাসের বলে।
আসুন মূল লেখায় চলে যাওয়া যাক।

নেপোলিয়ন বোনাপার্টঃ
ষোল বছর বয়সে নেপোলিয়ন প্যারিসের ইকল সামরিক শিক্ষাকেন্দ্রে লা ফেয়র (La-Fere) রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে সময়টাতে তার তেমন কাজ থাকতো না, তখন ডুবে থাকতেন বই-এর মধ্যে। এক সময় কর্শিকার ইতিবৃত্ত রচনায় হাত দেন। কিন্তু শেষ করতে পারলেন না। বেশ সুন্দর কয়েকটি গল্প লিখলেন। তার আদর্শ ছিলো রুশো। তাই রুশোর বিরোধিতা করে কোনো রচনা প্রকাশিত হলে সেই রচনার বিরুদ্ধে কলাম ধরতেন। তবে যাই করেন, মাথায় থাকে অর্থ উপার্জনের চিন্তা। এক সময় ঠিক করলেন, লেখক হবেন। রুশোর রচনা, রুশোর মতবাদ তাকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে, তিনি তাকে অনুসরণ করতে থাকেন।
রুশোকে বলা হয় ফরাসি বিপ্লবের 'Chief prophet of the Revolution' বা 'বিপ্লবের প্রধান প্রবক্তা' । রুশোই প্রথম বলেছিলেন- 'মানুষ জন্ম-স্বাধীন, সমাজই তাকে শৃঙ্খলিত করে'। তার বিখ্যাত বই 'The social Contract' এবং 'Discourse on the origin of inequality' নেপোলিয়ন বাইবেলের মতো মনে করতেন। রুশো বলেছিলেন- 'কোনো মানুষ এমন ধনী হবে না যাতে সে অন্য মানুষকে কিনে নিতে পারে আবার সে এমন দরিদ্র হবে না যার জন্য তাকে নিজেকে বিকেয়ে দিতে হবে।' মানুষের বুদ্ধির থেকেও মানুষের সুন্দর অনুভূতি গুলোকে রুশো বেশি গুরুত্ব দিতেন। নেপোলিয়নের রাজনৈতিক চিন্তাকে নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত করতে রুশোর রচনা গুলো একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। সমাজ পূর্ণতার দিকে এগোলেও মানুষ অধঃপতিত হচ্ছে- এই বিপরীতধর্মী সামাজিক ঘটনাপ্রবাহকে তিনি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি তার রচনায় বারবার বলেছেন- 'যশ ও আড়ম্বর আমাদের সুখ দিতে পারে না। তা আমাদের অধঃপতন ও দুঃখের দিকে নিয়ে যায়। নেপোলিয়নের দিকে তাকালে এই সত্যদ্রষ্টার কথার সত্যতা পাওয়া যায়।
নেপোলিয়ন আগ্রহ কেবল দর্শন বা সমাজতত্ত্বের বইয়ে আবদ্ধ ছিলো না। তিনি ইতিহাস, বিজ্ঞান, অঙ্কশাস্ত্র সব বিষয় নিয়েই তার আগ্রহ ছিলো। মুখ দেখে কেমন করে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা করা যায় সে বিষয় নিয়েও তিনি পড়াশুনা করলেন। আইনের বই তার খুব প্রিয়ো। এই সময়ে কোনো সময়ে নেপোলিয়ন শাস্তি হিসেবে ২৪ ঘন্টা একটা সেলে বন্দি ছিলেন। নেপোলিয়ন কেবল একটি আইনের বই নিয়ে সেলে ঢুকে গেলেন আর বইটি শেষ করে সেল থেকে বের হয়ে এলেন। পরবর্তীকালে তার প্রণীত 'Code Napoleon' নামে যে আইন সারা বিশ্বে সামাদৃত হয় তার শুরু হয় এই সময়টাতেই।
১৭৮৯ সাল, ফরাসী বিপ্লবের বছর। আর নেপোলিয়ন কে বলা হয় ফরাসী বিপ্লবের সন্তান। কেন? ধীরে ধীরে আমরা জানবো। এই বছরে ফ্রান্সের নানা জায়গায় বিশেষ করে প্যারি শহরে বিপ্লবের বুদ বুদ দেখা দেয়। খাবারের অভাব, বেকার সমস্যা, দাঙ্গা, লুঠতরাজ সর্বত্র বিশৃঙ্খল পরিবেশ। প্যারি শহরের জনসংখ্যা তখন ছয় লক্ষের মতো। এর মধ্যে যাজক ১০ হাজার, অভিজাত শ্রেনী ৫ হাজার, আর ৪০ হাজারের মতো বণিক, শিল্পপতি ও বুদ্ধিজীবী বুর্জোয়া শ্রেনী। আর বাকী ৯০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র পীড়িত। এদের অনেকের নেই কাজ, নেই বাসস্থান। তার মধ্যে দ্রব্যমূল্যের মাত্রহীন উর্দ্ধগতির সাথে পাল্লা দেয়া ভার। যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় ৪ পাউন্ড রুটির দাম ৮-৯ সূ ছিলো। ১৭৮৯ সালে সেই রুটি বেড়ে দাড়ালো ১২-২০ সূ তে। অথচ একজন সাধারণ শ্রমিকের দিনমজুরি ছিলো ২০ থেকে ৩০ সূ। রুটি নিয়ে প্রায়ই দাঙ্গা হতো।
দীর্ঘ আট বছর পর ১৭৮৯ সালে ১৯ বছর বয়সে নেপোলিয়ন নিজের দেশ, ছোট্ট কর্শিকাতে আসেন। বাড়িতে এসে দেখতে পেলেন, মা কী ভিষণ কষ্টে চরম অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এতো গুলো ছোট ভাই-বোন কেউ সাহায্য করার নেই। মা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে তাদের বড়ো করার চেষ্টার করছেন। ঠিক করলেন নিজের রেজিমেন্টে ফিরে গিয়ে যেভাবে পারেন, যতটা পারেন অর্থ উপার্জন করে মাকে পাঠাবেন।
নেপোলিয়ন ঠিক করলেন কৃচ্ছ্রসাধন করে জীবন-যাপন করবেন। লক্ষ্য কত কম ব্যয় করে বেঁচে থাকা যায়। প্রচুর পরিশ্রম আর কম ঘুমের ফলে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হন। ১৮ মার্চ ১৭৮৯ সালে বোন লুসিয়েনকে একটা চিঠি লিখে নেপোলিয়ন জানানঃ
'আমার শ্রম ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। আমি আটদিনে একবার পোশাক পাল্টাই। অসুস্থতার পর থেকে আমি খুব কম ঘুমাই। মোম বাত্বির খরচ বাঁচাতে রাত দশটায় ঘুমাতে চলে যাই, ভোর চারটের সময় উঠে পড়ি। তিনটের সময় দিনে একবার খাই- এতেই আমার শরীর ভালো থাকে।'

এডলোফ হিটলারঃ
১৯০৫ সালে ১৬ বছর বয়সে স্কুলে ছেড়ে হিটলার ১৯০৭ সালে আসেন ভিয়েনায়। মাঝের দুই বছর হিটলারের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই দুই বছরে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কখনো ভাবছেন গান শিখবেন- গির্জা সংগীত। চলল গান শেখা, গির্জার কোয়ারে যোগ দেয়া। আবার একসময় ঠিক করলেন গির্জার বিশপ হবেন। আবার মন চলে যায় ছবি আঁকায়। শিল্পী হয়ে নাম করতে হবে। নইলে লোককে নিজের কী পরিচয় দিবেন? এই সময় হাতের কাছে যে বই পেতেন সব পড়তেন। কোনো বাছবিচার ছিলো না। স্মৃতি শক্তি ছিলো প্রখর। যা পড়তেন তা ভুলতেন না। শিল্প ও স্থাপত্যের ইতিহাস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিলো। আর পড়তেন মনস্তত্ত্বের বই।
১৯০৫ সালে বের হয় সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) বিখ্যাত বই, 'Three Essays on the theory of sexuality'। বইটি বের হওয়ার সাথে সাথে তিনি বিখ্যাত হয়ে যান। ১৯০৭ সালে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের শহর ভিয়ানায় এসে তিনি ফ্রয়েডের লেখা পড়েন। ভিয়েনায় তিনি আসেন শিল্পী হওয়ার গভীর বাসনা নিয়ে। একজন চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দিন কাটান আর কবিতা লেখেন। তার সব কবিতাই প্রেমিকার উদ্দেশ্যে নিবেদিত (প্রেম পর্বে এ সম্পর্কে কথা হবে)। জার্মান ইতিহাস চর্চা, শিল্পতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনো এবং সেই সঙ্গে সামরিক বিষয় সম্পর্কে নানান অনুসন্ধান তার চিন্তার জগৎ জুড়ে থাকত। অসংখ্য রোমাঞ্চ উপন্যাসও পড়েন এই সময়। নাটক দেখতে দেখতে সংগীতের প্রতি আকর্ষণ বাড়ল কারণ অপেরাধর্মী নাটকেই তার আগ্রহ বেশি। এই সংগীত প্রীতি থেকে চললেন পিয়ানো বাজানোর পাঠ নিতে। উদ্দেশ্য সংগীত রচনা ও সুরসৃষ্টি।
যাই হোক অক্টোবর মাসে শুরু হলো ভিয়েনার বিখ্যাত একাডেমী অব ফাইন আর্টসের শিল্পশিক্ষার সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষা। এখানকার নিয়ম হলো, পরীক্ষার পাশাপাশি কতগুলো নিজের আঁকা ছবি জমা দিতে হতো। দিনরাত পরিশ্রম করে হিটলার নমুনা চিত্র পোস্টকার্ডে আঁকলেন। এই ছবিতে ফুটে উঠলো ভিয়েনার বাড়িগুলোর স্থাপত্য সৌন্দর্য আর শহরের রাস্তাঘাটের বৈশিষ্ট্য। ১১৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮০ জনের সাথে হিটলরও উর্ত্তীর্ণ হলেন। পরের বাছাইয়ের পরীক্ষায় পাশ করলেন মাত্র ৩৯ জন। কিন্তু এর মধ্যে হিটলারের নাম নেই। তিনি একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন।
স্কুল থেকে জানিয়ে দেয়া হলো, হিটলারের প্রতিভা আছে, তবে তা স্থাপত্য শিল্পে। তিনি গেলেন স্থাপত্যশিল্পের ক্লাসে ভর্তি হতে। সেখানে গিয়ে শুনলেন, সেখানেও তিনি ভর্তি হতে পারবেন না। কেননা, স্থাপত্য শিল্পে ভর্তি হতে হলে অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। ফলে হিটলারের শিল্পী হবার স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়।
মা'র শরীর ভালো নয়, এই খবর শুনে ফিরে এলেন লিনজ এ। শহরতলীতে একটা বাসা নেন। ভাই বোনদের নিয়ে কষ্টে করে দিন কাটান। ডাক্তাতের সাথে কথা বলেন। মা'র স্তনে ক্যানসার। মা'র চিকিৎসার যাতে কোনো ত্রুটি না হয় সেদিকে নজর দিতে ডাক্তার কে অনুরোধ করেন। শুশ্রষার ভার হিটলার নিজের কাধে তুলে নেন। বাড়ির যাবতীয় কাজের দায়িত্বও নিজের কাধেই তুলে নিলেন। ছোট বোন পলার স্কুলের পড়া দেখিয়ে দেয়া, তার জামা কাপড় গুছিয়ে দেয়া, ঘর-দোর পরিস্কার করা, এমনকি রান্নাবান্না করা সবই মুখ বুজে করতে লাগলেন। মা'র নজরে কোথাও যেন বিশৃঙ্খলা ধরা না পড়ে। আর মা'র সেবাযত্ন তো আছেই। অথচ কাউকে কিছু বুঝতে দেন না।
ক্যান্সার যন্ত্রণায় যখন মা ছটফট করতেন তখন হিটলার যে কী করবেন ভেবে পেতেন না। মুখ লুকিয়ে কাঁদতেন। মা একটু ঘুমালে তার বিছানার পাশে বসে থাকতেন। হিটলারের বোন জানিয়েছেন, 'যত রাতেই না কেন জেগে উঠতাম, দেখতাম ভাইয়া ঠিক মায়ের পাশে নীরবে পায়চারি করছেন। পাছে ঘুম এসে যায় তাই হয়তো বসতেন না। আমরা ভেবে পেতাম না ভাইয়া ঘুমাতেন কখন।' এত চেষ্টা করেও মাকে বাচাতে পারলেন না। মা'র মৃত্যূতে একবারে ভেঙ্গে পড়েন। সারা দিনরাত মা'র জন্য কাঁদেন। ড. ব্লক বলেছেন, 'আমার দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে আমি কখনো কোনো তরুণ বালককে মা'র মৃত্যূর জন্য এমন ভেঙ্গে পড়ে শোক করতে দেখিনি।' ১৯০৮ সালে অর্থাৎ হিটলারের বয়স যখন ১৯ বছর তখন তার হাতে যে পরিমান অর্থ ছিল তাতে তখনকার দিনে ভালো মতোই কেটে যাওয়ার কথা যদিও হিটলার তার 'মাইন ক্যাম্ফ' (mein kampf) এ বলেছেন, এই সময় তার বড় দারিদ্রের মধ্যে গেছে।
মিল-অমিল নেপোলিয়ন-হিটলার (প্রথম পর্ব)
মিল-অমিল নেপোলিয়ন-হিটলার (দ্বিতীয় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৬