

কথা ছিলো খুব তাড়াতাড়ি এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বটা দিবো। কিন্তু কথা রাখতে পারলাম কই। চাকরি ইচ্ছা আর বাস্তবতার মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে। সে কথা থাক। আসুন আমরা ইতিহাস খুঁড়ে দেখি আসলেই কি এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা?
আজ তাদের ছোটবেলা, লেখাপড়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ এইসব নিয়েই জেনে নিই।
নেপোলিয়নঃ

ছোটবেলায় নেপোলিয়ন ছিলেন একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। বাবা কার্লো ঠিকই বুঝেছিলেন, কি অসাধারণ ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে তার শান্ত-স্বভাবের এই ছেলেটির মধ্যে। তাই তিনি ছেলে কে ভালো পড়াশোনার জন্য অধীর হয়ে উঠলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, নেপোলিয়ন এলেন ব্রিয়নের সামরিক স্কুলে। এখানে সামরিক স্কুল ছিল অনেক গুলোই, তবে মানের দিক থেকে বলতে হবে এটি ছিল নিম্নমানেরই। ভোর ছ-টার সময় উঠে খেয়ে শুরু হতো পড়াশুনা এবং ট্রেনিং। সকালে পড়তে হতো ইতিহাস, অঙ্ক, ভূগোল, অঙ্কন, লাতিন আর জার্মানি ভাষা। বিকালে অসিচালনা (তরবারী কৌশল), নৃত্য, সঙ্গীত এবং হাতের লেখা। তবে এর মধ্যে অঙ্কই ছিলো তার সবচেয়ে প্রিয়ো বিষয়। মুখে মুখেই তিনি সমাধান করতে পারতেন জটিল সব অঙ্ক। অঙ্কের প্রতি তার আগ্রহ এমনই তীব্র ছিলো যে অঙ্কের জটিল সমস্যার সমাধান এর জন্য এক নাগাড়ে তিন দিন খাওয়া-স্নান ভুলে ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতেন। এই একাগ্রতা নিষ্ঠা তাকে শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অঙ্কের প্রতি এই ভালোবাসাই তাকে প্যারিসের বিখ্যাত ইকল রয়্যাল মিলিটারি স্কুলে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সাধারণত ধনী সম্ভ্রান্ত না হলে এই স্কুলে ভর্তি হওয়া সহজ নয়। সামরিক বিভাগ থেকে অঙ্কে খুব মেধাবী দের নাম জানতে চাইলে ব্রিয়ান স্কুল থেকে যে চারজন ছাত্রের নাম যায় তাদের মধ্যে নেপোলিয়ান ছিলেন অন্যতম। কেননা, নেপোলিয়ন এই ব্রিয়ান স্কুলে ১৭৮০ থেকে পরপর চার বার অঙ্কের বিশেষ পারদর্শিতার জন্য পুরস্কৃত হন।
লেখাপড়ায় নেপোলিয়নের যে বিষয়গুলোর প্রতি গভীর অনুরাগ ছিলো সেগুলো হলো, ইতিহাস, ভূগোল, অসিচালনা ইত্যাদি। তিনি ভালো আঁকতে পারতেন না। জার্মান ভাষার প্রতিও তার তেমন আগ্রহ ছিলো না। তবে হোমারের কাব্য তার প্রিয়ো ছিলো। এক সময় মাকে লেখেন,- 'মা, হাতে একটা তরবারি থাকলে আর পকেটে একটা হোমার থাকলে আমি পৃথিবী জয় করতে পারি।' ইতিহাসের মধ্যে রোমের ইতিহাস ছিলো তার খুব প্রিয়ো। সেন্ট হেলেনায় বসে যখন তিনি আত্মজীবনী লিখছেন তখন বলেছেন, জুলিয়াস সিজারের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধার কথা।
লেখাপড়ার জীবন অন্য সব ছেলেদের মতো তার এতো আনন্দে কাটেনি। কেননা সামরিক স্কুলে অন্য সবাই বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকেই এসেছিলো আর নেপোলিয়ন কেবল মেধার জোরে টিকে ছিলেন। এ দিকে তার পিতার পেটের ক্যান্সার ধরা পরে। বাঁচার আর আশা নেই। পরিবারে চরম আর্থিক সংকট। ইচ্ছা ছিলো নৌ-বিভাগের অফিসার হবেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে নিয়ে এলো সেনাবাহিনীতে। বন্ধুদের সাথে সিন নদী পথে এলেন প্যারিসে। কিন্তু সন্ধ্যার আগে স্কুলে ঢুকতে দেয়া হবে না, তাই অন্য বন্ধুরা যখন বেরিয়ে পড়ল প্যারির সৌন্দর্য দেখতে, তখন নেপোলিয়ন তাদের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে একটা বই কিনে পড়তে শুরু করলেন। বইটির নাম- 'গীল ব্লাস'- এক দরিদ্র হতভাগ্য স্প্যানিশ বালকের গল্প। সেই একদিন রাজনৈতিক ক্ষমতার উচ্চশিখরে উঠতে পেরেছিল। কে জানে, এই বইটি তাকে কতখানি অনুপ্রানিত করেছিলো, ফ্রান্সের সম্রাট হওয়ার জন্য!
১৭৮৫ সালে নেপোলিয়ন খবর পেলেন বাবা আর নেই। বাবার জন্য যতটা না দুঃখ পেলেন তার থেকে বেশি চিন্তায় পড়লেন কিভাবে চলবে তার পরিবার। তাই তার চাচাকে চিঠি দিলেন, -পরিবারের আর্থিক অবস্থাটা একটু সামাল দিন। এতো দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও নেপোলিয়ন মাত্র এক বছরে যে পাঠ্যক্রম শেষ করেন তা অন্যদের শেষ করতে দুই থেকে তিন বছর লাগে। সামরিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাস করে এই বছরেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে গোলন্দাজ বিভাগে সেকেন্ড লেফটন্যান্ট পদ পান।
হিটলারঃ

১৮৯২ সালে পদোন্নতি হওয়ায় হিটলার এর বাবা ব্রাউনাউ ছেড়ে চলে আসেন পাসুতে। এর দু-বছর পর তিনি অস্ট্রিয়ার সুন্দর শহর লিনজ এ কাজে যোগ দেন। লিনজ হিটলারের খুব প্রিয়ো শহর। দানিউব নদীর তীরে এই ছোট্ট ছবির মতো শহরটির মায়ায় হিটলার এতোই মোহিত ছিলেন যে, একে তিনি তার প্রকৃত জন্মস্থানের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। এখানেই শুরু হয় হিটলারের শিক্ষাজীবন। আট বছর বয়সে তিনি চার্চের কোরাস গান শেখেন। সেই সময় হয়তো চেয়েছিলেন একজন পোপ বা পুরোহিত হতে। ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯০০ সালে অস্ট্রিয়ার লিনজের স্টেইনগাস এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
পড়ালেখায় হিটলার ভালোই ছিলেন। যে বিষয়ে গুলো তার প্রিয়ো ছিলো সেগুলো খুব মন দিয়ে পড়তেন। আর যেগুলো ভালো লাগতো না, সেগুলো ছিলো চরম অবহেলা। তাই ফলাফল হতো মিশ্র। কখনো ভালো, কখনো খারাপ। হিটলার এর বাবা চাইতেন হিটলার তার মত সরকারি কর্মচারী হোক। তাই ছেলেকে মাঝে মাঝে কাষ্টমস অফিসে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তার ইচ্ছা চিত্রশিল্পী হওয়া। তাই খুব মন দিয়ে ছবি আঁকতেন। শুধু খেয়ালের বশে ছবি আঁকা নয়, একেবারে একে জীবিকা করাই তার ইচ্ছা। কিন্তু এ নিয়ে দ্বন্দ শুরু হয় বাবার সাথে।
১৯০৫ সালে জার্মান, ফরাসি, অঙ্ক আর স্টেনোগ্রাফিতে ফেল করলেন। নিজের আত্মজীবনীতে (মাইন ক্যাম্ফ, Mein Kampf) তিনি বলেন, - এর কারণ বাবার অবাধ্য হয়ে বাবার উপর প্রতিশোধ নেয়া, সেই সাথে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকা। লক্ষ্য চিত্রশিল্পী হওয়া। দিনরাত ছবি আঁকেন। আঁকাতে ঝোঁক মূলতঃ স্থাপত্যচিত্রে। নবম শ্রেণী পর্যন্ত টেনেটুনে পাশ করা গেল কিন্তু তারপর ফল হল খুব খারাপ। নবম শ্রেণীতে পড়াশুনার প্রতি বিরক্তি আর হতাশায় একদিন নেশা করে বসলেন। এটাই জীবনের প্রথম এবং শেষ নেশা। তিনি জীবনে আর কখনও মদ স্পর্শ করেন নি। নেশার চোটে ভুল করে পরীক্ষার মার্কশিটের কাগজই টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করেন।
ওই নবম শ্রেণী পর্যন্তই পড়ালেখা। অবশ্য এর জন্য তেমন একটা দুঃখও ছিল না মনে। তখন চিত্রশিল্পী হওয়ার রঙিন স্বপ্নে ভরে আছে মন। আর একটা নেশা ছিলো। নাটক দেখা। নিয়মিত নাটক দেখতেন। ১৬ বছর বয়সে লিনজ মি উনিসিপল থিয়েটারে একটি নাটক দেখেন নাম 'Cola di Rienzi'। নাটকটির বিষয়বস্তু ছিলো মধ্যযুগের রোমের গরিব মানুষদের, ধনী আর ক্ষমতাসীন অত্যাচারীদের হাত থেকে মুক্তির সংগ্রাম। নাটকটি দেখে হিটলার এত অনুপ্রণিত হন যে, হিটলারের বন্ধু অগাস্ট কাবুজেক মন্তব্য করেন, - এই নাটক দেখার পরই হিটলারের মুখ থেকে যেন বাঁধ-ভাঙা জলস্রোতের মত অন্তরের সব কথা, তাঁর ভবিষ্যৎ সব পরিকল্পনা বিপুল আবেগে উৎসারিত হতে লাগলো। এই নাটকটি যে হিটলারকে ভবিষ্যৎ জীবনেও যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল তাতে সন্দেহ নেই।
মিল অমিল গুলো নিজ দায়িত্বে খুঁজে নিন। আমি আর কি বলতে পারি। ভালো লাগলে জানিয়েন।
মিল-অমিল নেপোলিয়ন-হিটলার (প্রথম পর্ব)
মিল-অমিল নেপোলিয়ন-হিটলার (তৃত্বীয় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:৫২