সক্রেটিস - পর্ব ১১ (কতিপয়তন্ত্র এবং আমরা কোথায় আছি?)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সক্রেটিস- পর্ব ১০ (সক্রেটিস এর মৃত্যূদন্ড)
সক্রেটিস - পর্ব ৯ (সক্রেটিস এর বিরূদ্ধে অভিযোগ সমূহ)
সক্রেটিস - পর্ব ৮ (কিছু উক্তি)
সক্রেটিস- পর্ব ৭
কতদিন পর আবার সক্রেটিসকে নিয়ে লিখতে বসেছি। শায়মা আপিকে কথা দিয়েছিলাম, আমি সক্রেটিস নিয়ে লিখবো। সেই থেকেই এই লেখার পথ চলা। একবার মনে হলো, অনেক তো হলো- এইবার ক্ষান্ত হই। অন্য কিছু নিয়ে লিখি। সক্রেটিসের মৃত্যূর মধ্যে দিয়ে সক্রেটিস পর্বের শেষ হোক। এর পর মনে হলো এখনো কি আমরা সক্রেটিসকে চিনতে পেরেছি? সক্রেটিস এর মূল সুরটি ধরতে পেরেছি? আমারতো মনে হয় না। এখনো অনেক বাকী।
আজ যে বিষয়টি আলোচনা করতে চাচ্ছি তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা যে শুধু আমাদের দেশের জন্য তা কিন্তু না। এটা যে কোনো দেশের জন্য, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এডিমেন্টাসঃ কী ধরনের সরকারকে তুমি 'কতিপয়তন্ত্র' বলে অভিহিত করতে চাও?
সক্রেটিসঃ কতিপয়তন্ত্র আমরা তাকেই বলব, যেখানে সরকারের ভিত্তি হচ্ছে সম্পত্তি এবং যেখানে অর্থবানরাই ক্ষমতাবান আর দরিদ্রগণ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত।
ঃ হ্যাঁ, একথা ঠিক।
ঃ কিন্তু আমাদের বোধহয় উচ্চাভিলাষতন্ত্র থেকে কতিপয়তন্ত্রের পরিবর্তন্টা আগে ব্যাখ্যা করা আবশ্যক।
ঃ হ্যাঁ, এই পরিবর্তনটি আমাদের জানা আবশ্যক।
ঃ অবশ্য এর একটি অপরটিতে কীভাবে পরিবর্তিত হয়সেটি ধেখার জন্য খুব তীক্ষ্ণ চোখের নিশ্চয়ই আবশ্যকতা নেই?
ঃ কেন?
ঃ ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তির অর্জন এবং ব্যক্তিগত ভান্ডারে তা জমা করার মধ্যেই উচ্চাভিলাষতন্ত্রের ধ্বংস নিহিত। উচ্চাভিলাষতন্ত্রের শাসকগণ বেয়াইনি কিংবা তাদের স্ত্রীগণ আইনের কোনো পরোয়া করে না। (আমাদের দেশে শুধু স্ত্রীগণ নয়, আত্মীয়স্বজন সহ কেউই তোয়াক্কা করেন না।)
ঃ হ্যাঁ, একথা ঠিক।
ঃ ফলে একজন যখন অপরজনকে ধনী হতে দেখে তখন সে নিজে তার চেয়েও ধনী হতে চায়। ধন-উপার্জনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এমনিভাবে অধিকসংখ্যক নাগরিকই অর্থলিপ্সু হয়ে দাঁড়ায়। (একটু বাংলাদেশের কথা চিন্তা করুনতো!)
ঃ এরূপ হওয়াই সম্ভব।
ঃ এমনিভাবে তারা অধিক থেকে অধিকতর ধনবান হতে আরম্ভ করে। আর যত অধিক তারা সম্পদের কথা চিন্তা করে, তত কম তারা ন্যায়ধর্মের বিষয়ে আগ্রহবোধ করে। কারণ, দাঁড়িপাল্লায় তুমি যখন ধনসম্পদ আর ন্যায়ধর্ম একসঙ্গে ওজন করতে চাইবে, তখন একদিকে যখন ধনসম্পদ ভারি হতে থাকবে তখন অপরদিকে ন্যায়ধর্ম হ্রাস পেতে থাকবে।
ঃ এ কথা যথার্থ।
ঃ এবং যে-অনুপাতে এরূপ রাষ্ট্রসম্পদ এবং সম্পদবানের সম্মান বৃদ্ধি পেতে থকবে ঠিক সেই অনুপাতে অপরদিকে ন্যায়ধর্ম এবং ন্যায়বান অসম্মানিত হতে থাকবে।
ঃ নিঃসন্দেহে।
ঃ আর একথাও সত্য, যাকে তুমি সম্মান কর তারই চর্চা হয়, তারই বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু যে অসম্মানিত, সে অবজ্ঞাত হতে থাকে।
ঃ এ কথা স্পষ্ট।
ঃ পরিণামে এরূপ রাষ্ট্রে সম্মানের দ্বন্দ সম্পদের দ্বন্দে পরিণত হয়। সম্মানের জন্য দ্বন্দের বদলে এবার সকলে অর্থ আর ব্যবসায়কামী হয়ে উঠে। এখন তারা সম্পদবানকেই সম্মানিত করে; তার প্রতি সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এবং সম্পদবানকে শাসক হিসাবে নিযুক্ত করে এবং দরিদ্রকে তারা অসম্মান করে। (আমরা কি তাই করছি না?)
ঃ তারা এরূপই করে।
ঃ এর পরবর্তী ধাপে এরা এরূপ একটা আইন প্রণয়ন করে, যে আইনের আদেশে বিশেষ বিশেষ পরিমাণ অর্থকে নাগরিকত্বের শর্ত হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়। এ-অর্থের পরিমাণ কোথাও কম, কোথাও বেশি হতে পারে। কারণ, কতিপয়তন্ত্রের সংখ্যা কম কিংবা বেশি হতে পারে। নির্দিষ্ট অর্থের চেয়ে কম যাদের অর্থের পরিমাণ, সরকরের সকল ক্ষমতা থেকে তাদের বঞ্চিত রাখা হয়। সন্ত্রাসের মাধ্যমে যদি তারা সংবিধানের মধ্যে এই সমস্ত পরিবর্ত্ন অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম না হয়, তা হলে অস্ত্রের জোরে শাসকগণ তাদের বাঞ্চিত পরিবর্তন সাধন করে।
ঃ খুবই সত্য কথা।
ঃ মোটামোটি এভাবেই কতিপয়তন্ত্রের সরকার স্থাপিত হয়।
এডিমেন্টাসঃ তুমি ঠিকই বলেছ, সক্রেটিস। কিন্তু এরূপ সরকারের চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী এবং এদের যে-ত্রুটির কথা তুমি একবার উল্লেখ করেছিলে, সেগুলিই-বা কি?
সক্রেটিসঃ প্রথমত, শাসনের শর্তের কথা ধরো। জাহাজ কে চালাবে? মনে করো শর্ত করা হল, যার অর্থ আছে সে-ই জাহাজ চালাবে, সে নয় যে জাহাজ চালাতে জানে। একজন দরিদ্র যদি নৌচালনায় দক্ষ হয় তবুও সে নৌযানের নাবিক হতে পারবে না। কারণ নৌযানচালনার গুণ নির্দিষ্ট হয়েছে-অর্থ, নৌচালনার দক্ষতা নয়। এমন যদি হয়, তার পরিণাম কী হতে পারে বলে তুমি মনে কর?
ঃ এর পরিণাম নির্ঘাত ধ্বংস। জাহাজ সমুদ্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
ঃ হ্যাঁ। তাই হবে, আর এ কি জাহাজের ক্ষেত্রেই কি সত্য? যে-কোনো কিছুর চালনার ক্ষেত্রেই কি এ-সত্য থেকে বাদ থাকবে? যে-কোনো কিছুর চালনার ক্ষেত্রেই কি এ কথা সত্য নয়?
ঃ হ্যাঁ, সর্বত্রই এ কথা সত্য।
ঃ কিন্তু একটি রাষ্ট্র? সে কি এ-সত্য থেকে বাদ থাকবে? না, রাষ্ট্রচালনার ক্ষেত্রেও এ-পরিণাম সত্য?
ঃ শুধু সত্য নয়, আমি বলব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ সবচেয়ে বেশি সত্য। কারণ, একটি রাষ্ট্রচালনা হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
ঃ তা হলে, কতিপয়তন্ত্রের এটাই হচ্ছে প্রথম ত্রুটি?
ঃ নিঃসন্দেহে এটা তার ত্রুটি।
আমার প্রিয়ো পাঠকগন যদি এই লেখাগুলো পড়ে থাকেন তবে একটু চিন্তা করেন। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ সাল আগে জম্মগ্রহণ কারী একজন সক্রেটিস যে চিন্তা করেছেন সেই কতিপয়তন্ত্র কী গেড়ে বসে নাই আমাদের রাজনীতিতে? তবে, আমাদের পরিণতি কি?
এইবার সক্রেটিসকে নিয়ে একটি গল্পদিয়ে শেষ করি। একদিন সক্রেটিস এর এক পরিচিত জন সক্রেটিস এর দিকে একটু দৌড়ে এসে (আমরা যাকে Excited বলি সেরকম হয়ে, এর ভালো বাংলা মনে পরছে না।) জিজ্ঞাস করলেন- 'সক্রেটিস তুমি কি জানো, ডায়াগোনেস (Diogenes) সম্পর্কে আমি যা শুনলাম?'
সক্রেটিস বললেন, 'এক মুহূর্ত থাম। আমাকে বলার আগে আমি ছোট একটি পরীক্ষা নিতে চাই। আমি একে তিন ধাপের পরীক্ষা নাম দিয়েছি।'
সেই পরিচিত জন জিজ্ঞাস করলেন, 'তিনটা ধাপ?'
'ঠিক তাই', সক্রেটিস বললেন, 'ডায়েগোনেস সম্পর্কে আমায় বলার আগে তুমি কি বলতে চাচ্ছ তার আগে পরীক্ষা (filter) করে নিই।'
'এর প্রথম ধাপটি হলো সত্য পরীক্ষা। আমায় যা তুমি বলতে চাচ্ছ সে সম্পর্কে তুমি কি নিশ্চিত যে এটি সত্য?'
লোকটি বললেন, 'না, আমি কেবল শুনেছি মাত্র।'
'ঠিক আছে', সক্রেটিস বললেন, 'তবে তুমি জানোই না এটি সত্য কি মিথ্যা। এর পরের ধাপটি ভালোত্ব নিয়ে। ডায়েগোনেস সম্পর্কে তুমি আমায় যে কথা বলতে চাও তা কি তার ভালো সম্পর্কে?'
'মনে হয় না.......'
'না!', সক্রেটিস কিছুটা আশ্চর্য হয়ে আবার জিজ্ঞাস করেলেন, 'তুমি আমায় ডায়াগোনেস সম্পর্কে কিছু জানাতে চাও যা মূলতঃ খারাপ তাও সত্য এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে?'
লোকটি বিব্রত হয়েই কাধঁ ঝাঁকালো।
সক্রেটিস বললেন, 'তোমার এখনো আরেকটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে, কেননা এখনো তৃত্বীয় ধাপটি বাকী। এই ধাপটি হলো উপকারিতা সম্পর্কে। তুমি ডায়েগোনেস সম্পর্কে যা বলতে চাও তা কি আমার কোনো উপকারে আসবে?'
লোকটি বললেন, 'না, আমি এই ব্যাপারে নিশ্চিত নই'।
'আচ্ছা', সক্রেটিস বললেন, 'তুমি ডায়াগোনেস সম্পর্কে আমায় বলতে চাচ্ছো যা সত্য নয়, ভালো কিছুও নয় আমার উপকারেও লাগবে না, তবে আমায় অথবা, অন্য কাউকে কেন বলতে চাচ্ছো?'
লোকটি এবার সত্যিই লজ্জা পেলো।
এই হলো সক্রেটিস সম্পর্কে একটি ছোট্ট উদাহরণ কেন তিনি একজন মহান দার্শনিক? শুধু কি তাই, সময়কে উপেক্ষা করে কিভাবে এতো উপরে নিজেকে নিয়েছেন, আছেন এবং থাকবেন।
সবাইকে ধন্যবাদ। অনেকেই আমাকে উৎসাহীত করেছেন এই লেখা চালিয়ে যাওয়ার। তাঁদের অনুপ্রেরণাই আরো একটু প্রলম্বিত করা হলো এর পথ চলা শেষ কে।
বি.দ্রঃ এক বসায় লিখেছি, কিছু বানান ভুল থাকতে পারে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভুল ধরিয়ে দিলে পরে ঠিক করে দেয়া হবে।
সক্রেটিস- পর্ব ১
সক্রেটিস- পর্ব ২
সক্রেটিস- পর্ব ৩
সক্রেটিস - পর্ব ৪ (এটাকে প্রেম পর্বও বলা যায়)
সক্রেটিস- পর্ব ৫
সক্রেটিস- পর্ব ৬
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন