সক্রেটিস - পর্ব ৮ (কিছু উক্তি) শায়মা আপিকে কথা দিয়েছিলাম আমি সক্রেটিস নিয়ে লিখবো। সেই কথা রাখতেই এই লেখার বিস্তার। এই পর্যন্ত ৮টি পর্ব লেখা হয়ে গেছে। সক্রেটিস কে নিয়ে তো অনেক ক্যাচাল পারলাম। এবার আসেন দেখি তার বিরূদ্ধে অভিযোগ গুলো ছিল কি কি?
৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সত্তুর বছর বয়সে সক্রেটিসের বিরূদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাঁর বিরূদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনা হয়।
এক. তিনি এথেন্সের উপাস্য দেবতাদের মানেন না।
দুই. তিনি নতুন দেবদেবী চালানোর চেষ্টা করছেন।
তিন. এথেনীয় তরুণদের তিনি এইসব শিক্ষা দিয়ে বিপথগামী করে তুলেছেন।
যারা তাঁর বিরূদ্ধে মামলা দায়ের করেন, তারা কেউই তেমন পরিচিত বা বিখ্যাত ছিলেন না। বলা চলে তুলনামূলকভাবে অখ্যাত ব্যাক্তি। তাদের কারোর যে সক্রেটিসের উপর ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিলো এমন মনে হয় না। কাজেই ধরে নিতে হচ্ছে যারা তাঁর বিরূদ্ধে অভিযোগ করেছেন তাদের পেছনে ছিলো বিরাট একদল অভিযোগ কারী। এরা কারা? এরা কি এথেন্সের জনসাধারণ? এথেন্সের ক্ষমতাসীন চক্র? তথাকথিত গণতন্ত্রকারী, যারা ভাবতেন সক্রেটিস গণতন্ত্রের শত্রু এবং এথেন্সের অভিজাত দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে? এসব প্রশ্নের জবাব যাই হোক না কেন, একটা বিষয় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সক্রেটিসের বিপক্ষে একটা জনমত ছিলো। অন্ততঃ একটা জনমত তৈরি করা সম্ভব হয়েছিলো। যে অভিযোগগুলি আদালতে পেশ করা হয়েছিলো সেগুলির বেশির ভাগই অতি তুচ্ছ এবং গুরুত্বহীন। আদালতের সামনে অভিযোগগুলিকে প্রমাণ করাও যায় নি। প্রমাণিত হলেও তাতে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সক্রেটিসের মৃত্যূদন্ড হওয়ার কথা নয়, বড়ো জোর তাঁর নির্বাসন বা কারাদন্ড হতে পারতো।
এই অভিযোগ এনেছিলেন তিনজন। এদের নাম এ্যানিটস, মেলিটস এবং লাইকন।
এ্যানিটস (Anytus) ছিলেন একজন গণতন্ত্রী রাজনৈতিক নেতা, তিনি মামলা করেছিলেন শিল্পী ও রাজনীতিবিদদের হয়ে।
মেলিটস (Meletus) ছিলেন এক 'প্রাণবন্ত অখ্যাত তরুণ' বিয়োগান্তক কবি। 'স্বল্পকেশ, হালকা দাড়ি এবং বড়শির মতো নাকওয়ালা' -এই হলো মেলিটসের চেহারার বর্ণনা। তিনি মামলা করেছিলেন কবিদের পক্ষ নিয়ে।
লাইকন (Lycon) ছিলেন আরও অখ্যাত এক ছান্দসিক। তিনি মামলা দায়ের করেছিলেন উকিলদের স্বার্থ রক্ষার্থে।
এখন খতিয়ে দেখা যাক কেন তারা এই মামলা করেছিলেন? কেন করেছিলেন তা জানা যায় প্লেটোর, Apology থেকে। সক্রেটিস নিজেই জানাচ্ছেন এর কারণ। চেয়ারেফন (Chaerephon) একবার ডেলফির (Delphi) মন্দিরে জানতে চান 'সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী আর কেউ আছেন কিনা?' চেয়ারেফনের জবাবে দেবী পাইথিয়া জানিয়ে দিলেন যে সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী আর কেউ নেই। এই ঘটনা সক্রেটিসকে বেশ বিচলিত করে। তিনি মনে করলেন এই বলে দেবী আসলে কি বোঝাতে চাইছেন? দেব-দেবতারে তো আর মিথ্যা কথা বলতে পারেন না।অথচ তিনি নিজে জানেন তিনি আদৌ পন্ডিত বা জ্ঞানী নন। তাই পন্ডিত বা জ্ঞানী বলে খ্যাত একজনের কাছে তিনি যান, এই জানার জন্য যে অন্তত এইবার প্রমাণ হবে তিনি (সক্রেটিস) আসলেই জ্ঞানী নন। প্রথমে যার কাছে তিনি যান তিনি একজন রাজনীতিবিদ। তাকে যাচাই করে যে শিক্ষা পেলেন তা হলো এই রকমঃ 'বুঝতে পারলাম অনেক মানুষ- বিশেষত উনি নিজে- ওঁকে পন্ডিত মনে করেন, কিন্তু সত্যসত্য উনি নন। তারপর আমি তাকে বললাম, দেখুন আপনি নিজেকে পন্ডিত মনে করছেন, কিন্তু আপনি তো আসলে তা নন।' এতে তার পরিষদের অনেকেই সক্রেটিসের উপর নাখোশ হন। সক্রেটিস নিজে এই ভাবলেন, 'আমি তো এই ভদ্রলোকের চেয়ে বড় পন্ডিতই। হতে পারে উনি আর আমি- দুজনেই- জানার মতো কিছুই জানি না। তবে উনি কিছু না জেনেও মনে করেন অনেক কিছু জানেন, আর আমি যখন কিছুই জানি না তখন মনে করি কিছুই জানি না। আমাদের মধ্যে এই সামান্য পার্থক্য। এই পার্থক্যটুকুর সুবাদেই হয়তো ওর চেয়ে আমি বড় পন্ডিত বা জ্ঞানী বলা হয়েছে। পার্থক্য এইঃ আমি যা জানি না, তা জানি বলে ভুল জানি না।' এই ভাবে আরেক ভদ্রলোকের কাছে থেকেও একই শিক্ষা পেলেন।
এর পর তিনি গেলেন কবিদের কাছে। এই আশায় যে তারা হয়তো কিছু জানাতে পারবেন। কবিদের প্রশ্ন করলেনঃ 'এই কবিতায় আপনি কী বুঝাতে চেয়েছেন? উদ্দেশ্যঃ এই সুবাদে আমারো খানিক জ্ঞান হয়। আথেনসবি ভায়েরা আমার, আপনাদের সামনে সত্য বলতে শরম লাগছে, কিন্তু উপায় কী- আমাকে তবু বলতেই হচ্ছে। কবির কবিতার অর্থ, খোদ কবিসাহেবদের চেয়ে চারপাশে সমবেত রবাহূতরাই ঢের ভালো বলতে পারছে মনে হলো। কবিরা যে সকল কবিতা লেখেন তা লেখা হয় এক ধরনের প্রকৃতিদত্ত শক্তির দৌলতে আর অনুপ্রেরণার প্রকোপে, জ্ঞানের জোরে আদৌ নয়।'
সর্বশেষে গেলেন শিল্পীদের কাছে। শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান শূন্যের কোঠায় জেনে চিন্তা করলেন এইবার তাদের কাছ থেকে কিছু শিখবেন। কিন্তু হায়! তাঁর ভাষাতেই শুনি, 'দেখলাম কবিদের যে দোষ এই শিল্পী মহাত্মাদেরও সেই একই দোষ। উভয় দলই মনে করেন, যেহেতু ওঁরা এক একজন নিজ নিজ বিদ্যায় সফলকাম সুতরাং দুনিয়ার অন্য সকল ওজস্বী বিষয়েও ওঁরা এক একজন দিগগজ পন্ডিত। ওঁদের এই ভুল ধারণার কারণে ওঁরা নিজ নিজ বিদ্যায় যাও বা জনাতেন তাও মলিন করে ফেলতেন। সুতরাং ওহিবাহিকার হয়ে আমি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, আমিকি ওঁদের পন্ডিত্য, ওঁদের মূর্খতা নিয়ে ওঁদেরই মতন হবো, না কি দুয়ের কোনটাই না নিয়ে যেমন আছি তেমনই থাকব? নিজকে আর ওহিবাহিকাকে আমি উত্তর দিলামঃ আমার পক্ষে, আমি হয়ে থাকাই শ্রেয়।'
বোঝাই যাচ্ছে দিন দিন তাঁর শত্রুর সংখ্যা তিনি নিজে কিভাবে বাড়িয়েছেন। তাঁর বিরূদ্ধে আনীত অভিযোগ এক এক করে সক্রেটিস খন্ডন করেছে। এর একটি (শেষেরটি) আগে এক পর্বে দেখানো হয়েছে। তাই সেই বিষয়ে আর বিস্তারিত গেলেম না। এই সব আমরা জানতে পারি প্লেটোর, Apology থেকে। তাঁকে মৃত্যূদন্ডে দন্ডিত করার আরো কিছু কারণ আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবো এর পরবর্তী পর্বে। (কালকে পোষ্ট দিতে পারবো কিনা আল্লাহপাকই জানেন। অফিস আছে, তাও আবার Month Closing Day.)
বিশেষ দ্রষ্টাব্যঃ এই লেখাটা একটু বেশি ছোট হয়ে গেলো। কি আর করা, সবাই একটু ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১২ রাত ১১:৩৩