
সক্রেটিস পর্ব- ১
সক্রেটিস পর্ব- ২
সক্রেটিস পর্ব-৩
শায়মা আপিকে কথা দিয়েছিলাম, আমি সক্রেটিস নিয়ে লিখবো। সেই কথা রাখতেই এই লেখা শুরু করা। এর আগের পর্বেই বলেছিলাম, প্রেম সম্পর্কে সক্রেটিসের ধারণা নিয়েই হবে এই পর্ব।
গ্রিক পুরাণ মতে, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি (Aphrodite)। তাই প্রেম সম্পর্কে সক্রেটিসের বক্তব্য জানার আগে আফ্রোদিতি সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক। প্রেম যেমন দুই শ্রেণীর, মর্ত্যপ্রেম ও দিব্যপ্রেম। এর অধিষ্ঠাত্রী আফ্রোদিতে দেবীও দুইজন। মর্ত্য আফ্রোদিতে চঞ্চলা, নিকৃষ্ট কামোদ্দীপক; আর দিব্য আফ্রোদিতে ধীরা, নিষ্কলুষ প্রেমের উদ্দীপক। মর্ত্য আফ্রোদিতে নবীনা, থিয়াস ও ডাইয়োনের কন্যা; আর স্বর্গীয়া আফ্রোদিতে বয়োজ্যোষ্ঠা, এর জন্ম হয় বিনা মাতায়, পিতা উরেনাস থেকে। এই দিব্য আফ্রোদিতের প্রভাবিত প্রেমদেবই ছিল সেই সময়ের পূজ্য।

এই বার আসা যাক প্রেম সম্পর্কে সক্রেটিসের বক্তব্য। এই বক্তব্য আমরা জানতে পারি প্লেটোর সিম্পোজিয়াম থেকে। প্লেটোর সিম্পোজিয়াম বইটির মূল উপজীব্য বিষয়ই হলো প্রেম। প্রেম সম্পর্কে সাত জন বক্তার বক্তব্য নিয়েই এই বইটি রচিত। প্রথম বক্তা ফ্রেড্রস, দ্বিতীয় বক্তা পসেনিয়াস তৃতীয় বক্তা এরিক্সিমেকাস চতুর্থ বক্তা অরিস্টোফেনিস পঞ্চম বক্তা আগাথন ষষ্ঠ বক্তা সক্রেটিস সপ্তম বক্তা এলসিবিয়াডিস।

সক্রেটিসের বক্তৃতার সারাংশঃ প্রেম (আফ্রোদিতে) আসলে দেবতাও নয়, আবার মানুষও নয়,- এদের মাঝামাঝি, রুহ, ফেরেশতা, জিন বা ওই প্রকার কোনো কিছু (এই কথাটা কেন আসলো তা বর্ণনা করার জন্যই আফ্রোদিতের কথা লেখা হয়েছে)। এদের দ্বারাই স্বর্গ ও মর্তের মধ্যে একটা যোগসূত্রের সৃষ্টি হয়। প্রেম বলতে কোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ বা প্রীতি বোঝায়, সুতরাং প্রেম অন্য নির্ভর। তা ছাড়া, প্রেম সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সুন্দরের সঙ্গ কামনা করে; অতএব সে নিজে সুন্দর নয়, নইলে সুন্দরের অভাববোধ থাকবে কেন? আবার, যা সুন্দর তাই সত্য ও যা সত্য তাই সুন্দর। সুতরাং প্রেমের যখন সুন্দরের অভাব রয়েছে, তখন মানতে হবে, তার মধ্যে সত্য, শ্রেয়, প্রজ্ঞা প্রভৃতি গুণেরও অভাব রয়েছে। এসব কথা আমি শিখেছি মানটিনিয়া নিবাসিনী কোনো গুণবতী মহিলা ডাইয়োটিমার কাছ থেকে। তার কাছ থেকে আরো শুনেছি, প্রেম সুন্দর ও অসুন্দরের মাঝামাঝি, জ্ঞান ও অজ্ঞানের মাঝামাঝি। প্রেমের জন্মবৃত্তান্ত শুনলেই এসব কথা পরিস্কার বোঝা যায়। এর মাতা মানবী 'দারিদ্র্য' আর পিতা হচ্ছে 'উদ্ভাবন' দেবের পুত্র 'কৌশল' দেব। আফ্রোদিতের জন্মদিনে স্বর্গে উৎসব হচ্ছিল, তখন 'কৌশল' সোমরস পান করে মত্ত অবস্থায় স্বর্গের উদ্যানে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। এমন সময় 'দারিদ্র্য' প্রার্থী হয়ে স্বর্গদ্বারে এসে দ্বার খোলা পেয়ে উদ্যানে 'কৌশল'কে শায়িত অবস্থায় দেখতে পায়। তখন সে ভাবল, এই সুযোগে 'কৌশলে'র সন্তান পেটে ধারণ করতে পারলে দুঃখ ঘুচবে। তাই সে 'কৌশলে'র পাশে শায়িত হয়ে 'প্রেম' কে গর্ভে ধারণ করে। তাই প্রেমের শ্রেণী হয়েছে দেবতা ও মানবের মাঝামাঝি। তাই প্রেম মাতার ন্যায় সদা দারিদ্র্য, আর প্রাকৃতিক দুর্যোগপিষ্ট হয়ে তার শরীরটা হয়েছে গাট্টাগোট্টা ও মজবুত- সুকোমল বা সুকমার মোটেই নয়। দেব-স্বভাবের ফলে সৌন্দর্যের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ রয়েছে, আর তার মাথায় অনেক বুদ্ধি খেলে, সারা জীবন জ্ঞানের অন্বষণ করে বেশ জাদু শিখেছে- আলকেমিস্টদের মতো নিকৃষ্ট ধাতুকেও সোনার মতো উজ্জ্বল করে দেখাতে পারে, আর তর্করসিকের মতো ভ্রান্তিকেও সত্যের মতো করে উপস্থিত করতে পারে।
প্রেমের আরো একটি ব্যাপকতা আছে। ব্যাপকভাবে ধরতে গেলে শ্রেয় ও সুখের যাবতীয় ভাবই প্রেমের অন্তর্গত। মানুষ স্বভাবতই শ্রেয়কে আত্মীয় আর অশ্রেয়কে অনাত্মীয় ভাবে। কেবল যা শ্রেয় তাই মানুষের প্রেয়। কিন্তু, কেবল হিতকর জিনিসই মানুষের প্রিয়। তবে একথাও জুড়ে দেয়া যায় যে- হিতকর জিনিস সকলেই 'নিজের জন্য' পেতে চায়। আর শুধুর প্রাপ্তিই নয়, স্থায়ীভাবে পেতে চায়। তা হলে মোদ্দা কথা দাঁড়াল এই যে- 'শ্রেয়কে চিরকালের জন্য পাবার বাসনার নামই প্রেম।'
মানুষ অমর হতে চায়, তাই সাধারণ লোকে সন্তান উৎপাদনের দিকে, আর বিশিষ্ট লোকে ভাবোৎপাদনের দিকে আকৃষ্ট হয়। উৎকৃষ্ট ভাব- অর্থাৎ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য প্রভৃতি- অপরকে শিখিয়ে যেতে পারলে সেইসব শিষ্যের মধ্যেই মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকবে, এই জন্যই জ্ঞানী ব্যক্তিরা সুলক্ষণযুক্ত, সুরুচিসম্পন্ন কিশোরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই অজৈব ভাব সঞ্চালনই অমরত্ব লাভের প্রকৃষ্ট পন্থা। কুৎসিত পরিবেশে সুন্দরের সৃষ্টি হয় না বলেই সুন্দর পাত্রের সন্ধান করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, প্রেমের লক্ষ্য 'সৌন্দর্য' নয়, বরং লক্ষ্য হচ্ছে সুন্দর পরিবেশে ভাব, সত্য ইত্যাদির জন্মদান করা। এই উদ্দেশ্য এত প্রবল যে, সন্তান রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে পশু -পক্ষীরাও জীবন বিসর্জন করতে কুন্ঠিত হয় না, মানুষের তো কথাই নেই।
মানুষ যশ চায়- এই কারণে সকলেই হোমার, হেসিয়ড প্রভৃতি কবিদেরকে মনে মনে হিংসা করে এবং তাঁদের মতো যশস্বী হতে চায়। এই অজৈব আকাঙ্ক্ষাই উন্নত পর্যায়ের প্রেম, এর সাধনাতেই মানুষ ক্রমান্বয়ে উচ্চতর স্তরে উন্নীত হয়। প্রথম পর্যায়ে, কোনো বিশেষ সুকান্ত বালককে ভালবেসে তার সঙ্গে আলোচনা করে উভয়েরই উন্নতি হয়। তারপর অনেকের মধ্যেই দেহসৌষ্ঠব লক্ষ করে, বিশেষ থেকে নির্বিশেষ দৈহিক সৌন্দর্যের দিকে মন দেয়; তারপর আত্মিক সৌন্দর্যের দিকে তার মন যায়, তখন আর প্রেমাস্পদের দৈহিক সোন্দর্য তেমন প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় না। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ক্রিয়াকর্মের বা প্রতিষ্ঠানাদির সৌন্দর্য লক্ষ করে, এরপর জ্ঞানবিজ্ঞান, শ্রেয় ও প্রজ্ঞার সৌন্দর্য তার মনকে অধিকার করে, তারপর সে বস্তুনিরপেক্ষভাবে সৌন্দর্যের অনাদি বিশুদ্ধ রূপ দেখতে পায়। ডাইয়োটিমা আমাকে বলেছে, এই শেষ স্তরে পৌছে নির্বিশেষ সৌন্দর্যের ধ্যানই মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য,- সেই মানবজীবনের চরিতার্থতা, এই প্রত্যক্ষ দর্শনেই মানুষ অমরত্ব লাভ করে।
আমার খুব লোভ হচ্ছে চতুর্থ বক্তা - আরিষ্টোফেনিসে'র বক্তব্যটি দিয়ে দেই। তার মতে প্রেমের কাহিনী হলো এই-
প্রথমত, মানুষ ছিল তিন শ্রেণীর, পুরুষ, স্ত্রী আর নপুংসক (বা হিজড়ে); দ্বিতীয়ত, আগে মানুষ এখনকার মতো চেপটা ছিল না, বেশ গোলাকার নাদুসনুদুস ছিল- তার ছিল চার হাত, চার পা, ঘাড়ের উপর একটি মাথা, কিন্তু দুই ধারে দুই মুখ। এরা সামনে পিছনে দুই দিকেই হাটতে পারতো, কিন্তু খুব দ্রুত চলতে হলে অষ্টাঙ্গ ব্যবহার করে সার্কাসের ছোকরাদের মতো ডিগবাজি খেতে খেতে চলত। পুরুষের জন্ম হয়েছিল সূর্যের থেকে, স্ত্রীলোকের জন্ম পৃথিবী থেকে আর হিজড়েদের জন্ম হয়েছিল চাঁদের থেকে। সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ সবইতো গোল, কাজে কাজেই এদের শরীর গোলাকার হবে না তো কি হবে? এরা বেশ বলবান আর দুর্দান্ত ছিল, এমনকি সময় সময় দেবতাদেরকেও আক্রমন করতে দ্বিধা করত না। এইসব দেখে শুনে যিয়াসদেব (Zeus) বলল, 'দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা! তাই বলে ঘ্যাঁচ করে এক কোপে সুপারি কাটার মতো দু ফাঁক করে কেটে ফেলে আপোলোকে আদেশ দিলেন চামড়া টান করে নাভির উপর বেঁধে দিয়ে, কাটা ঘা সারিয়ে দিতে। সেই থেকে আমাদের হয়েছে দুই হাত, দুই পা, এক মুখ ইত্যাদি। যা হোক এতে মানুষের জোর হয়ে গেল অর্ধেক, কাজেই এখন মানুষের জারিজুরি থেমে গেছে, আবার দেবতারাও দ্বিগুন মানুষের কাছ থেকে পূজা-আর্চনা পাচ্ছেন। তোমরা ভাবছ, এসব গালগল্পের সঙ্গে আবার প্রেমের সম্বন্ধ কোথায়? সম্বন্ধ এইখানে যে, এখন অর্ধেক মানুষ তার অপরার্ধের খোঁজ করে এবং দেখা পেলে তারা পরম আগ্রহে সম্মিলিত হয়। এরই নাম প্রেম।
পুরুষের অর্ধাংশ পরস্পর মিলিত হলে তারা আর স্ত্রীলোক চায় না, তাদের প্রেমই শ্রেষ্ঠ প্রেম- বয়স্ক প্রেমিক আর কিশোর প্রেমাস্পদের মধুর প্রেম। স্ত্রীলোকের অর্ধাংশ পরস্পর মিলিত হলে তারা আবার পুরুষের তোয়াক্কা করে না। তারা পরস্পরের সাহচর্যেই সুখী ও সন্তুষ্ট থাকে, বিবাহ-বন্ধন পছন্দ করে না। যারা নপুংসক বা উভলিঙ্গ, তাদের অর্ধাংশ পরস্পর মিলিত হলে তাদের পুরুষাংশ স্ত্রী-অংশের প্রতি আর স্ত্রী-অংশ পুরুষাংশের প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়। এরাই সংসারের সাধারণ কামুক শ্রেণী। এরা কেনল সন্তান উৎপাদন করেই সন্তুষ্ট ও সুখী জীবন যাপন করতে চায়।
(একটু মিলিয়ে দেখুন আপনি কোন শ্রেণীতে পরেন। হাঃ হাঃ হাঃ . . .
আবার সামনের সপ্তাহে লেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করছি।)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১২ দুপুর ১২:১৫