* অনেক বছর পরে লগইন করলাম। ভাবলাম কিছু পোস্ট করলে কেমন হয়। তাই দীর্ঘ ছয় বছর পরে সামুতে পোস্ট করলাম। নতুন কিছু না, গত কালকে ফেসবুকে দেয়া একটা পোস্ট।
-----
একাত্তর টিভিতে নিউজ করেছে 'মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই শনাক্ত হবে করোনা রোগী !' এই কাজটার আপডেট আমি সপ্তাহখানেক আগে ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাস মারফত দেখেছিলাম। তারও এক সপ্তাহ আগে এই রিলেটেড একটা ডেটাসেট আর কয়েকটা টিউটোরিয়াল দেখেছি অনলাইনে। তাই ভেবে খুশী হয়েছিলাম যে দেশের স্টুডেন্টরা কাজ করছে। কিন্তু টিভি নিউজ দেখে লেখার প্রয়োজন বোধ করছি। বিশেষত যখন সরকারের সাথে কথা হচ্ছে বলে দাবী করা হয়েছে।
কাউকে ক্রিটিসাইজ করার জন্য বা কাজ করার আগ্রহে বাঁধা দেয়ার জন্য বলছিনা। যারা এই প্রজেক্টে কাজ করেছেন তাদেরকে চেষ্টা করার জন্য ধন্যবাদ। এই ক্রাইসিস এর সময়ে সবাই যে যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাহায্য করার এটা খুবই তৃপ্তিদায়ক।
তবে এই স্পেসিফিক প্রজেক্ট নিয়ে আমার একদম ফার্স্টহ্যান্ড কাজ করার এক্সপেরিয়েন্স আছে এবং এর কিছু কিছু রিস্কের ব্যাপারে জানাশোনা থাকায় এই লেখাটা লিখছি।
বুকের এক্সরে থেকে কোভিড-১৯ জনিত নিউমোনিয়া ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি দিয়ে শনাক্ত করা খুবই চমৎকার একটা "টয়" প্রজেক্ট "বিগিনারদের জন্য"।
কেন?
গুগলে সার্চ করলে এই প্রজেক্ট রিলেটেড এটলিস্ট ১০টা টিউটোরিয়াল পাওয়া যাবে।
আমি বলছিনা যে কাজটায় নভেলটি নাই বলে (অন্যের ডেটাসেট, অন্যের কোড, অন্যের প্রযুক্তি) এটা করা যাবেনা। আমাদের এইরকম কাজের দরকার আছে, অবশ্যই আছে। এজন্য ড্যাফোডিলের টিমটাকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে এর মার্কেটিং নিয়ে। আসলে মার্কেটিং নিয়েও আমার তেমন সমস্যা নেই। আগে পেপার পত্রিকায় বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের প্রজেক্ট নিয়ে নিউজ আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। আমি নিজেও আমার 'নট সো নভেল' কাজ নিয়ে পেপার টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়েছি। আমার অস্বস্তির একমাত্র কারণ এইটা মেডিক্যাল ফিল্ডের কাজ হওয়াতে।
গত বছর আমি জেনারেল ইলেক্ট্রনিকসের হেলথকেয়ার এআই টিমে এইরকমই একটা প্রজেক্ট নিয়েই কাজ করেছি যেখানে এক্সরের পাশাপাশি রেডিওলজিস্টদের লেখা রিপোর্ট নিয়ে এনালাইসিস করতে হয়েছে। এই কোম্পানী স্মার্ট এক্সরে মেশিন নিয়ে কাজ করছে এবং গত বছরই এফডিএ তাদের মেশিন এপ্রুভ করেছে যেটা এক্সরে করার সাথে সাথে নিউমোনিয়া আছে কিনা বলে দিতে পারে। আমার টিমই এই কাজটা করেছে।
সেখানে আমি নিউমোথোরাক্স নামের একটা টার্মের সাথে পরিচিত হই এবং কাজ করি। অনেক সময় গাড়ির এক্সিডেন্টে ফুসফুস আর বুকের পাঁজরের মাঝখানে বাতাস ঢুকে যায়। আস্তে আস্তে সেটা ফুসফুসকে চাপ দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ফুসফুস কলাপ্স করে ভিকটিম মারা যেতে পারে। টিপিক্যালি বুকের একটা এক্সরে করে রেডিওলজিস্টরা একটা রিপোর্ট লেখেন যে নিউমোথোরাক্সের সম্ভাবনা কতখানি, যেটা দেখে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেন। কিন্তু দেখা গেছে যে ১০০ জন রোগীর ১০০ টা এক্সরের প্রতিটা পাঁচজন রেডিওলজিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করালে ৫০% এর বেশীরভাগ সময়ে নিউমোথোরাক্স আছে কিনা এ ব্যাপারে পাঁচজন একমত হতে পারেননা। কারণ সমস্যাটা কঠিন। সেখানে রিয়েল লাইফে একটা এক্সরে একজন রেডিওলজিস্ট দেখেন, সেটা সময়সাপেক্ষ, এবং তার অনুমান ভুল হলে রোগী মারা যেতে পারেন। এক্সরে রিপোর্ট আসতে ৮-১০ ঘণ্টার বেশী সময়ও লাগতে পারে। এখানেই ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্মার্ট এক্সরে মেশিন বানানো হচ্ছে যেটা এক্সরে করে সাথে সাথে নিউমোথোরাক্সের চান্স কত খানি সেটা যথেষ্ট দক্ষতার সাথে বলতে পারে।
এই মডেলে কাজ করার জন্য আমাকে ১ সপ্তাহ ধরে ন্যাশনাল হেলথ ইন্সটিটিউটের ট্রেনিং করতে হয়েছে প্রাইভেসী, এথিকস নিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম গুগল করে একটা প্রি-ট্রেইন্ড রেজনেট মডেল ফাইনটিউন করে দেবো আর কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু কাজটা এত সহজ না আসলে। আমাকে লিটারেলী মেডিক্যাল সায়েন্সের অনেককিছু নিয়ে জানতে হয়েছে।
এত বড় গল্প বলার কারণ টা হচ্ছে রিস্কটা বোঝানো। ক্লিনিকাল ফিল্ডটা এমন না যেখানে আমি ঠাস করে একটা মডেল মেরে দিয়ে বলে দেবো এআই হচ্ছে নতুন ইলেক্ট্রিসিটি। হেলথকেয়ারে এআই এর চ্যালেঞ্জ সবচাইতে বেশী অনেক কমপ্লিকেশনের জন্য।এখানে টয় প্রজেক্টের কোন জায়গা নাই।
ডাক্তার, রেডিওলজিস্ট, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, রোগীর ডেটা ব্যবহার করার অনুমতি, ডোমেইন নলেজ অনেককিছুর জটিলতা আছে। এই জটিলতাগুলি শখ করে তৈরি করা হয়নি। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ এড়ানোর জন্যই করা হয়েছে।
ড্যাফোডিলের প্রজেক্টটাতে আমার মনে হয়না কোন রেগুলেশন মানা হয়েছে। এটা জাস্ট একটা টয় প্রজেক্ট। যেভাবে টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে সেখানে এটা অনেকের মনে ভুল আশার জন্ম দেবে, মিসগাইডেড করবে। ক্লিনিক্যাল ব্যাপার না হলে আমি মাথা ঘামাতাম না আসলে এটা নিয়ে।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার বাংলাদেশে এটা যদি প্র্যাক্টিক্যালি ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয়া হয়, হ্যাজার্ডের সম্ভাবনা আছে। কারণ আমার ধারণা যে ডেটা দিয়ে মডেলটা বানানো হয়েছে সেখানে কোন বাংলাদেশীর এক্সরে নেই। ডেমোগ্রাফির উপর রোগের সিম্পটম ডিপেন্ড করে (ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন)।
ফাইনালী, কোন ফান্ডের মাধ্যমে যদি এটা ডেপলয় করার পরে ডেটাসেট, টিউটোরিয়ালের আসল মালিকরা এসে তাদের ভাগ দাবী করে?
হেলথকেয়ার হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এপ্লাই করার জন্য সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং জায়গা।
আমি আবারো বলছি, ড্যাফোডিলকে আমি ছোট করছি বলে ভাববেন না, তাদের চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমি চাই উনারা এটা নিয়ে আরও কাজ করুক। কিন্তু সেটা যাতে জাস্ট এক জায়গা থেকে ডেটা নিলাম, আরেক জায়গা থেকে মডেল, এবং আরেক টিউটোরিয়াল থেকে কোড দেখে সিস্টেম বানিয়ে টিভিতে প্রচার করে দেয়াতে সীমাবদ্ধ না থাকে।
আমি খুবভালো মত বুঝি দেশ থেকে এই লাইনে খুব নভেল কিছু করা একদমই সম্ভব না। এর জন্য যে পরিমাণ ম্যাথম্যাটিকাল ব্যকগ্রাউন্ড লাগে, এক্সপার্ট মেন্টর লাগে আমাদের তা নাই।
তবে উনারা দেশের ডেটা কালেক্ট করতে পারেন, ডাক্তারদের সাথে কোলাবোরেট করতে পারেন। যাতে আসলে নলেজ তৈরী হয়। উনাদের জন্য শুভকামনা।
তবে আমাদের সাংবাদিকদের অনেক সতর্ক হতে হবে এসব ব্যাপারে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বর্তমান রিসার্চ যেসব চ্যালেঞ্জ ফেইস করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিডিয়া হাইপ।
কোথায় যেন দেখেছিলাম যে এখনের যে টেস্টকিট গুলি আছে সেগুলি অনেক সময় ঠিকমত ডিটেক্ট করতে পারেনা। অল্টারনেটিভ কয়েকটা মেথড নিয়ে কাজ হচ্ছে দেশে। সেখানে যেসব সীমাবদ্ধতা আছে সেগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য এআই ব্যবহার করার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে মনে করিয়ে দিতে চাই, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুধুমাত্র একুরেসী ক্যাল্কুলেশন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। গবেষণা তো আরও না।
সায়েন্টিফিক রিসার্চে স্পিড থাকলে ভালো। কিন্তু যখন স্পিড খুবই বেশী হয় তখন সেখানে গভীরতা কম থাকার সম্ভাবনা বেশী, ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারার সম্ভাবনা কম, মানুষকে মিসগাইডেড করার সম্ভাবনা বেশী।
ব্যক্তির চাইতে প্রতিষ্ঠান বড়, প্রতিষ্ঠানের চাইতে বিজ্ঞান বড়।
** দয়া করে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির কাউকে নিয়ে ট্রল বা মজা করে তাদের চেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করবেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সামনে চমৎকার সব কাজ করবেন তারা। ট্রল কারো প্রাপ্য হলে সেটা সাংবাদিকদের।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:০৭