somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুভি পোস্টমর্টেম - রেদওয়ান রনির চোরাবালি

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অপেক্ষায় ছিলাম সিলেটে কবে আসবে চোরাবালি। গতকাল রাস্তায় পোস্টার দেখেই সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক যেতে হবে। হরতালের জন্য আগামীকালের পরীক্ষা ক্যানসেল হওয়ায় দুপুরের শো ধরার জন্য দৌড় দিলাম ৩জন নন্দিতা সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে। হলে ঢুকতে একটু দেরী হয়ে যাওয়ায় প্রথমের খানিকটা মিস করে ফেলেছি। :(



সুমন(ইন্দ্রনীল) এতিম এক ছেলে যে ছেলেবেলায় মায়ের উপর অত্যাচার করা চেয়ারম্যানকে খুন করে তার ক্যারিয়ার খুনী হিসেবে শুরু করে। তার গর্ভবতী মাকে চেয়ারম্যান রেপ করার চেষ্টা করে এবং তাতে সুমন বাধা দেয়। এতে ক্ষুব্ধ চেয়ারম্যান মৌলানার সাহায্যে তার মাকে দোররা মেরে খুন করে। সুমন সেই চেয়ারম্যানকে খুন করে পালিয়ে যায়। তারপর বাজারের এক চায়ের দোকানে কাজ নেয় এবং ঘটনাচক্রে এক গুন্ডা তাকে আর তার মাকে ছোট একটা ঘটনায় গালাগালি করে তাকে মারায় সুমন তাকে রামদায়ের কোপে মেরে ফেলে। আলী ওসমান (শহীদুজ্জামান সেলিম) তাকে আশ্রয় দেয় এবং নিজের ছেলের মত বড় করে তোলে, অবশ্য খুনী হিসেবে।

আলী ওসমান এক দুর্নীতিগ্রস্থ নেতা। তার কাছেই সুমন বড় হয় এবং খুন করতে থাকে একের পরে এক আলী ওসমানের শত্রুদের। আলী ওসমানের কাছে রক্ষিতা হিসেবে থাকে এক মডেল সুজানা। সে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লে আলী ওসমান তাকে এবরশানের অর্ডার দেয়। সে তা না মানলে এবং তাকে বিয়ে করার চাপ দিলে তাকে টর্চার করে ভাগিয়ে দেয় আলী ওসমান।

সুজানা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তার সাংবাদিক বান্ধবী নবনী আফরোজকে (জয়া আহসান) আলী ওসমানের সব কুকীর্তি ফাস করে দেয়। একথা জেনে আলী ওসমান সুমনকে নির্দেশ দেয় সুজানাকে খুন করার। এরই মধ্যে সুজানার প্রেমে পড়ে এক ডাক্তার। সে সুজানাকে তার বাসায় অনাগত বাচ্চার জন্য একগাদা জুতো আর কার্ড গিফট করে। সুজানা যখন এই কার্ড পড়ছিলো তখনই আসে সুমন আর সুজানার মাথায় গুলি করে খুন করে। তখখই কার্ড আর জুতা দেখে সে বুঝতে পারে সুজানা প্রেগন্যান্ট ছিলো। তার মনে পড়ে যায় নিজের মায়ের কথা। অনুশোচনায় ভুগতে থাকে সে।

ডাক্তার থানায় যায় আলী ওসমানের বিরুদ্ধে মামলা করতে, কিন্তু অসৎ পুলিশ অফিসার মামলা না নিয়ে আলী ওসমানকে জানিয়ে দেয়। আর নবণী তার পত্রিকায় ছাপায় আলী ওসমানের কুকীর্তির কথা। আলী ওসমান সুমনকে নির্দেশ দেয় তাদের দুজনকে খুন করার।

কিন্তু সুমন তা না করে তাদেরকে নিয়ে আটকে রাখে এক শ্মশানের মধ্যে বাড়িতে আর আলী ওসমানকে বলে যে তাদের খুন করা শেষ। নবনী ও সুমন প্রেমে পড়ে। নবনী সুমনকে আলী ওসমানের মামলায় রাজসাক্ষী হবার অনুরোধ করে। ইতিমধ্যে আলীওসমান জেনে যায় সুমনের বেইমানীর কথা এবং একসময় তার লোক দিয়ে নবনী আর ডাক্তারকে তুলে নিয়ে আসে। সুমনের সামনে ডাক্তারকে খুন করা হয় আর সুমনকে তুলোধুনা করে তার লোকেরা। আলী ওসমান যখন নবনীর আংগুল চাপাতি দিয়ে কাটতে যায় তখন সুমন উঠে সবাইকে মেরে নবনীকে নিয়ে পালায়। নবনী সুমনকে আবারো বলে রাজসাক্ষী হতে। তখন সুমন বের হয় আলী ওসমানকে খুন করতে। তার বেডরুমে তাকে খুন করে সুমন। তারপর বাকীরাও ধরা পড়ে। সুমনে জেলে যায় এবং বের হয়ে আসে নবনীর কাছে।


চিরাচরিত বাংলা ছবির সাথে তেমন একটা পার্থক্য নেই গল্পে। কিন্তু একটা জিনিসই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। সেটা হলো মেকিং।

ক্যামেরার কাজ মুগ্ধ করার মত। নায়ক কিলার সুমনের ছোটবেলার কাহিনী যখন ফ্ল্যাশব্যাকে দেখায় তখন কিছু কিছু দৃশ্য নজর কারার মত। বিশেষত মৃত মায়ের পাশে বসে চোখমুখ শক্ত করে কিশোর সুমন যখন কুপির আগুনের ভিতর দিয়ে আঙ্গুল চালাতে থাকে তখনের দৃশ্যটা ভোলার মত নয়। বেশ দুর থেকে নেয়া একটা শটে সেই ঘরের দৃশ্যটা দেখা যায় একটু পরে। শটগুলোয় আলো ছায়ার ব্যাপারগুলো দেখলেই বোঝা যায় কতটা যত্ন নিয়ে করা হয়েছে কাজগুলো। মায়ের খুনী (নামটা মনে নেই) কে খুন করার পর রেললাইনের উপর দিয়ে সুমনের পালিয়ে যাবার দৃশ্যটা থিম, দৃশ্যপট, ক্যামেরার কাজ আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর মিলিয়ে অসাধারণ ছিলো।
প্রতিশোধপরায়ণ একটা ছেলের প্রাণ বাচানোর চেষ্টা, মনের ক্ষোভ, কৈশোরের চঞ্চলতা সবকিছুই চলে এসেছে সেই দৃশ্যে। লোকেশন ছিলো চমৎকার। বাজারের মধ্যে এক লোককে খুন করার পর তার পালিয়ে যাবার দৃশ্যটাও সুন্দর করে দেখানো হয়েছে। পুরো সিনেমাতে এই ফ্ল্যাশব্যাকের জায়গাটাই চমৎকার লেগেছে। কিশোর সুমনের অভিনয় খুবই ভালো ছিলো।

তবে দুটো জায়গায় একটু খুত ধরা পড়েছে। সুমনের মাকে দোররা মারার দৃশ্যটা রিয়েলিস্টিক হয়নি। অন্য কোন ভাবে হয়তোবা করা যেত। দোররা মারার ঘোষণা যখন মৌলানা দেয় সেই দৃশ্যটা সিনেমার মনে হয়নি বরং বিজ্ঞাপনীয় অতিরঞ্জিত শট মনে হয়েছে। তাছাড়া সুমনের মাকে যখন চেয়ারম্যান কুপ্রস্তাব দেয়ার পর সুমন তাকে মারতে যায় তখন ক্যামেরায় ক্লোজ শট নিলে এবং এংগেলটা চেঞ্জ করলে মনে হয় আরো বেটার হতো।

পুরো সিনেমার একটা ক্ষমতাবান চরিত্র ছিলো আলী ওসমান। চোখ ধাধানো অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। এক্ষেত্রে রেদওয়ান রনি তার চরিত্র চিত্রায়নে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠার একাধিক দৃশ্যে হাত দিয়ে মুখে বাড়ি দেয়ার কাজগুলো প্রতি দৃশ্যে কন্টিনিউ করতে ভুল করেননি তিনি। বাঘের মত হিংস্রতা, কপটতা, নরম বুলি, চালাকি সবকিছুই চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছের শহীদুজ্জামান সেলিম। তবে এই চরিত্র আগে প্ল্যানমত যদি হুমায়ন ফরিদী থাকতেন তাহলে কন্ঠস্বরটা আরো মানিয়ে যেত। সুমনের বেইমানী ধরা পরে যাবার পর তার কাজকর্ম খুবই ম্যাচিউরড মনে হয়েছে মেকিং এর জন্য। এককথায় গডফাদার হিসেবে চমৎকার অভিনয় করেছেন।

নবনীকে যখন সুমন আটকে নিয়ে যায় তখন গাড়ির ভেতর সানগ্লাস পড়া সুমন যেকোন হলিউডি ফিল্মের দৃশ্যই মনে করিয়ে দেয়। তবে তাদের প্রেমে পড়াটা খুবই দ্রুত মনে হয়েছে। আলী ওসমানের গ্যাং এ ও কিছুটা অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। সেখানে তার পোষা গুন্ডাদের মধ্যে সুমনকেই যা একটু ঠান্ডা মাথার স্মার্ট মনে হয়েছে। বাকীদেরকে আর দশটা মুভির মাথা গরম, চোখট্যারা মাস্তানই মনে হয়েছে। এটলিস্ট সুমন বেইমানী করার পর যাকে আলী ওসমান সুমনের জায়গা দেয় তার একটু স্মার্ট হওয়া উচিত ছিলো। জাস্ট ফর কম্পারিজন। সেই গ্যাং এ এক শর্ট লোক ছিলো যে শেষে একটা টুইস্ট দেয়। চমৎকার ছিলো তার অভিনয়। হাসির খোরাক জুগিয়েছে। আলী ওসমানের চরিত্রের সাথে তার বাড়িটা মানিয়ে গেলেও তার গ্যাং টা মানায় নি। সুমন ঠান্ডা মাথার খুনী হলেও তার মুখে একটু হিংস্রভাব থাকলে আরো ভালো লাগতো। এটলিস্ট ছোটবেলার সুমনের আগ্রাসী ভাবের বিন্দুমাত্রও চোখে পড়েনি।

অপ্রয়োজনীয় সিন তেমন একটা ছিলো না। স্ক্রিপ্টটা বাংলাদেশের ছবির তুলনায় অনেক বেশী পারফেক্ট। যদিও মাঝে মাঝে কিছু শট একটু বেশী সময় ধরে নেয়া উচিত ছিলো তারপর অন্য সিনে যাওয়া যেত।

ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর একদমই আলাদা। সিনেমার সাথে মানিয়েছে। প্রেমে পড়ার পর আকাশ-পাতাল মিলিয়ে কোন রোমান্টিক গান না থাকায় রনিকে আবারো ধন্যবাদ। শেষের দিকে নবনী যখন জেলে যায় সুমনকে আনতে তখনের মিউজিক মনে করিয়ে দেয় কোরিয়ান রোমান্টিক মুভির কথা। খুবই ম্যাচিউরড কাজ হয়েছে সেটা। একদম শেষ দৃশ্যে নবনীর স্বর্গীয় হাসির পর যখন হঠাৎ ডিরেক্টরের নাম আসে তখন চমৎকার একটা আত্বতৃপ্তি পেলাম। পারফেক্ট এন্ডিং।

সবশেষে কেউ যদি চোরাবালিকে হলিউডি, ইরানী ছবির সাথে মেলাতে যান তাহলে বলবো যাবেন না। এটা বাংলাদেশের মুভি। এবং আদর্শ কমার্শিয়াল একটা মুভি। দেশের হলে হলে চলার মত মুভি। প্রথম মুভি হিসেবে রেদওয়ান রনি প্রত্যাশার চাইতে বেশী দিয়েছেন। যেসব ছোটখাট ত্রুটি আছে সেগুলো সময়ের, অভিজ্ঞতার সাথে চলে যাবে। আর গল্পের ব্যাপারে বলবো এখনকার সময়ের জন্য ঠিক আছে। এখনের মেইনস্ট্রীম ঢালিউডি গল্প এমনই, যেটা খুব তাড়াতড়ি বদলাবে।

চমৎকার পরিবর্তন হিসেবে বলা যায় স্ক্রিপ্ট, ক্যামেরাওয়ার্ক, মিউজিক। সবচাইতে বড় কথা ছবিটা একবার দেখার পর আমার পরের শোটাই আবার দেখতে ইচ্ছা করছিলো। হল ভালোনা তাই দেখিনি। বলাকা/ সিনেপ্লেক্সে দেখবো আবার আশা করি। আজ খুবই গর্ব হচ্ছে আমার দেশের চলচিত্র অনেক এগিয়ে যাচ্ছে ভেবে।
সবাইকে রিকুয়েস্ট হলে গিয়ে দেখবেন প্লিজ। সময়, পয়সা দুটোই উশুল হবে।

এগিয়ে যাক বাংলাদেশের সিনেমা । স্যালুট রেদওয়ান রনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:০৭
১৯টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×