আমার ছোটভাই ক্লাশ সিক্সে পড়ে। তাকে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, “অক্সিজেনের সংকেত কি?” সে হা করে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। আমি তখন তাকে বললাম, “ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ার তর্জনী উপরে তুললে আমরা কি বুঝি?” সে বলল “আউট”। আমি বললাম, “তাহলে অক্সিজেনকে বুঝতে...” এইটুক বলার সাথে সাথেই সে বলে ফেলল ক্যাপিটাল ও।
একটু চালাক ব্যক্তিমাত্রই ধরতে পেরেছেন ঘটনাটা কি। আমার মাথায় তখন চিন্তা আসলো। এখানে দোষটা কার? আমার ছোটভাইয়ের দোষ হল সে একটা কঠিন বাংলা শব্দ মনে রাখতে পারেনি। আরো স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে বুঝতে পারেনি। আর দেশের পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষকরা অক্সিজেন এর সাথে ক্যাপিটাল ও এর সম্পর্ক বোঝানোর জন্য একটা কঠিন বাংলা শব্দকে উপকরণ হিসেব নিয়েছেন, যেটার অর্থ বুঝতে গেলে বাংলা ব্যকরণের জ্ঞান আবশ্যকীয়। তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়ালো? একটা বাচ্চাকে কি বিজ্ঞান বুঝতে হলে আগে বাংলা ব্যকরণ শিখে আসতে হবে? কঠিন সব বাংলা শব্দ মুখস্ত করতে হবে? বিজ্ঞানের মত একটা বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করছি আমরা মুখস্ত বিদ্যার উপরে।
স্কুলে কলেজে সংজ্ঞা মুখস্ত করতাম, “ক্ষমতার একক ওয়াট। এক সেকেন্ডে এক জুল কাজ করার সামর্থ্যকে এক ওয়াট বলে।” সংকেত J/s. হা করে তাকিয়ে দুইটার মাঝে সম্পর্ক খুজতাম। পোলাপানকে দেখতাম হরদম মুখস্ত করে ধুমায়া নাম্বার পাচ্ছে বিজ্ঞানে। আমাকেও নাম্বার পেতে হবে। তাই মুখস্ত করতাম। শিক্ষাব্যবস্থাটাই এমন যে এই সংজ্ঞাটা বানান ভুল ছাড়া খাতায় লিখতে পারাটাই বিজ্ঞান শেখা। জুল, নিউটন, ওয়াট, মিটার/ সেকেন্ড, কেজি পার মিটার স্কয়ার এই কঠিন কঠিন টার্মগুলোর মানে কয়টা ছেলেমেয়ে বোঝে সেটা জাজ করার কোন সিস্টেম নেই। কয়টা ছেলে এক জুল শুনলেই কল্পনায় দেখতে পায় যে এক বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের কোন বস্তুর উপর এক কেজির একটা বাটখারা রাখায় জিনিসটা সরে যাচ্ছে? তাতে যে পরিমাণ কাজটা হচ্ছে সেটাকেই এক জুল বলা হয়, সেটা জাজ করার কোন সিস্টেম নেই।
জাজ করা তো পরের ব্যাপার। আমাদের পুরো দেশের লক্ষ্য হচ্ছে, বইয়ের সংজ্ঞাটা যাতে আমরা পরীক্ষার খাতায় বানান ভুল ছাড়া হুবহু লিখে নাম্বার নিয়ে আসতে পারি। এই কাজটা করতে ব্যর্থ হলেই কম নাম্বার, শিক্ষকের ঝাড়ি, বাসা থেকে বের করে দেয়ার মত কাজগুলা করা হয়।
এখানে দোষটা কার? ছোট ছোট বাচ্চাগুলার? নাকি আমাদের পুরা শিক্ষাব্যবস্থাটার? পাঠ্যবইগুলার – যেগুলো দেখলেই ভয় লাগে? নাকি শিক্ষকদের- যারা ক্লাশে ছাত্রছাত্রীদের সাথে বইয়ের যোগসূত্রটা তৈরী করেন মুখস্তের মাধ্যমে? নাকি নীতিনির্ধারকদের – যারা পাঠ্যবইগুলোকে আনন্দময় করার চাইতে ভয়ের বস্তু হিসেবেই রাখতে পছন্দ করেন এবং স্কুলের শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন নি? মোদ্দা কথা একটাই। আমরা একটা অসুস্থ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পড়াশোনা করেছি যেটার টার্গেট পূরণ করতে হলে মুখস্থ ছাড়া গতি নেই।
কিছুদিন আগে চালু হলো সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। টার্গেট ছিলো মুখস্থ নির্ভরশীলতা কমানো, গাইডবই, প্রাইভেট পড়ার উপর নির্ভরশীলতা কমানো। নি:সন্দেহে চমৎকার উদ্যোগ। কিন্তু কাদের জন্য জিনিসটা খাটে? আমরা শহুরে পোলাপান সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড় দেই প্রাইভেটে, এসে যাই স্কুলে, স্কুল থেকে ফিরে আবার প্রাইভেট অথবা বাসায় টিচার। আমাদের মাথায় সংসারের কোন চিন্তা নেই কারণ আমরা পড়াশোনা করি বলে আমাদের সাতখুন মাফ। বোন-দুলাভাই সুইডেন, জার্মানী থেকে হাতঘড়ি পাঠান। কারণ আমরা পড়াশোনা করি। আমাদের হাতে সুযোগ আছে সৃজনশীলতা দেখানোর। কিন্তু একবার ভাবুন তো গ্রামের সেই ছেলেটার কথা। যাকে সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে গরু নিয়ে যেতে হয় ফসলের মাঠে। দেরী করলে বাবার উত্তম মধ্যম। যেতে হয় বাজারে ফসল, মুরগীর ডিম বিক্রি করতে। প্রায় দিনই স্কুলে যাওয়া বাদ দিতে হয়, কারণ ফসলের মাঠে কাজ আছে। বিকালে দৌড়াতে হয় চেয়ারম্যানের কাছে সরকারী গমের জন্য ধরণা দিতে। তার কাছে সুযোগ কোথায় পরীক্ষার খাতায় সৃজনশীলতা দেখানোর? প্রতিদিন দারিদ্রের শেকল ছিড়ে বেরিয়ে আসার জন্য তাকে অনেক সৃজনশীল পথ অবলম্বন করতে হয়। তার কাছে কেউ নেই কোন একটা অংকে আটকে গেলে সাহায্য করার। কোন ইংরেজী শব্দের অর্থ বলে দেবার। তার কাছে একটা মলিন গাইডবই ছাড়া কিছু নেই। অথচ এই ছেলেটির মাথাই হয়তোবা অনেক শার্প। অনেক বড় বড় গুনভাগ হয়তোবা মুহুর্তেই করে দিতে পারে। গলিত অলিম্পিয়াডের গাড়ি তার দরজায় যায়না। তাকে কেউ বিজ্ঞান, গণিত শেখাতে যায়না।
এভাবে আমরা কি মেধা হারাচ্ছি না?
সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেডিক্যালে ভর্তির জন্য আর এডমিশন টেস্ট লাগবে না। কারা কোন লজিকে এই সিদ্ধান্ত নিলেন আমি ঠিক জানিনা। আমি তাদের তুলনায় অতি ক্ষুদ্রজ্ঞানের মানুষ। তবু আমার গায়ে খটকা লেগেছে। তারা কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন জানিনা। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটা সাবজেক্টে স্টুডেন্ট রিকোয়ারমেন্ট আলাদা। প্রকৌশলে পড়তে হলে ম্যাথ, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্সের বেসিক শক্ত হতে হয়। তাই প্রকৌশলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নটাও এমন ভাবে করা হয় যেন কাংখিত ছাত্ররাই চান্স পায়। মেডিক্যালে লাগে বায়োলজি, কেমিস্ট্রি। তাদের প্রশ্নটাও এমনভাবে করা হয় যেন যারা চান্স পায় তাদের বায়োলজি, কেমিস্ট্রির দখল নিয়ে যেন চিন্তা করা না লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হরহামেশাই দেখা যায়, অনেক ছেলেপেলে অনেক কম জিপিএ নিয়ে ভর্তি হয় এডমিশন টেস্টে ভাল করে। তার সাথেই ডাবল গোল্ডেন পাওয়া রংচং এ শহুরে স্টুডেন্টরাও ভর্তি হয় একই ক্লাশে। বছরশেষে দেখা যায় কম জিপিএঅলা গ্রাম্য ছেলেটাই ফাস্টবয় আর রংচং এ ব্যাকগ্রাউন্ডঅলা ছাত্রটা দুই সাবজেক্টে ফেল। সরকার যে সিস্টেমটা চালু করতে যাচ্ছে তাতে এই গ্রাম্য ছেলেটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চান্সই পেত না। এই সিস্টেমে আমরা কি দেশকে একটা অথর্ব শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছিনা?
সেনাবাহিনীতেও তো লোক নেয়ার সময় শারিরীক সামর্থের পরীক্ষা নেয়া হয়। কারণ সেখানে আগের রেজাল্টের চেয়ে সেটাই দরকার বেশী।
আমার মতে আমাদের এখন নজর দেয়া উচিত প্রাইমারী স্কুলের দিকে। বড় দু:খজনক পরিস্থিত সেখানে। জাপানে নাকি বাচ্চারা সকালে বাবা মার আগে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাবার জন্য। স্কুল থেকে বাসায় ফেরে মন খারাপ করে। আর এদেশে সম্পূর্ন উল্টো পরিস্থিতি। একটা বাচ্চা তার চাইতে বেশী ওজনের একটা ব্যাগ কাধে নিয়ে স্কুলে যায় কাদতে কাদতে। বাসায় ফিরে আসলে স্বর্গ হাতে পায়।
আমাদের স্কুলগুলোতে পড়াশোনা মানেই একগাদা সাজেশনওয়াইজ প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় বমি করো। কি শিখলে সেটা দেখার বিষয় না।
বুয়েটের উপর একটু পন্ডিতি এপ্লাই করা হলো। ফলাফল হাতে নাতে দেখা গেলো সেশনজটের মাধ্যমে। আমি যেই ভার্সিটিতে পড়ি সেখানে ভর্তি হবার সময়েই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম দু-এক বছরের সেশনজটের। এই সাড়ে তিন বছরে পলিটিক্যাল কোন বড় ঝামেলা না হওয়াতে আর ক মাস পড়েই আমাদের বিএসসি শেষ। যেখানে বুয়েটে আমারই বন্ধুরা সেশনজটে আমার থেকে এক বছর পিছিয়ে গেছে। কি দরকার এই নোংরা পলিটিক্সগুলা করার?
মাননীয় নেতানেত্রীরা, আমরা তো আপনাদের সন্তানের মতই। একটাই পার্থক্য আপনাদের সন্তানের সাথে, আমাদের লন্ডন, আমেরিকায় পড়াশোনার সামর্থ্য নেই। তাই আপনাদের দয়ায় গরীব মানুষের টাকায় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। তাই বলে এভাবে তো শিক্ষাব্যবস্থাটাকে নিয়ে আপনারা খেলতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আপনাদের নোংরা রাজনীতিটা তুলে নিলে কি এমন সমস্যা হয় আপনাদের? নিত্যনতুন খায়েশ থেকে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের নামে প্রহসনগুলো কি না করলেই নয়?
যেখানে আমরা বাচ্চাদেরই ভালো একটা শিক্ষাব্যবস্থা দিতে পারছিনা, সেখানে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল নিয়ে টানাটানি করাটা বাতুলতা মাত্র। আগে গোড়া শক্ত হোক, তারপর না হয় আগা শক্ত করা যাবে
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১০:২৭