ধর্ম, পুঁজিবাদ আর মার্ক্সবাদের মধ্যে যে বিতর্ক তা আজ সর্বমহলে স্পষ্ট । আধুনিক প্রচারণায় ধর্মকে পুঁজিবাদের সহসঙ্গী হিসেবে তুলে ধরা হয় । অন্যদিকে ধর্মকে মার্ক্সবাদ বিরোধী আদর্শ হিসেবে চিত্রিত করা হয় । আবার মার্ক্সবাদকে নাস্তিক্যবাদের সমার্থক হিসেবে ব্যক্ত করা হয় । বিপরীত প্রচারণাও রয়েছে । যেমন ঃ ধর্ম পুঁজিবাদ ও মার্ক্সবাদ বিরোধী আদর্শ, মার্ক্সবাদ নাস্তিক্যবাদের বিরোধী- ইত্যাদি ।
কোন কোন বামপন্থী ইসলাম ধর্মকে পুঁজিবাদের সমর্থক আদর্শ হিসেবে প্রচার করে । আবার কোন কোন কমিউনিস্ট মত প্রকাশ করে যে ইসলাম কোনভাবেই মার্ক্সবাদ বিরোধী নয়, উল্টোভাবেও বলে- মার্ক্সবাদ কখনোই ইসলাম ধর্মের বিরোধী কোন আদর্শ নয় । এ ধরণের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রচারের মূল কারণ – তাদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা অথবা ভাসাভাসাভাবে ইসলাম অধ্যয়ণ । খুব কম মানুষই আছে যারা গভীরভাবে ইসলামকে বুঝার চেষ্টা করেছে । আর সে কারণেই ইসলামকে পুঁজিবাদের সমর্থক এমনকি মার্ক্সবাদের বিরোধী নয় বলে মতামত ব্যক্ত করা হচ্ছে । যারা বলছে ইসলাম পুঁজিবাদের সমর্থক তারা ইসলাম বুঝতে পারেনি অথবা ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব থেকে বলছে । যারা বলছে ইসলাম মার্ক্সবাদ বিরোধী নয় অথবা মার্ক্সবাদ নাস্তিক্যবাদের সমার্থক নয়- তারা ইসলাম ও মার্ক্সবাদ সম্পর্কে না বুঝেই বলছে, অথবা রাজনীতি করার স্বার্থেই মুসলিম সেন্টিমেন্টক ব্যবহার করছে ।
প্রথমেই মার্ক্সবাদীদের জানতে হবে যে, ইসলাম পুঁজিবাদ বিরোধী আদর্শ । এ বিষয়টি প্রমাণ করতে হলে বুঝতে হবে ইসলাম কি ? এবং পুঁজিবাদ বলতে কি বুঝায় ? ইসলাম আর দশটি ধর্মের মত কোন ধর্ম নয়, ইসলাম হল ‘দ্বীন’ বা জীবন ব্যবস্থা । আংশিক বা খণ্ডিত জীবন ব্যবস্থা নয় , পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা । ইসলাম শুধুমাত্র কতগুলো নীতি নৈতিকতার সমষ্টি নয়, আনুষ্ঠানিক এবাদতের মধ্যেও ইসলাম সীমাবদ্ধ নয় । ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন যা শুধুমাত্র কতগুলো আহকাম বা বিধিনিষেধ পালনের মধ্যে দায়িত্ব শেষ করে না । বরং ইসলাম বিশ্বাসীদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে সামাজিক দায়িত্ববোধ । ইসলাম সন্ন্যাসবাদকে প্রশ্রয় দেয় না । যাবতীয় অনর্থক কর্মকে ইসলাম নিষিদ্ধ করে সামাজিক, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুমিনকে করে দায়িত্ব সচেতন । সূরা ইমরানে কোরআন বলছে- “ তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদের পাঠানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য । তোমরা যাবতীয় সৎকর্ম সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার এর মূলোচ্ছেদ করবে । ’’ (৩ ঃ ১১০)
মানবজাতির কল্যাণে নিয়োজিত হওয়ার জন্য এত স্পষ্ট বক্তব্য কোন ধর্মে এমনকি কোন মতাদর্শে পাওয়া যাবে না । এর মানে ইসলাম মুমিনকে তখনই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয় – যখন সে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অব্যবস্থাপনার সংস্কার সাধনে আত্মনিয়োগ করার মধ্য দিয়ে মানবজাতির কল্যাণকে সুনিশ্চিত করতে পারে । পৃথিবীর যাবতীয় ধর্ম ছাড়াও পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে এর মত বা এর চেয়ে উন্নতমানের কোন বাক্য কেউ দেখাতে পারবে ?
এ আয়াতে স্পষ্ট হয়েছে ইসলাম চূড়ান্তভাবে অন্যায়, অবিচার, লুণ্ঠন , শোষণ, দুর্নীতির শুধু বিরোধিতাই করে না, ইসলাম পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট সকল প্রকার অব্যবস্থাপনার মূলোচ্ছেদ ও ধ্বংস কামনা করে । শুধু কামনা বা আশা পোষণে সীমাবদ্ধ না থেকে ইসলাম মুমিনদের সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয় । কোরআন সে নির্দেশকে তুলে ধরেছে এভাবে- “ তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যাবত ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয় ।” (২ ঃ ১৯৩ )
যে ইসলাম মানুষকে সন্ন্যাসবৃত্তি পরিত্যাগ করে নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত গণ মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুমিনদের দায়িত্বশীল করে তোলে যেখানে গণমানুষের কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই একমাত্র ব্রত, সেখানেই ইসলাম ধর্ম কিছুতেই উল্টানো জগৎ চেতনা তৈরি করতে পারে না । ইসলাম ধর্ম কিছুতেই আফিম হতে পারে না । সামগ্রীক ধর্ম সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের বক্তব্য – “ ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, প্রাণহীন পরিবেশের প্রাণ, এটা হচ্ছে জনগণের আফিম ।” (মার্ক্স, ১৯৭৫)
কার্ল মার্ক্স ইসলাম ধর্মকে আর দশটা ধর্মের সাথে একাকার করে ফেলেছেন । কার্ল মার্ক্স খ্রিষ্টান ধর্মের ব্যবহারিক দিকটার মধ্যে যে কদর্যরূপ লক্ষ্য করেছেন তা বাকিসব ধর্মের বৈশিষ্ট্য মনে করেন । ধর্মের অপব্যবহার আর ধর্মের প্রকৃত রূপ এক অর্থ বহন করে না । ধর্মের অপব্যবহারে ধর্মকে পুঁজিবাদের সমর্থক মনে হতে পারে, কিন্তু তা তো ঐশী ধর্মের প্রকৃত রূপ নয় । বরং তা হোল ধর্মের ইহজাগিতকরণ ।
ঐশী ধর্ম ইসলাম যে পদ্ধতিতে মুমিনদের আহ্বান করছে নির্যাতিত, নিপীড়িত, মজলুমদের পক্ষে দাঁড়াতে , এরকম উদাত্ত আহ্বান কোন মতাদর্শে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়নি । কোরআন বলছে – “ তোমাদের কি হোল যে তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহ্র পথে এবং অসহায় নর নারী এবং শিশুদের জন্য, যারা বলে ‘ হে আমাদের প্রতিপালক এই জনপদ যার অধিবাসী জালিম উহা হতে আমাদিগকে অন্যত্র নিয়ে যাও, তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক কর এবং তোমার নিকট হতে কাউকে ও আমাদের সহায় করো ।’’ (৩ ঃ ৭৫)
যে ইসলাম এই নির্দেশ প্রদান করে যে, মুমিন হবে ঐ সকল মানুষের অভিভাবক ও সহায় যারা অসহায় ও মজলুম হয়ে আছে, যারা জালিমের অত্যাচারে, শোষণ আর জুলুমের শিকার – সেই ইসলাম কি করে পুঁজিবাদের সমর্থক হতে পারে ? সে ইসলাম কি করে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক হয়ে কাজ করতে পারে ? ইসলামের কোন পক্ষশক্তি জালেমের জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়নের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে না । উপরন্তু ইসলাম মুমিনদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানায়- যাতে করে জালেমের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় ।
ইসলাম কি করে পুঁজিবাদের সমর্থক হয় যখন পুঁজিবাদের সকল বৈশিষ্ট্য ইসলাম নাকচ করে দেয় ? পুঁজিবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল –
১। ব্যক্তিগত মালিকানা
২। শ্রমের পণ্যকরণ (Commodification of Labour)
৩। উদ্ধৃত মুনাফা লাভ
৪। উদ্ধৃত মুনাফা বিনিয়োগ
৫। মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতা
৬। সঞ্চয়কৃত পুঁজি বিনিয়োগ
ইসলাম পুঁজিবাদের ব্যবস্থার ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধী এমনকি মার্ক্সবাদী ব্যবস্থার ব্যক্তিগত মালিকনার উচ্ছেদেরও বিরোধী । আল্লাহ্ পাক সূরা বাকারায় মুত্তাকীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেন- “ তাদেরকে যে উপনোপকরণ দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে ।’’ (২ ঃ ৩)
“ তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর । ” (২ ঃ ২৬৭)
এর মানে ব্যক্তি যা উপার্জন করে তার চূড়ান্ত মালিক আল্লাহ্, ব্যক্তি হল সাময়িক শর্তযুক্ত মালিক । ব্যক্তি এক্ষেত্রে সমস্ত সম্পদ বা উপার্জন আত্মভোগেও ব্যয় করতে পারে, আবার আল্লাহ্র নির্দেশে ব্যয়ও করতে পারে । উপার্জন কোন কাজে ব্যয় করবে তা নির্ভর করে তার বিশ্বাসগত দিকের উপর । ব্যক্তি যদি চূড়ান্ত মালিক হিসেবে আল্লাহ্কে মেনে নেয় তখন আত্মভোগে প্রয়োজনীয় ভোগ করবে এবং এক অংশ জনকল্যাণে ব্যয় করবে । যারা জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করে না কোরআন তাদেরকে দ্বীনে অস্বীকারকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে । সূরা মাউনে বলা হয়েছে– “ তুমি কি তাকে দেখেছো , যে দ্বীনকে অস্বীকার করে ? সে তো সেই যে এতিমকে তাড়িয়ে দেয়, অভাবগ্রস্থকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না ।”
ইসলাম দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য কোন কোমল সুরের ব্যবহার করে নি । ইসলাম দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে না আসাকে ভৎসনা করেছে এমনকি দ্বীনে অস্বীকারকারী হিসেবে ঘোষণা করেছে । ইসলাম মুমিনদের এই নির্দেশ প্রদান করে যে, ‘ উপার্জিত সম্পদের মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর । এর মানে অভাবী মানুষের সাহায্য কোন করুণার বিষয় নয় । এ হলো দায়িত্ব, স্পষ্ট সামাজিক দায়িত্ব । এ হলো খোদাপ্রেমিকদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ, যে নির্দেশ বাস্তবায়নে ব্যক্তি নিজেই ব্যক্তিগত ভাবে এমনকি সামিষ্টকভাবে তৎপর হতে পারে ।
মার্ক্সবাদ ব্যক্তিকে এরূপ কোন দায়িত্ব প্রদান করেনি । মার্ক্সবাদ মনে করে ব্যক্তি এরূপ দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা বা যোগ্যতা রাখে না । সে কারণে মার্ক্সবাদে ব্যক্তি মালিকানার চূড়ান্ত উচ্ছেদ এর মাধ্যমে সমস্ত মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে সোপর্দ করা হয় । মার্ক্সবাদ মনে করে, যতদিন ব্যক্তিমালিকানা থাকবে ততদিন পুঁজিবাদ থাকবে । ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ হলেই রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে , তখনই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে । এর মানে ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ না হলে মানুষের অধিকার ফিরে পাওয়ার কোন সম্ভবনা নাই- এমন ধারণায় মার্ক্সবাদ মানুষের অধিকার শুধুমাত্র একটি কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পণ করে । মার্ক্সবাদ মনে করে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত পুঁজিবাদ থাকবে, ইসলাম মনে করে ‘ব্যক্তিগত মালিকানা থাকা অবস্থায় পরিশুদ্ধ বিশ্বাসে একজন মুমিন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সামাজিক দায়িত্বে নিয়োজিত হতে পারে । মার্ক্সের মতে- “ The supersession of private property is therfore the complete emancipation of all human senses and qualities .” (Marx, EPM)
এর মানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ না হলে মানুষের মুক্তি আসবে না । মার্ক্সের এমন ধারণাকে বাতিল করে ইসলাম ঘোষণা করে যে- ঈমান বা পবিত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে মুমিন তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে আমানত মনে করে সেই সম্পত্তিতে অভাবীদের হক পূরণ করতে দায়িত্বশীল থাকে । ইসলাম সাথে সাথে এ দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের উপরও সোপর্দ করে । সূরা নেসায় উল্লেখিত আয়াত অনুসারে সে দায়িত্ব অভিভাবকের উপর বর্তায়, যারা অসহায় নরনারীদের সহায় ।
পুঁজিবাদের অপর বৈশিষ্ট্য হল শ্রমের পন্যকরণ । শিল্প পুঁজিবাদে শ্রমিকের শ্রমকে পণ্যকরণ করার মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া উদ্ধৃত মূল্য লাভ করে । কার্ল মার্ক্স শ্রমের এ ধরণের ব্যবহারকে প্রশ্ন করেন এবং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরীর পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন । ইসলাম এক্ষেত্রে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে শ্রমিকসহ সকল অসহায় নিপীড়িত মানুষের পক্ষে জোরালো ভূমিকা নেয়ার জন্য মুমিনদের দায়িত্ব প্রদান করে । ইসলাম অভাবগ্রস্থদের অভাব পূরণের দায়িত্ব যেমন দিয়ে থাকে, তেমনি তাদের সাথে উন্নত আচরণের নির্দেশ দেয়। সূরা আরাফে আল্লাহ্ বলেন- “ আল্লাহ্ অন্যায় আচরণের নির্দেশ দেন না । ... বল, আমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের । ” (৭ ঃ ২৮,২৯)
অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন- “ আল্লাহ্ ন্যায়পন্থীদের ভালবাসেন । ” (৬০ ঃ ৮)
যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহে ঈমান রাখবে, তারা আল্লাহ্কে ভালবাসবে, সে কারণে তারা হবে দায়িত্বশীল ও ন্যায়পন্থী । ন্যায়পন্থী না হলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় অর্পিত হলেও শ্রমিক তার অধিকার পেতে পারে না । ন্যায়পন্থী হলে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ছাড়াও শ্রমিক পেতে পারে উন্নত আচরণ ও তার অধিকার । যারা মানুষের অধিকার দেয় না , তাদের ভৎসনা করে কোরআন বলছে- “ আল্লাহ্ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন । যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তারা তাদের অধীনস্ত দাস দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ হতে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা এ বিষয়ে সমান হয়ে যায় । তবে কি উহারা আল্লাহ্র অনুগ্রহ অস্বীকার করে ? ” (১৬ ঃ ৭১)
এ আয়াতে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম অধীনস্তদের বঞ্চিত করাকে কিছুতেই সমর্থন করে না । এর মানে শ্রমিকদের স্বল্প মজুরী দিয়ে উদ্ধৃত মুনাফা অর্জন করা ইসলাম সম্মত নয় । ইসলাম আরো অগ্রসর হয়ে বলছে – “ তাদের ধন সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের হক । ” (৫১ ঃ ১৯)
ইসলাম এভাবে ধনী সম্প্রদায়কে অভাবীদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শুধু নির্দেশ দেয় না, বাধ্যতামূলক করে । সুতরাং শ্রমিক বা অভাবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন করে নতুন মতাদর্শের প্রয়োজন পড়ে না । ইসলাম এমন এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন – যে দ্বীন শোষিত, বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের সমস্ত দিক নির্দেশনা ও বিধান জারি করেছে । সুতরাং ইসলাম শুধু পুঁজিবাদের বিরোধিতাই করছে না, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য ইসলাম মুমিনদের লড়াই করতে আহ্বান জানায়, যাতে করে ধনীদের কাছে অভাবীদের যে হক বা অধিকার রয়েছে তা আদায় করে কল্যাণকামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায় । সে জন্যে মার্ক্সবাদ বা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়াই ইসলাম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট ।
পুঁজিবাদে শ্রম শোষণ যেমন সমর্থিত তেমনি শোষিত উদ্ধৃত মূল্য বিনিয়োগ করে পুঁজির আকার বড় করতে প্রচেষ্টা চালায় । ইসলামে শ্রম শোষণ শুধু নিষিদ্ধই নয়, ন্যায় বিচারের মধ্য দিয়ে অভাবী বঞ্চিতদের জন্য সম্পদ বণ্টনের দায়িত্ব প্রদান করে । এ কারণে ইসলাম যাকাত ব্যবস্থাকে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ জারি করেছে, যাতে করে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান কমে যায় । নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন অসমতা হ্রাসের উপায় হিসেবে উল্লেখ করেন যে,ধনীর সম্পদের এক অংশ যদি দরিদ্র মানুষের মধ্যে বণ্টন করা যায়,তবে অসমতা হ্রাস পাবে । ইসলাম বহু আগেই অসমতা হ্রাসের এ বিধানকে যাকাত নামে কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে । পুঁজিবাদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা । পুঁজিবাদীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় পুঁজি গঠনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় । পুঁজি গঠনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে তারা সঞ্চয় প্রকল্প গ্রহণ করে । অতি বেশি সঞ্চয়মুখী হয় অধিক মাত্রায় বিনিয়োগের জন্য । এ অবস্থায় কৃপণতা তাদের স্বভাবে পরিণত হয় । কৃপণতার কারণে স্বাভাবিক ব্যয়, আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব, অভাবীদের প্রতি ও বঞ্চিতদের প্রতি যে স্বাভাবিক দায়িত্ববোধ- তা হারিয়ে পুঁজিপতিরা নিরন্তর চালিয়ে যায় মুনাফা লাভের অবিশ্রান্ত প্রতিযোগিতা । কোরআন সে প্রতিযোগিতাকে এভাবে তুলে ধরে
“ প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও,... তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই । ” (সূরা, তাকাছুর)
এভাবেই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়ে পুঁজিপতিরা যে সঞ্চয়ের সংস্কৃতি চালু রাখে তার ব্যাপারে কোরআনের বক্তব্য হল – “ দুর্ভোগ প্রত্যেকের ... যে অর্থ জমায় ও উহা বারবার গণনা করে । সে ধারণা করে অর্থ তাকে অমর করে রাখবে । ... সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় । ” (সূরা হুতামা)
উপর্যুক্ত আয়াতে বুঝা যায় ইসলাম বহু আগেই পুঁজিবাদ এর বিরোধিতা করে এসেছে । যখন কোরআন নাজিল হয়েছে তখন সমাজে বিকশিত পুঁজিবাদ না থাকলেও পুঁজিবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোর বিরোধিতা করা হয়েছে কোরআনে । কেননা ইসলাম নীতিগত ও আদর্শিকভাবে সেকুলারিজমের বিরোধী । ‘পুঁজিবাদ’ সেকুলারিজম থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয় । বরং সেকুলারিজমের বিকাশের সাথে সাথে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে । সেকুলারিজম হল ইহজাগতিকতা । ‘পুঁজিবাদ’ ইহজাগতিকতার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত । পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যই হল এই জগতেই ব্যক্তিগত পুঁজির পাহাড় বানাতে হবে, এ জগৎ হল সুখ সমৃদ্ধির সমস্ত আধার । সে কারণে পুঁজিবাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই । কেননা ইসলাম মনে করে মানুষের জন্য সবচেয়ে উত্তম স্থান হল পরকাল । পরকাল হল সুখ সমৃদ্ধির কেন্দ্র । ইসলাম পার্থিব জীবনকে ভোগ বিলাস বা সুখ-সমৃদ্ধির কেন্দ্র মনে করে না- যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মনে করা হয় । ইসলামে পার্থিব জীবন হল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জীবন, এ জীবন নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য নয় । এ জীবন হল মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োজিত থাকার জন্য । এ কারণে কোরআন বিভিন্নভাবে পার্থিব জীবনের ভোগ বিলাস ও প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থেকে সৎকর্মের প্রতিযোগিতায় আত্মনিয়োগের কথা ব্যক্ত করেছে । ইসলাম পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যত বেশি মাত্রায় অবস্থান নিতে সক্ষম, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ততখানি সক্ষম নয় । কেননা সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানার কারণে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এর বিকাশ হওয়ার সুযোগ রয়েছে । ইসলামে সে রকম কোন সুযোগ নেই , কেননা ইসলাম ন্যায়বিচারকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে এবং তার চূড়ান্ত পুরস্কার অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবে পরকালকে ঘোষণা করেছে । সমাজতন্ত্রে এ ধরণের কোন সুযোগ নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:০১