৫ মে দিবাগত গভীর রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে আত্মীয়-স্বজনরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিখোঁজদের বাসা-বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে এখন মাতম চলছে। পুলিশ ও একটি প্রভাবশালী দলের পেটুয়া বাহিনী’র নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ে নিখোঁজদের অনেক আত্মীয়-স্বজন মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। ময়মনসিংহ সদর মাসকান্দাস্থ মিফতাহুল উলুম মাদ্রাসার দাওরা বিভাগের নিখোঁজ ছাত্র হাফেজ সিরাজুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ থানার তুলনধনের আত্মীয়-স্বজনের মাঝে মাতম চলছে। শাপলা চত্বরের সমাবেশে অংশ নেয়া নিখোঁজ হাফেজ সিরাজুল ইসলামের বড় ভাই নুরুল ইসলাম ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বহু খোঁজখুঁজি করেও নিখোঁজ হাফেজ সিরাজুল ইসলামের সন্ধান পায়নি। নিখোঁজ হাফেজ সিরাজুল ইসলাম ময়মনসিংহ সদরের মাশকান্দা নয়া পাড়া খালপাড়স্থ বড় ভাই নূরুল ইসলামের বাসায় থাকত। হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের সাথে সে ঢাকা অবরোধে অংশ নিয়ে শাপলা চত্বরের সমাবেশে গিয়েছিল। ময়মনসিংহ সদরের একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক মুফতী মুহিববুল্লাহ ইনকিলাবকে গতকাল জানান, ৫ মে দিবাগত গভীর রাতে মতিঝিলের সমাবেশে গুলিতে শাহাদাত বরণকারী ফুলপুর থানার সুতিয়াপাড়া বউলা গ্রামের সিদ্দিুকুর রহমান মাস্টারের ছেলে হাফেজ আতাউর রহমানের লাশ তার সাথীরা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে গ্রামের বাড়িতে নিয়া আসে। নিহত আতাউর রহমানের লাশ ৬ মে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তিনি জানান, হেফাজতের সমাবেশে নিহত ভালুকা থানার তালাব গ্রামের শাহ নেওয়াজের ছেলে মাওলানা আব্দুল ওহাবের লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এসব নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে এখনো মাতম চলছে। হেফাজতের সমাবেশে নিখোঁজ ময়মনসিংহ সদরের জামিয়া মোহাম্মদীয়া নূরিয়া মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ জোনাইদ হাসান ওরফে ইনসান (১৮) কে এখনো পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ হাফেজ জোনাইদের পিতা হাবিবুর রহমান ছেলের সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হেফাজতের মহাসমাবেশে অংশ নেয়া বগুরার আদমদিঘি থানার কাতলা গ্রামের মরহুম মইজদ্দিন ফকিরের ছেলে কৃষক সেকান্দার আলী ফকির (৪০) স্থানীয় ৬-৭ জন হেফাজতের কর্মীর সাথে ৫ মে মতিঝিল সমাবেশে অংশ নেয়। এক ছেলে এক মেয়ের জনক সেকান্দার আলী ফকিরের স্ত্রী স্বামীর সন্ধান না পেয়ে রাতদিন কান্না কাটি করে বার বার মুর্ছা যায়। সেকান্দার আলী ফকিরের বড় ভাই আজহার আলী ফকির গতকাল নিখোঁজ ভাই সেকান্দার আলী’র সন্ধানে কামরাঙ্গীর চর মাদ্রাসায় গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৫ মে হেফাজতের মতিঝিলের সমাবেশ থেকে নিখোঁজ ফেনী সদরের পশ্চিম বিজয় সিংহ গ্রামের মকসুদুর রহমানের ছেলে মসজিদের ইমাম মাওলানা হাফেজ মাইনুল ইসলাম (২৭) কে এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি মাইজবাড়িয়া এলাকার একটি মসজিদে ইমাম ছিলেন। ৫ মে সমাবেশে পৌঁছে তিনি মসজিদ কমিটি’র কাছে ফোনে কথা বলেছিলেন বলে মাইনুল ইসলামের ভগ্নিপতি রিয়াদ জানান। তার স্ত্রী বিবি জহুরা, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে চাঁদপুর থেকে জেলা প্রতিনিধি জানান,
চাঁদপুরে হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলিতে তাদের দু’সদস্য শাহাদাত বরণ করেছেন। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয় ১৮ জন। আহত হয় কমপক্ষে ৫০ জন কর্মী। গুলিবিদ্ধ ১৮ কর্মী ঢাকা ও চাঁদপুরের বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে। শাতাদাত বরণকারীরা হলেন, কচুয়ার দায়চর গ্রামের সেন বাড়ির আনু মুন্সির ছেলে হাবিব উল্লাহ মুন্সি ও চাঁদপুর সদর উপজেলার সকদি গ্রামের বাবুল খানের ছেলে মাহফুজ খান (২৮) ।
এছাড়া কচুয়া উজানী মাদ্রাসার ছাত্র সোহেল মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তা’ অস্বীকার করেছে। অপরদিকে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক হেফাজতের সমাবেশে অংশ নেয়া শিক্ষকদের বেতন কর্তনসহ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
চাঁদপুর জেলা হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাও. আন্ওয়ারুল করীম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাও. জুনায়েদ হাসান মুখতার জানান, শাতাদাত বরণকারী দু’জনের মৃতদেহ এনে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রশাসন ও রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেকেই আহত-নিহতের খবর গোপন রাখছেন।
গত ১২ মে রোববার জেলা মাসিক আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সমন্বয় সভায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. ইসমাইল হোসেন বলেছেন, ‘সরকারের টাকায় খেয়ে-পড়ে সরকার বিরোধী হেফাজতের সমাবেশে অংশ নিয়ে ঢাকায় ভাঙচুর এবং সরকারের সম্পদ ধ্বংসকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তিনি আরো বলেন, গত ৫ মে হেফাজত ইসলামের সমাবেশের দিন চাঁদপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১শ’ ২৮ জন শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে স্কুল ও মাদ্রাসার ৭০ জন শিক্ষক ছুটি না নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকে হেফাজতের সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে জেলা প্রশাসক এসব শিক্ষকদের ১ দিনের বেতন কর্তন করে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের নির্দেশ দেন ।
এদিকে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে নিখোঁজ হয় চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার উজানী মাদ্রাসার ছাত্র সোহেল। প্রায় সপ্তাহখানেক তার ব্যবহৃত মোবাইল বন্ধ ছিল। সোহেল ওই ঘটনার পর থেকে মাদ্রাসায় অনুপস্থিত ছিল। জেলা হেফাজত কর্মকর্তারা সোহেলকে নিহত বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে জানান।
১১ মে উজানী মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা আ. রহমান স্থানীয় দু’সংবাদ কর্মীকে ডেকে নিয়ে জানায় পত্রিকায় প্রকাশিত সোহেল বেঁচে আছে। সে মাদ্রাসায় ক্লাসও করছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উজানী মাদ্রাসায় সোহেল নামে ৫ জন অধ্যয়নরত। শিক্ষা সচিব যাকে সংবাদকর্মীদের কাছে উপস্থাপন করেন মাদ্রাসার হাজিরা খাতায় তার নাম ‘সোহাইল’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রশাসনিক চাপের মুখে মাদ্রাসাটি সোহেলের মৃত্যু নিয়ে রহস্যজনক আচরণ করছে। এমনকি কচুয়ার দায়চর গ্রামের নিহত হাবিবুল্লাহ মুন্সীর বাড়িতে শাসকদলীয় নেতা-কর্মী ও প্রশাসনের পক্ষ থেকেও হুমকি-ধমকি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে এমন তথ্য যাতে ফাঁস না হয় সে ব্যাপারে তাদের কঠোর নীরবতা পালন করতে বলা হয়েছে।