দমকা হাওয়ায় প্রকৃতি উন্মাতাল। শোঁ শোঁ আওয়াজে খ্যাপা হুংকার দিচ্ছে। ঘুটঘুটে জমানো অন্ধকারে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমক ঝড়ের নগ্নতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে, তা যেন অন্ধকারের চেয়েও ভয়ংকর। পাশের বাড়ির সীমানা বরাবর গজিয়ে ওঠা ইউকেলিপটাস গাছগুলো বড় চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, ডাল ভেংগে পরলে ঘরের চাল টিকবে তো? হঠাৎ শান্তর চোখে পরল মা শীতে কাঁপছে। বেড়ায় বেশ কিছু ছিদ্র দিয়ে হনহনিয়ে বাতাস আসছে, কই এগুলো তো আগে দেখেনি! টিনের চালেও চোখ বুলিয়ে নিল, সেখানেও একই অবস্থা। বাউন্ডুলে কে চিৎকার করে ডাকল শান্ত, হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, "এগুলি নিশ্চই তোর কাজ? তোর কি কোন আক্কেল নাই? সারাদিন কি করিস? এত উল্টাপাল্টা করিস, বাসার মধ্যে এইগুলা কি করছিস দেখ".....এক নিঃশাসে চরম বিরক্তির সাথে ঝাড়ল শান্ত। "দেখ ভাইয়া, অনেক উল্টাপাল্টা বকলি এতক্ষন, এসবের আমি কিছুই জানিনা, তাছাড়া এত ভাব না নিয়ে কি করা যায় বল, আমি দেখলে এতক্ষনে ঠিকই করে ফেলতাম"- কথা গুলি সহজে হজম হয়না বাউন্ডুলের। দুজনে মিলে লেগে গেল আপাতত গেটিস দিয়ে জোড়াতালি লাগাবার, রাতটা কোনরকম পার করা আর কি।
মা মুচকি হাসে। মলিন শরীর, সেখানে হাজারো রোগের বাসা, তারপরও ক্লান্ত নয়। মুখে তার একরাশ স্নিগ্ধতা, তাকালে এখনও অদ্ভুত আবেগে মনটা ভরে যায়। তার অকৃত্তিম দরদ নদীর পানির মত ক্রমশই বহমান। বুক ভরা ভালবাসায় হৃদয় নিংড়ানো উদারতা।
এই তো যেমন আজ। শান্তটা আজ মওকা পেয়ে বেশ একচোট নিয়ে নিল বাউন্ডুলের উপর। এমনিতে তো কথায় পেরেই ওঠেনা। বাউন্ডুলেটাও এক নম্বরের হতচ্ছারা, কোন রাখ ঢাক নাই, মুখের উপর যা তা বলে দেয়। দুশ্চিন্তা হয় মাঝে মাঝে। মায়ের এইসব ভাবনা শেষ হয়না, দেখে ঝড়ের তীব্রতা কমে গেছে অনেক। একটু একটু করে বৃষ্টি পরা শুরু হয়েছে। বাইরে ব্যস্ততা আর কোলাহলের শব্দ কানে আসছে। মানুষ তার ঘরবাড়ি ঠিকঠাক করে নিচ্ছে, সাধের গরু ছাগল গুলিকে নিরাপদে নিচ্ছে বাকি রাতের জন্য। জানিনা এই ঘরের কি অবস্থা হবে, গতবারও ছেলেগুলি কোথা থেকে ধার দেনা করে সব ঠিকঠাক করলো। আর ভাল লাগেনা।
দরজায় ধাক্কা শুনে এগিয়ে গেল শান্ত, রাজা এসেছে ছাতা হাতে। ভাইয়ের হাতে ছাতা দেখে কিছুটা অবাকই হয়, এই দুপুরেও ছিল প্রকট রোদ, বৃষ্টির কথা কি আগেই জানত নাকি? ভাবে রাজাভাইয়ের আসলেই অনেক বুদ্ধি, সব কিছুর জন্যই আগাম প্রস্তুতি নেয়া থাকে। বিস্ময়কে তাড়াতাড়ি গিলে ফেলে শান্ত, আবার না জানি বুঝে ফেলে। বলে, "বাইরের তো অবস্থা ভাল না, কোথায় ছিলেন রাজা ভাই?"
"ঘরে রান্না বান্না হইছে কিছু? ক্ষুধা লাগছে অনেক।" এড়িয়ে যেয়ে রাজার উত্তর।
তে তে উঠে বাউন্ডুলে, "ঘরে ঢুকেই আগে খাই খাই, কোথায় কি পাওয়া যায় সেইদিকে নজর না?"
"তুই এত চিল্লাস কেন, জানিস কোথায় ছিলাম? মসজিদে, আল্লাহ বিল্লাহ তো কিছু করিসনা।"-রাজা
মসজিদের কথা শুনে শান্তর মনটা নরম হয়ে যায়, তারও মনে পরে এশার নামাজটা পড়া হয়নাই। কিন্তু বাউন্ডুলে আরও এক ধাপ উপরে উঠে বলে, "আল্লাহ বিল্লাহ করতে গেছিলেন নাকি ঝড় দেখে পাকা ঘরে লুকাইয়া আছিলেন, আল্লাহর উপর দিয়া আর কতদিন?"
-"তুই কি বলতে চাস ছোটলোক, নামাজ রোজার বালাই নাই, ধর্ম কর্মের কিছু বুঝিস? সারাদিন তো আজাইরা কাজ করে বেড়াস।"
আরও কিছু বলতে থাকে রাজা, শান্ত থামিয়ে বলে "আসলে ঝড়ের মধ্যে ঘর ঠিকঠাক করতে অনেক কষ্ট হইছে, তাই মেজাজ করছে। কিন্তু আপনি এর মধ্যে ধর্ম টেনে আনছেন কেন?" কিছুটা বিরক্ত শান্ত।
-"ও, তুইও আজ ওর সাথে গলা মিলানো শুরু করলি! তোকে তো ভালই জানতাম, মনে রাখবি শুধু নামাজ রোজা করলেই সাচ্চা মুসলমান হওয়া যায়না। ঐ বেয়াদবটার সাথে চলে ঈমানের বারোটা বাজাসনে শান্ত, এশার নামাজ পড়ছিস?"
শান্ত দ্বিধায় পরে যায়, মেনেও নিতে পারেনা আবার ধর্মের ব্যাপারে প্রতিবাদও করতে পারেনা। বাউন্ডুলেকেই বলে,
"তুই এরকম গায়ে পরে তর্ক করতে যাস কেন? ভালভাবে কথা বলতে পারিসনা?"
বাউন্ডুলে থামেনা, তার রাগের মাত্রা মানেনা সম্পর্ক, মানেনা ধর্ম, নিজের ঘরটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় সত্যি,
"আপনি খুব বড়লোক হয়ে গেছেন না? ঘরের খাবেন আর মসজিদে যেয়ে ঘর ভাঙ্গার ঘটলা পাকাবেন যেন আপনার কথায় উঠবোস করি? আমাদের ঘরে যখন কিছু জানোয়ার আগুন লাগিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলছিল, আমাদের মায়ের আর্তচিৎকারে যখন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, তখন তাদের দালালি করে আপনি আজ বড়লোকি দেখান? আমি হয়ত ছোটলোক, আপনার মত বেজন্মা ন্ই, আমি কিচ্ছু ভুলিনাই, আপনার লজ্জাও করেনা এই ঘরে থাকতে, এই ঘরে খাইতে? বড় বড় কথা বলবেন তো আজই শেষ করে ফেলব"......শান্ত ধরে থাকে উন্মত্ত বাউন্ডুলে কে।
রাজার মধ্যেকার বুনো হিংস্রতা যেন কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে উঠছে। কিছু একটা বলবে, সমর্থনের আশায় শান্তর চোখে তাকায়, কিন্ত ওর দৃষ্টি আর শান্ত নেই, সেই একই কথার প্রতিধ্বনি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে ওর জ্বলন্ত চোখ থেকে। একগাদা অবজ্ঞা আর ঘৃনা ভরে রাজা বলে,
"আমাকে চিনলিনা তোরা, তোদের আমি উচিৎ শিক্ষা দেব।"
এই বলে নিজের খাবারের ভাগ টুকুর সন্ধানে যায় রাজা। ক্রোধে উন্মত্ত বাউন্ডুলে যেতে চায় সব হিসাব নিকেষ চুকিয়ে দিতে, শান্ত হাত ধরে ফেলে, বলে
"এভাবে রাতের আঁধারে না, ওর হিসাব দিনের আলোয় সবার সামনে চুকানো হবে, যাতে করে ঘৃনার বাষ্পে ওর শরীরে ফোস্কা পরে, ওর ইতিহাস যেন হয় একটা অপরাধীর ইতিহাস, বেঈমানের ইতিহাস।" শান্তর কথায় থামে বটে, কিন্তু এভাবে কতদিন জানেনা বাউন্ডুলে।
সব কথাই শুনছিল মা। তারই ছেলে তার ঘরকে শতছিদ্রে ভরে রেখে যায় চুপি চুপি, ঝড়ে যেন পড়ে যায়, এটা সে কাউকে বলতে পারেনা। লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। চোখ গুলো চাপা কষ্টে ভিজে আসে। মনে পরে যায় তার দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাসের সেই অসহ্য সময়ের কথা, শত বিপদে পরম যত্নে আগলে রাখার আকুতি, তীব্র প্রসব বেদনার মাঝেও নতুন আলোয় নতুন মুখ দেখার পবিত্র আকাংখা। অশ্রু ঝরতেই থাকে, মনের মাঝে জমে ওঠে কালো মেঘ। হঠাৎ ঘরে ঢোকে শান্ত আর বাউন্ডুলে। কতক্ষন হয়ে গেছে বোঝা যায়না। বৃষ্টি টা থেমে গেছে। নিজেরাই আলো জ্বালায় ওরা। দুজনে মিলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরা অনাহুত পানি সরাতে থাকে। ঘরটা দেখে নিতে থাকে আবার। মা শোনে, ওরা বলছে ঘরটা মজবুত করবে এবার, কোন ছিদ্র রাখবেনা, এই ঘরেই যে ওদের মা থাকে! ওদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে মা, ওদের চোখের তেজী আলোয় জমানো কালো মেঘটা সরে যায়। রাতটা বোধ হয় আর বেশী নেই। অন্ধকারটাও কেটে যাবে তাড়াতাড়ি। মায়ের মন বলে ওঠে, তোরা ভাল থাক বাবা।
---এটা একটা অতিব সাধারণ গল্পমাত্র। বাস্তব জীবনের কোন ঘটনা বা চরিত্রের সাথে যদি কেউ কোন মিল পেয়ে থাকে, তবেই গল্প সার্থক!!!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১:৩০