দিনার খুব একা একা লাগছে, এতো বড় হোস্টেলে তারা মাত্র ৪০ জন ছাত্রী। গন্ডোগোল শুরু হবার সাথে সাথে সবাই যে যার বাড়ী চলে গেছে। দিনা যেতে পারে নাই। অনেক দিন তার বাড়ীর সাথে কোনো যোগাযোগ নাই। যেহেতু তার ছোটো ভাই মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিয়েছে, রাজাকারদের ভয়ে তার বাড়ীর সবাই এখন পলাতক। সারাদিন তার খুব অস্হির অস্হির লাগে...রাত বারলে অস্হিরতাটা মাথা ব্যাথায় রূপ নেয়। সময় কাটানোর জন্য দিনা চিঠি লিখতে বসেছে। বোটানির ইমনকে তার খুব ভালো লাগে। প্রথম থেকেই তারা বন্ধুর চাইতে অনেকটাই বেশী। ইমনের আগামীকাল জন্মদিন। সে সন্মোধন ছারাই চিঠি লিখতে বসে, পরে ভেবে চিন্তে সন্মোধন লিখবে। ইমনকে লিখা এটাই তার প্রথম চিঠি।
কেমন আছো? ভালো থাকার কথা না, আসলে আমরা কেউই ভালো নেই। তুমিতো তাও বাসায় আছো, আমার কথা চিন্তা করো, কতোদিন বাসায় যাই না, কে কেমন আছে কিছুই জানিনা। আগে কাঁদতাম, এখন কাঁদাও ছেড়ে দিয়েছি। সময় কাটানোটাই এখন খুব কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের হলআপা তাও আমাদেরকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি জানি তিনি নিজেও শান্তিতে নেই। তার চেখের নীচে ২ ইন্চী কালি জমেছে।
তোমার জন্মদিনে নিজ হাতে কেক বানিয়ে খাওয়াবো, এটা আমার অনেক দিনের শখ। ফাতেমার কাছ থেকে কেক বানানোও শিখেছি। কিন্তু দেশটার কি হলো, ফারুক ভাইকে নীলক্ষেতে পাঠালাম ডিম আনার জন্য, কিন্তু কোথাও নাকি ডিম পাওয়া যাচ্ছে না। ২/১টা দোকানে পাওয়া গেলেও অনেক দাম, এদিকে আমার হাত প্রায় খালি। তবে ওটা নিয়ে টেনশন করি না, কারন টেনশন করলেই তো কেউ আমাকে এসে টাকা দেবে না। দেশটা যে কবে স্বাধীন হবে? তোমার সাথে রিক্সাকরে ঘুড়ে বেড়াবো....কিছুই ভালো লাগে না।
আচ্ছা, সবাই তো যুদ্ধে যাচ্ছে, তুমি কেনো যাচ্ছো না? তুমি কি আমাকে আসলেও ভালোবাসো? তাহলে আমার জন্য দেশটাকে কেনো স্বাধীন করছো না?
এতটুকু লিখতেই ফারুক ভাই এসে খবর দিলো যে হল আপা ডাকছে। নিশ্চই হল আপার একা একা ভালো লাগছেনা। আপা প্রায়ই দিনাকে তার রুমে ডেকে গল্প করেন, স্বাধীনবাংলা বেতার শুনেন। দিনা ঘড়ির দিকে তাকালো, কিছুক্ষনের মধ্যে চরম পত্র অনুস্ঠানটি শুরু হবে। দিনা চিঠি লিখা বাদ দিয়ে আপার রুমের আসলো। কারেন্ট না থাকায় ব্যাটারী দিয়ে রেডিও শুনতে হবে, ওদিকে সব ব্যাটারী ডাউন হয়ে গেছে। আপা স্টোভচুলায় তাওয়ার উপরে ব্যাটারী গরম করার চেস্টা করছেন। এমন সময় একটা আর্মী জিপ এসে হলের গেইটে দাড়ঁলো। মেজর আসলাম আর পাঁচ জন সঙ্গী নিয়ে হলে প্রবেশ করলেন। অন্যদের বাইরে দাঁড় করিয়ে মেজর সাহেব হল আপার রুমে ঢুকলেন। খুব ভদ্রভাবে ইংরেজীতে তার পরিচয় দিলেন। তাকে চা খাওয়ানো হলো। তিনি চলে যাওয়ার আগে আপা কে বললেন, আমাকে হোস্টেল থেকে কিছু মেয়ে সাপলাই দিতে হবে তেজগাঁও কেন্টনম্যান্টে। যারা ভালো নাচ গান করতে পারে তাদের একটা লিস্ট বানিয়ে রাখবেন........ও, আর এই মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, ওকে আমি আজ নিয়ে যাবো। কথা শোনার সাথে সাথে দিনার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। আপা মেজর সাহেবার হাতে পায়ে ধরেও দিনাকে রক্ষা করতে পারলেন না।
দিনা একটা রুমে একাকী বসে আছে। চারিদিকে অসম্ভব নিরবতা,কেবল দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ। দিনা কোনো কিছুই চিন্তা করতে পারছেনা। যদি তারা তাকে মেরে ফেলতো, তাহলেও যেনো ভালো ছিলো। টেবিলের উপরে ঢাকনা দেওয়া খাওয়া, দিনার প্রচন্ড খুদা পেয়েছে....কিন্তু খাবার কথা চিন্তাই করতে পারছেনা। রাত ১০:৩০টা দিকে মেজর সাহেব রুমে এলেন। তার মুখ থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বের হচ্ছে। কোথা থেকে যেনো দিনার মনে অনেক সাহস জোগার গলো। সে খুব স্পস্ট ভাবে মেজরকে বললো, আপনি যা চান আমি তাই করবো, শুধু দয়া করে আমাকে সকালে ছেরে দিবেন, কাল ইমনের জন্মদিন, আমি তাকে খুব ভালোবাসি.....তার সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে।
৮ অক্টবর, সকাল ৯ টা, দিনা চোখ খুলে দেখে মোহসিন হলের মাঠের এক কোনে সে পড়ে আছে। গায়ে যতটুকু কাপড় আছে, তা লজ্জা নিবারনের জন্য যথেস্ট নয়। সে অনেক কস্টে শরীর টাকে টেনে হিচরে হলের গেইটে নিয়ে গেলো। শুনতে পেলো আগের দিন রাতে হলে কেয়ামত হয়েছে, হলে কেউ নেই........
ইমনদের বাসা ধানমন্ডি ৪ নাম্বার। বুড়ো এক রিক্সাওয়ালাকে দিনা অনুরোধ করলো তাকে নিয়ে ধানমন্ডি যেতে। রিক্সাওয়ালার খুব মায়া হলো। সে তার পরনের সার্ট খুলে দিনাকে পরতে দিলো..... রিক্সা নিয়ে উড়ে চলতে লাগলো, দিনা কাঁদছে......দিনা কোনোদিন এতো কাঁদেনি....এক সময় সে ইমনদের বাসায় এসে পৌছলো। মেইন গেইটে মস্তবড় তালা ঝুলছে.......দিনা ভাবছে, এখন সে কোথা যাবে?
=============================================
পাদটীকা
যুদ্ধের সময় এরকম কতো ঘটনা যে ঘটেছে, আমরা কতোটুকু অনুভব করতে পারি, আদৌ কি অনুভব করতে পারি কিছু? উপরের গল্পটা আমি লিখার চেস্টা করেছি সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করে। ইন্টারনেট ঘেটে খবরটা পেয়েছিলাম। সেখানে যা লিখা ছিলো তা হুবুহু কপি পেস্ট করলাম।
“ …..Some army officer raided the Rokeya Hall, the girls’ hostel of Dacca University, on October 7, 1971. Accompanied by five soldiers, Major Aslam had first visited the hostel on October 3, and asked the lady superintendent to supply some girls who could sing and dance at a function to be held in Tejgaon Cantonment. The superintendent told him that most of the girls had left the hostel after the disturbances and only 40 students were residing but as a superintendent of a girls’ hostel she should not allow them to go to the cantonment for this purpose. Dissatisfied, Major Aslam went away. Soon after the superintendent informed a higher army officer in the cantonment, over the telephone, of the Major’ s mission.
However, on October 7, at about 8 p.m. Major Aslam and his men raided the hostel. The soldiers broke open the doors, dragged the girls out and stripped them before raping and torturing them in front of the helpless superintendent. The entire thing was done so, openly, without any provocation, that even the Karachi-based newspaper, Dawn, had to publish the story, violating censorship by the military authorities. In seven days after liberation about 300 girls were recovered from different places around Dacca where they had been taken away and kept confined by the Pakistani army men. On December 26, altogether 55 emaciated and half-dead girls on the verge of mental derangement were recovered by the Red Cross with the help of the Mukti Bahini and the allied forces from various hideouts of the Pakistani army in Narayanganj, Dacca Cantonment and other small towns on the periphery of Dacca city.
সুত্র: http://www.genocidebangladesh.org
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:১১