বসন্তের এইসব দিনগুলোতে কখনো খুব বাতাস বয়।
এইসব দিনগুলো স্বপ্ন ভুলিয়ে দেয়। ঘুম থেকে জেগে উঠে ভাবতে থাকি স্বপ্নটা কি ছিল।
এইসব দিনগুলোতে কিছু ভুল মাখা থাকে।
অজস্র লাইলাক, অ্যাযালিয়া আর প্যানসি ফোটে এইসব দিনগুলোতে। তবে এইসব সাতরঙা ফুলগুলো দূর থেকে দেখতেই ভাল লাগে।
এইসব দিনগুলোতে সাইফের সাথে আবার আমার দেখা হয়ে যায়।
২০০৬ থেকে ২০১৪। আট বছর হল। সকালে বারান্দায় রেলিংয়ের উপর বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম। কখনো ভাবিনি সাইফের সাথে আবার দেখা হতে পারে। তবে পৃথিবীটা ভীষণ ছোট। এবং গোল। ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে আবার দেখা হয়ে যায় প্রায় সবার সাথেই।
জানতাম সাইফ ন্যুইয়র্কে আছে, তবে যোগাযোগ ছিল না। ক'দিন আগে হঠাৎ কল করেছিল। একটা প্রজেক্ট নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলাম সেসময়। কার কাছ থেকে আমার নম্বর পেয়েছে বললো, লস এঞ্জেলেসে আসছে বিজনেসের কাজে, আমার সাথে দেখা হতে পারে কিনা জানতে চাইলো। ইন ফ্যাক্ট, কিছুক্ষণ পর আমিই কলব্যাক করলাম; জানালাম, এয়ারপোর্ট থেকে ওকে পিক করব এবং পরদিন সময় দেব। আফটার অল, হি ওয়াজ মাই ফ্রেন্ড, ওয়ান্স আপন আ টাইম। এটুকু কার্টেসি আমি করব।
এলএএক্স এর কাছে স্টারবাকস এ যথাসময়ে অপেক্ষা করছিলাম, সাইফ বেরিয়ে এসে কল করল। আমার সবুজ ছোট জাগুয়ার কনভার্টিবলের বুটে অন-বোর্ড লাগেজটা রেখে হাগ করল সে। কিছুটা পিছিয়ে দু'হাত কোমরে রেখে তার পুরো অবয়বে জরিপের দৃষ্টিতে তাকাই,
-তেমন বদলাওনি সাইফ, সামান্য ওয়েট গেইন করেছ শুধু।
-শর্মি কেমন আছ? কেমন ছিলে? কিছুটা চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করে সাইফ।
আমার হাসি পায়, "হপ ইন প্লিজ, এখানে বেশিক্ষণ পার্ক করে রাখা যায় না। বিজি এরিয়া, লেট'স ম্যুভ ফার্স্ট!"
অফিস-স্যুটটা খুলে পেছনে রেখে ড্রাইভিং সীটে বসি। সাইফকে র্যাডিসনে পৌঁছে দেব। বসন্তের এই দুপুরগুলো সদ্য কাপড়-শুকানো ড্রায়ারের ভেতরের মত। গরম, টোস্টি।
-দিব্যি আছি। অনেকদিন পর বাংলায় কথা বলতে পারছি, ফিলিং গ্রেইট নাউ।
সাইফের দিকে তাকালাম, ওর চোখে সেই পুরনো গাঢ় দৃষ্টি ।
-অনেক বদলে গেছ তুমি শর্মি।
-হুম।
-তোমার চাবি ভাবটা নেই, অনেক টোনড হয়েছ।
-ফিটনেস ক্লাবের অবদান।
-অন্যরকম লাগছে তোমাকে। পুরনো শর্মির মত লাগছে না।
আমি জোরে হেসে উঠি, "ইউ আর অ্যাবস্যলুটলি রাইট! অনেকটাই বদলেছি। আমার একটা রোগ হয়েছে, হাসিরোগ।"
হোটেল কাছেই। সাইফকে জানালাম সকাল ন'টার ভেতর তাকে নিতে আসব।
মোনিককে কল করলাম, সন্ধ্যায় হ্যাং আউট করবে কিনা, ডিনার করব রেড লবস্টারে। সোৎসাহে রাজি হলো; রেস্তোরাঁয় প্রায় উড়ে এসে জড়িয়ে ধরল, "মিসড ইউ সো মাচ হান!!" বিইজ কালারের হাল্কা প্রিন্টের সামার ফ্রকের সাথে উজ্জ্বল হাসিতে মোনিককে অপূর্ব লাগছে। খাবার চ্যুজ করে চিল্ড বিয়ারে চুমুক দিয়ে সেই কথা তাকে বলি। মোনিকের মুখে আজ শুধু অ্যালানের গল্প। ফ্রান্স থেকে ক'দিন পর আসছে তার বয়ফ্রেন্ড, সেই সুখে ভীষণ সুখি এখন সে।
জিজ্ঞেস করি কাল আমাদের সাথে ল্যাঙ্কাস্টারে যেতে চায় কিনা।
-নোপ। লাভবার্ডসদের সাথে আমি একা কোথাও যাই না। নিজেকে এতিম এতিম লাগে।
আমার অট্টহাসিতে চারপাশের টেবিল থেকে সবাই আড়চোখে তাকায়।
-প্লিজ শর্মি, এইখানে এভাবে হাসে না। তুমি এখন বড় হয়েছ। লোকে কি বলবে?
আমার হাসি বন্ধ হয় না। ওকে দ্যান। রাতে অন্তত খোঁজ নিও । সহি সালামতে ফিরতে পারলাম কিনা।
ইউসিএলএ তে মাস্টার্সে মোনিক আমার প্রথম বন্ধু ছিল। ডক্টরেটশেষে নভার্টিসে আমি জয়েন করার পরও, এখনও, সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সাইফের কথা জানে সে।
-ওকে সময় দেয়ার দরকার কি ছিল তোমার শর্মি? হি'জ কাইন্ডা ইচি র্যাশ, অর পিম্পল আন্ডার দ্য স্কিন, নো ডাউট। অর টুথেক। ইউ আর জাস্ট ট্রায়িং নাম্বিং ইয়োর গাম হানি। পুল দিস মিন সেলফ আউট অব ইউ-এন্ড টস ইট রাইট অ্যাওয়ে!
আমি চুপ থাকি। আজ প্রথম নয়- এই কথাগুলো আগেও অনেকবার শুনেছি মোনিকের মুখে।
পরদিন কাজ শেষ হয়ে গেল দ্রুত। জব ছেড়ে দিয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা শুরু করেছে সাইফ- সেই সুবাদে এখানে আসা। একফাঁকে আইফোনে বউ বাচ্চার ছবি দেখালো। মিষ্টি দুই ছেলে মেয়ে। গিন্নিমার্কা শান্তশিষ্ট বউ। সুন্দর পারিবারিক ছবি। ছবি দেখার পাশাপাশি আমি সাইফকে দেখছিলাম, কি আগ্রহভরে সবাইকে চেনাচ্ছে! হাল্কা কোঁকড়ানো চুল আর প্রেমিকসুলভ চেহারাতে তাকে পুরনোদিনের ম্যাথিউ ম্যাকনেয়ই এর মত দেখাচ্ছে। প্রেমিকদের ভেতরেও প্রকারভেদ আছে! আমার কেবলই মনে হতে থাকে; সাইফ সেই চিরকালীন প্রেমিকপ্রজাতির দলে-যারা বারবার প্রেমে পড়ে, অথবা প্রেমেই পড়ে থাকে। আমার দৈনন্দিন ব্যায়ামের মতই, প্রেমকে হয়ত এরা দৈনন্দিন অনুশীলনের বিষয় হিসেবে নিয়েছে। তেরোতে হোক আর তিরাশিতে হোক, সেই প্রেমে ভাটা পড়ে না কখনো, শুধু প্রেমিকাগুলো মুহুর্মুহু বদলে যায় ...
অলস বিকেলে ম্যালিবু বীচের নীল পানিতে হেঁটে পা ভেজাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় সাইফের ফ্লাইট।
- তোমার কথা বল শর্মি । বিয়ে করছ না কেন?
-তোমার বিরহে গো! আমি হাসি।
সাইফ কিছুটা আহত চোখে তাকায়। আমি সবকিছুর জন্য স্যরি।
-ডোন্ট বি। আমি ফান করছিলাম। সময় পাচ্ছি না, তাই হচ্ছে না।
-তোমার বয়ফ্রেন্ড?
-নাহ। স্টিভ আমার কলিগ। ভালবাসা কি আমি জানি না। বায়োলজিক্যাল নিড বলতে পার, সোশ্যাল কমিটমেন্ট বলতে পার। উই'ভ এগ্রিড টু গেট ম্যারিড। ইট'ইল হ্যাপেন স্যুন। এবারের ক্রিসমাসের ছুটিতে বার্বাডোসে অনুষ্ঠানটা হবে। চাইলে অ্যাটেন্ড করতে পারো।
-অগ্রীম অভিনন্দন শর্মি।
-শুকরিয়া! শুকরিয়া!
ক'জন কিশোর হল্লা করে সার্ফিং করছে অদূরে, তাদের দেখছি আনমনে। কথা বলতে বলতে সাইফ আমার কাছে ঘেঁষে এসেছে, আমার হাত তার মুঠোয় এখন; চোখে ফুটে উঠছে সোনালি সেই আলো। আমি বাধা দেই না, সেই চোখে চোখ রাখি। সেই সোনালি সর্পীয় সম্মোহন থেকে একবার চোখ ফেরাই, আবার চোখ রাখি।
সাইফ চলে গেছে। রাতে নির্ঘুম বিছানায় এক পিদিম-জ্বলা সন্ধ্যাবেলার কথা মনে পড়ে আমার। হাকিম চত্বরে আমার দু'হাত দু'হাতে আটকে তার বুকের ওপর রেখেছিল সাইফ, হৃদয়ের ভাষা পড়তে বলেছিল। গালের বেয়ে পড়া অশ্রুতে আমার আঙুল ছুঁইয়ে চিনিয়েছিল ভালবাসার মূর্ত মানে কি হতে পারে। আমার শুধু সেই কথাই মনে পড়ে! বলেছিল, আমাকে না পেলে সে মরে যাবে। আমি তখন অনেক বিশ্বাস করতাম। মানুষকে। পরীক্ষাশেষে স্রেফ অভিবাসনের জন্য অচেনা একটা মেয়েকে তার বিয়ে করার কথা শুনে অন্যদেরকেই অবিশ্বাস করেছি। হয়ত সব মানুষ- মানুষ নয়। কিংবা, সাইফ হয়ত ঠিক ততটা খারাপ নয়, যতটুকু তাকে ভাবছিলাম। বদ্ধ পুকুরের নোনতা স্বাদ আর সোঁদা গন্ধে আটকে থেকে দরকার কি! ক্রমাগত বদলানোর নামই তো জীবন!
মোনিককে বলতে পারিনি, একবারের জন্যে হলেও- সাইফকে দেখাটা আমার জন্য কতটা জরুরি ছিল! অন্ধকারে নিঃশব্দে বিছানায় পা গুটিয়ে উঠে বসি, আমার পুরো শরীরের ত্বকে হাত বুলাই। কোথায় লুকিয়ে আছে সেই পিম্পল? সেই ক্ষুদে অসুস্থ সত্তার অস্তিত্ব আজ আমাকে খুঁজে পেতেই হবে! আমি হন্য হয়ে উঠি। খুঁজে পেলে নির্ঘাত তাকে উপড়ে ফেলব আজ! তারপর... এই আট বছরের জমানো সব ঘুমগুলোকে নিয়ে ক্লান্ত বালিশে মাথাটা এলিয়ে দেব। আমার কিছু ঘুম দরকার।