সমস্যাটা ব্যাপক না, তারপরও চোখের লাগার মত। এষা ব্যাপারটা অনেক দিন ধরে খেয়াল করছে। ফেসবুক পেইজের কোন গল্পে কমেন্ট করলেই তাতে লাইক দেয় আনিস নামে একটা আইডি।
কোন গল্প পড়ে দেখা গেলো শুধু দু:খের ইমো দিয়েছে। কিন্তু ওই ছেলে তাতেও লাইক দিয়ে বসে আছে। প্রথমে ভেবেছিল লাইক ভাইরাসে আক্রান্ত ছেলেটা। অনেকের এ সমস্যা আছে। না পড়েই লাইক দিয়ে দেয়। অনেকটা নেশার মত। যেহেতু এ বিষয়টা এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞানে অন্তর্ভূক্ত হয় নাই তাই আপাতত এর কোন চিকিৎসা নেই। তবে এষা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যেভাবে লাইক দেওয়া শুরু হয়েছে তাতে এক সময় এটা একটা মানসিক রোগ হিসাবে দেখা হবে।
নিজের কমেন্টে লাইক দেখে ওই পোস্টে অন্য কমেন্টগুলোতে আনিসের লাইক আছে নাকি দেখে। নাতো। অন্য কোন কমেন্টে ওই ছেলে লাইক দেয় নি। তাহলে তার তাতে দিচ্ছে কেন! আশ্চর্য ব্যাপারতো।
সামিয়ার সাথে ভাল বন্ধুত্ব এষার। ক্লাস সেভেন থেকে একসাথে পড়ছে। সে সামিয়াকে ব্যাপারটা বলতেই ও হাসতে হাসতে শেষ।
আরে বাবা এখানে হাসার কি আছে। খুব বিরক্ত হয়েছিল ও।
হাসি থামিয়ে সামিয়া বলে, এখন কারো মনে ঢোকার পদ্ধতি অনেক সহজ হয়ে গেছে।
: বুঝলাম না, কারো মনে ঢোকার পদ্ধতি সহজ হবে কেন! আর এখানে মনে ঢোকার কথা আসছে কেন?
সামিয়া আবার হাসে। এই মেয়েটা যে এত্ত হাসতে পারে। লাফিং গ্যাসের ক্ষমতাকে হার মানাবে মনে হয়।
: শুন এরকম তো হতেই পারে। আচ্ছা তোকে বুঝিয়েই বলি। আগে কোন ছেলের একটা মেয়েকে পছন্দ হলে কি করতো। ওই মেয়েকে দেখার জন্য রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতো। রাতের বেলায় মশার কামড় খেয়ে ওই মেয়ের বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা।
: আরে, তুই এসব কি বলছিস। যা বলবি শর্টকাট বল। এত আগের কথায় যাচ্ছিস কেন!
: দোস্ত বলতেছিতো। তুই ঠান্ডা মাথায় শোন। ভাল লাগবে। বলে হাসতে থাকে সামিয়া।
রাগ করে উঠে যাবে চিন্তা করেও উঠতে পারে না এষা। তাদের সার্কেলে পাঁচ বান্ধবী আছে। এই একমাত্র সামিয়ার সাথেই কারো ঝামেলা হয় না। অন্যদের সাথে কোন না কোন ভাবে রাগারাগিই হয়। কিন্তু সামিয়ার সাথে কেউ রাগ করতে পারে না। রাগ করতে না পারার কারণটা হয়ত ওর মনখোলা হাসি।
এষা গম্ভীর ভাবে বলে, ঠিক আছে বল।
: আচ্ছা বলতেছি। ছেলেটা এত কষ্ট করতো কেন! ওই মেয়েটার একটু দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য।
: তো কি হয়েছে!!
: এখানেই তো কথা। এত কষ্ট করে আগে দৃষ্টি আকর্ষন করতে হতো। আর এখন দেখ, ফেসবুকে কমেন্টে একটা ক্লিক করেই কি সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। আর পটেও যায়। কি সহজ, তাই না!!
: ওই এখানে তুই পটানোর কি নমুনা পেলি। যত্তসব। তোর সাথে একথাটা শেয়ার করাই ভুল হয়েছে।
: রাগ করছিস কেন!! সরি দোস্ত সরি। পটানোর কথাতো দুষ্টামি করে বললাম। তবে ছেলেটা সার্থক।
: কেন?
: ওই যে তোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে। এ বিষয়টা নিয়ে তোর সিরিয়াসনেস দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা শুধু সফল না, বেশ সফল। আচ্ছা টপিকটা বাদ দেয়। মজা করার জন্য এতসব কথা বললাম। আর যেহেতু লাইক দেয়ার অপশন বন্ধ করা যায় না, তখন লাইকের এ অত্যাচার সইতেই হবে। দেখিস না আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। বেশ দুশ্চিন্তামুক্ত আছি।
: ঠিক আছে বাদ দিলাম।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
ওই সময় আলোচনা থেকে টপিকটা বাদ হয়েছিল, তবে মাথা থেকে ব্যাপারটা মুছতে পারছে না এষা। ছেলেটা সম্পর্কে কৌতুহল হচ্ছে। প্রোফাইল পিকচারে একটা ছবি। সেখানে লেখা : এই ব্যক্তি মরার আগে মৃত হতে চায় না।
এর মানে কি! মরার আগে মৃত হয় কিভাবে!
নিজের সম্পর্কে লেখা : নাম : কাজেই পরিচয়, নামে নয়, তাই আসল নামটা উহ্যই থাকুক।
* অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানে প্রস্তুত এক অধম, যে কিনা অদ্ভূত সব স্বপ্ন দেখে। কখনো আকাশে উড়ার (ডানা নাই), কখনোবা মধ্য সমুদ্রে নিচে মৎস্য প্রাণীর সাথে বন্ধুত্ব করতে, ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বিশ্ব রেকর্ড করতে (সাঁতারই জানে না), ইচ্ছে হয় সুন্দর সুন্দর গল্প লিখে তাকে চমকে দিতে, সে যে গল্প পড়তে অনেক পছন্দ করে (সারা জীবন বাংলায় টেনে টুনে পাস করেছে যে তার পক্ষে কি তা সম্ভব)।
আগে কখনো প্রোফাইল দেখতেই যায়নি আইডিটার। তবে সামিয়ার সাথে কথা বলার পর প্রথমবারের মত প্রোফাইল চেক করতে গিয়ে বেশ অবাক হলো এষা। ছেলেটা নিশ্চিত পাগল।
প্রোফাইল থেকেই মেসেজ অপশনে গিয়ে মেসেজে লিখে : আচ্ছা আপনি আমার সব কমেন্টে লাইক দেন কেন! আমাকে কি আপনি চিনেন?
সন্ধ্যা বেলায় চেক করে ইনবক্স। নাহ উত্তর আসে নি। পরের দিনও আসে নাই। ফেসবুকে যে বসছে না, তা নয়। নতুন কোন গল্পে কমেন্ট করলেই কিছুক্ষণের মধ্যে লাইক দিচ্ছে।
দ্বিতীয় দিনও অপেক্ষার পর যখন মেসেজের উত্তর আসে না তখন বেশ খারাপ লাগে। কি অসামাজিক। মেসেজের উত্তর দেয় না।
তৃতীয় দিন লিখে পাঠায়, “মেসেজের উত্তর দিলেন না! কিন্তু ঠিকই লাইক দিয়ে যাচ্ছেন। আপনার সমস্যাটা কি বলবেন। শুনেন আমার এ মেসেজের উত্তর না দিলে আপনি আর লাইক দিতে পারবেন না। কেননা আমি আর কমেন্ট দিবো না। প্রতিটি গল্পই আমি পড়ি। কমেন্ট করতে ভাল লাগে। কিন্তু আপনার মত অচেনা, অসামাজিক একটা লোকের জন্য আমার কমেন্ট দেওয়া বন্ধ রাখতে হচ্ছে।”
মেসেজটা দিয়েই ফেসবুক থেকে লগ আউট করে এষা। অনেক পড়া বাকী। ফাউল এ লোকটার জন্য তিনদিন পড়ায় মনযোগ দেওয়া যায়নি। ও নিজ থেকে মেসেজ দিয়েছে অথচ মেসেজের কোন উত্তর দেয়নি এ ব্যাপারটা বেশি খারাপ লেগেছে। বার বার মনে হচ্ছিলো মেসেজ দিলো কেন! ছেলেটা গুরুত্বই দিলো না। মেসেজ দিয়ে তা ফিরিয়ে নেওয়ার অপশন থাকলে ভাল হতো। তাহলে মেসেজ দিয়েকিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন উত্তর নাই দেখা যেতো সাথে সাথে ফিরিয়ে নেওয়া যেতো। এসব অপশন যে কবে আসবে!
পড়ায় মন দিলেও ঠিক মন আসছে না, ইকোনোমিক্সে থার্ড ইয়ারে পড়ে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হচ্ছে দুইজনকে। এদের মধ্যে হেকসার অন্য জন ওলিন। ওলিন আবার হেকসারের ছাত্র। এ দুইজনকে কিসে পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে এত ঘাঁটাঘাটি করার। করবি তো কর। নতুন তত্ত্ব বানাতে যাস কেন! তাদের তত্ত্বের নামও দিয়েছে একটা অর্পিত উপাদান তত্ত্ব। যত্তসব। শিক্ষক ও ছাত্র এই দুই চীজকে পেলে কুটি কুটি করা যেত।
শেষ পর্যন্ত দেখবে না দেখবে না করেও আবারও ফেসবুকে ঢুকলো এষা। হুম নতুন মেসেজ এসেছে। সরাসরি নতুন মেসেজে গেলো। হা ওই বদ ছেলেটাই মেসেজ পাঠিয়েছে এতক্ষনে।
“ কাউকে ভাল লাগলে তাকে লাইক দেওয়াই যায়। তবে প্লিজ আপনি কমেন্ট দেওয়া বন্ধ করবেন না। আপনি যদি লাইক দিতে মানা করেন। তবে আমি আর লাইক দিবো না। কষ্ট হবে জানি। তারপরও লাইক দিবো না। প্লিজ আপনি কমেন্ট করবেন।
এষা লিখে পাঠায়, লাইক না দিলে কষ্ট হবে কেন? আর আপনি আমার প্রথম মেসেজের উত্তর দেন নি কেন! উত্তর কিন্তু এখুনি দিবেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তর আসে, জানি না, কষ্ট হবে কেন! তবে বেশ কষ্ট হবে। আসলে কি লিখবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। আপনার মেসেজ পেয়ে এত ভাল লাগছিলো। কিন্তু কিছু ভালোর উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না। একটা ভয় কাজ করে। যদি বিরক্ত হন। কি লিখতে গিয়ে কি লিখি। বিশ্বাস করেন এ ভয়ে উত্তর দেওয়া হয়নি। আমি কিন্তু আপনার মেসেজের উত্তর বিশ বারের ওপর লিখছি। এবং প্রতিবারই মুছে ফেলেছি। বার বার মনে হয়েছে আমার উত্তর শুনে আপনি বিরক্ত হবেন। আর আপনাকে আমি চিনি না। ভয়ে আপনাকে এড রিকোয়েস্ট পাঠাই নি। যদি বিরক্ত হন।
: বুঝলাম। আচ্ছা এতজন থাকতে অন্যদের কমেন্টে লাইক দেন না। আমার কমেন্টে লাইক দেন কেন! আমাকে তো আপনি চিনেনই না।
: হুম চিনি না। তবে আপনার মনে আছে কিনা জানি না। এই পেইজের প্রথম দিকে মা নিয়ে একটা ছেলে গল্প লিখেছিল। ওই গল্পে আপনার কমেন্টটা এত ভাল লাগলো এরপর আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম। আসলে আমার মা নেই। ওই গল্পের কিছু অংশ আমার জীবনের সাথে মিল আছে। আমার বয়স যখন তিন মা এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান।
: ওহ সরি। আচ্ছা গল্প লেখকদের ফ্যান থাকে। কিন্তু কমেন্টদাতারও যে ফ্যান থাকে তা প্রথম জানলাম।
এরপর উত্তর না আসছে না দেখে বিরক্ত হয় এষা। এ ছেলেটা এমন কেন। উত্তর দিতে কি সমস্যা। কাজ থাকলে বলে গেলেই তো পারে।
এষা লিখে পাঠাই, মেসেজ দিলে উত্তর না পেলে আমার যথেষ্ট বিরক্ত লাগে। আপনি চুপ হয়ে গেলেন যে। কোন কাজ থাকলে বলে যাবেন যে ফেসবুক থেকে উঠছি।
চ্যাট করার সময় ওই পাশের ব্যক্তি কি করছে তা বোঝা সম্ভব হয় না। এ কারণেই যা লিখে তাই সত্য মনে হয়। সত্য মনে হয় কথাগুলো। মনে এক কথা রেখে ওপরে অন্য কথা বলে খুব ভাল সম্পর্ক তৈরি করা ফেলা যায় ভার্চুয়াল লাইফে। তাছাড়া বাস্তবে সামাজিকতা দেখাতে আন্তরিকতা লাগলেও ভার্চুয়াল তার জন্য বেশি আন্তরিকতার প্রয়োজন না। অনেকে এ ব্যাপারটা কাজে লাগায়। আর কেউ কেউ ফাদে পড়ে বিশ্বাস হারায়।
তবে আনিসের চোখে পানি। ল্যাপটপের স্ক্রীণ ঝাপসা লাগছে চোখের পানির কারণে। মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা নিয়ে বেশি সুখ স্মৃতিও মনে নেই। তারপরও মা-কে এত মনে পড়ে।
সে লিখে পাঠায়, আমি একটু পরে উত্তর দেই।
এর পর থেকে দুইজনের মধ্যে নিয়মিত কথা হতো ফেসবুকেই। একসময় মোবাইলে কথা হয়। নিয়মিত কথা চলায় দুইজন দুইজনের প্রতি দুর্বল হয়েছে। এক পর্যায়ে তা ভালোবাসায় রুপ নেয়। তবে কেউ কখনো কাউকে বলে নি তোমাকে খুব ভালোবাসি। অনুভূতির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
দুই বছর পর।
দুই পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়। ধূমধাম করে বিয়ে হয়। বাসর রাত। খাটে বসে আছে এষা। পাশের টেবিলের ওপর রাখা দুইটা ল্যাপটপ। এষাই আগে থেকে তা রাখতে বলেছে। কারণ জিজ্ঞেস করেছিল আনিস। এষা বলে, ওইদিনই দেখবে।
আনিস খাটে গিয়ে বসে। লজ্জায় কোন কথা বলতে পারে না।
এষা চোখের ইশারায় ল্যাপটপ গুলো আনতে বলে। ল্যাপটপ দুইটা খাটে আনা হয়।
এষা ওর ল্যাপটপটা চালু করে। নেট কানেক্ট করে। সরাসরি ঢুকে যায় ফেসবুকে। অবাক হয়ে আনিস দেখে যায়।
এতে কড়মড় করে তাকায় এষা। মাথা উচানোর ভঙ্গি করে মাথা নাড়ে। যার অর্থ তোমারটা অন করছো না কেন!
সাথে সাথে আনিসও ল্যাপটপ অন করে। ফেসবুকে ঢুকে। আনিস দেখে নক করছে এষা। সেখানে লেখা, তুমি এত লাজুক কেন!! আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।
এই প্রথম ভালোবাসি কথাটা বলা।
আনিসের কাছে স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। সে শুধু লিখে পাঠায় আমিও।
এরপর দুইজনই তাদের রিলেশন শীপ পরিবর্তন করে। তা করার পর বন্ধ করা হয় ল্যাপটপ। অফ হয়ে যায় ভার্চুয়াল লাইফ। এখন শুধুই সুন্দর কিছু বাস্তবতা। সুন্দর কিছু মূহুর্ত।
লেখা : ৬ জানুয়ারি, ২.১৮ পিএম থেকে ৩.৩৩ পিএম।