রুমানার কাছে ব্যাপারটা ঠিক স্বপ্ন স্বপ্ন না, অবাস্তব মনে হচ্ছে। ভালও লাগছে। তবে সে ভাল লাগা এত তীব্র না যে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হবে। তার ওপর শীত একেবারেই অপছন্দ ওর কাছে। সে শীতেই সকাল বেলায় কম্বলের পরশ থেকে বের হতে হয়েছে। এজন্য কিছুটা বিরক্ত।
কিছুটা বিব্রতও বটে। কোন সাজগুজ করে আসে নি। নতুন কারো সাথে দেখা করতে গেলে অল্প হলেও সাজগুজ করে আসাটাই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা ভাবতেই নীলার কথা মনে পড়লো। ওদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। সে আপুটা বয় ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবে। প্রথম দেখা। দেখা হবে বিকালে। সে সকাল থেকেই প্রস্তুতি।
ওনার প্রস্তুতি দেখে বেশ হাসি পাচ্ছিলো রুমানার। গোসল করতে গিয়ে দেড় ঘন্টা কাটালেন। আচ্ছা বেশিক্ষণ গোসল করলে কি বেশি সুন্দর দেখায়! তারপর আরেক মুসিবত। কিছুক্ষণ পর পর এক একটা জামা পড়ে আসেন।আর রুমানাকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা রুমানা বলো তো, কেমন লাগছে এ ড্রেসে আমাকে।
: আপু বেশ ভাল লাগছে। ওই ভাইয়া আপনাকে দেখে বেশ খুশী হয়ে যাবে।
: আচ্ছা দাড়াও গোলাপী ড্রেসটা পড়ে আসি।
: এটাতে কেমন লাগছে?
: ওয়াও! আপু দারুণ। তুমি এম্নেতেই সুন্দর। তোমাকে যেকোন কাপড়েই ভাল লাগবে।
আবার কেন জানি ছুটে যান। আকাশী রঙের আরেকটা জামা পড়ে আসেন।
: আপু তোমাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বললাম তো তোমাকে সব কাপড়েই ভাল মানায়। তুমি নিশ্চিন্তে যেতো পারো।
কথাটা শুনে যেন লজ্জা পান উনি।
: আরে নাহ, প্রথম দেখাতো। এত দিন কথা হয় কখনো সামনা সামনি দেখা হয়নি। আজই প্রথম হবে।
ইমনের সাথেও আজ প্রথম দেখা রুমানার। তবে তা আগে জানত না। সকাল বেলায় ফোন। এত সকালে সাধারণত ফোন দেয় না ও। অন্য সব ত্যাগ সহ্য করতে পারলেও ঘুমের ত্যাগ নাকি ও সহ্য করতে পারে না।
ফোন রিসিভ করার পর রুমানা শুনতে পায়, শুভ জন্মদিন ডা. রুমানা।
: আমি আবার ডাক্তার হলাম কবে। ডাক্তার হতে বেশ দেরি আছে। তাই এ মুহূর্তে ডাক্তার সম্বোধন করার কোন দরকার নেই।
: সমস্যা নাই। হবেই তো। ডাক্তার না হয়ে তো অন্য কিছু হতে পারবে না।
: মানে!!
: আজ তোমার জন্মদিন। এভাবে কথা বলছো কেন!! আমি বলতে চাচ্ছি তুমি তো চাইলে এখনতো আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। তোমাকে ডাক্তার হতেই হবে।
: হুম বুঝলাম। এখন বলো এত সকালে ফোন দিয়েছো কেন! জন্মদিনের উইশ করতে?
: জন্মদিনের উইশ রাতেই করতে পারতাম। কিন্তু করি নাই। তোমার এলাকায় এসে করবো বলে?
: বলছো কি!! তুমি এখন কোথায়?
: তোমার হোস্টেল গেইটের ৩০০ মিটার কাছাকাছি দূরত্বে। এর কম বেশি হতে পারে।
: জন্মদিনের উইশ করতে তুমি সিলেট থেকে এখানে চলে এসেছো! মহা পাগল ছেলে তো, বাবা।
: হুম কিছুটা তো পাগলই। আচ্ছা তোমার কি সময় হবে একটু বের হওয়ার।সামনা-সামনি আবার উইশ করতে পারলে ভাল লাগতো।
: এরকম পাগলামি না করলেই কি হতো না?
: আচ্ছা আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি। পরে না হয় আরেকদিন দেখা হবে।
: এই চুপ, এতদূর আসার পর এখন আবার ভাব দেখাচ্ছো নাহ!! যেখানে আছো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এক পাও নড়বে না। আমি আসছি। বলেই রেখে দেয় রুমানা।
কথাটা শুনে এত্ত ভাল লাগে ইমনের। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। ৫০০ টাকার একটা নোট বের হয়ে আসে। সেটা দেওয়ার জন্য এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু এই সাত সকালে কোন ভিক্ষুক চোখে পড়ে না। আশাহত চোখে তারপরও ভিক্ষুক খুঁজতে থাকে।
ইমন আর রুমানা বসে আছে ফিস্ট রেস্টুরেন্টে। রুমানাকে দেখে মুগ্ধ ইমন।একটা কালো রঙের শাল জড়িয়ে এসেছে। মায়াবী মুখ। মুখে কোন ধরণের প্রসাধনী নেই। তাড়াহুড়া করে চুল একবার আঁচড়িয়েই চলে এসেছে বুঝায় যাই। তারপরও এত মায়াবী লাগছে।
দুইজনে সামনা সামনি বসা।
প্রথম কথা বলে ইমন, আচ্ছা এবার তোমার কততম জন্মদিন?
: কেন?
: এম্নেই।মেয়েদের নাকি বয়স জিজ্ঞেস করতে নাই। যা করতে নাই তা করে একটু সহজ হতে চাচ্ছি আর কি?
হেসে দেয় রুমানা। সত্যি সত্যি বলে দেবো?
: আরে নাহ! এম্নে দুষ্টামি করলাম।
: আচ্ছা তুমি বলো তো, এই পাগলামি করলে কেন? কাল সন্ধ্যাতেই চ্যাটে কথা হয়েছে। ওসময়ও তো বলো নাই, আসবে।
: ইচ্ছা হলো পাগলামি করার, তাই করলাম। বলেই হেসে দেয় ইমন।
: এসব পাগলামী বিশেষ কারো জন্য স্টকে রেখে দাও। এখন দেখাচ্ছো কেন?শেষ হয়ে যাবে তো!
: হুম এতদিন তো রেখেই দিয়েছিলাম। এখন দেখানো শুরু করছি বিশেষ জনের জন্য। নাহলে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এখানে আসি। আম্মু জানে না এখানে আসছি। শুধু জানে বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি, সেখানে রাত হতে পারে।
: তার মানে রাতে বন্ধুর বাসায় গিয়ে সময় কাটানো হয়?
: হা মাঝে মাঝে। কেন এটা তোমার পছন্দ না?
: আরে আমার পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার আসছে নাতো। শুনি বয়সের দোষে কয়েক বন্ধু মিলে আজে বাজে কাজ করা হয় একসাথে হলে।
হা হা হা করে হেসে উঠে ইমন।
: হুম ঠিক বলছো। তবে আমি ওই তাস খেলা পর্যন্ত আছি। এর বাহিরে যেতে পারি না। তবে দেখো এবার থেকে বাসায় থাকবো। আর ফেসবুক নেশা হওয়ার পর বন্ধুদের সাথে তেমন রাতের আড্ডা হয় না।
এসময় ওয়েটার গরম গরম পরোটা, ডিমের মামলেট, ভাজি এনে দেয়।এগুলো খাওয়া যাবে? নাকি অন্য কিছু দিতে বলবো।
: নাহ নাহ ঠিক আছে।
ওরা খেতে শুরু করে।
ভালবাসা ও কিছু আবেগের গল্প পেইজে তোমার গল্প গুলো যে এক একটা কয়বার করে পড়ি, হিসাব নেই। এত্ত ভাল লাগে। তবে সেদিন ওই পেইজে ঢুকে এত্ত খারাপ লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো....
রুমানা খাওয়া বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করলো, কি দেখে খারাপ লাগছিলো।
: রিয়েল ডেমোন নামে একজন আছে না?
: হা, রিক ভাই। দারুণ লিখে। এত সুন্দর করে যে কিভাবে লিখে। এত্ত ভাল লাগে পড়তে।
: কচু লিখে। তোমাকে নিয়ে গল্প লিখলো। এটা দেখে এত্ত বিরক্ত লাগছে।মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো গল্পটা পড়ে। তোমাকে নিয়ে ও গল্প লিখবে কেন!! যত্তোসব। সেদিন ইচ্ছা হচ্ছিলো আমিও গল্প লিখি।
: লিখলেই পারো।
: নাহ, আমার এত শখ নেই। লেখকরা ভাল না। ওরা শুধু মেয়েদের পাগল বানাতে পারে। কাজের কাজ কিছুই পারে না। দেখো না হুমায়ুন আহমেদ কি কাজটা করলো। নিজের মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করে বসলো। এটা কি ঠিক হলো?
: আচ্ছা তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আশ্চর্যতো! আমার জন্মদিনে এভাবে উইশ করার জন্য এলে?
: ওহ সরি।
দাড়াও দাড়াও। আমার তো মনেই নেই। ওয়েটারকে ডাক দিলো। প্যাকেটটা নিয়ে আসো তো।
বিশাল ফুলের প্যাকেট। বেশ সুন্দর। গোলাপ আর রজনীগন্ধার সংখ্যাই বেশি।
রুমানার হাতে তুলে দিয়ে ইমন বলে, শুভ জন্মদিন।
এতগুলো ফুল পেয়ে বেশ ভাল লাগে রুমানার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এত বড় প্যাকেট নিয়ে হোস্টেলে ঢোকা যাবে না। পুরা হোস্টেলে খবর হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ দুই জনেই চুপ। রুমানা চিন্তা করছে এত সুন্দর ফুলগুলোর কি গতি করা যায়। আর ইমন চিন্তায় আছে কোন বিষয়ে কথা বলা যায়।
রুমানা বলে, থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ ভেরি মাচ। যদিও কোন উপহার পাওয়ার সাথে সাথেই তা বলা হয়। তবে আমি একটু দেরিতেই দিলাম।
আর একটা কথা, তোমার আবেগ দেখে ভাল লাগছে। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তবে...
তবে কি??
না থাক আজ সুন্দর এ দিনে নাই বলি। অন্য একদিন বলবো।
: প্লিজ বলো,, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ........ বলো..........................
বিদায় মুহূর্তটায় একটু গুমট ভাব ছিলো। ইমন হাজার বার অনুরোধের পরও রুমানা তবের ব্যাপারটা বলে নি।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
টাঙ্গাইল থেকে ফেরার পর তিনদিন কেমন যেন যায় ইমন। ওর মা নিলুফা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ছেলর এ কি হলো। কিছুই তো বলছে না। কিছু বললে চুপ করে থাকে। জোর করেও কিছু খাওয়ানো যায় না।
: বাবা, তোর কি হয়েছে খুলে বল। এমন করছিস কেন?
: কিচ্ছু হয় নাই। আমাকে একা থাকতে দাও।
: কেউ কিছু বলেছে?
: বললাম তো কিচ্ছু হয় নাই। তুমি এখন যাও তো।
এদিকে তিনদিন পার হলেও কোন খোঁজ খবর নাই দেখে দুশ্চিন্তা হয় রুমানার। ফেসবুকেও নাই। ওই একাউন্টেরই কোন হদিস নেই। ডি এ্যাকটিভ করছে নিশ্চয়। ঘোরের বশে না, তাহলে বাস্তবেই কি এভাবে পছন্দ করে! রিক ভাইয়ের গল্প লেখার ব্যাপারটা যখন বলছিলো তখন এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সত্যি সত্যি তাহলে!
চতুর্থ দিনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। রুমানা রিসিভ করে স্বভাব সুলভ সালাম দেয়।
ওয়া আলাইকুম সালাম। মহিলার গলা।
আচ্ছা মা, তোমার পরিচয়টা একটু দিবে?
আজব ব্যাপারতো। ফোন করছে উনি। আবার পরিচয় জানতে চাচ্ছে।
: কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
: হুম না চেনারই কথা। আচ্ছা তোমাকে খুলেই বলি। আমার ছেলে ইমনের কল লিস্টে শেষ কল ছিল তোমার নাম্বারে, এছাড়া তোমার নাম্বারেই কল বেশি ওর কল লিস্টে। তোমার মোবাইলে কল করার পর আর কোথাও ওর কল নেই। ওর বাবা অপারেটর অফিসের গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে।মোবাইলটাই যে কোথায় রেখেছে কে জানে। কয়েকদিন ধরে ও কেমন জানি হয়ে গেছে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে না। তুমি কে আমি জানি না।আমার মনে হচ্ছে তোমার সাথে কোন কিছু হয়েছে। তবে প্লিজ এমন কিছু করবে না যাতে আমার ছেলেটা এমন কষ্ট পায়। একটাই ছেলে আমার। ওর খারাপ কিছু আমি সহ্য করতে পারি না। আর মা হিসাবে বলছি না, বাস্তবে আমার ছেলেটা কিন্তু অনেক ভাল। কত আজেবাজে নেশা থাকে এ বয়সে।ইমনকে নিয়ে এসব বিষয়ে আমার চিন্তা করতে হয়নি কখনো।
একটানা কথাগুলো বলে যান নিলুফা বেগম।
আরো কথা হয় দুইজনের মধ্যে।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
ইমনের বাবা-মা ইমনকে নিয়ে নিজেদের গাড়ীতে করে টাঙ্গাইলে উদ্দেশ্যের রওয়ানা দেয়। ইমনের লজ্জা লাগছিলো। ও ভেবে পাচ্ছে না ব্যাপারটা বাবা-মা কিভাবে জানলো। নিলুফা বেগমের প্ল্যান আজ দুপুর বেলায় চারজন মিলে একসাথে খাবে।
এদিকে তাদের আসার কথা শুনে কেমন জানি লাগে রুমানার। আসলে ও পরীক্ষা করতে চেয়েছিল ইমনের কাছে ব্যাপারটা কি শুধুই সময় কাটানো নাকি সত্যি সত্যি আবেগ রয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি ভালোবাসে।
কোন ড্রেস পড়ে ওদের সাথে যাবে এবার চিন্তা করে রুমানা। নিজেকে নীলার মতো মনে হচ্ছে ওর কাছে। তবে এ মনে হওয়াটাতে আনন্দই লাগছে ওর।সাথে লজ্জাও।
ভাগ্যিস রুমমেট অনি নাই। থাকলে ইচ্ছামত ক্ষেপাতো।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১৮