শুক্রবার তেমন কাজ নেই। সপ্তাহের এই দিনটা অবসর। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আনিস এ দিনে খালার বাসায় চলে যায়। শহরে খালা থাকায় এ এক সুবিধা। সপ্তাহের অন্যান্য দিন মেসের খাবার খেয়ে মোটামুটি বিরক্ত ও। এ দিনটাতে খালার হাতের রান্না খেয়ে সাপ্তাহিক বিরক্তি দূর করে।
খালা আয়েশা বেগমও বোনের ছেলের জন্য বেশ আয়োজন করেন। নিজের কোন ছেলে নাই। দুই মেয়ে। আনিসকে নিজের ছেলের মত দেখেন। শুক্রবার আসলেই সকাল থেকে শুরু করেন আনিস প্রিয় খাবার গুলো প্রস্তুত করার।
সকালের দিকে যেতে চাইলেও যাওয়া সম্ভব হয়নি। শোয়েব বলল : একটা মোবাইল কিনতে হবে। সাথে যাবি।
শুনে একটু বিরক্ত হয় আনিস। কিন্তু বিরক্ত ভাবটা আড়াল করে বলে, আজ শুক্রবার। বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ। কাল কিনিস।
: আচ্ছা ঠিক আছে। তুই যেতে না চাইলে যাবি না। শুক্রবারের অজুহাহ দিস না।
: আরে আমি কি বলছি যাবো না? তুই যে কেন বেশি বুঝিস। আচ্ছা তোর লামিয়ার খবর কি?
লামিয়ার কথা তুলে এ প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করতে চায় আনিস। কারণ শোয়েব এমন একটা ছেলে রাত দুইটা বাজে কেউ বলল, এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একটু যেয়ে দেখতে পারবি। ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে সে চলে যাবে। অন্যের জন্য এভাবে এত বেশি বোধ হয় শুধু ওর দ্বারাই সম্ভব।
মাঝে মাঝে আনিসের ভাবতে খুব ভাল লাগে যে শোয়েব ওর রুমমেট। একটা ছেলে এত সরল কিভাবে হয় তা ভেবে না ও। যেদিন বুয়া আসে না সেদিন শোয়েবই রান্না করে। মজার ব্যাপার হলো একদিন। বুয়া আসে নি। শোয়েব আয়েশ করে পাকঘরে বসে বরবটি কাটতেছে। এসময় ফোন।
ধ্যাত এসময় আবার কে ফোন করলো। রান্নার জ্বালায় বাঁচি না, আবার ফোন। ডেস্কের ওপর থেকে ফোনটা না। তবে ফোনে ইনকামিং নাম্বার দেখে ভীষণ খুশী হয়। আনিস কাজ না করলেও শোয়েবের পাশে বসে থাকে। মাঝে মাঝে লবণ, মরিচ বাড়িয়ে দেয়। কাজ বলতে এতটুকুই।
ফোনে সত্য কথা বলে দেয় শোয়েব। লামিয়া জিজ্ঞেস করছিলো : কি করছো। ও সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দেয়, রান্না করি।
আর যায় কোথায়। দুপুর বেলায় দুইজনের মাঝে মেহমান জুটলো। লামিয়া শোয়েবের হাতের রান্না খেতে চলে এসেছে। এ সহজ সরল ছেলেটার সাথে কি দু:সাহসী মেয়েরে বাবা। লামিয়া সেদিন দুই বার ভাত নিয়ে খেলো। অথচ খাওয়া দাওয়ায় ও বরাবরই বেশ আলসে। শোয়েবের হাতের রান্না এ কারণেই নাকি কে জানে।
ওর মা জানলে নির্ঘাত শোয়েবকে খবর দিতেন। রান্নায় সাহায্য করার জন্য, তা নাহলেও অন্তত ও রেঁধেছে এ ব্যাপারটা প্রকাশ করতে। শোয়েবের ভাগ্য ভাল। এ খবর লামিয়ার মা জানে না।
খাওয়ার মধ্য খানেই লামিয়া ঘোষণা দিলো, প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার নাকি ও এখানে দাওয়াত খেতে আসবে। খাবার খেয়ে দারুণ সন্তুষ্ট হয়।
কি সাংঘাতিক।
শোয়েব হাসে।
আনিস বলে, ভালই হবে। আমি শুক্রবার থাকি না। তোমাদের দুই জন মিলে বিয়ের আগে টুনাটুনির সংসার হয়ে যাবে।
লামিয়া বলে, থাকেন না মানে! আপনি তাহলে কোন সংসারে যান।
: আরে কোন সংসারে নাতো। খালার বাসায় যায়। সপ্তাহে একদিন ঘুরে আসি।
শোয়েব ভাতের প্লেট সরাতে সরাতে বলে, ওর কাজিনটা কিন্তু ওকে দারুণ পছন্দ করে। বেশ সুন্দরী।
লামিয়া বলে, আরে তাই নাকি। আনিস ভাই তাহলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন। কাজিনকে দেখার জন্য চলে যাওয়া। আগে বলবেন না। কি নাম? কিসে পড়ে?
আনিস লজ্জা পায়। : আরে ধ্যৎ। শোয়েবও বলল। আর তুমিও বিশ্বাস করলে। প্রেম করো বিধায় যা বলে তাই বিশ্বাস করবে। এরকম অন্ধ বিশ্বাস ঠিক না।
: ওয়াও! আনিস ভাই দেখি এখন প্রেম নিয়ে গবেষণাও করছেন। ভাল ভাল। যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আপনার বন্ধু আপনার সম্পর্কে কোন দু:খে মিথ্যা কথা বলবে। আরে নাম বললেন নাতো।
শোয়েব বলে, আমি বলে দিই।
ওকে থামায় দেয় লামিয়া। তুমি বলবে না। আমি আনিস ভাইয়ের মুখে তার ভালোবাসার মানুষটা নাম শুনতে চাই।
আনিসের ভাত খাওয়া শেষ। গ্লাসে পানি ঢালে। ভালোবাসার মানুষ শব্দটা শুনে মুখে পানি না তুলে বলে, আশ্চর্য ব্যাপারতো। এখানে আবার ভালোবাসার মানুষ আসলো কোথা থেকে। কি যে মুসিবত। আমার আন্টি যদি এসব শুনে। কি যে লজ্জা।
লামিয়া দমে না। ও বলে, অবশ্যই ভালোবাসার মানুষ। সে যে আপনার ভালোবাসার মানুষ তা নিয়ে আমার যুক্তি আছে।
: মানে!! তুমি আবার যুক্তিও আবিষ্কার করে ফেলছো? সুন্দরী মেয়েদের এই সমস্যা। অল্পতেই যুক্তি আবিষ্কার করে ফেলে।
লামিয়া বলে, সুন্দরী মেয়েদের সমস্যা দেখে তো সরে পড়েন না। বরং আরো পিছে পিছে লেগে থাকেন। প্রতি শুক্রবার দেখতে চলে যান।
শোয়েব কিছু বলে না। ও দুই জনের কথা শুনে যায়। ওর মজা লাগে।
: আচ্ছা ওই কথা থাক। এখন তোমার কি যুক্তি আছে তা বলো।
: আমি আপনার ভালোবাসার জন্য আমার প্রবল ইচ্ছাকে নষ্ট করে দিলাম। আমি কিন্তু আমার ইচ্ছাকে সহজে নষ্ট করি না। আপনার জন্য করলাম। শুধু আপনার ভালোবাসার মানুষটির জন্য। এর চেয়ে বড় যুক্তি কি আছে?
আনিস কিছু বুঝতে পারে না। অবাক হয় ও। মুখে বলে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
লামিয়া মুখ চেপে হাসে। বলে, আচ্ছা খুলেই বলি। এই যে প্রতি শুক্রবার আমি চাচ্ছিলাম এখানে এসে শোয়েব সাহেবের রান্না খেতে। কিন্তু আপনি শুক্রবারে থাকবেন না। আপনার ভালোবার মানুষের কাছে চলে যাবেন। সেজন্য আমার আসা হবে না। বুঝছেন?
: আমার না থাকার সাথে তোমার না আসার সম্পর্ক কি? তুমি নি:সঙ্কোচে আসতে পারো। টোনাটুনির সংসার হবে। বলে হা হা করে হাসে আনিস।
লামিয়া একটু চোখ বড় করে। আপনার হাসি থামান। টোনাটুনির সংসার বিয়ের পর। বিয়ের আগে না। আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন আমাদের বিয়ে হয় নাই।
আনিসের একটু মজা করতে ইচ্ছা হয়। আচ্ছা চলো এক কাজ করি। আজই তোমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিই। আমি স্বাক্ষী হতে রাজি আছি। শোয়েব কি বলিস?
শোয়েব বলে, বিয়ে সম্পর্কে আমার আগের অভিজ্ঞতা নাই। আগে তো কখনো করি নাই। তাই বিয়ে সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।
এটা শুনে শোয়েবের হাতে চিমটি দেয় লামিয়া। তুমি আগে বিয়ে না করায় আফসোস করতেছো। নাহ!! আহারে আমার বিয়ে পাগল শোয়েব।
: আরে আমি বিয়ে পাগল! তোমারে বলল কে? আমি বিয়েই করবো না।
: ঠিক আছে কইরো না। তোমার বিয়ে করতে হবে না। বলার ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার মত ক্যাবলাকে বিয়ে করার জন্য সব মেয়ে বসে আছে।
: আমি ক্যাবলা?
: হুম অবশ্যই। ১০০% সত্য কথা। আর এ বিষয়ে তোমার যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে তবে আনিস ভাইকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারো।
আনিস ওদের ঝগড়া থামিয়ে দেয়। বলে, আচ্ছা ঝগড়া বন্ধ করোতো। দাঁড়াও পাচ মিনিট। আমি বাহিরে যাচ্ছি। ঠান্ডা পানীয় একটা নিয়ে আসি। ঝগড়ার সময় এটা ভাল কাজ দেয়।
শোয়েব বলে, নাহ নাহ। তোর আনতে হবে না। আমি আনতে যাচ্ছি।
আনিস মানা করে। কিন্তু শোয়েব মানা শুনে না। জোর করে বাহিরে যায়।
আনিসের অস্বস্তি লাগে।
: আচ্ছা আনিস ভাই, বললেন না তো। আপনার কাজিনের নাম কি?
: কি করবে জেনে।
: আগে বলেন তো।
: একটা শর্তে বলতে পারি।
: কি শর্ত?
: তুমি ওই নাম নিয়ে কখনো ক্ষেপাতে পারবে না। ঠিক আছে?
: আচ্ছা ঠিক আছে। বলেনতো এবার।
: শারমিন।
: বেশ সুন্দর নামতো। অনেক সুন্দর তাই না?
: আরে একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেখি আরো বিপদ। নতুন প্রশ্ন আসতেছে।
: আরে বলেন না। বললে কি ওনার সৌন্দর্য কমে যাবে? আপনিও না।
: কি?
: কিছু না। বলেন, কে প্রথম অফার দিয়েছে। উনি নাকি আপনি?
আনিস বলে, এখানে আবার অফার আসলো কোথা থেকে? শোয়েব একটা বিষয় নিয়ে মজা করলো আর তুমিও সত্য সত্য ধরে নিলে?
এর মধ্যে শোয়েব আসে। এই আমার বিরুদ্ধে কি বিষেদগার হচ্ছে। এত কষ্ট করে পেপসি আনতে গেলাম। আর এখানে এসে যদি শুনি আমার বিরুদ্ধেই অভিযোগ চলছে। এত কষ্ট রাখবো কোথায়।
আনিস বলে, লামিয়াকে কিছু কষ্ট দিয়ে দেয়। শেয়ার করতে পারিস দুজনে।
: বিড়ালের কাছে মাছ পাহারা দেয়ার বুদ্ধি দিস?
লামিয়া ক্ষেপে উঠে। আমারে বিড়াল বললে। তোমার তো সাহস কম না।
আনিস পেপসি গ্লাসে ঢালে লামিয়ার হাতে দিয়ে বলে, আচ্ছা আগে খাওয়া হোক। পরে না হয় ঝগড়া। খেলে ঝগড়া করার এনার্জি বাড়বে।
কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠে।
মোবাইল কেনার সময় শোয়েবের সাথে যায় আনিস। শোয়েব স্যামসাং ব্যান্ডের মোবাইল একটা কিনে।
++++++++++++++++++++++
শারমিন প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার দিনটার জন্য অপেক্ষা করে। সকাল থেকে দরজায় কেউ নক করলেই ছোটে যায় আনিস আসছে ভেবে। আর আনিস ভাইটা না কেমন যেন। ওনার জন্য এত আগ্রহ করে বসে থাকা হয়। অথচ একটু বুঝেও না ব্যাপারটা। এসেই মনিকে নিয়ে দুষ্টামি শুরু করে। পাক ঘরে গিয়ে রান্না দেখে।
শারমিনের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে রান্না শিখতে। রান্না করার উছিলায় অন্তত পাকঘে থাকা যাবে। আনিস ভাই সাথে থাকবেন। কিন্তু আয়েশা বেগম কিছুতেই সে সুযোগ দেন না। যাও পড়ালেখা করো। রান্না এখন করতে হবে না।
আনিসকে দেখে খালা খুশী হন। রাতে তাদের বিয়ের দাওয়াত আছে। আনিসকে সাথে নিয়ে যাবেন।
সন্ধ্যাবেলায় আনিস বিয়ের দাওয়াতের কথা শুনে বলে, আন্টি আপনারা যান। আমি রুমে চলে যাচ্ছি।
: রুমে চলে যাবি মানে! আমাদের সাথে দাওয়াত খেয়ে তারপর যাবি।
: আমাকে তো দাওয়াত দেয় নাই।
: আরে ছেলে বলে কি!! তোর আঙ্কেলের বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। আমাদের স্বপরিবারের দাওয়াত দিয়েছে। তুই কি আমাদের পরিবারের বাহিরের নাকি। তোকে যেতেই হবে।
আনিস বিয়ের দাওয়াতে সাথে যাবে শুনে শারমিনের বেশ ভাল লাগছে। গোলাপী রঙের থ্রিপিস পড়েছে। অনেকক্ষণ ধরে সাজলো ও। আনিস ভাইটা যে কেন তাকায় না। আচ্ছা তাকালে কি মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে।
মনি তার বড়বোনকে দেখে বলল, আপু তোকে তো অনেক সুন্দর লাগছে। ওখানে সাবধানে থাকিস। সবাই না হয় তোর দিকে চেয়ে থাকবে। শেষে আছাড় টাছাড়া খেয়ে একাকার হবে।
: এই চুপ কর। তোর পাকনামি করতে হবে না।
সবাই বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত। আনিস সিএনজি আনার জন্য বের হলো।
সিএনজি চালকদেরও যে কি হয়েছে। ওদের ইচ্ছামত জায়গা ছাড়া অন্য জায়গায় যেতে চায় না। দুইটা খালি সিএনজিকে গন্তব্যস্থল বলল। কিন্তু একটাও রাজি হলো না।
রাস্তার ওপারে কয়েকটা সিএনজি খালি দাড়িয়ে আছে। সেগুলো দেখে আনিস রাস্তা পার হতে চাইলো। এসময় দ্রুত আসা একটা সিমেন্ট বাহী ট্রাক ওকে ধাক্কা দেয়। চোখের পলকে আনিস রাস্তায় পড়ে যায়। ও আওয়াজ করে। কিন্তু রাস্তার চলাচলরত গাড়ির শব্দে সে আওয়াজ কারো কানে যায় না।
ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি ব্রেক করে জোরে। দেখে ছেলেটি রক্তাক্ত পড়ে আছে। এসময় ট্রাক ড্রাইভারের মাথায় আসে একটাই চিন্তা। আহত ছেলেটার চিকিৎসার সকল খরচ তাকে দিতে হবে। চিকিৎসার জন্য এত টাকা দেওয়া সম্ভব না। তার চেয়ে ছেলেটার ওপর দিয়ে চলে গেলে ছেলেটা মারা যাবে। আইনে দূর্ঘটনায় মারা গেলে ২০ হাজার জরিমানা দিলেই হয়ে যাবে।
আর কিছু না ভেবে মুহূর্তের মধ্যে ওই অবস্থায় আনিসের ওপর দিয়ে চলে যায় ভারী সিমেন্ট বাহী ট্রাকটা। মৃত্যুর আগে শেষ চিৎকারটা করে আনিস। তবে কেউ শুনে না। রক্তাক্ত নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে দেখে রাস্তায় চলাচলরত লোকরা ছুটে আসে।
আয়েশা বেগম ও তার দুই মেয়ে অপেক্ষা করছে আনিস কখন সিএনজি আনবে। তাদের অপেক্ষার শুরুটা যা কখনোই শেষ হবে না তারা তখনও জানে না।
আইন যে ড্রাইভারদের ঘাতক হতে উৎসাহিত করে এ ব্যাপারটা দেখবে কে?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫৭