শীতকাল আসবে আসবে করছে। ফ্যান চালালে ঠান্ডা লাগে। আবার বন্ধ করলে গরম লাগা শুরু করে। অদ্ভূত অবস্থা। সেজন্য রাতের বেলা সর্বোচ্চ গতিতে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে মুহিন। যদিও ঘুমাতে অনেক দেরি হয়। প্রতিদিন রাতে নুবাহর সাথে কথা বলে। কথা বলতে না পারলে নাকি সেদিন নুবাহ’র ঘুমই আসে না।
তবে দুই দিন ধরে কথা হচ্ছে না। শুধু রাতের বেলা না। দিনের বেলায়ও কথা হচ্ছে না। কথা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ও। সেদিন ফেসবুকে চূড়ান্ত রকমের তর্ক হলো। মুহিন মেসেজ লিখে পাঠায় : এখন কথা না বলে ঘুমাচ্ছো কেম্নে? এক সময় না বলতে আমার সাথে কথা না হলে ঘুম হয় না।
দুই দিনে বেশ কয়েকটা মেসেজ দিয়েছে। কিন্তু কোন উত্তর আসে নাই।
মুহিন এই একটা ব্যাপার অনেক কঠিন ভাবে নিয়েছে। অথচ নুবাহ-র সামান্য অপছন্দও সহ্য করতে পারে না ও। একসময় খুব সিগারেট খেতো। সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা জানতে পেরে নুবাহ কখনো মানা করেনি। শুধু একদিন বলেছিল, সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে বেশ কষ্ট করতে হয়। তোমাকে এত যখন পছন্দ করি তাই ওই কষ্টটা মেনে নিতেই হবে।
এটা শুনে অনেক কষ্ট হলেও মুহিন সিগারেট ছেড়ে দেয়। ওর বন্ধুরা তা নিয়ে প্রায় সময় ঠাট্টা করে, হাসাহাসি করে। বন্ধুদের কেউ সিগারেট ধরালেই কথাটা তুলে। আমাদের মুহিন তো মেয়ের কথায় সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। আরে ব্যাটা, মেয়েদের এত ভয় পেলে চলে। এরকম ছেলেগুলোতো পুরুষ কাতারে থাকার যোগ্যই না।
ওরা ভেবেছে নুবাহ আমাকে জোর করে সিগারেট ছাড়িয়েছে। মুহিন কিছু বলে না। যা ভাবুক ভাবুক গিয়ে। ভাবুক নুবাহ ওর ওপর প্রভাব খাটায়। ভালোবাসায় যদি প্রভাব খাটানো না যায় তবে আর কিসের ভালোবাসা। ভালোবাসা হচ্ছে প্রভাব খাটানোর সবচেয়ে ভাল পাত্র।
এ মুহূর্তে মুহিনের ঘুম আসছে না। নুবাহর সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। সারাদিন কি কি ঘটনা ঘটলো. ক্যাম্পাসে কি কি হলো, বাসায় ছোট বোনের সাথে কি ঝগড়া হলো সব না বলে শান্তি পায় না ও। আর এখন মেসেজের পর্যন্ত উত্তর দিচ্ছে না। মুহিন একই মেসেজ আরো কয়েকবার পাঠায়। একটার উত্তর আসে। খুশী মনে ভিউতে ক্লিক করে মুহিন। মেসেজে লেখা, আমার কথা রাখলে তবেই কথা বলবো, না হলে বন্ধ।
মুহিনেরও জেদ হয়। থাক! সে না বলে থাকতে পারলে ও পারতে সমস্যা কোথায়।
ঘটনাটা পরশুদিনের। ডিসেম্বরের দুই তারিখ। ফেসবুকে চ্যাট হচ্ছিল। হঠাৎ করে নুবাহ লিখে পাঠায়,ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারটা পরিবর্তন করে বাংলাদেশের পতাকা দাও।
মুহিন প্রশ্ন রাখে, কেন?
: সবার ফেসবুকে বাংলাদেশের পতাকা, মানচিত্র থাকলে, দেখতে ভাল লাগবে। আর খেয়াল করেছো বিজয়ের মাস শুরু হয়ে গেছে। দেখো না আমি দিয়েছি। তুমিও দাও।
ব্যাপারটা কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে মুহিন। অনেকে ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচারে দেশের প্রতীক লাগিয়ে নিয়েছে। অনেকে আহবান জানিয়েছে যাতে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করা হয়। পুরা বাংলাদেশীদের বিশ্ব অন্যভাবে দেখবে। মুগ্ধ হবে। এদেশ সম্পর্কে জানবে।
মুহিন বলে, আমার কাছে ব্যাপারটা অন্যরকম লাগছে।
কিন্তু ওপাশ থেকে কোন উত্তর নেই।
কিছু বলছে না দেখে মুহিন আবার লিখে পাঠায়, আসলে তোমারটা দেখে ভাল লাগছে। তবে.....
এপাশ থেকে মুহিন দেখে.. নুবাহ রাইটিং
: তবের পর কি? থেমে গেলে যে!
: আবেগকে এত সহজে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করে না। কেন জানি কিছু আবেগ অন্তরে রাখতে ভাল লাগে। আর যারা ফেসবুক প্রোফাইলে দেশ যুক্ত করেছে তারা সবাই দেশপ্রেমিক হয়ে যায়নি। দেশ প্রেমিক হওয়া এত সহজ না।
: তুমি বিষয়টা এত কঠিন ভাবে নিচ্ছো কেন? একটা মাস প্রোফাইল পিকচারে দেশের ছবি রাখলে তোমার কি সমস্যা হবে খুলে বলো তো।
: কোন সমস্যা হবে না। তবে কোন লাভও হবে না। বরং মনে খুত খুতে লাগবে। মনে হবে আমি যে দেশ প্রেমিক রাষ্ট্র করে বেড়াচ্ছি। দেশ প্রেমিক এটা কাজ দিয়ে করে দেখানোর বিষয়।
: তুমি সব কিছু বেশি বুঝো। আবেগ প্রকাশে খুত খুতে লাগবে কেন?
: দেশের সাথে আমার সম্পর্ক আমি আর আমার প্রিয় মাতৃভূমি জানে। এটা শুধু পতাকা দিয়ে দেখিয়ে বেড়ানোর কোন জিনিস না।
: এত কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করা হলো। একটা নিজস্ব পতাকা পেলো দেশ। সে লাল সবুজ পতাকে বিশ্বকে চেনাতে তোমার এত আপত্তি কেন? আর পতাকার কি কোন মূল্য নেই। তোমার কথা হচ্ছে পতাকা না থাকলেও হতো।
: নাহ আমি সেটা বলি নাই। ধরো বাংলাদেশ জিতছে। মাঠময় খেলোয়াড়দের পতাকা নিয়ে ঘোরা। এটা আলাদা উদ্দীপনা আনে। আমরা কাজের দ্বারা আমাদের দেশকে বিশ্বকে চেনাবো। ফেসবুকের প্রোফাইলে দিয়ে বিশ্বকে চেনানোর কোন মানে হয় না। এটা এক ধরণের সস্তা প্রদর্শন ব্যবস্থা।
: তুমি এটাকে সস্তা বলছো!! এ পতাকা অর্জনের জন্য এতজন শহীদ হলেন। আর তুমি তাকে সস্তা বলছো? আচ্ছা তোমার হয়েছেটা কি বলো তো?
: পতাকা দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। তা আনতে অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু আনাটাই কি শেষ। আমার দেশে সে পতাকার মূল্য কি কাজেকর্মে আছে? বরিশালে কি হলো? এক মুক্তিযোদ্ধা তার মেয়ের ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় খুন হলো। আগে সে জিডি করলেও ব্যবস্থা নেয় নি পুলিশ। স্বাধীনতার সেখানে মূল্য কোথায়? লিমন এক নিরপরাধী ছেলে। তার পা হারাতে হলো কেন?
নুবাহ লিখে : সেগুলোর সাথে পতাকার কি সম্পর্ক?
: অবশ্যই আছে। যে ঘুষখোর আজ পতাকা দিয়ে ফেসবুকের দেশপ্রেম দেখাচ্ছে তাতে কি পতাকার সাথে নির্মম রসিকতা হচ্ছে না?
: তারা তো অতি অল্প জন। তাদের কথা ভেবে তুমি তোমার আবেগ প্রকাশ করবে না? এটা তো বোকামী।
: হয়ত বোকামী। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ব্রাজিল আর্জেন্টিনার বিশাল বিশাল পতাকা উড়ানো হয় এদেশে। বিল্ডিংয়ের ছাদে, রাস্তা জুড়ে পতাকায় ছেয়ে দেওয়া হয়। তখন তা দেখে খারাপ লাগে।
: তোমার খারাপ লাগে কেন?
: একারণেই লাগে যে, আমাদের দেশের পতাকা কোন দেশে এভাবে উড়ানো হয় না। উড়ানোর মত কোন কাজ আমরা করতে পারি নাই। অথচ ওদের পতাকা নিয়ে আমরা নাচানাচি করি। ওই যে বললাম না আবেগের সস্তা প্রকাশ।
: অন্যদেশের পতাকা নিয়ে এভাবে লাফালাফি ঠিক না, এটা আমিও মানি। তবে নিজের দেশে পতাকা নিয়ে তো লাফালাফি করাই যায়। তাই না?
মুহিন লিখে পাঠায়, নুবাহ শুনো। তোমার প্রোফাইলে পতাকা দেখে আমার ভাল লাগছে। অনেক পতাকা দেখে বেশ ভাল লাগছে। তবে তাতে আমার নিজের চোখের শান্তি হচ্ছে। আমি পতাকা দেখে দেশের শান্তি খোজার চেয়ে কাজ করে দেশের শান্তি খোজাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
: পতাকা দিলে কি তোমার কাজ-কর্মে শান্তি খোঁজা কমে যাবে? যত্ত সব। তুমি যে কি উল্টা পাল্টা বুঝো। দেশকে ভাল লাগে তাতেও তুমি অন্য মানে খুঁজছো।
: হা হা হা। উল্টা পাল্টাই বটে। তবে দেশের পতাকা প্রদর্শন করতে না পারার যে একটা ক্ষুব্ধটা আমার মনে আছে। সে ক্ষুব্ধটা দিয়ে আমি চাই দেশের জন্য কিছু করতে। যদিও সেগুলো ছেলেমানুষী শোনাচ্ছে। কিন্তু আমি সেটাই করার চেষ্টা করবো। আমার দেশের পতাকাকে বিশ্ব দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের পতাকা হিসাবে চিনবে না। চিনবে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে।
: তোমার কিছু কথা ঠিক আছে। কিন্তু এটা মানতে পারলাম না পতাকা দিলেই দেশের প্রতি কাজ করার আগ্রহ কমে যাবে। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে শিশু মনে করো না। তোমাকে পতাকা দিতেই হবে। আমি দিয়েছি। তুমিও দিবে। এটা আমার শেষ কথা।
: নাহ, সরি আমি দিচ্ছি না।
সাথে সাথে ফোন। নুবাহ করেছে।
চিবিয়ে চিবিয়ে ও বলে, তুমি আবার বলো তো নাহ শব্দটা।
মুহিন কিছু বলে না। মেয়েটা রাগ করলে খবর আছে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিবে। তখন বিপদ। তার চেয়ে চুপ থাকা মঙ্গল।
: কি চুপ হয়ে গেছো যে! আবার উচ্চারণ করো, না শব্দটা। দেখি শুনি। অনেকক্ষণ তো দেখলাম। এবার শুনতে ইচ্ছা করছে।
মুহিন আমতা আমতা করে বলে, শুনো এই যে দেশের প্রতি তোমার আবেগ অনেক ভাল লাগছে।
: সত্যি ভাল লাগছে?
: হুম সত্যি।
: তাহলেতো হয়েই গেলো। আমার আবেগটা ভাল। এখন আমি চাচ্ছি তুমিও ফেসবুকে প্রোফাইলটা চেঞ্জ করবে।
মুহিন চুপ থাকে। কেন জানি এ বিষয়টাতে অনড় থাকতেই ইচ্ছা করছে ওর।
অনেকক্ষণ কথার উত্তর না পেয়ে নুবাহ বলে, আজ এখন কয়টা বাজে! দাড়াও ঘড়ি দেখি। এখন রাত একটা বিশ। এ মুহূর্ত থেকে পুরা একমাস তোমার সাথে কোন কথা নেই। কোন কথা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি ফেসবুকে তোমার পিকচারটা পরিবর্তন করবে।
আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে।
এরপর বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে মুহিন। কোন কলই রিসিভ করে নি নুবাহ।
দিনগুলো বেশ খারাপ যায় মুহিনের। রাতে ঘুম হয় না। প্রতিদিন অনিয়মে দিন কাটে। ইচ্ছা হয় প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে দিতে। আবার নিজের কাছে নিজের এভাবে আত্মসমর্পন দেখতে খারাপ লাগবে ভেবে করে না। পিকচার না দেওয়ার পক্ষে এত কথা বলে এখন যদি দেয় তখন কেমন দেখাবে। এখন ওর মনে হচ্ছে পিকচার দিলে সমস্যা নেই। কিন্তু এত কথা যেটার পক্ষে বলল সেটা বিপক্ষে কি করে যাওয়া যায়! আর মেয়েটা কেমন। একটা অনুরোধ পর্যন্ত করছে না।
+++++++++++++++++++++
১৫ ডিসেম্বর। রাত ঠিক বারোটায় নুবাহর ফোন আসে।
নুবাহর ফোন দেখে খুশীতে আত্মহারা মুহিন।
: হ্যালো, কেমন আছো? কেমন অসহায় গলায় জিজ্ঞেস করে নুবাহ।
: হ্যা ভালো। কিন্তু তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
: আমার কিচ্ছু হয়নি। আচ্ছা প্রিয় জনের খুশীর জন্যও তো অনেক সময় মনের বিরুদ্ধে কাজ করা যায় তাই না? কাল আমাদের বিজয় দিবস। অনেক সংগ্রামের পর এদিনটাতে আমরা জয়লাভ করি। এদিনে আমার বন্ধুদের প্রোফাইলে থাকবে দেশের পতাকা। তুমি অন্তত একটা দিনের জন্য দিবে দেশের পতাকা?
মুহিন কিছু বলে না। ও ফেসবুকে ঢুকে দেশের লাল সবুজের পতাকা ওর প্রোফাইলে দিয়ে দেয়। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে পতাকাটা দেখে ওর নিজেরও বেশ ভাল লাগছে। কি সুন্দর মায়াবী পতাকাটা। শরীরে কেমন কাপন ধরিয়ে দেয়। এ কাঁপন দেশ প্রেমের।