আমার জন্ম আজ থেকে ১৬ বছর আগে। এটা শুধু বছর ভিত্তিক বয়সের হিসাব। একেবারে নিখুঁত ভাবে বলতে গেলে এটা হবে ১৫ বছর ০৯ মাস ২৯ দিন। প্রথম লাইনে কিছুটা বাড়িয়ে বলছি বলে কেউ কিছু মনে করেন নাই তো? মনে করলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
তিন তলার সুন্দর বাড়ীতে আমার বেড়ে উঠা। বাবা অনেক রুচিশীল এবং শৌখিন। বিশাল বাড়ী। এত সুন্দর করে বাড়ী বানালেও বাবার এ বাড়ীতে ঠিক থাকা হয় না বেশি সময় ধরে। বেশির ভাগ সময়ই বিদেশে থাকেন তিনি। দেশে থাকলেও মাসে একবারের বেশি এ বাসায় আসেন না।
বাবা অর্থ উপার্জনের পিছনে ব্যস্ত। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কঠিন কঠিন কথা শুনাতে। অনেক কঠিন কথা। কিন্তু পারি না। কেননা বাবা আমাকে দেখতে পারেন না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে এড়িয়ে চলতেই বাবা এই ঘরমুখো হন না। আগে খুব খারাপ লাগত। বাবারা সন্তানদের কত আদর করে। অথচ আমার বাবা দেখি আমার থেকে দূরে থাকতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু যেদিন কারণটা সম্পর্কে অল্প একটু জানতে পারলাম সেদিন থেকে বাবার প্রতি আমার আর কোন ক্ষোভ নেই। এখন আমিই উল্টা নিজেকে আড়াল করে রাখি বাবার কাছ থেকে। বাবা যেদিন বাসায় আসে সেদিন আমি রুম থেকে একবারের জন্যও বের হই না। যদি বাবার সাথে দেখা হয়ে যায় এই ভয়ে।
আমার মা মৌমিতা চৌধুরী। অনেক সুন্দর এক মহিলা। তার সুন্দরের কিছু আমি পেয়েছি। কিছু না বলে অনেক বেশিই পেয়েছি বলতে হয়। অন্যরা আমাকে দেখে যে মুগ্ধ হয় তা দেখে বুঝি সেসব। তবে আমার একটি গোপন ইচ্ছা আছে। অনেক গোপন ইচ্ছা। কাউকে বলি নাই। আপনাদের প্রথম বলছি। আমি আমার মুখ এসিড দিয়ে ঝলসে দিবো। যে মেয়ের মনে এত দুঃখ সে মেয়ের এত সুন্দর মুখ থাকার কোন অর্থ হয় না। আপনারা কি অবাক হয়েছেন। অবাক হবেন না। এত সাহস আমার নেই। এত সাহস থাকলে অনেক আগেই নিজ থেকে পৃথিবীটাকে বিদায় জানিয়ে দিতাম।
মা আরো বেশি ব্যস্ত। বাবা ব্যস্ত টাকা আয়ে। আর মা ব্যস্ত টাকা গুলো খরচের জন্য। সারাদিন ঘুরেন। তার বন্ধুর অভাব নেই। অনেকেই বাসায় আসে। কতজনকে যে অ্যাঙ্কেল ডেকেছি ঠিক নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে বোধ হয় সবচেয়ে বেশি অ্যাঙ্কেল আমারোই।
বেশির ভাগ শিশুই নাকি কথা শিখে মার কাছ থেকে। আমার সে সৌভাগ্য হয় নাই। নিলুফা নামে এক আয়া ছিল আমাদের বাসায়। আমার দেখাশুনার ভার ছিল তার উপর । নিলুফার গ্রামের বাড়ি ছিল জামালপুর। সে আমাকে কথা শিখিয়েছে। তার কাছ থেকে অনেক আঞ্চলিক ভাষা শিখেছি। নিলুফা এখন আর আমাদের সাথে নেই। শুধু আমাদের সাথে না কারো সাথেই নাই। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে সে চলে গিয়েছে নিজে নিজে। কারণ কি জানি না। অনেক ভেবেছি। কিন্তু পাই নি। শক্ত হয়ে যাওয়া আমি নিলুফার মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছি। যদিও সমস্যা হয় মাঝে মাঝে ঘুমে। স্বপ্নে নিলুফার সাথে আমার কথা হয়।
ওকে প্রতিবারই জিজ্ঞেস করি, কিজন্য তুমি এরকম করলে?
উত্তরে সে শুধু হাসে। এ ব্যাপারে কিছুই বলে না।
আমি বলি, বললে তোমার সমস্যা কি? হাসছো কেন? বলো, প্লিজ বলো।
আমার কথা শুনে নিলুফা গম্ভীর হয়। বলে, বলব সব বলব। তবে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে একটু।
: অপেক্ষা করতে পারবো না। এখুনি বলো।
: নীরা তুমি কি জানো তুমি আমার অনেক প্রিয়, শুধু তোমার জন্য হলেও আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। তারপরও পারলাম না। শেষ চেষ্টা করেও পারলাম না।
: আশ্চর্য, আরে বলো না, কি হয়েছিল। কেন চলে গেলে আমাদের ছেড়ে?
: আরো বড় হও। বিয়ে হোক তোমার। তোমার বিয়ের পর তোমাকে সব খুলে বলব আমি।
এই কথা বলে সেদিন চলে গিয়েছিল নিলুফা।
অথচ আমি যে কারণটা খুব জানতে চাই। চারদিকে এত আলো, তারপরও নিজেকে খুব অন্ধকার মনে হয়।
( ২৯ সেপ্টম্বার সমকালের সুহৃদ সমাবেশে পাতায় প্রকাশিত হয়েছে।)