শান্ত সকাল। কারো সাথে দেখা করার জন্য বিকালটাই কেমন যেন প্রচলিত। বেশির ভাগ দেখাই বিকালে হয়। সকালে তেমন হয় না। তবে আবীর আর লিজা সকালে এসেছে দেখা করতে। একটা কফি শপে বসে আছে ওরা। দুজন মুখোমুখি। সামনে কফির বদলে লাচ্ছি। যদিও কেউ খাওয়া শুরু করে নি।
এই সকাল বেলায় কফি শপে ভীড় নেই। লিজা আর আবীর বসেছে কোণার দিকের এক টেবিলে। অন্য একটি টেবিলে তিন জন বসা। আর বাকী সব গুলোই খালি।
সন্ধ্যায় লিজার ফ্ল্যাইট। অস্টেলিয়ায় চলে যাবে। চলে যাবে না বলে বলা যায় ফিরে যাবে। একমাসের জন্য সে দেশে এসেছে। আবীর এবং লিজা দুজন দুই দূরবর্তী শহরে থাকে। মোবাইল, ফেসবুকে নিয়মিত কথা হলেও সামনাসামনি দেখা অনেক দিন পর। আগে দিনের কত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে সেগুলো ভাবলে আবীরের অন্যরকম লাগে। দুজনে লং জার্নিতে চলে যেত। লিজা ড্রাইভারকে বলত, কানে হেডফোন লাগাতে। আর জোরে ভলিয়ম দিয়ে গান শুনতে। উদ্দেশ্য ড্রাইভার যেন ওদের কথায় নজর দিতে না পারে। লিজা চাইত না ওদের দুজনের প্রিয় কথাগুলো অন্য কেউ শুনুক। আবীর বলত, তুমি বেচারাকে যেভাবে জোরে গান শুনতে বাধ্য করো দেখা যাবে কিছুদিন পর কানেই শুনছে না।
লিজা হাসত, আরে কান যাওয়া এত সহজ না। কামাড়ের দোকানে যারা কাজ করে তারা তো ঠিকই শুনে। ওদের কান ঠিক থাকে কিভাবে?
লিজা পড়ে এসেছে বেগুনী রঙের একটা থ্রিপিস। ঠোটে হালকা লিপিস্টিক। কপালে খুব ছোট একটা কালো টিপ। সাজগোজের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই লিজার। তারপরও আজ কেন যেন একটু সেজেছে। লিজা লাচ্ছির নলে ঠোঁট দেয়। এরপর আস্তে আস্তে টানতে থাকে।
-আচ্ছা আমাকে কেমন লাগছে বলো তো?
-হুম ভাল।
লিজা একটু আশ্চর্য হওয়ার ভান করে। শুধু ভাল?
আবীর কিছু বলে না।
-আচ্ছা আমার না একটুও যেতে ইচ্ছা করছে না। কি করি বলো তো।
- কেন কেন? কি সুন্দর দেশ। যেতে ইচ্ছা করছে না কেন?
- সুন্দর না ছাই। উপরের সৌন্দর্যই সবকিছু না। যেগুলোর উপরের সৌন্দর্য আছে সেগুলোর দেখবা ঠিকই ভিতরে কোন না কোন সমস্যা আছে।
আবীর বলে, তুমি তো অনেক সুন্দর। আমি তো তোমার মধ্যে কোন সমস্যা দেখতে পাই না।
-আছে আছে। অনেক সমস্যা আছে। তুমি বোকা তো বুঝতে পারো না। আর বোঝারও দরকার নেই। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার কি জানো? সেখানে প্রাণভরে কথা বলতে পারি না। সবাই এত বেশি ব্যস্ত যে। যেত ব্যস্তহীনতা কোন জীবন না।
আবীর কিছু বলে না। চুপ থাকে।
লিজা বলে, চুপ কেন তুমি? কি হলো? আমার মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাও। বলে ফেল।
আবীর লিজার দিকে তাকায়। এক মায়াবী আভা মুখ। দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।
কথা বলা শুরু করে আবীর, শুনো আমি কলেজে পড়ি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পাইনি। কোন ফিউচার নেই। আর আর্থিক দিক থেকেও তোমাদের অনেক নিচে আমাদের অবস্থান।
লিজা বিরক্ত হয়। শুরু করলা লেকচার? আমি এগুলো শুনতে চাই না।
আবীর বলে, তুমি শুনো। প্লিজ শুনো।
লিজা অনিচ্ছা স্বত্বেও বলে, ঠিক আছে বলো।
-এখন তোমার জগৎ পরিবর্তন হয়েছে। আগে বয়স কম ছিল। তাই আমার প্রতি কাঁচা আবেগ ছিল। আগেও জানতাম। এখনও জানি। আসলে সব পরিবর্তন হয়েছে। দেখো ইউনিভার্সিটির স্মার্ট ছেলেদের দিকে তাকালে তোমার অন্যরকম লাগবে। এখন আমাদের সম্পর্ক রাখা ঠিক হবে না।
লিজা লাচ্ছির গ্লাস সরিয়ে রাখে।
-তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? শুনো, এখন অনেক কিছু বদলেছে এটা সত্য। আর অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশার ব্যাপারটাও ঠিক অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু সম্পর্ক ব্রেক আপ করলেই কি সব শেষ? হা কিছু ব্যাপার এড়িয়ে যাওয়া যাবে হয়ত। কিন্তু দুইজনই ঠিকই কষ্ট পাবো। কি লাভ কষ্ট পাওয়ার। কে বেশি কষ্ট পাবে জানি না, তবে এটা জানি আমার অনেক কষ্ট হবে।
আবীর এবারও কোন কথা বলে না। মুখ নিচু করে শুনে যায়।
-দেখা যাক না ভবিষ্যতে কি হয়। সময় আমাদের পক্ষেও যেতে পারে। এখন সময়ের হাতেই ছেড়ে দাও। এগুলো নিয়ে চিন্তা করো না। স্বপ্ন দেখে যাই। তবে এতটুকু অনুরোধ থাকবে তুমি আমার স্বপ্নের সঙ্গী থাকবে।
বিদায়টা হয় বড় সাদামাটা ভাবে। দুইজন দুইজনের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকা কিছুক্ষণ। তারপর পরষ্পরের প্রতি ভাল থাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা।
সন্ধ্যায় শব্দ করে বিমানটা বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে যায়। আর সাথে নিয়ে যায় লিজাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিমানটি অদৃশ্য না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে আবীর। এখন শুধুই নিঃসীম শূন্যতার আকাশ। আবীরের মনে হয় তার স্বপ্নগুলোও নিঃসীম শূন্য। কষ্ট হয় আবীরের। তার কষ্টই যেন বেশি।