প্রফেসর হঠাৎ একদিন বললেন "আমি যেই রিসার্চ প্রপোজালটি পাঠিয়েছিলাম সেটা একসেপ্ট হয়নি। তোমাকে আর সাপোর্ট দিতে পারব না, তুমি তোমার রাস্তা দেখতে পারো"। যারা একাডেমিক লাইনে কাজ করনে তারা ভাল করেই জানেন এরকম ঘটনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত না, বিশেষ করে আমেরিকায় একাডেমিক পজিশনগুলোতে এরকম ঘটনা হুট-হাট করেই ঘটে থাকে। তবে এটা একটি মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, এদের ফান্ড অনেক বলেই জানতাম, তাই ঘটনার আকস্মিকতায় আমি স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ এবং প্রবল হতাশ হলাম। একটু চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম "ওকে কি আর করার, তুমি আর আমাকে কতদিন সাপোর্ট দিতে পারবে"? উওরে জানাল "প্রজেক্টের যেই অবশিষ্ট টাকা আছে সেটা দিয়ে সর্বোচ্চ আগামী তিন-চার মাসের-মত সাপোর্ট দিতে পারব।" আমি একটি প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছি, প্রফেসর বললেন "এই তিন-চার মাসের মধ্যে তোমার কাজের উপর একটি জার্নাল লিখে শেষ কর এতে তোমার এবং আমার অনেক ফায়দা হবে"। আমি সম্মতি স্বরূপ মাথা ঝাঁকালাম।
ঘটনাটা গত ডিসেম্বরের শেষের দিকের। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চর হিসেবে গত বছরের মে মাসে, আর চাকরিটা এই বছরের এপ্রিলেই শেষ হয়ে যাবে। বছর পার হবার আগেই যে এরকম একটি অঘটন ঘটবে সেটা হজম করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল আমাকে। চাকরি হারানোর চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে নতুন একটি জায়গায় এসে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, কিছু মানুষের সাথে সখ্যতা হয়েছে, বাসা গুছিয়ে মোটামুটি স্থির হয়েছি তখনি আবার ভাঙ্গনের সুরে বিষাদে মনটা ভরে উঠল। আমার ইচ্ছা ছিল আসতে ধীরে একাডেমী ছেড়ে ইন্ডাস্ট্রিতে অথবা ন্যাশনাল ল্যাবগুলোতে ঢুকার চেষ্টা করব, তবে হঠাৎ প্রফেসরের ফান্ড না পাওয়াতে সব প্ল্যান যেন ওলট-পালট হয়ে গেল! ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে আমেরিকার চাকরির বাজার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, আর এদিকে আমি টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের, আর সব ঠাডাও যেন আমেরিকার টেক কোম্পানিগুলোর উপরই পরেছে। ফেইসবুক, এমাজন থেকে শুরু করে বড় বড় কোম্পানিগুলোতে হাজার হাজার লোক ছাটাই শুরু করেছে এবছর। আর ছোট ছোট কোম্পানিগুলোও লোক নেয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে!
অর্থনীতি যখন স্থবির হয়ে আসে ছোট-বড় সব কোম্পানিগুলো তখন নিজদের ঘুটিয়ে নেয় শামুকের ন্যায়, পুঁজিবাদের এই একটি অসুবিধা। আমি সাধারণত বেশীর ভাগ চাকরি Linked-in এপ্লাই করি, এর সুবিধা হল এখানে দেখা যায় কতজন একটি পজিশনে আবেদন করেছে, আমি লক্ষ করলাম কোন একটি পজিশন ওপেন হলেই সঙ্গে সঙ্গেই দুইশত এর অধিক প্রার্থী আবেদন করে বসে। তার মানে রিক্রুয়েটাররা হয়ত বেশিরভাগ সিভি পড়েও দেখবে না। যাইহোক এই বছরের শুরুতে আমি বেশ কিছু কোম্পানিতে এবং ন্যাশনাল ল্যাবে আবেদন করলাম। যেখানে গত বছর অনেক টেক কোম্পানির রিক্রুয়েটাররা Linked-in -এ নক করত ইন্টারর্ভিউ দেবার জন্য, যেমন গত বছর আমি ফেইসবুক, এমাজন, গুগল এবং টয়োটার সাবসিডিয়ারির এক কোম্পানি থেকে ডাক পেয়েছিলাম ইন্টারভিউ দেবার জন্য আর এবছর লক্ষ্য করলাম কেউ ডাকে না আবেদন করার পরও! তারপরও কয়েকটি কোম্পানি এবং একটি ন্যাশনাল ল্যাব থেকে ডাক পেয়েছিলাম, তবে কাম বারি দিতে পারিনি, ফলাফল শূন্য।
অতঃপর ভাবলাম আমার আবুল ভাই ভাল মানে যাক আবার একাডেমীতেই যাই পরিস্থিতি অনুকূল হবার আগ পর্যন্ত। একটি পিএইচডি ডিগ্রি আছে তাই অন্য কিছু নাহলেও একাডেমীতেই অন্তত চ্যালচ্যালাইয়ে পোষ্ট-ডক্টরাল রিসার্চর হিসেবে ঢুকে যেতে পারব। আমার চাকরী শেষ হবার কথা ছিল এপ্রিলে, মার্চ মাসে চারটি ইউনিভার্সিটিতে আবেধন করলাম এবং তিনটি থেকেই ডাক পেলাম। প্রথম ইন্টার্ভিউ ছিল ইউনিভার্সিটি অব এরিজোনাতে, প্রথম ইন্টার্ভিউতেই কেল্লা ফতে! প্রফেসরের সাথে কথা বলে মনে হল লোক ভাল, তিনিও বললেন আমার এখানে আস পোষ্ট-ডক্ট হিসেবে, এখানে ডেটা সাইন্টিস হিসেবে পজিশন ফাকা আছে সেখানে সামনের বছরগুলোতে তুমি চেষ্টা করতে পার, তুমি গুড ক্যান্ডিডেট। তার পামে কাজ হল, আমি চলে এলাম! আর অন্য যেই ইন্টার্ভিউগুলো চলছিল সবগুলোকেই না করে দিলাম।
এই মাসের পনের তারিখে নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম ইউনিভার্সিটি অব এরিজোনাতে। আমি থাকতাম অরিগনে, এই মাসে এলাম এরিজোনাতে। অরিগণ থেকে এরিজোনার দুরুত্ব প্রায় ১৪০০ মাইল/২২৫৩ কিমি, চিন্তা করলাম ড্রাইভ করেই অরিগণ থেকে এরিজোনা যাব। ড্রাইভ করে যাবার শানে নুযুল হল এখানে মাল পানি খরচ কম হবে, তাছাড়া অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে যেতে পারব। আমার রুট ছিল অরিগণ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকো, সান-জোস এবং লস-এঞ্জেল হয়ে এরিজোনা।
প্রায় ছয়দিন ড্রাইভ করে এই মাসের নয় তারিখে এরিজোনাতে এসে পৌঁছলাম। আমার পুরো জার্নি ছিল রোমাঞ্চকর, ভৌতিক এবং অদ্ভুত সুন্দর। গত বছর আমি আমেরিকার এলাবামা থেকে ড্রাইভ করে অরিগণ গিয়েছিলাম, দুরুত্ব ছিল প্রায় ২৫০০ মাইল/৪০২৩ কিমি, তখন ভ্রমণটাকে তেমন আমার ল্যান্সে বন্ধী করতে পারিনি। তবে এবার আমার প্রথম থেকে ইচ্ছে ছিল এই ভ্রমণটা আমি আমার ল্যান্স বন্ধী করব এবং ব্লগের পাতায় শেয়ার করব। এই সিরিজটাতে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে আমার ভ্রমনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। তাই এই পর্বে আজ কিছুটা ভূমিকা দিয়েই শুরু এবং শেষ করলাম।
ভ্রমণের কিছু বিচ্ছিন্ন ছবি।
চলবে...
ভ্রমণের ভিডিও ব্লগ ফেইসবুক পেইজে।