সময় , নদীর স্রোত এবং সুন্দরী মেয়ে কারো জন্যই নাকি অপেক্ষা করে না অথবা সময় গেলে সাধন হবে না ।সুন্দরী মেয়ে এবং নদীর স্রোতের ব্যাপারে জানি না তবে সময় যে কারো জন্য অপেক্ষা করে না এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা ! এই তও্বটি আমার নহে বরং বিজ্ঞানীদের শিরোমণি আলবার্ট আইনস্টাইন গত শতাব্দীতেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গণিত এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন । আইনস্টাইন এই ধরায় তশরিফ আনার আগে মনে করা হত সময় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব জায়গায়ই একই । আইনস্টাইনের স্পেশিয়াল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে স্পেস-টাইম বা স্থান-কাল নিয়ে তার বিখ্যাত সূত্রটি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সময় এই মহা জগতের সব জায়গাই পরম বা একই নয় বরং আপেক্ষিক । আমার কাছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তও্বকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে রহস্যময় সূত্র গুলোর মধ্যে অন্যতম মনে হয় ।
প্রথমেই আপেক্ষিকতা কি বুঝার জন্য ছোট্ট একটা উদাহারন দেয়া যাক , ধরুন আপনি ট্রান্সফরমার সিরিজের সুন্দরি নায়িকা মেগান ফক্সের সাথে ঘন্টাখানেক সময় টক বা বাতালাপ করছেন । দুজনে মিলে পুনুর পুনুর করে মিষ্টি মধুর কথা বলছেন ,মাঝে মাঝে বিভিন্নরকমের খুনসুটিতে মেতে উঠছেন । ফক্সের সাথে কাটানো এই ঘণ্টা খানেক সময় আপনার কাছে মনে হবে এইতো মাত্র অল্প সময় যেন চোখের নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। এবার ধরুন আপনাকে বলা হল ঘণ্টা খানেক সময় দৌড়ানোর জন্য । মনে করুন আপনি দেখতে গোলগাল পটল, পেটটা সামনের দিকে দশ ইঞ্চি বেড়ে সিজদা দিয়ে আছে । এই ক্ষুদ্রাকার হাতির সমান শরীর নিয়ে যদি ঘণ্টা খানেক দৌড়ান তাহলে আপনার মনে হবে সময় যেন শেষই হচ্ছে না , এই ঘণ্টা খানেক সময়কেই মনে হবে অনেক লম্বা একটা সময়। লক্ষকরে দেখুন ঘন্টাখানেক সময় একবার মনে হচ্ছে অল্প সময় আরেক বার অনেক লম্বা, এই ব্যাপারটাকেই মূলত আপেক্ষিকতা বলে ।
আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তও্বে বলেছেন পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম সব জায়গাই এক । আলোর গতি এই মহাজগতের সব জায়গাই একই । যাইহোক ব্যাপারটা ভালভাবে বুঝার জন্য আবার উদাহারনে যাওয়া যাক, আপনি চলন্ত ট্রেনে করে যাচ্ছেন । ট্রান্সফরমার সিরিজের সুন্দরি নায়িকা মেগান ফক্স খতর-নাক মেয়ে, আপনার পিছু ছাড়ছে না , ট্রেনের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনাকে অবলোকন করছে । ধরুন আপনি ট্রেনে দাঁড়িয়ে জোরে একটা ঢিল মারলেন সামনের দিকে। ট্রেনের গতি যদি ৫০ আর আপনার ঢিলের গতি যদি ৪০ হয় তাহলে মেগান ফক্সের কাছে মনে হবে ঢিলের গতি বুঝি ৯০ (৫০+৪০) । এখন ঢিলটা যদি উল্টোদিকে মারেন তাহলে ফক্সের কাছে মনে হবে ঢিলের গতি বুঝি ১০ (৫০-৪০) । শানে নজুল কি ? একবার ঢিলের গতি মনে হচ্ছে বাড়ছে আরেক বার কমছে ।
এবার উদাহারনটা আলো দিয়ে দেয়া যাক , ধরুন আপনি মহাশূন্যে মহাকাশ যানে করে প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে যাচ্ছেন । এখন আপনি যদি একটা লেজার লাইট থেকে আলো সামনের দিকে মারেন , আপনি মনে করতে পারেন আলোর গতি বুঝি বেড়েছে আসলে তা নয় একই আছে । আপনি যদি আলো উল্টোদিকে মারেন তাহলেও আলোর গতি কমবে না (আমি গাণিতিক ফর্মুলার ডেরিবেশনে গেলাম না ) । মনে করুণ মেগান ফক্স কোনভাবে আপনার পিছু ছাড়ছে না , আরেকটা স্থির মহাকাশযান থেকেও আপনাকে অবলোকন করছে । এবার মর্গান ফক্স স্থির মহাকাশ যান থেকে আলো ছুড়ল আর আপনি প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে চলমান যান থেকে আলো ছুঁড়লেন । অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন আপনাদের দুজনের কাছ থেকে ছুড়া আলোর গতি সমান । আপনি যতই বা যেই অবস্থান থেকেই চেষ্টা করুণ আলোর গতি বাড়াতে বা কমাতে পারবেন না । এই ব্যাখ্যাটাই আইনস্টাইনের দিয়ে গেছেন যে আলোর গতি সব জায়গাই একই ।
মহাজগতের গ্রহ নক্ষত্র সব কিছুর গতিই আপেক্ষিক একমাত্র আলোর গতি ছাড়া । আইনস্টাইন এই ব্যাপারটা ধরার পর ভাবলেন কেইসটা কি , আলোর গতি যেহেতু বাড়ছে বা কমছে না তার মানে এখানে অন্য কোন প্যারামিটারের পরিবর্তিত হচ্ছে । আইনস্টাইন ধরতে সক্ষম হন প্যারামিটারগুলো হচ্ছে সময় এবং স্থান বা দৈর্ঘ্য, সোজা কথায় গতির সাথে সময় এবং স্থানের সম্পর্ক বের করেন । আইনস্টাইন গণিত দিয়ে প্রমাণ করেন প্রচণ্ড গতিশীল কোন যানে ভ্রমণ করলে সময় ধীর গতিতে চলবে স্থির অবস্থার তুলনায় । গত শতাব্দীর ৭০ এর দশকে বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটা প্রমাণের জন্য একটা পরীক্ষা করেন এটমিক ঘড়ি দিয়ে, তারা প্লেনে করে পৃথিবীকে দুবার পদক্ষিন করেন , পদক্ষিন করার আগে দুনিয়ার এটমিক ঘড়ির মান এবং প্লেনের ভিতরের এটমিক ঘড়ির মান একই সেট করেন । পরীক্ষা শেষে তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন দুটো ঘড়ির সময় দুরকম দেখাচ্ছে তার মানে দাঁড়াচ্ছে প্লেনের ঘড়ির মান কিছুটা কম দেখাচ্ছে ।
আইনস্টাইনের সূত্র মতে আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে যেতে পারলে আমরা ভবিষ্যতে যেতে পারব । আলোর গতির সমান গতিতে গেলে সময় স্থির হয়ে যাবে ! যদি আলর গতির বেশি গতিতে যেতে পারি তখন হয়ত আমরা অতীতে যেতে পারব । চিন্তা করন আলোর গতির বেশী গতিতে গিয়ে আপনি হয়ত এমন সময়ে পৌছবেন যখন আপনার দাদারই জন্ম হয় নাই ! ব্যাপারটা চমক-পদ নয় ! ধরুন মেগান ফক্স যেহেতু আপনার এত পিছু নিচ্ছে তাই রেগে গিয়ে ফক্সের সানডে মানডে ক্লোজ করে দিলেন মানে শাদী মোবারক করে ফেললেন । এই সুন্দরি নায়িকা বউকে নিয়ে এই গ্রহে কোন জায়গায় হানিমুনে গেলে পেস্টিজ পানচার তাই আপনি ব্রেন খাটালেন অন্য কোন গ্যালাক্সির কোন অচিন গ্রহে যাবেন হানিমুনে । যেই-ভাবা সেই কাজ তিন দিনের জন্য চলে গেলেন অন্য গ্যালাক্সির কোন গ্রহে । তিন দিন পর যখন মধুচন্দিমা এবং হানিমুন করে ফিরে এলেন তখন মোটামুটি একটা ধাক্কা খেলেন , আপনার কাছে যেটা তিন দিন এই দুনিয়াতে এসে দেখলেন সেটা প্রায় ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে। আপনার বয়সী অনেকেই ইতিমধ্যেই পটল তুলে ফেলেছে আর যারা বেচে আছে তাদের এক পা কবরে!পটলের দাম যে এত সস্তা আপনি হয়ত কল্পনায় ও ভাবেননি !
উপরের আলোচনা থেকে অনেকেই মনে করতে পারেন মানব সম্প্রদায় তাহলে হয়ত শীঘ্রই টাইম মেশিন তৈরি করে ফেলবে আইনস্টাইনের সূত্র ব্যাবহার করে । যাইহোক এবার বাস্তবতার দিকে ফিরে তাকানো যাক। আইনস্টাইনের সূত্র অনুসারে অতীতে পরিভ্রমণ করা অসম্ভব কারণ আলোর গতির সমান বা বেশীর গতিতে যেতে চাইলে অসীম এনার্জি বা শক্তির প্রয়োজন । আর আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে যেতে চাইলেও আমাদের এই গ্রহের সমস্ত এনার্জি খরচ করলেও সম্ভব নহে ! তবে কেহ পশ্চাৎ দেশ দিয়ে পাহাড় ঠেলে যদি বলেন সবই সম্ভব তাহলে আমার কিছু বলার নাই!
এর পরের আলোচনাগুলো অবিশ্বাসীদের জন্য নহে !
সময়টা আমার কাছে মনে হয় শুধু পরিবর্তনের নির্দেশক । কোন কণা বা প্রতিকণা যাই বলি না কেন, সময় শুধু এর পরিবর্তন নির্দেশ করে । যেমন মানুষ ছোট থেকে বড় এরপর বৃদ্ধ হয় । সময় মূলত আমাদের এই পরিবর্তনের নির্দেশ করে! যেই জিনিশ পরিবর্তন হয় সময় মূলত তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । স্রষ্টাকে আমরা আমাদের সময়ের ফ্রেমে বন্ধী করতে চাই অর্থাৎ আমাদের সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে চেষ্টা করি ! স্রষ্টা কোন কণা বা প্রতি কণা দিয়ে তৈরি বস্তু নয় বরং তিনি অপরিবর্তনশীল তাই সময় তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না , সুতরাং স্রষ্টার শুরু এবং শেষ খুঁজতে যাওয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নহে ! স্রষ্টা হল সুপ্রিম ক্ষমতা বা অসীম ক্ষমতার অধিপতি , আলোর গতি দিয়ে তাকে বন্ধী করা যাবে না । তাই আমরা বলতে পারি স্রষ্টা যে কোন গতিতেই চলতে পারে, আলোর গতি তার কাছে নিতান্তই মামলি ব্যাপার মাত্র।
যেহেতু স্রষ্টার কাছে আলোর গতি কোন বাধা নয় তাই সময় পরিভ্রমণ তার কাছে কোন ব্যাপারই না । আমরা বলতে পারি তিনি মানব প্রজাতি তথা সমগ্র সৃষ্টির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত আছেন । আমরা অনেক সময় তকদীরের ব্যাপারে বলি , সৃষ্টি কর্তা যদি আমাদের ভাগ্য লিখেই থাকেন তাহলে আমাদের ভাল কাজ করে লাভ কি ! সে যা লেখছে তাইতো হবে! ব্যাপারটা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় , সৃষ্টিকর্তা আমাদের তথা সমগ্র মানব জাতির ভবিষ্যৎ ইতিমধ্যেই জানেন তা তিনি লিখে রাখছেন , তিনি লিখে রাখছেন তাই হচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয় ! তাই আমাদের কৃতকর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষ দিয়ে কোন ফায়দা নাই । বরং সে যদি আমাদের তকদীর না লিখে রাখতেন বা না জানতেন তাহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হত তার গতি কি আলোর গতির মাঝে সীমাবদ্ধ । সমগ্র সৃষ্টি তার কাছে একটা সিনেমার রিলের মত তিনি যে কোন সময় যে কোন পয়েন্টে তা দেখতে পারার মত ক্ষমতা রাখেন এটা তার কাছে বা হাত কা খেইল হে।
আমরা অনেক সময় নিজের দায় স্বীকার না করে তকদীর বা ভাগ্যকে দোষারোপ করে নিজের দায়িত্ব এড়াতে চাই ব্যাপারটা মোটেই যুক্তিসংগত নয় । ভাগ্যকে দোষারোপ না করে আমরা যেন আমাদের কর্ম সম্পাদন করতে পারি নিষ্ঠার সাথে । আল্লাহ আমাদের সবার মঙ্গল করন।
আগের পর্ব
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ১ম পর্ব ): স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল, নাস্তিকেরাই কি অন্ধ বিশ্বাসী নয় !
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ২য় পর্ব) : ধর্ম এবং উন্নয়ন কি সাংঘর্ষিক বিষয় !
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৩য় পর্ব ) : মানব মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে আসছে ! বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি আমাদের পিছনে নিয়ে যাচ্ছে নাতো ?!
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৪র্থ পর্ব ) : বিগ ব্যাং কি আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিতে পারে ? ষ্টিফেন হকিং এর সাথে আমার দ্বিমত
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৫ম পর্ব ) : বিবর্তন তও্বের পোষ্টমোর্টেম রিপোর্ট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:২৫